পিতৃভূমি, হৃদপিণ্ডের মতো অবিরত কাজ করো তুমি
বাঁচিয়ে রাখো আর বেঁচে থাকো সর্বদাই
আর আমার সমগ্র সত্ত্বাজুড়ে দুনিয়ার গান হয়ে থাকো
তোমার অহংকার নেই, কোনো হুঙ্কারও নেই
আছে সততা সাহস আর সত্যের প্রতি ভালবাসা
সত্যের কাঠিন্য আমি অনুভবে বুঝতে পারি
ভালবাসতে পারি তাই তোমার কঠিন সত্য।
তুমি বদলে যাও সময়ের আঘাতে আঘাতে
কোন সুদূর অতীতে জন্ম তোমার, কত শত বছর আগে?
তোমার ইতিহাস তুমি মনে রাখোনি
আমি ভাবিনি তুমি ছিন্নভিন্ন বোঁটার ফুল
দাঁড়িয়ে আছো তুমি, ডেকেছ আমাদের তোমার সর্বাঙ্গে।
পিতৃভূমি, তুমি যাকে কৃষক বলো সেই তোমার প্রাণ
তুমি যাকে কবি বলো সে তোমার ব্যথায় কাতর
আর যে শ্রমিক সে জানে কীভাবে নির্মিত হয় গ্রাম
সমগ্র জীবনের প্রণোদনা থেকে তোমাকে বুঝেছি
রক্তের স্রোতে বুঝেছি তোমার সন্তানের ব্যথা
কৃষকের বাহুর ডগায় দেখেছি ধানের গুচ্ছ
আমি তোমার চোখের গভীরে দেখেছি পিতৃভূমির ছবি
লিচু গাছে যেমন থাকে গ্রীষ্মকালে গভীর আগুন
তেমনি আমার সত্ত্বা জুড়ে তোমার আগুন জ্বলেছে সবকালে;
তোমার আঙিনায় বর্ষাকালে যে মাছেরা খেলা করে তাদের
পাখনা হতে পাখা জন্মায়, তারা পাখি হয়,
তোমার প্রাথমিক বিদ্যাঘরে আমার জ্ঞানের হাতেখড়ি
তোমার সন্তানের কোলে আমার অগণিত ভুল শিক্ষা
বেঁচে থাকার শিক্ষা, ঘৃণা ভালবাসা ও বোধের শিক্ষা
তোমার সর্বাঙ্গে বৈচিত্র্যের কারুকাজ, বহুমুখী রঙ
তোমার খেলার মাঠে খেলা করে ফসলের মৌ মৌ গান
বিজলীর ঝলকায় তুমি দেখাও ঘর জুড়ে প্রাণ জাদুঘর
অশান্ত অক্ষরে তুমি তুলে আনো শ্রেণির ইতিহাস
সংগ্রামের বৈচিত্র্যে ভরা তোমার চারদিকে রক্তের দোলা
তারপরও তোমাকে দেখাতে পারিনি শ্রেণিহীন ছবি
পথিকেরা কেন পথ ভুলে ভালবাসে তোমার কথাকে
কেউ কী আসবে না ভোররাতে সাম্য মৈত্রীর আশায়?
তোমার সকল ঘরে প্রতি সন্ধ্যে বেলা আলো জ্বলে ওঠে
আমাদের ঘরে জ্বলে প্রতিরাতে জ্ঞান আর শিক্ষার আলো
সেই আলোয় পার্থক্য করেছি আমরা জনগণ আর গণশত্রুকে
প্রবৃত্তির ক্ষুদ্রতা ত্যাগ করে আমি একা হয়েছি দিশারি
আনতে চেয়েছি নতুন বাগান, বাগানের ফুল ফল ঋদ্ধ সমাজ
পিতৃভূমি, মনে পড়ে, তোমার বুকে ভর করে প্রথম হাঁটতে শেখা
তোমার আলিঙ্গনে মাথা রেখে ঘুমনো দীর্ঘ ষোলটি বছর
তোমার নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে মিশে থাকা কৈশোরের কাল
সমাজের ডাকে ছেড়ে আসা তোমার অস্তিত্বের অনুভূতি
হে আমার মুক্ত প্রাণের বায়ু তুমি হইয়ো না শীতল
দাও দাও আরো শক্তি দাও চূর্ণ করো এই পুঁজির শিকল
প্রতিটি ফসলকে তৈরি করো, নিজের হৃদপিণ্ড যেমন যুক্ত
আমাদের শ্রমে গড়া প্রতিটি শস্যদানা আমার রক্ত কণা
আর আমার শ্রমিকের হাতুড়ির আঘাত আমার ফুসফুস
যে শ্রমিক চালিয়েছে চাকা, তার হাত দুটি আমার প্রাণকণা
আমি তোমার প্রতিটি ধূলিকণায় চুম্বন করে বুঝেছি জীবনের স্বাদ
তোমার প্রতিটি ফলবান বৃক্ষ স্পর্শ করে বুঝেছি লেনিনের ঘামের শক্তি
আর তোমার পথে হেঁটে দেখেছি আগামি তৈরি হবে প্রাণের সম্পদ
একাকী যা পারিনি তা সকলের চেষ্টায় হয়ে যায়
দ্বন্দ্ব ও সংঘাতে তৈরি হয় চলবার প্রগতির পথ
বৈষম্যহীন সে পথে হেঁটে হেঁটে যাব সাম্যের শেষ সীমানায়
ব্যক্তিগত উন্নতি ও লোভের ঘরে খিল আঁটা থাকবে বহুদিন
সকলের ভোগ্য সম্পদ তৈরি করে আমরা আনবো সুদিন
ভালোবাসা বিলিয়ে দিয়ে আমি শস্যখেতে আনবো আলো
বীজতলা থেকে ফলের বাগানে আনবো লাল নীল পাখি
হে আমার জন্মভূমি, তুমি বিশালতার চেয়ে অনেক বড়
যে তোমার সবকিছু সুন্দর করতে চায় সত্য হোক তার জয়গান
মুখরিত হোক সত্যের জয়গানে আমাদের সমগ্র জীবন
হায়
হায় দেশপ্রেম, তোমার সোনালি ডানাতে এখন স্বর্ণ প্রলেপ
তুমি উৎপাদনে গর্বী শস্য শ্যামলে স্বাধীন অমর বাংলা
এ দেশের মাঝখানে তুমি টিকে আছো শির উঁচু রেখে
হেলে পড়োনি ঝড়ে দুমড়িয়ে মুচড়িয়ে যাওনি শীতে
তোমার হৃদয়ের আলো জ্বেলে আমাদের ক্রমমুক্তি হবে
আরো পড়ুন
- সুন্দর নান্দনিক সমতাঘর
- তোমার বিজয় সমতার জয়
- ঐ পারে স্বপ্নগতিগাড়ি
- আমরা দুজনে স্বপ্নের আবছা আলো দেখি
- শোনা যায় সেই ডাক, ভালোবাসি
- সম্পর্ক, মানে শক্তির নিত্যতা
- তুমি আসবেই আমার শ্রেণিহীন রক্তে
- আমরা সেদিন, বহুদিন তারপর কিছুদিন জীবনের গল্প বলেছি
- প্রত্যাশার স্বাপ্নিক আমরা ফেরি করি আশার আলো
- বেদনার নীল রঙে রাঙানো কষ্টগুলো
- সৃষ্টির শব্দে মুখরিত আমাদের যৌথ খামার
- সরসী
- On First Looking into Chapman’s Homer কবিতার মূলভাব ও সারমর্ম
- ফ্যানির প্রতি, জন কিটসের Ode To Fanny কবিতার অনুবাদ
২২ ডিসেম্বর ২০০৭,
দামোল, হরিপুর, ঠাকুরগাঁও
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।