আবুল ফজল ছিলেন আকবরের এক নবরত্ন, সুপণ্ডিত, ইতিহাসবেত্তা ও রাজনীতিক

শেখ আবুল ফজল ইবন মুবারক বা আবুল ফজল (ফার্সি: ابو الفضل) ১৪ জানুয়ারি ১৫৫১ – ১২ আগস্ট ১৬০২) ছিলেন মুঘল সম্রাট আকবরের নবরত্নের অন্যতম, সুপণ্ডিত, ইতিহাসবেত্তা, সামরিক অধিনায়ক, রাজনীতিবিদ ও সাহিত্যশিল্পী। আল্লামা আবুল ফজল ১৫৫১ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জানুয়ারি ভারতের আগ্রায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শায়খ মুবারক আলী তৎকালীন প্রখ্যাত আলেম ছিলেন। শায়খ মুবারক আলী নগোরীর দ্বিতীয় পুত্র ছিলেন আবুল ফজল। তার বড় ভাইয়ের নাম শায়খ ফৈজী, যিনি আকবরের সভার একজন কবি ছিলেন।[১]

প্রাচ্যদেশীয় রাষ্ট্রচিন্তার চারণক্ষেত্র হিসেবে ভারতীয় রাষ্ট্রচিন্তা বিশেষ গুরুত্বের দাবিদার। প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক চিন্তাধারা স্বকীয় ও মৌলিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ছিল। শিল্প বিপ্লবের ফলে ইউরোপ জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যায় যে অগ্রগতি অর্জন করে তাকে কাজে লাগিয়ে ইংল্যান্ড ভারতের উপর আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয় এবং ভারতকে পরিণত করে পরাধীন উপনিবেশে। এই সুযোগে পাশ্চাত্য ভাষ্যকারগণ প্রাচীন ভারতের ঐতিহ্যমণ্ডিত ইতিহাসকে অস্বীকার করে। কিন্তু যে কারণে পাশ্চাত্য ভাষ্যকারগণ ভারতীয় রাষ্ট্রচিন্তাকে অস্বীকার করেন তা নিতান্তই অযৌক্তিক। ভারতের মতো বৃহৎ একটি দেশে রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশ ঘটেনি তা সত্যিই অবিশ্বাস্য।

ভারতীয় রাষ্ট্রদর্শনের ভাষ্যকার বিনয়কুমার সরকার মনে করেন প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের এমন কোনো শাখা ছিল না যেখানে রাষ্ট্রতত্ত্ব, রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়নি। প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের রাষ্ট্রনীতি ও লোকপ্রশাসন বিষয়ক গ্রন্থাবলি মানগত দিক দিয়ে ইউরোপীয় সাহিত্যের সাথে তুলনীয় ছিল। সুতরাং প্রাচীন ভারতে যে উন্নতমানের রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশ সাধিত হয়েছিল তার পশ্চাতে মুসলিম দার্শনিক আবুল ফজলের অবদান ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।[২]

আবুল ফজলের শিক্ষা ও কর্মজীবন

বড় ভাই শায়খ ফৈজীর তত্ত্বাবধানে এবং পিতার সাহচর্যে আবুল ফজল প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সেই এই মনীষী তাঁর শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি টেনে ব্যাপক জ্ঞান লাভ করেন। বড় ভাই শায়খ ফৈজীর মাধ্যমে ১৫৭৪ খ্রিস্টাব্দে আবুল ফজল মুঘল সম্রাট আকবরের দরবারে স্থান লাভ করেন। ধীরে ধীরে তার জ্ঞান গরিমা এবং বুদ্ধি কৌশল দ্বারা অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি সম্রাট আকবরের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেন। তাঁর প্রতিভা ও প্রশাসনিক দক্ষতার গুণে প্রথমে তাকে কেরানীগিরির দায়িত্ব দেয়া হলেও অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি আকবরের মন্ত্রিসভার সদস্য হয়ে যান। এরপর তাঁর দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার বলেই তিনি সদরুস সুদুর বা সম্রাটের প্রধান উপদেষ্টার পদে নিযুক্ত হন। তিনি অল্প সময়েই তার প্রতিভা, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার বলে সম্রাট আকবরের সর্বাপেক্ষা বিশ্বস্ত পরামর্শদাতার স্থান লাভ করেন।

আবুল ফজলের প্রভাবেই সম্রাট আকবর ধর্মীয় বিষয়ে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতে শুরু করেন। এ সময় সম্রাট আকবর বিভিন্ন ধর্মের সমন্বয়ে ‘দ্বীন-ই-ইলাহী’ নামের একটি নতুন ধর্মমতের প্রবর্তন করেন। আবুল ফজল ছিলেন আকবরের প্রবর্তিত দ্বীন-ই-ইলাহীর প্রধান ধর্মযাজক। তিনি নামাজ, রোজা, হজ্জ্ব ও অন্যান্য ইসলামি বিধানের বিরুদ্ধে আপত্তি উত্থাপন ও সেগুলোকে উপহাস করেন। আবুল ফজল ও কতিপয় আখেরাত ভুলে যাওয়া ব্যক্তি আকবরকে প্রভাবিত করে বিভ্রান্তিকর নতুন ধর্ম দ্বীন-ই-ইলাহীর প্রবর্তন করান।

এই কারণে জাহাঙ্গীরের ষড়যন্ত্রে তিনি নারওয়ারের নিকট সরাই বীর ও অন্ত্রীর মধ্যবর্তী কোনো এক স্থানে বীর সিংহ বুন্দেলার হাতে ১২ আগস্ট ১৬০২ তারিখে নিহত হন।

১৫৯৭ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মুরাদের সঙ্গে তিনি দাক্ষিণাত্য বিজয়ে প্রেরিত হয়েছিলেন । বলা হয়, আবুল ফজল যুবরাজ সেলিম বা পরবর্তীতে জাহাঙ্গীরের সিংহাসনে আরোহণের বিরোধিতা করেছিলেন। রাজকুমার সেলিম, আবুল ফজলের জন্য অনেক অন্যায় কাজ হতে বিরত থাকতে বাধ্য হন। সেজন্য তিনি আবুল ফজলের উপর ক্রোধান্বিত ছিলেন।

পাঁচ বৎসর পরে যখন তিনি প্রত্যাবর্তন করছিলেন সেই সময় রাজকুমার সেলিমের পরামর্শে বুন্দেল খণ্ডের অন্তর্গত আর্চার রাজা বীরসিংহদেব তাকে ১৬০২ খ্রিস্টাব্দে হত্যা করে, তার ছিন্ন মস্তক সেলিমের নিকট প্রেরণ করেন। সেলিম ঐ মস্তক জঘন্য স্থানে নিক্ষেপ করে স্বীয় জঘন্য মনোবৃত্তির পরিচয় দিয়েছিলেন। সম্রাট আকবর স্বীয় বন্ধু ও মন্ত্রীর মৃত্যু সংবাদে এত মর্মাহত হইয়াছিলেন যে, তিনি দুই দিন দুই রাত আহার নিদ্রা পরিত্যাগ করেছিলেন।[৩]

প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাসের ক্ষেত্রে আবুল ফজলের সমালোচনায় সম্রাট আকবরের চিন্তার পরিবর্তন ঘটে এবং ধর্মের গোড়ামীর স্থানে তাঁর মনে একাধিক ধর্মের প্রতি সহানুভূতির সৃষ্টি হয়।[৪] আবুল ফজল রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সামাজিক স্থিতিশীলতার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তাঁর আইন-ই-আকবরীতে তিনি সামাজিক চুক্তিতে প্রতিশ্রুত সার্বভৌমত্বের একটি তত্ত্ব উপস্থাপন করেছিলেন।

ফজলের মতে, সার্বভৌমত্ব কোন বিশেষ বিশ্বাসের সাথে যুক্ত ছিল না। আবুল ফজল বিভিন্ন ধর্মের ভালো মূল্যবোধগুলো প্রচার করেছিলেন এবং তাদের শান্তি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একত্রিত করেছিলেন। তিনি মানুষকে আবদ্ধ চিন্তা থেকে মুক্ত করে মুক্তির দিকে নিতে চেষ্টা করেছিলেন। তিনি আকবরকে যুক্তিবাদী শাসক হিসাবে উপস্থাপন করে তাঁর মতামতকেও ন্যায়সঙ্গত করেছিলেন।

আবুল ফজল রচিত গ্রন্থাবলী

আবুল ফজলের রচনাবলির তালিকা তেমন দীর্ঘ নয়। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা, রাষ্ট্রচিন্তা ও সাহিত্যচিন্তার আলোকে মোট দশটি গ্রন্থ রচনা করেছেন বিভিন্ন পটভূমিতে।

আবুল ফজলের একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘আকবরনামা’ বা ‘আকবরের শাসন ও ইতিহাস’। এটি ফারসি ভাষায় রচিত। তিন খণ্ডে রচিত আকবর নামায় মোঘল সম্রাট আকবরের পূর্ব পুরুষগণের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এবং তার ৪৬ বছরের শাসনামলের বিস্তারিত ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়েছে।

এই গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডটি আইন-ই-আকবরী নামে পরিচিত। এছাড়াও তিনি বাইবেলের একটি ফারসি অনুবাদও করেন। ‘মক্তোবাত-অল্লমী’ নামক তাহার পত্রাবলী রাজকীয় দরবারের উচ্চ আদর্শে পূর্ণ।

নিম্নে গ্রন্থগুলো উল্লেখ করা হলো:

১. আকবরনামা: ফার্সি ভাষায় রচিত এ গ্রন্থখানি প্রতিভাশীল আবুল ফজলের অক্ষয়কীর্তি। গ্রন্থটি দুই খণ্ডে বিভক্ত। এতে সম্রাট আকবরের পূর্ব পুরুষগণের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এবং তার ৪৬ বছরের শাসন ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়েছে।
২. আইন-ই-আকবরী: আবুল ফজলের বিখ্যাত গ্রন্থ। এ গ্রন্থে আইন-কানুন, শাসন পদ্ধতি, বিভিন্ন বিষয়ের পরিসংখ্যান স্থান পেয়েছে।
৩. দীবচাহ-ই-রাম নামাহ: এটি বিখ্যাত গ্রন্থ ‘মহাভারত’ এর ফার্সি অনুবাদের ভূমিকা।
৪. ইয়ার-ই-দানিশ: ফার্সি গ্রন্থ ‘আনওয়ার সুহায়লী’র সার-সংক্ষেপ।
৫. ইনঞ্জিল: বাইবেল এর ফার্সি অনুবাদ।
৬. রুকআই আবুল ফজল: আবুল ফজলের ব্যক্তিগত পত্রাবলির সংকলন যা তাঁর ভ্রাতুস্পুত্র নূরউদ্দিন মুহাম্মদ সম্পাদনা করেন।
৭. মুনাজাত: এটি তাঁর দীর্ঘ কবিতার গ্রন্থ।
৮. ইনশা-ই আবুল ফজল বা মাকতুবাতই আবুল ফজল: এটিও আবুল ফজলের পত্রাবলির সংকলন।
৯. দীবচা-ই তারিখই আলখী: এটিও একটি ভূমিকা গ্রন্থ।

তথ্যসূত্র

১. অনুপ সাদি, ২৪ মার্চ ২০১৯, “আবুল ফজল ছিলেন ভারতীয় ঐতিহাসিক এবং সামরিক অধিনায়ক”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/biography/allama-abul-fazl/
২. অধ্যাপক একেএম শহীদুল্লাহ ও এম রফিকুল ইসলাম, প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা, গ্রন্থকুটির ঢাকা, প্রথম পুনর্মুদ্রণ জানুয়ারি ২০১৮/১৯, পৃষ্ঠা ১২২-১২৩।
৩. শ্রীশশীভূষণ বিদ্যালঙ্কার সংকলিত ও দেবব্রত চক্রবর্তী প্রকাশিত ভারতীয় ঐতিহাসিক জীবনীকোষ, প্রথম সংস্করণ কলকাতা ১৩৪৩, পৃষ্ঠা ২১৪।
৪. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; ৫ম মুদ্রণ জানুয়ারি, ২০১২; পৃষ্ঠা ৪২।

Leave a Comment

error: Content is protected !!