ইবনে রুশদের দর্শন বা আবু রুশদের দর্শন বিষয়ক চিন্তাধারা (ইংরেজি: Philosophical thoughts of Ibn Rushd) হচ্ছে সামন্তবাদী যুগে মানবের বা মানবীয় আইনের ঊর্ধ্বে প্রত্যাদেশ ও ভাববাদকে তুলে ধরা। মানুষের শ্রেণিবিভেদে বিশ্বাসী ইবনে রুশদ আল ফারাবির যুক্তিবিদ্যা বিষয়ক মতবাদে আগ্রহী ছিলেন। প্লেটোর “রিপাবলিক” গ্রন্থের ভাষ্য রচনাকালে ফারাবির নৈতিক ও রাজনৈতিক চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। তবে রুশদ প্রধানত ইবনে বাজ্জার চিন্তাধারার অনুসারী ছিলেন এবং তাঁর ওহি বা রিসালাতে প্রজ্ঞার সঙ্গে মিলনের বিষয়ে এবং একাকীত্বের শাসন (রিজিম অব সলিডারিটি) সম্বন্ধে তাঁর রচিত গ্রন্থের ভাষ্য রচনা করেছিলেন।
ইবনে রুশদ কুরআনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। আল্লাহর অস্তিত্ব, হুকুম, গুণাবলী, কার্যাবলী, বিশ্বসৃষ্টি, নবী প্রেরণ, তকদীর, সুবিচার-অবিচার, ভবিষ্যৎ জীবন, আখিরাত ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করেছেন। সুফীবাদের বিরোধিতা করা, সৃষ্টি অনন্ত বলে ধারণা দেয়া, আল্লাহকে বিশ্বজগতের অংশ মনে করা ইত্যাদিসহ ইসলামী ধারণা বিষয়ে নানাবিধ বিতর্কিত মত দেয়ায় ইবনে রুশদ সম্পর্কে মুসলিম বিশ্বে সেকালে এবং পরবর্তীতেও নানা ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি হয়েছে।
গ্রীসীয় প্লেটো-এ্যারিস্টটলীয় দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হবার কারণে ইবনে রুশদের চিন্তায় ইসলামী ব্যাখ্যা ও মানবিক সীমাবদ্ধতার দর্শনের মধ্যে সমন্বয় করতে গিয়ে বেশ কিছু ভ্রান্তি ও জটিলতা তৈরি হয়। এ ছাড়া রুশদের মুক্তবুদ্ধি ও যুক্তিবাদের ব্যাখ্যাকে মহিমা দিতে পাশ্চাত্যেও তাকে ইসলাম বিরুদ্ধ ধর্মনিরপেক্ষ দার্শনিক বানিয়ে ফেলা হয়। ফলে একদিকে মুসলিম বিশ্বে আলীমদের দ্বারা তার সমালোচনা হয় তীব্রভাবে, অন্যদিকে গোঁড়া খ্রীষ্টানরাও তাঁকে বিভ্রান্ত বলে ঘোষণা দেন।
এ ভাবে ইবনে রুশদের নামে ‘সত্যের দ্বৈত তত্ত্ব’ অর্থাৎ ‘প্রত্যাদেশের সত্য’ এবং ‘দর্শনের সত্য’ – এমন ধারণা প্রচলিত হয়ে যায়। ইবনে রুশদ গ্রিক দর্শনের প্রভাবে এর সঙ্গে ইসলামের ধারণাকে সমন্বয় করতে যাওয়াতেই ভ্রান্ত ব্যাখ্যার মাধ্যমে দ্বৈত সত্যের ধারণা তৈরি হয়। মুসলিম আলীমগণ ইবনে রুশদকে ভুল বুঝেছিলেন খুব সম্ভবত তাঁর আল গাজ্জালীর বিরোধিতা করায় এবং তাঁর দার্শনিক যুক্তির সঙ্গে শরীয়ার বিরোধ রয়েছে মনে করে। ওদিকে গোড়া খ্রিস্টান যাজকরা তাকে ধর্মীয় ব্যাখ্যা থেকে নয়, বরং সাম্প্রদায়িক ধর্মবিদ্বেষ থেকেই বিকৃতভাবে তুলে ধরেছিলেন। সে সময় প্যারিসের চার্চ ইবনে রুশদের প্রচারিত সূত্রসমূহ থেকে ২১৯টি সূত্রকে ধর্মবিরুদ্ধ প্রতিপন্ন করে বাতিল বলে ঘোষণা দেয়। এতদসত্ত্বেও এ্যারিস্টটলের দর্শনের উপর ইবনে রুশদের ভাষ্যসমূহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে বাধ্যতামূলকভাবে থেকে যায়। ‘এভেরোয়িজম’ ইতালীর উত্তরাঞ্চলের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে শক্ত ভিত্তি গেড়ে বসে। এ ছাড়া পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয় ইবনে রুশদের ব্যাখ্যাসম্বলিত এরিস্টটলীয় দর্শন জ্ঞানার্জনের মূল কেন্দ্রে পরিণত হয়।
রুশদের দর্শন সংক্রান্ত ভ্রান্ত ধারণার নিরসন
পরবর্তীকালে অবশ্য প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় জগতে বিশেষজ্ঞগণ তাঁদের ধারণা পাল্টে ফেলেন। ইবনে রুশদ সম্পর্কে দ্বৈত সত্যের ধারণা পরিত্যক্ত হয়। বিশেষজ্ঞরা এই স্বীকৃতি সর্বত্রই দেন যে, ইবনে রুশদ আসলে এক আর অভিন্ন সত্যের ধারণাই তুলে ধরেছেন। এটাকে শরীয়ার সত্য বলা যায়। আল গাজ্জালীর বিরোধিতা করতে গিয়ে ‘তাহাফুত আল তাহাফুত’ গ্রন্থে ইবনে রুশদ আল্লাহ প্রেরিত ‘ওয়াহি’ বা প্রত্যাদেশ এবং রিসালতকে অস্বীকার করেন নি। আবার এ দু’টিকে তিনি দর্শনের সত্য – এর কাতারেও নামিয়ে আনেন নি। উল্টো ইবনে রুশদের বক্তব্য হচ্ছে শরীয়ার বিধানই আদর্শ রাষ্ট্রের সংবিধানের জন্য সর্বমৌলিক ও চূড়ান্ত। গাজ্জালীর সঙ্গে রুশদ আলাদা হচ্ছেন এখানেই যে, গাজ্জালী দর্শনের ভিতর শরীয়ার বিধানের অস্বীকৃতি আর বিরোধিতার সন্ধান পান। ওদিকে রুশদের দর্শনচিন্তা বিষয়টি শরীয়ার জন্য প্রশ্নহীন সমর্থন প্রত্যাশা করে।
ইবনে রুশদ এ ভাবে মুসলিম বিশ্বে তাঁর পূর্বসুরী চিন্তাবিদ ইবনে সিনার এবং ইউরোপে তাঁর উত্তরসুরী সেইন্ট থমাস এ্যাকুইনাসের সঙ্গে স্বীয় চিন্তার সঙ্গতি বিধান করেন। ওই দু’জনের মতো তিনিও ধর্ম বিশ্বাস ও দর্শনের সমন্বয় সাধনের পথে এগোন। ইবনে রুশদ বস্তুত দর্শনের প্রত্যেক ক্ষেত্রে ও পর্যায়ে গ্রীক কাঠামোর উপর ইসলামী প্রত্যাদেশের মুকুট পরিধান করান। ডব্লিউ. মন্টোগোমারী ওয়াট “ইসলামিক সার্ভে”-তে এজন্যেই মত দেন যে, ইবনে রুশদের জীবন ও চিন্তার গভীরে এই একই ধারণা পরিব্যাপ্ত ছিল যে, দর্শন ও প্রত্যাদেশ উভয়ই সত্য।
যা হোক, আলীমদের বিরূপ সমালোচনার মুখে খলীফা আল মনসুর ইবনে রুশদকে নির্বাসন দিলেও পরবর্তীকালে আবার তাকে রাজ দরবারে ফিরিয়ে এনে কাজীর পদে অধিষ্ঠিত করেন।
প্রত্যাদিষ্ট শরীয়া আইনের প্রাধান্য
ইবনে রুশদের দর্শনচিন্তা সংক্রান্ত সমস্যার একটা মূল্যায়ন করেছেন আরউইন রোজেনথাল তার “পলিটিক্যাল থট ইন মিডিয়াভাল ইসলাম” গ্রন্থে। তাঁর মতে, আদর্শ প্রত্যাদিষ্ট আইনরূপে শরীয়ার প্রাধান্য এবং আদর্শ রাষ্ট্রের আদর্শ সংবিধানরূপে শরীয়ার রাজনৈতিক ভূমিকার স্বীকৃতি প্রদানে আল ফারাবি অপেক্ষা কোনোক্রমেই কম সচেতন ছিলেন না ইবনে রুশদ। ইবনে রুশদের দ্ব্যর্থহীন সূত্র ও স্পষ্ট বক্তব্যের ভিতর দিয়ে এমন সচেতনতারই বহিপ্রকাশ ঘটেছে। এতে করে এটাও সন্দেহাতীতভাবে বোঝা গেছে যে, ইসলাম ধর্মীয় দার্শনিকরূপে তার গুরুত্ব ইবনে সিনার চেয়ে কম নয় মোটেও।
ইবনে রুশদও প্রত্যাদেশ ও দর্শনের মধ্যেকার সম্পর্ক আলোচনাকালে প্রত্যাদিষ্ট আইনকে সর্বদাই বেশি মূল্য দিয়েছেন। তিনি এটি সুস্পষ্টভাবেই অবগত ছিলেন যে, ওহী বা প্রত্যাদেশের উৎস হচ্ছে আল্লাহর অসীম ও অভ্রান্ত প্রজ্ঞা। আর অন্যদিকে সৃষ্ট মানবের অসীম ও ভ্রান্ত যুক্তিই দর্শনের উৎস। রুশদ এটাও বুঝতেন যে, প্রত্যাদেশ ঘটায় অখন্ড ও সামগ্রিক সত্যের প্রকাশ। বিপরীতে দর্শনের সত্য খন্ডিত ও আংশিক। রুশদ আরো মনে করতেন যে, কালামপন্থী ধর্মতাত্ত্বিকদের বিতর্ক নয়, ডেমোনোস্ট্রেটিভ আর্গুমেন্ট বা প্রতিপাদক যুক্তিই প্রত্যাদেশের সঙ্গে দর্শনের সঙ্গতি বিধানের উপায়। এটি অবশ্য অস্বীকার করার জো নেই যে, রুশদ সিনা, ফারাবি এদের চেয়েও গ্রীক দর্শন দ্বারা অধিক প্রভাবিত ছিলেন এবং সে কারণে ইসলাম ও গ্রীক দর্শনের সমন্বয়ের চেষ্টায় অধিক প্রয়াসীও ছিলেন।
তথ্যসূত্র:
১. হাসানুজ্জামান চৌধুরী, মো আব্দুর রশীদ, এ এমদাদুল হক ও অন্যান্য; রাষ্ট্রবিজ্ঞান দ্বিতীয় খণ্ড, রাষ্ট্রচিন্তা, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা, ত্রয়োদশ প্রকাশ, ২০২০, পৃষ্ঠা ৯২-৯৩।
রচনাকাল ১৮ মার্চ, ২০২১, এসজিআর।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।