প্রতিমা বড়ুয়ার গান হচ্ছে উত্তরবঙ্গের এমন ধরন যার মূল বিষয় শ্রম, বেদনা, প্রেম

প্রতিমা বড়ুয়ার গান (ইংরেজি: Songs of Pratima Barua) হচ্ছে উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সংস্কৃতির অন্তর্গত গানের এমন একটি বিশেষ ধরন যার মূল বিষয় শ্রম, বেদনা, কৃষক ও কিষাণীর প্রেম। সামন্তবাদী কৃষি সমাজের জনগণের সুখ-দুঃখ, প্রধানভাবে নারীর মনোবেদনাকে তাঁর গাওয়া গানে দেখা যায়। 

বাংলার একেক অঞ্চলের লোকগানের বৈশিষ্ট্য একেকরকম। উত্তরবঙ্গে ভাওয়াইয়া এবং দক্ষিণবঙ্গে ভাটিয়ালি বাঙালির প্রধান লোকগান। কিন্তু এই দুই প্রধান ধারার বাইরে অন্তত আরো ৩০০-৪০০ লোকগান একসময় ছিল যার এখনও কিছু কিছু টিকে আছে। উত্তরবাংলার কুচবিহার ও আসামের গোয়ালপাড়িয়া লোকগানের সাথে বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার ঝুমুর গানের বিষয় ও কথায় আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। মানুষের শ্রমের ভিন্নতা এবং ভূখণ্ডের জলবায়ুর প্রকৃতি এই বিভাজন তৈরি করে। কোচবিহার ও গোয়ালপাড়ার লোকসংগীত গবেষক জলি বাগচী লিখেছেন,

“কোনো অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থা সেই অঞ্চলের সাধারণ মানুষের জীবন, জীবিকা, চারিত্রিক গঠনের ওপর প্রভাব ফেলে। কোচবিহার ও গোয়ালপাড়ার সাধারণ মানুষ সরল প্রকৃতির, সহনশীল এবং জীবনের চাহিদা খুব কম। এরা মূলত কৃষিজীবী। এই দুটো অঞ্চলেই উল্লেখ করার মতো কোনো কলকারখানা গড়ে ওঠেনি। চা-শিল্প ও কাঠের ব্যবসা রয়েছে। তবে অন্যান্য ধরনের ব্যবসা বাণিজ্যও আছে। কোচবিহার ও গোয়ালপাড়ার লোকসংগীতের ওপর এই দুই অঞ্চলের কৃষিজীবন, অঞ্চলের জীবজন্তুর মধ্যে হাতি, বন্যমোষ এবং নদী গভীর প্রভাব ফেলেছে – যা থেকে আমরা পাই মাহুত, মইষাল, সাদু ও নাইয়ার গান।”[১]

প্রতিমা বড়ুয়ার গান এবং সেসবের বৈশিষ্ট্য

উত্তরবঙ্গের গোয়ালপাড়িয়া লোকগানের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে শ্রমজীবী মানুষের দৈনন্দিন জীবন। প্রতিমার গাওয়া কৃষক, মাঝি আর মাহুতের গানে আছে শ্রমঘনিষ্ঠ মানুষের জীবন। তিনি যেসব গান গেয়েছেন সেসবের কয়েকটি শ্রমের গানের কয়েকটির কথাগুলি এইরকম।

  • ও মোর মাহুত বন্ধুরে গেইলে কী আসিবেন …
  • … মইষ চড়ান, মইষাল বন্ধু, ঘাটের উজানে।/ তোমার মইষের ঘণ্টা বাজে, মন উড়াং বাইরং করে রে …
  • গদাধরের পারে পারে ও ঐনা মাউতে চরায় হাতি …
  • … তখনি না কইচোং মইষাল রে/ মইষাল না যাইন গোয়ালপাড়া/ কাড়িয়া নিবে হাতের বাঁশি ছিঁড়িবে গলার মালা। মইষাল রে …
  • … গৌরীপুরের সৌখিন চেরি রে/ ও রে নাইওর যাবার চায়/ স্বামীর সংগে পেখনা করে/ ঢাকাই শাড়ি চায় রে।। …
  • … নাউ কুটিনু ঘুচি রে ঘুচি/ সাধু চালে থুইয়া দাও।/ শিশুতে করাইচেন বিয়া রে/ সাধু এলাউ গন্দায় গাও। …
  • … ফুলের সাজি লইয়া রে যশোদা/ যান বা গোয়ালপাড়া/ অলি অলি গলি গলি/ তায় বেচায় কমলা রে। …
  • … আগুনের ছলে মুই বাইরা জাং/ তবুও শ্যাম তোর দেখা না পাং …
  • … মদকিয়া মদ খায়/ আগুন দিতে আই মোর রাতি পোয়ায়রে/ নলের ডাঙে মোর শরির পরিল কালারে। …
  • … কদম গাছে হেলানিরে দিয়া/ কালা বাজায় মোহন বাঁশি সই/ না যাইও যমুনার জলে। …
  • কলসীর পানী মাজিয়ায় ঢালিয়া/ কলসী হইল মোর খালিরে/ আরে কলসীতে নাই মোর পানীরে। …
  • … আরে কমলা সুন্দরীর পেন্দনের শাড়ি/ রইদে ঝিলমিল করে রে/ আরে কমলা সুন্দরীর কানের সোনা/ নাচিয়া যাইতে ঢোলে রে/ ও তুই ভাল করিয়া বাজানরে দোতরা সুন্দরী কমলা নাচে …

শ্রমজীবী কৃষক ও কিষাণীর দুঃখের গান ফুটিয়ে তুলেছে নারীর ভূমি দাসত্ব, স্বামীর দূর এলাকায় দাসত্বের কারণে ঘটিত বিচ্ছেদ, দৈনন্দিন অভাবের বেদনা। প্রতিমা বড়ুয়ার গানে অবশ্যই আছে সামন্তবাদী সমাজের অভাবগ্রস্ত নারীর দুঃখের কথা।  দুঃখের গানের কয়েকটির কথাগুলি এইরকম

  • ও তোমরা গেইলে কী আসিবেন, ও মোর মাহুত বন্ধুরে …
  • ও প্রাণ কুকিলা রে, একবার আসিয়া একবার দেখা দিয়া, তোরে বাদে মনটা মোর থাকেরে কান্দিয়া …
  • … ও মোর হায় হস্তীর কন্যারে, খানেক দয়া নাই মাহুতোক নাগিয়া রে…
  • … কচুর পাতার পানি যেমন রে/ ও জীবন টলমল টলমল করে/ ওই মতন মানুষের দেহা/ কখন ঢলিয়া পড়ে জীবন রে …
  • বালু টি টি পংখীরে কান্দে বালুতে পড়িয়া/ আর গৌরীপুরিয়া মাহুত কান্দে ও/ সখী ঘরবাড়ি ছাড়িয়া, সখিও …
  • … ও মোর দান্তাল হাতির মাহুত রে/ যেদিন মাহুত ছাড়িয়া যায়/ নারীর মন মোর ঝুরিয়া রয় রে…
  • … হাতির মায়া জানো/ নারীরও বেদনা রে মাহুত/ কিবা তোমরা জানো রে
  • … আরে বাপো কানা মাও কানা ও/ ও দারুণ বিধি কানা পারার লোক/ পইছার লোভে বেচেয়া খাইচে/ স্বামী নাবালোক/ মন মোর কান্দে রে। …

প্রেম ভালোবাসার গান হচ্ছে অন্যান্য লোকগানের মতোই গোয়ালপাড়িয়া লোকগানেরও আরেকটি বৈশিষ্ট্য। সেই ভালবাসা গ্রামীণ সামন্তীয় কৃষকের নিত্যদিনের জীবনযাপনের সাথে জড়িয়ে।

  • কি অ’ বন্ধু কাজল, ভোমরারে, কোন দিন আসিবেন বন্ধু/ কয়া যান কয়া যান রে। …
  • তোমরা না যাইও না যাইও সই রে ওই না যাইও যমুনা জলে,
  • ওই গদাধরের পারে রে/ ও মোর মাউতে চরায় হাতি/ কী মায়া নাগাইলেন মাহুত রে/ ও তোর গলায় রসের কাঠি …
  • গাও তোলো গাও তোলো বন্ধু গাও তোলো ডাংগিয়া/ … কোন বা চোরা নিয়া যায় মোক চুরি না করিয়া রে। …
  • আমার বাড়ি যান ও মোর প্রাণের মইষাল রে/ ও মইষাল বইসতে দিব মোড়া/ বুক্কোতে হেলানি দিয়ারে/ ও মইষাল বাজাইবেন দোতারা।। …
  • মনের আয়েনা খুলিয়া দেখিলে হয়/ দেহের কপাট মেলিয়া দেখিলে হয়/ মনের মানুষ কোথায় পাওয়া যায়। …
  • অ’ মোর বন্ধু ধন রসিয়া দেখা দেও মোক/ একবার আসিয়া।/ আসিবার চায়া আসিলেন না/ মনের আগুন মোর নিবাইলেন না …

বিরহ ও আশার মাঝখানে দুলতে থাকা সেই যন্ত্রণাগ্রস্ত নারীদের ব্যথা প্রতিমা বড়ুয়ার গান যেভাবে তুলে ধরেছে তেমন করে আর কেউ কোনোদিন ফুটিয়ে তুলবে না। রাজপরিবারের কন্যা হয়েও কিষাণীর যন্ত্রণাকে বুকে ধারণ করে গান গেয়েছিলেন প্রতিমা। সেই হস্তীর কন্যা প্রতিমা বড়ুয়া পাণ্ডের প্রতি গোয়ালপাড়িয়া ও ভাওয়াইয়া গানের শ্রোতাদের মুগ্ধতা থাকবে যুগ যুগ ধরে।

প্রতিমা বড়ুয়ার একটি গান শুনুন ইউটিউব থেকে

তথ্যসূত্র

১. জলি বাগচী, শ্যামল চক্রবর্তী উদ্ধৃত, মাহুত বন্ধুরে প্রতিমা বড়ুয়া পাণ্ডের জীবন ও গান; জ্ঞান বিচিত্রা প্রকাশনী, আগরতলা; ফেব্রুয়ারি, ২০০৫; পৃষ্ঠা- ১৪।

Leave a Comment

error: Content is protected !!