ইসলামি রাষ্ট্রের কথা — আবদুল হক

পাকিস্তান আদর্শবাদী রাষ্ট্র, ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং ইসলামি আদর্শ রূপায়ণের জন্যই এর জন্ম, একথা অনেকে আপ্তবাণীর মতো উচ্চারণ করেছেন এবং আরও অনেকে আপ্তবাণীর মতোই বিশ্বাস করেছেন পাকিস্তান আমলে। ইসলামি রাষ্ট্র গঠনের প্রশ্ন পাকিস্তানের প্রায় জন্মমুহূর্ত থেকেই ছিল। কিন্তু এটা কোনো ক্রমেই সর্বসম্মত অভিমত ছিল না। এ প্রশ্নে মতবিরোধ ছিল যথেষ্ট। ইসলামি রাষ্ট্রের দাবির ফলস্বরূপ ১৯৫৩ সালে পাঞ্জাবে অরাজকতার উদ্ভব হয়েছিল এবং মুসলমানের হাতেই কিছু মুসলমানকে প্রাণ দিতে হয়েছিল, তারই ফলে লাহোরে সামরিক আইন জারির প্রয়োজন হয়- পাকিস্তানে সে-ই প্রথম সামরিক আইন জারি। রাষ্ট্র ধর্মভিত্তিক হওয়া উচিত না ধর্মনিরপেক্ষ, এ প্রশ্নের মীমাংসা অনেক রাষ্ট্র- অমুসলিম ও মুসলিম উভয়ই- অনেক বছর আগেই করেছে; কোনো কোনো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের বয়স শতাধিক বছর, রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপের সঙ্গে ধর্মকে সংযুক্ত রাখা উচিত কি অনুচিত এ সিদ্ধান্তে পৌঁছার জন্য প্রায় সব ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রকেই রক্তাক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আসতে হয়েছে। তথাপি ওদের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া পাকিস্তানে সম্ভব হয়নি। একাত্তরের রক্তাক্ত অভিজ্ঞতার পর বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু ও- ধরনের অভিজ্ঞতা অনেকটা যেন দিল্লী-কা-লাড্ডুর মতো, যা খেলেও পস্তাতে হয়, না খেলেও পস্তাতে হয়। অথবা যেন বয়োপ্রাপ্তির মতো কতকগুলো বিশেষ বিশেষ অভিজ্ঞতা না হওয়া পর্যন্ত সমাজের পক্ষে সাবালক হওয়া, সচেতন হওয়া, সম্ভব নয়। ইসলামি রাষ্ট্রের যে-কোনো আলোচনায় এরূপ রাষ্ট্রের লক্ষ্য ও কর্মসূচী সম্বন্ধে আলোচনা অপরিহার্য; কিন্তু এ সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণায় উপনীত হওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে প্রথমে যে উপলব্ধি হয় এবং প্রথমেই যেখানে ধাক্কা খেতে হয় তা হচ্ছে, ইসলামি রাষ্ট্রের লক্ষ্য ও কর্মসূচি সম্বন্ধে কোনো মতৈক্য নেই। ইসলামি রাষ্ট্রের কথা বলতেন আলেম-সম্প্রদায়; এবং ইসলামি রাষ্ট্রের কথা বলতেন এরূপ আধুনিক-শিক্ষিত রাজনীতিক ব্যক্তিবর্গ ও বুদ্ধিজীবী, যাঁদের কোনো অর্থেই আলেম বলা সম্ভব নয় এবং কোরআন হাদিস ও ফেকাহ সম্বন্ধে যাঁদের জ্ঞান সাধারণ মানুষের চাইতে খুব বেশি নয়। ইসলামি রাষ্ট্রের প্রশ্নে নানা আলেমের নানা মত; এবং এ ব্যাপারে আধুনিক শিক্ষিতরাও কম যান না। অবশ্যই এঁরা একই রকম নিঃস্বার্থ আদর্শবাদ এবং একই উদ্দেশ্য নিয়ে কথা বলেন না। তথাপি, ইসলামি রাষ্ট্রবাদীরা বিভিন্ন সময় যে-সব কথা বলেছেন এবং তাঁদের রাজনৈতিক রচনাসমূহে যে-সব অভিমত প্রকাশ করেছেন তাতে দেখা যায় এঁদের মধ্যে দু’টি সুস্পষ্ট শ্রেণী আছে। একটি শ্রেণী আলেমদের নিয়ে গঠিত, আরেকটি শ্রেণী আধুনিক-শিক্ষিতদের নিয়ে। তার অর্থ এই নয় যে ইসলামি রাষ্ট্রের প্রশ্নে আলেমরা একটি অভিন্নমত সুসংহত শ্রেণী। মোটামুটিভাবে বলা চলে আলেম- সম্প্রদায়ের নজর অতীতের বিভিন্ন কেতাব ও ইতিহাস-বর্ণিত সামাজিক রাষ্ট্রীয় ধারণার প্রতি, এবং শিক্ষিত-সম্প্রদায়ের দৃষ্টি স্বৈরাচারী থেকে গণতান্ত্রিক সব রকম আধুনিক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ধারণার প্রতি। আলেম-সম্প্রদায় তাঁদের রাষ্ট্র-ধারণায় কিছু আধুনিক রাষ্ট্রধারণার ভেজাল দিয়ে থাকেন।[১] পক্ষান্তরে আধুনিক-শিক্ষিতরা আধুনিক রাষ্ট্রধারণায় কিছু আধুনিক রাষ্ট্রধারণায় কিছু ইসলামি ভেজাল দিয়ে থাকেন।[২] তবে ভেজাল দুটোই। কিন্তু কি পরিমাণ ভেজাল দেওয়া সঙ্গত এই নিয়ে দু’টি শ্রেণীর মধ্যেই প্রবল মতবিরোধ বর্তমান; দু’টি শ্রেণীরই বিভিন্ন উপদল নিজেদের মতবাদকেই অকাট্য ইসলামি মতবাদ বলে প্রমাণের চেষ্টা করে থাকেন। অতএব স্বভাবতই কে কতটা ইসলামি রাষ্ট্রের কথা বলতে পারেন এই নিয়ে এঁদের মধ্যে প্রবল প্রতিযোগিতা ছিল (এবং এখনও আছে)। এতটা ছিল যে, একদলের ইসলামি-রাষ্ট্রবাদী ক্ষমতাসীন হলে অন্য দলের ইসলামি- রাষ্ট্রবাদীকে কারারুদ্ধ করতেও প্রস্তুত ছিলেন। এবং সেটা যেহেতু যখন-তখন সম্ভব নয় এই কারণে একদল অন্যদলকে বিদেশের দালাল বলে আখ্যা দিতেন অথবা একদল অন্যদলকে ইসলাম থেকেই খারিজ করতেন। 

অর্থাৎ আসল কথাটা ইসলামি রাষ্ট্র নয়, স্বার্থ-সংঘাত। আর এই কারণেই এমনও হতে পারে যে, এঁরাই কালক্রমে পরস্পর পরস্পরকে বাতিল করে দেবেন। কিন্তু ঐ বাতিলের ব্যাপারটা শান্ত মস্তিষ্কে ঘটবে কি? অথবা ঘটবে আরো কোনো নিদারুণ অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে? (১৯৫৩ সালের পাঞ্জাবের অরাজকতাকে বলা যেতে পারে ধর্মীয় প্রশ্নে একটা গুরুতর ঘটনা)। এ সম্বন্ধে কোন সুনিশ্চিত অবিষ্যদ্বাণী আপাতত সম্ভব নয়। সাধারণ মানুষের অজ্ঞতার সুযোগে ধর্মের অপব্যবহার এবং ধর্মকে স্বার্থ সাধনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার বহুকাল যাবৎ চলে আসছে। পাকিস্তানে তাই-ই করা হয়েছে। বাংলাদেশের দিক থেকে ইসলামি রাষ্ট্র এখন অতীতের ইতিহাস। ইতিহাস, হিসাবেই আমরা ইসলামি রাষ্ট্র প্রসঙ্গের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক পরীক্ষা করে দেখব। 

২ 

ইসলামি রাষ্ট্রবাদীগণ বলতেন পাকিস্তান আন্দোলনের উদ্দেশ্যই ছিল ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। ইসলামি রাষ্ট্রের সপক্ষে এইটে ছিল তাঁদের একটা খুব বড় যুক্তি। তাঁদের মতে পাকিস্তান আন্দোলনের মূল কথাটা সোজা ভাষায় ছিল এই রকম “আমরা ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই, এইজন্যই ভারত-বিভাগ এবং পাকিস্তান চাই।” অথবা “আমরা পাকিস্তান চাই এবং পাকিস্তান একমাত্র ইসলামি রাষ্ট্রই হতে পারে।” এরূপ ধারণা সৃষ্টির যাঁরা প্রয়াস পেয়েছেন তাঁরা ইতিহাসনিষ্ঠার পরিচয় দেননি। পাকিস্তান আন্দোলনের ইতিহাসকেই তাঁরা বিকৃত করেছেন। পাকিস্তান দাবি করেছিল এবং পাকিস্তান আন্দোলনকে নেতৃত্ব দিয়েছিল একটিমাত্র রাজনৈতিক দল, যে-দল হচ্ছে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ। এবং মুসলিম লীগের অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্। এ কথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে লাহোর প্রস্তাব গ্রহণের কয়েক বছর আগে থেকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত তিনিই ছিলেন মুসলিম লীগ। মুসলিম লীগের এবং মুসলিম জনগণের সমর্থনে তিনিই ছিলেন পাকিস্তানের স্রষ্টা। আর এই কারণেই তাঁকে বলা হয় পাকিস্তানি জাতির জনক। ভারতীয় মুসলমানেরা কেন পাকিস্তান চেয়েছিল তা মুসলিম লীগের বিভিন্ন প্রস্তাব এবং জিন্নাহ্ সাহেবের বক্তৃতায়- বিবৃতিতে অসংখ্যবার বলা হয়েছিল। পাকিস্তান কী প্রকৃতির রাষ্ট্র হবে তারও ক্বচিৎ- কখনো আভাস দেওয়া হতো। ইসলামি রাষ্ট্র স্থাপনের জন্যই পাকিস্তান দাবি করা হয়েছিল একথা প্রমাণ করতে হ’লে এসব প্রামাণ্য ঐতিহাসিক দলিলের ভিত্তিতেই তা করতে হবে, কোনো সস্তা স্লোগানের, হ্যান্ডবিলের বা পোস্টারের ভিত্তিতে নয়। ঐসব প্রস্তাবে বক্তৃতায় বিবৃতিতে এমন কথা বলা হয়নি যার অর্থ করা যেতে পারে “আমরা ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই, আর এ জন্যই ভারত-বিভাগ চাই।” 

পাকিস্তান দাবির কারণ সুবিদিত, পাকিস্তানের সব প্রামাণ্য ইতিহাসেই এ আন্দোলনের বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে, তথাপি স্মরণ করা যেতে পারে: অখণ্ড স্বাধীন ভারতে হিন্দুরাজ স্থাপিত হবে, সে-রাষ্ট্রে মুসলমানেরা একটা চির-সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীতে পরিণত হবে, তাদের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হবে এবং তারা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হবে এই ছিল মুসলিম লীগের যুক্তি, মুসলিম সমাজের ব্যাপক আশঙ্কা, আর এই আশঙ্কাই ছিল পাকিস্তান দাবির কারণ। বৃটিশ আমলে নানারূপ ঐতিহাসিক কারণে মুসলিম মধ্যবিত্তের পশ্চাদপদতা, নবজাগ্রত ভারতীয় জাতীয়তাবাদে হিন্দু-সাম্প্রদায়িকতার প্রাধান্য, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, হিন্দু-সাম্প্রদায়িকদের অবিমৃষ্য উক্তি, ১৯৩৭ সালের পর কংগ্রেস- শাসিত প্রদেশসমূহে এবং কেন্দ্রে ক্ষমতা বন্টনে মুসলিম লীগের প্রতি উপেক্ষা, সরকারি চাকুরি বন্টনে মুসলিম প্রার্থীর প্রতি অবিচারের অভিযোগ, এবং আরও অনেক হেতু ঐ আশঙ্কাকে ঘনীভূত করেছিল। আরও একটি বড় কারণ ছিল বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিভেদমূলক উস্কানী। এইসব কারণে ভারতীয় মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান দাবি এবং ইসলামি রাষ্ট্র গঠনের জন্যই পাকিস্তান দাবি, এই দুটি কথার মধ্যে সুস্পষ্ট মৌলিক তফাৎ আছে। এ তফাৎ বোঝা কিছুমাত্র কঠিন নয়; তবু যদি কেউ না বোঝেন তা’হলে তাঁর বোঝার ক্ষমতার প্রশংসা করা যায় না। আর যদি তিনি বুঝেও না বোঝেন তবে সেটা উদ্দেশ্য-প্রণোদিত এবং সে ক্ষেত্রে ইতিহাস-নিষ্ঠা ও সততার প্রশ্ন অবান্তর। বস্তুত পাকিস্তান আন্দোলনের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা সে-রাষ্ট্র ইসলামি হবে কি হবে না, এবং তার অর্থনৈতিক কর্মসূচি কি হবে সে সম্বন্ধে মুসলিম লীগ প্রায় কিছুই বলেননি। [৩] দ্বিজাতিতত্ত্ব ব্যতীত আর কোন দর্শনই লীগের ছিল না, কিন্তু এই দ্বিজাতিতত্ত্বও জিন্নাহ্ সাহেব কোনো অলঙ্ঘনীয় তত্ত্ব হিসেবে উদ্ভাবন করেননি, পাকিস্তান আন্দোলনের একটা রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে উদ্ভাবন করেছিলেন; আর এই কারণেই, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়া মাত্র এ কৌশল অবান্তর হয়ে ওঠে এবং তিনি নিজেই ১৯৪৭ সালের ১১ আগস্টের নীতি-নির্দেশক ভাষণে দ্বিজাতিতত্ত্ব বর্জন করেন। এই ভাষণে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকল পাকিস্তানিকে তিনি এক জাতি হিসেবেই গঠনের কথা বলেন (এ সম্বন্ধে পরে আমরা আরো কিছু আলোচনা করব)। 

পাকিস্তান আন্দোলন যাঁরা প্রত্যক্ষ করেছিলেন তাঁদের মনে আছে এবং পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রামাণ্য ইতিহাসেও বর্ণিত হয়েছে যে পাকিস্তানে যাঁরা ইসলামি রাষ্ট্রের কথা বলতেন তাঁদের অনেকেই এবং বিশেষ করে আলেম সম্প্রদায়ের একটা বিপুল অংশ পাকিস্তান দাবির বিরোধী ছিলেন। তাঁদের যে-সব দল তখন পাকিস্তান আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিল তাঁদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য জমিয়তে ওলেমায়ে হিন্দ, আহরার পার্টি এবং জামাতে ইসলামি। জমিয়তে ওলেমায়ে হিন্দ পাকিস্তানকে স্বীকার করে নিতে পারেনি, ভারতেই থেকে গেছে। স্বাধীনতার পর আহরার পার্টি পাকিস্তানে পুনর্গঠিত হয় এবং পাকিস্তানকে স্বীকার করে নেয়। জামাতে ইসলামি দ্বিখণ্ডিত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান উভয় রাষ্ট্রেই কাজ করতে থাকে। পাকিস্তানি জামাতে ইসলামি পাকিস্তানকে স্বীকার করে নেয় এবং যে-রাষ্ট্রের জন্মেরই সে বিরোধী ছিল সেই রাষ্ট্রকে ইসলামি রাষ্ট্র করার জন্য প্রাণপণ করে। এখন প্রশ্ন এই ইসলামি রাষ্ট্র গঠনই যদি ছিল পাকিস্তান আন্দোলনের লক্ষ্য তাহলে এইসব দল ঐ আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিল কেন?[৪] 

 রাজনৈতিক দলিল ছাড়াও আরো একটি বিচার্য ঐতিহাসিক উপাদান জিন্নাহ সাহেবের ব্যক্তিগত জীবন- তাঁর শিক্ষা, আচার-আচরণ, চিন্তাধারা-তাঁর পক্ষে কি সম্ভব মওলানা সাহেবেরা যেমন ইসলামি রাষ্ট্র দাবি করেন তেমনি ইসলামি রাষ্ট্র দাবি করা? তাঁর বক্তৃতায় বিবৃতিতে সেরূপ দাবীর কথা কি কোথাও আছে? তিনি ছিলেন পশ্চিমী শিক্ষাপ্রাপ্ত; তাঁর বিরুদ্ধে মওলানাদের অভিযোগ ছিল তিনি মক্কায় হজ্জ করতে যাননি, এবং “তাঁর উদার মতামত এবং ধর্মীয় ব্যাপারে বাহ্যাড়ম্বরহীনতার হীন সুযোগ নিয়ে আহরারগণ তাঁকে ধর্মে অবিশ্বাসী বলে ব্যাখ্যা দেয়”। [৫] পরে মওলানা সাহেবেরা যাই বলুন, ঐ ধরনের উদ্ভট যুক্তি দেখিয়েই তাঁরা এক সময় পাকিস্তান আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলেন। 

  মওলানা মওদুদী পাকিস্তান আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলেন অন্য যুক্তিতে। পাকিস্তান দাবির একটা যুক্তি ছিল ভারতীয় (অখণ্ড) উপমহাদেশের হিন্দু ও মুসলমানেরা দু’টি স্বতন্ত্র জাতি। মওলানা সাহেবের ভাষায়, এই দ্বিজাতিতত্ত্বের সমর্থকেরা ছিলেন মুসলিম জাতীয়তাবাদী (পক্ষান্তরে অখণ্ড ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সমর্থক মুসলমানদের বলা হতো জাতীয়তাবাদী মুসলমান)। মওলানা মওদুদীর মতে মুসলমান কখনো কোনো রকমেরই জাতীয়তাবাদী হতে পারে না। “ন্যাশনালিজম এ্যান্ড ইন্ডিয়া” নামক গ্রন্থে (এটি তাঁর একটি উর্দু গ্রন্থের অনুবাদ) তিনি বলেছেন, ‘মুসলমান’ এবং ‘জাতীয়তাবাদ’ পরস্পর-বিরোধী শব্দ। ‘সমাজতন্ত্রী পুঁজিবাদী’ অথবা ‘সতী বেশ্যা’ যেমন স্ববিরোধী শব্দ-সমবায়, ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদীও’ তেমনি একটি স্ববিরোধী উক্তি।[৬] ঐ গ্রন্থে তিনি জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের কথা উল্লেখ করলেও তাঁর আসল লক্ষ্য ছিল পাকিস্তান আন্দোলনের বিরোধিতা। এবং ঐ কথা তিনি গোপন রাখেননি। পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, তাঁরা “ইসলামি নীতি ও লক্ষ্যের প্রতি উদাসীন। “[৭] মওলানা মওদুদীর এসব উক্তি থেকেও একমাত্র এই সিদ্ধান্তেই আসতে হয় যে, পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের পক্ষে ইসলামি রাষ্ট্র দাবি করা সম্ভব ছিল না। শুধু মওদুদী নন, আরও অনেক মওলানা পাকিস্তান আন্দোলনের বিরোধী ছিলেন একথা ইতিপূর্বে বলেছি। এঁদের আকৃষ্ট করার জন্য কেউ কেউ যুক্তি দেখাতেন, পাকিস্তান একবার স্থাপিত হলে একে ইসলামি রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করা যাবে। মওলানা মওদুদী এই যুক্তির উল্লেখ করে তাঁর ‘দি প্রসেস অব ইসলামিক রেভোলিউশন’ গ্রন্থে বলেছেন (এটিও তাঁর উর্দু বইয়ের অনুবাদ), “লেবুগাছ বড়ো হলে তাতে আম ধরতে পারে একথা যতটা সত্য, ঐ যুক্তি তার চেয়ে বেশী সত্যি নয়।[৮] স্বভাবতই তিনি একই গ্রন্থে বলেছেন, “এই তথা-কথিত মুসলিম জাতীয় রাষ্ট্র স্থাপন ত্বরান্বিত করার জন্য মুর্খের মতো আমরা সময় নষ্ট করতে যাব কেন, যখন আমরা জানি যে এ রাষ্ট্র শুধু আমাদের উদ্দেশ্য সাধনে কোনো কাজে আসবে না তা নয়, বরং আমাদের বিঘ্নস্বরূপ হয়ে দাঁড়াবে।” [৯] 

মওলানা মওদুদী এবং আরও অনেক মওলানার পাকিস্তান-বিরোধিতার উল্লেখ করে পাঞ্জাব গোলযোগ তদন্ত কমিশন তাঁদের রিপোর্টে বলেছেন “ধর্মের দোহাই দিয়ে আহমদীদের বিরুদ্ধে দাবিগুলি পূরণের জন্য যে-সব দল আজ গলা ফাটিয়ে চীৎকার করছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যেগুলি তারা সবাই ইসলামি রাষ্ট্রের আইডিয়ার বিরোধী ছিল। এমন কি জামাত-ই ইসলামির নেতা মওলানা আবুল আলা মওদুদীর মত ছিল যে, যদি নতুন মুসলিম রাষ্ট্র কোনো কালে প্রতিষ্ঠিত হয় তা’হলে তার শাসন ব্যবস্থা একমাত্র ধর্মনিরপেক্ষই হতে পারে।”[১০]

পাকিস্তান আন্দোলনের উদ্দেশ্য যে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছিল না তার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ ১৯৪৭ সালের ১১ আগস্ট তারিখে পাকিস্তান গণ-পরিষদে প্রদত্ত জিন্নাহ্ সাহেবের বক্তৃতা। ঐ তারিখ থেকে জীবনের শেষ পর্যায়ে এইটে ছিল তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা, ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চের পর এরূপ রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ সম্ভবত: তিনি আর দেননি। হেক্টর বোলিথো তাঁর লিখিত জিন্নাহ্-জীবনীতে একে বলেছেন তাঁর জীবনের মহত্তম ভাষণ, পাঞ্জাব গোলযোগ তদন্ত কমিশন বলেছেন “এক স্মরণীয় বক্তৃতা” পাকিস্তানের ইতিহাসে এটি একটি রাজনৈতিক ক্লাসিকে পরিণত, অসংখ্য লেখক এবং বক্তা এ বক্তৃতা থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন, তথাপি, এখানে তাঁর চেতনার এলবাম কয়েকটি অবিস্মরণীয় উক্তি পুনরায় উদ্ধৃত করা যেতে পারে:

আপনারা স্বাধীন; আপনারা স্বাধীনভাবে মন্দিরে যেতে পারেন, মসজিদে যেতে পারেন বা পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্গত যে কোনো উপাসনাগারে যেতে পারেন। যে কোনো ধর্ম, গোত্র বা বিশ্বাসের লোক হতে পারেন আপনি- রাষ্ট্রের কাজের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। … … …

কালক্রমে হিন্দু আর হিন্দু থাকবে না এবং মুসলমান আর মুসলমান থাকবে না; অবশ্য ধর্মীয় অর্থে নয়, কেননা ধর্ম হচ্ছে প্রত্যেকের ব্যক্তিগত বিশ্বাস; কথাটা রাজনৈতিক অর্থে, রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে।

এটা কি ইসলামি রাষ্ট্রবাদীর উক্তি, না ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীর? ধর্ম “ব্যক্তিগত বিশ্বাস” হয় কোন্ রাষ্ট্রে?

জিন্নাহ সাহেব প্রকাশ্য গণ-পরিষদে, প্রথম ও উদ্বোধনী অধিবেশনে এ বক্তৃতা দিয়েছিলেন। এ অধিবেশনের পাকিস্তানের বড় বড় নেতা এবং ১৯৪৬ সালে পাকিস্তান দাবির ইস্যুতে নির্বাচিত গণ-পরিষদ-সদস্যগণ উপস্থিত ছিলেন। পাকিস্তান সরকার কর্তৃক প্রকাশিত জিন্নাহ সাহেবের “Speeches As Governor General of Pakistan (1947-1948) নামক গ্রন্থে দেখা যায়, তাঁর বক্তৃতার সময় তাঁরা মুহূমুহূ হর্ষধ্বনি দিয়েছিলেন। তাঁর বক্তৃতা পাকিস্তান আন্দোলনের আদর্শের বিরুদ্ধে হলে ‘শেম শেম’ উচ্চারণ করাই কি তাঁদের পক্ষে স্বাভাবিক ছিল না? কিন্তু তাঁরা তাঁর নীতি-ব্যাখ্যা সম্পূর্ণভাবে সমর্থন করেছিলেন। এটাও একটা প্রমাণ যে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়নি। পাকিস্তান আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল এক বিশেষ সম্প্রদায়ের সুবধিার জন্য রাষ্ট্র সৃষ্টি করা মাত্র এই উদ্দেশ্যটাই স্পষ্ট ছিল, আর কোনো উদ্দেশ্য নয়।

নয়া রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা-লগ্নে এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে ‘জাতির জনকের’ এ ছিল নীতি-নির্দেশক বিবৃতি (Policy statement)। পাঞ্জাব গোলযোগ তদন্ত আদালত তাঁদের রিপোর্টে বলেছেন, “যে উপলক্ষ্যে তিনি এ কথাগুলি বলেছিলেন তা ছিল পাকিস্তানের ইতিহাসের পয়লা উল্লেখযোগ্য ঘটনা। …. এর উদ্দেশ্য ছিল, যে উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য নূতন রাষ্ট্র তার সব শক্তি নিয়োজিত করতে যাচ্ছে তাকে যতদূর সম্ভব স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা। ধর্ম সম্পর্কে বলা হয় যে, রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে এর কোনো যোগাযোগ নেই। ধর্ম প্রত্যেকের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার মাত্র। [১১] 

জিন্নাহ সাহেব নয়া রাষ্ট্রের যে মূলনীতি ব্যাখ্যা করেছেন তা ইসলামি রাষ্ট্রের নয়, অভ্রান্তভাবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের। তা সত্ত্বেও পাকিস্তান আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা একথা সততার সঙ্গে বলা যায় কি করে তা বোঝা কঠিন। জিন্নাহ সাহেবের এই ঐতিহাসিক ভাষণ বিলুপ্ত হবার নয়, তথাপি, কৌতুকের বিষয়, ইসলামি রাষ্ট্রবাদীগণ এমন ভাগ করেন যেন তিনি কখনো এ ধরনের বক্তৃতাই দেন নি।

আরেকটা কৌতুকের ব্যাপার হচ্ছে তাঁরা দ্বিজাতিতত্ত্বের জন্য জিন্নাহ সাহেবের প্রতি ভক্তিতে গদগদ তাঁরা আজ পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারেন নি যে জিন্নাহ সাহেব তাঁর ঐ ১১ আগস্ট ১৯৪৭ তারিখের ঐতিহাসিক ভাষণেই দ্বিজাতিতত্ত্বও বর্জন করেছিলেন। ঐ ভাষণে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বারংবার ‘হিন্দু সম্প্রদায়’ এবং ‘মুসলিম সম্প্রদায়’ কথা দুটি ব্যবহার করেছেন, ‘হিন্দু জাতি’ ‘মুসলমান জাতি’ নয়। ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতার কুফল তিনি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন গ্রেট বৃটেনের এবং বিশেষ করে অখণ্ড ভারতেরই উদাহরণ দিয়ে, সাম্প্রদায়িকতা বর্জনের কথা বলেছেন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এবং হিন্দু-মুসলমান ইত্যাদি সম্প্রদায়-নির্বিশেষে অসাম্প্রদায়িক পাকিস্তানি জাতি গঠনের কথা বলেছেন। ভারত-পাকিস্তানের মুসলমানদের নিয়ে এক জাতি এবং হিন্দুদের নিয়ে আরেকটি জাতি, পাকিস্তান আন্দোলনকালের এই দ্বিজাতিতত্ত্বের উল্লেখ তিনি এই বক্তৃতায় এবং তাঁর অবশিষ্ট জীবনের আর কোনো বক্তৃতায় করেন নি; ‘পাকিস্তানি মুসলমান’ এবং ‘পাকিস্তানি জাতি’ সমার্থক এমন কথাও বলেন নি, পাকিস্তানের হিন্দু-মুসলমান বাঙালি পাঞ্জাবি ইত্যাদি সবাই মিলে এক জাতি এই কথাই তিনি বলেছেন। লাহোর প্রস্তাবে গ্রহণের সময় থেকে ঐ বক্তৃতার পূর্ব পর্যন্ত যে দ্বিজাতিতত্ত্বের কথা তিনি বলতেন তা পাকিস্তান অর্জনের যুক্তি হিসাবেই বলতেন, একটা রাজনৈতিক কৌশল হিসাবেই এ যুক্তি প্রয়োগ করতেন, অলঙ্ঘনীয় সত্য হিসাবে নয়। পাকিস্তান অর্জিত হওয়ার ফলে ঐ যুক্তির আর প্রয়োজন ছিল না বলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মুহূর্তে প্রথম সুযোগে এবং নয়া রাষ্ট্রের প্রথম নীতি নির্দেশক ভাষণেই তিনি সে-তত্ত্ব বর্জন করেন। তাঁর ১১ আগস্ট ‘৪৭ তারিখের ভাষণটি মনোযোগ দিয়ে পড়লে এ ছাড়া অন্য সিদ্ধান্ত অসম্ভব। জিন্নাহ সাহেব ঐ তারিখের দ্বিজাতিতত্ত্ব বর্জন করেছেন এ সম্বন্ধে ইতিপূর্বে এদেশের আরও লেখক আলোচনা করেছেন, এটা জিন্নাহ সাহেবের অন্যতম সহকর্মী জনাব সোহরাওয়ার্দীরও অভিমত এবং এমনকি চৌধুরী খালিকুজ্জামানের মতো প্রতিক্রিয়াশীল নেতাও তাঁর “পাথওয়ে টু পাকিস্তান” গ্রন্থে এ কথা বলেছেন।[১২] ১১ আগস্ট ‘৪৭ তারিখের পর দ্বিজাতিতত্ত্ব আর কোনো জীবন্ত তত্ত্ব ছিল না, ছিল একটা বর্জিত রাজনৈতিক কৌশল মাত্র, ইতিহাসের একটা স্মৃতি মাত্র। তবু জিন্নাহ সাহেবের প্রতি অবিচল ভক্তির দাবিদার ব্যক্তিগণ অপরূপ সারল্য নিয়ে বরাবরই দ্বিজাতিতত্ত্বের কথা বলেছেন। [১২](ক) 

উল্লিখিত বক্তৃতায় জিন্নাহ্ সাহেব পাকিস্তানে হিন্দু-মুসলমান ইত্যাদি বিভিন্ন ধর্মীয় ও ভাষাভাষী সম্প্রদায়ের সমন্বয়ে যে পাকিস্তানি জাতি গঠনের কথা বলেছেন তার একমাত্র তাৎপর্য ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠন। একথা ঠিক যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে জিন্নাহ্ সাহেব কয়েকটি ভাষণে ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ কথাটা ব্যবহার করেছেন এবং এর কয়েকটি মূলনীতিরও উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে খানিকটা অসামঞ্জস্য এবং বিরোধিতা লক্ষণীয়। ইসলামি রাষ্ট্রবাদীগণ স্বভাবতই বলবেন ওই যে স্বয়ং জিন্নাহ সাহেব ইসলামি রাষ্ট্রের কথা বলেছেন। তাহলে ইসলামি আদর্শবাদই পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভিত্তি একথা বলা অনৈতিহাসিক হবে কেন? একথার জবাব হচ্ছে, ১৯৪৭ সালের ১১ আগস্ট তারিখ ভাষণে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের কথাও তো বলেছেন এবং অভ্রান্ত ভাষায় বলেছেন তার এই ভাষণকে কি গায়েব করা সম্ভব? মনে রাখা দরকার, পাকিস্তান আন্দোলনের সাফল্যের পর নয়া রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে পাকিস্তান গণপরিষদের এক ঐতিহাসিক অধিবেশনে এটি ছিল নীতিনির্দেশক ভাষণ, পক্ষান্তরে ইসলামি ‘রাষ্ট্র’ শব্দটি তিনি ব্যবহার করেছিলেন বিভিন্ন সমাবেশ এবং উপলক্ষ্যে প্রদত্ত মামুলি বক্তৃতায় ও বাণীতে। নীতিনির্দেশক ভাষণ এবং মামুলি বক্তৃতা ও বাণী কখনোই সমান গুরুত্বপূর্ণ নয়। 

তথাপি, একথা অনস্বীকার্য, তাঁর ১১ আগস্ট তারিখের ভাষণের সঙ্গে ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ কথাটা অসমঞ্জস্য। এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক বছরের মধ্যে স্বয়ং জিন্নাহ সাহেবের মুখ থেকে যেহেতু একথা বেরিয়েছে এই কারণে কথাটার কিছু গুরুত্ব আছে। ঐ ভাষণের কয়েক মাসের মধ্যে তিনি কথাটা ব্যবহার করলেন কেন তা বোঝা দরকার; কেননা ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ দাবির সঙ্গে এর সম্পর্ক আছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর কয়েকটি কারণে ইসলামি রাষ্ট্রের দাবি প্রবল হয়ে ওঠে। জিন্নাহ সাহেব ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ কথাটা উচ্চারণ করে সেই দাবিকে কিছু কনসেশন দিচ্ছিলেন মাত্র। পূর্ব ও পশ্চিম পাঞ্জাবে ভয়াবহ দাঙ্গার ফলে সাম্প্রদায়িকতা তীব্রতম পর্যায়ে উঠেছিল, অর্ধকোটি ছিন্নমূল নরনারী এসেছিল পশ্চিম-পাকিস্তানে। ‘মোহাজের’ নাম দিয়ে এদের সম্মানিত করা হয়েছিল। মোহাজের কথাটার সঙ্গে ইসলামের আদিযুগের স্মৃতি বিজড়িত। সে-যুগ মোহাজের সম্প্রদায় শুধু আশ্রয় পায়নি, সম্মান পেয়েছিল, নেতৃত্বও অর্পিত ছিল প্রধানত: সেই সম্প্রদায়ের হাতেই। অতএব পাকিস্তানে মোহাজের মনোভাব ছিল। মোহাজের সম্প্রদায় ছিল আদি ইসলামি রাষ্ট্রের অন্যতম স্তম্ভস্বরূপ। অতএব ইসলামি রাষ্ট্র স্থাপিত হলেই কোনো না কোনো উপায়ে মোহাজেরদের সব দুঃখ কষ্টের অবসান হবে। অধিকাংশ মোহাজেরের তা হয়নি, কিন্তু মোহাজের অনেক সুবিধে পেয়েছেন বই কি! তারা অনেক কিছু গুছিয়ে নিয়েছেন। 

এ ছাড়া ভারত থেকে আগত অনেক উদ্বাস্তু নেতা এবং পাকিস্তান অঞ্চলেও জনসংযোগহীন বহু নেতা নয়া রাষ্ট্রের নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তি অক্ষুণ্ণ রাখার আশা করেছিলেন ইসলামের ধুয়া তুলে। কিন্তু পাকিস্তান অর্জনের জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা এবং প্রকৃতই যখন পাকিস্তান অর্জিত হলো তখন তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আশা-আকাঙক্ষা পূরণ করা স্বতন্ত্র কথা। লীগ নেতৃবৃন্দ কতটা তা করেছেন ইতিহাসই সে কথা বারংবার বলছে। সদ্যস্বাধীনতাপ্রাপ্ত, স্বাধীনতার অভিজ্ঞতাবঞ্চিত জনগণের মনে একটা গৌরবময় মহৎ রাষ্ট্রধারণা জাগ্রত করা তাদের জন্য দরকার ছিল আদি ইসলামি রাষ্ট্রের স্মৃতির জাগ্রত করা ছাড়া এ অবস্থায় আর কি করা যেতে পারে। 

মওলানা সাহেবদের সমস্যা ছিল আধুনিক রাষ্ট্রধারণার সঙ্গে তাঁদের পরিচয়ের ও সমঝোতার অভাব এবং এরূপ রাষ্ট্রের প্রতি তাঁদের সহানুভূতির অভাব। তাঁদের অনেকে এমনকি পাকিস্তান সৃষ্টিরই বিরোধী ছিলেন। তাঁদের একমাত্র সম্বল ছিল পুঁথি পুস্তকের পৃষ্ঠায় বর্ণিত আদি ইসলামি রাষ্ট্রের ধারণা। অথচ নয়া রাষ্ট্রের প্রতি তাঁদেরও শুভেচ্ছা ও সমর্থনের দরকার ছিল। এ রাষ্ট্র তো মুসলমানদের জন্যই। এই কারণেও পাকিস্তানকে বলা হলো ইসলামি রাষ্ট্র। 

ইসলামি রাষ্ট্রের ধূয়ার আরেকটি কারণ, কিছু লোকের এই ধারণা ছিল যে, ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে একত্র রাখার একমাত্র কার্যকরী বন্ধন ইসলামি আদর্শবাদ। 

এইসব ধারণা যদি প্রবল না হতো, যদি পাঞ্জাবে দাঙ্গা না হতো, লাখ পঞ্চাশেক লোক পশ্চিম-পাঞ্জাবে না আসতো, কাশ্মীর নিয়ে সংঘর্ষ না হতো এবং ভারতের সঙ্গে সম্প্রীতির সম্পর্ক গড়ে ওঠার সুযোগ পাওয়া যেতো তাহলে ইসলামি রাষ্ট্রর দাবিহয়তো অতটা প্রবল হয়ে ওঠার অবকাশ পেত না। তবে সেটা সম্ভব ছিল না। অনুন্নত দেশ হিসাবে এবং কয়েকটি ইসলামি মহলের চাপে পাকিস্তানকে খুব শীগগিরই ইসলামি রাষ্ট্র হতে হতো। 

নয়া রাষ্ট্রের বিশেষ পরিস্থিতিতে ইসলামি রাষ্ট্রের যে দাবী উঠেছিল জিন্নাহ সাহেব তার প্রতি বধির হয়ে থাকেন নি, তাকে কিছু কনসেশন দিয়েছিলেন। তিনি স্বাধীনতার আসলে ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ কথাটা কয়েকবার ব্যবহার করেছেন এবং পাকিস্তানের আদর্শ হিসাবে ইসলামের কয়েকটি মৌলিক নীতির কথা উল্লেখ করেছেন, যেমন গণতন্ত্র, ব্যক্তি-স্বাধীনতা, ব্যক্তি-সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, ১৩ সামাজিক সুবিচার এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি উদার ব্যবহার। এ প্রসঙ্গে প্রথম কথা, জিন্নাহ সাহেব যখন এসব মহৎ নীতির কথা বলছিলেন তখন তিনি আসলে ফরাসি বিপ্লব এবং আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কয়েকটি মূল নীতির কথা বলছিলেন। তিনি ‘ইসলামি রাষ্ট’ কথাটা ব্যবহার করেছেন সত্য কিন্তু ঐসব মূলনীতির পরিপ্রেক্ষিতে যে রাষ্ট্রের চিত্র তিনি এঁকেছেন তার প্রকৃত অভিধা মওলানাদের পরিকল্পিত ইসলামি রাষ্ট্র নয়, ‘উত্তম আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ১৪ পক্ষান্তরে মওলানা সাহেবেরা যে ইসলামি রাষ্ট্রের কথা বলেছেন তা’ হচ্ছে থিওক্রেসী ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্র (কেউ কেউ বলেছেন থিও-ডেমোক্রসি)’ এরাষ্ট্রে গণতন্ত্র এবং পার্লামেন্টারি শাসনব্যবস্থার স্থান নেই (মওলানাদের রাষ্ট্র-পরিকল্পনা সম্বন্ধে পরে আমরা কিছু বিস্তারিত আলোচনা করব), কিন্তু জিন্নাহ সাহেব একাধিকবার পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, পাকিস্তান ‘থিওক্রেসী’ হবে না, হবে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। মওলানা সাহেবেরা যে ইসলামি রাষ্ট্রের কথা বলেছেন তাতে ব্যক্তি-স্বাধীনতা, ব্যক্তিসাম্য, ভ্রাতৃত্ব এবং সামাজিক সুবিচার অমুসলিম সম্প্রদায়সমূহের প্রতি প্রযোজ্য নয়, কেবল মুসলিম সমাজের সীমারেখার মধ্যেই প্রযোজ্য, তাও সীমাবদ্ধ পরিমাণে, কেননা এরূপ রাষ্ট্র হবে কঠোরভাবে রেজিমেন্টেড। পাকিস্তান আমলে আহমদী-বিরোধী আন্দোলন এবং দাঙ্গাই প্রমাণ যে সত্যিকারের ‘ইসলামি রাষ্ট্রে’ ঐসব মূলনীতি ক্ষমতাসীন মজহাব ব্যতীত অন্যান্য মজহাবের জন্য অবান্তর এবং অমুসলিম সম্প্রদায়গুলি তো বিবেচনার মধ্যেই আসে না। 

অতএব জিন্নাহ সাহেব ব্যবহৃত ‘ইসলামি রাষ্ট্র কথাটাকে খুব বেশি মূল্য দেওয়া এবং আক্ষরিক অর্থে নেওয়া সঙ্গত হবে না। সেভাবে নিতে গেলে তাঁর আরও এমন কিছু উক্তি আছে যা আক্ষরিক অর্থে নেওয়ার প্রশ্ন ওঠা অনিবার্য। যেমন অমুসলিমদের প্রতি উদার ব্যবহার প্রসঙ্গে তিনি সম্রাট আকবরের কথা উল্লেখ করেছেন।[১৫] সম্রাট আকবর অমুসলিমদের প্রতি শুধু উদার ব্যবহার করেন নি, এই উদার ব্যবহারকে একটা স্থায়ী ভিত্তি দেওয়ার জন্য তিনি হিন্দু-মুসলিম সমন্বয়েরও প্রয়াস পেয়েছেন এবং এমনকি একটি নূতন ধর্ম অথবা ধর্মীয় মতবাদও প্রচার করেছিলেন। তাহলে কি মনে করতে হবে জিন্নাহ সাহেব কোনো নূতন ধর্মেরও প্রবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছেন? তিনি সমাজতন্ত্রের কথা বলেছেন এবং স্বাধীনতার পূর্বে রাষ্ট্রের কোনো কোনো সংস্থা জাতীয়করণের কথাও বলেছেন।[১৬] তা হলে তাঁকে সমাজতন্ত্রী বলা যাবে কি? অধিকন্তু মওলানাদের সমালোচনা করে তিনি আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-সমাবেশে এক ভাষণে বলেছিলেন: ‘মুসলিম সমাজের প্রতিক্রিয়াশীল অংশ থেকে লীগ আপনাদের মুক্ত করেছে। … লীগ অবশ্যই অবাঞ্ছনীয় মৌলবী ও মওলানাদের (প্রভাব) থেকে আপনাদের মুক্ত করেছে। “[১৭]

জিন্নাহ্ সাহেবের ব্যক্তিগত জীবন এবং উক্তি নিভৃতে ইসলামি রাষ্ট্র নিষ্কাশন একটু কঠিন কাজ।

বস্তুত জিন্নাহ্ সাহেব যখন ইসলামি রাষ্ট্রের কথা বলছিলেন তখনও তার বক্তব্যের নির্গলিতার্থ ছিল ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, ইসলামি রাষ্ট্র নয়। এ-আলোচনায় আমরা সর্বতোভাবে জিন্নাহ্ সাহেবের বক্তব্যের প্রতি মনোনিবেশ করেছি এই কারণে যে, তিনিই ছিলেন নয়া রাষ্ট্রের স্রষ্টা এবং প্রকৃত প্রতিনিধি, এবং তার উক্তিই সবচাইতে প্রামাণ্য। তাঁর মৃত্যুর পরে সর্বাপেক্ষা সম্মানিত নেতা ছিলেন লিয়াকত আলী, তিনিও ইসলামি রাষ্ট্রের কথা বলেছেন, জিন্নাহর তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে জনসভায়, গণপরিষদে এবং আমেরিকা গমনকালে, এবং তাঁরই আমলে ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে গণপরিষদে ‘আদর্শ প্রস্তাব’ (Objective Resolution) গ্রহণ করা হয়। এসবই ইসলামি রাষ্ট্রবাদীদের ক্রমাগত চাপ ও প্রভাববৃদ্ধির লক্ষণ। তথাপি একটি প্রশ্ন থেকে যায়। আদর্শ-প্রস্তাব গ্রহণের পর পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল কি? এ সম্বন্ধে পাঞ্জাব তদন্ত আদালত তাঁদের রিপোর্টে মওলানাদের মতামতের সারমর্ম দিতে গিয়ে বলেছেন: “একটি আধুনিক জাতীয় রাষ্ট্র সম্পর্কে কায়েদে আজমের মতবাদ নাকি ১৯৪৯ সালের ১২ মার্চ তারিখে আদর্শ প্রস্তাব পাস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অকেজো হয়ে যায়। কিন্তু খোলাখুলিভাবেই স্বীকার করা হয়েছে যে এই প্রস্তাব যদিও মোটা মোটা শব্দ ও ধারায় ভর্তি, তবুও একটা চালাকি ছাড়া আর কিছু নয়। ইসলামি রাষ্ট্রের কোন নাম-নিশানা তো এর ভেতর নেই-ই, বরং মৌলিক অধিকার ইত্যাদি সম্পর্কে যে-সব ধারা আছে সেগুলি ইসলামি রাষ্ট্রের মূলে কুঠারাঘাত হেনেছে।[১৮] 

অতএব মওলানাদের মতে জিন্নাহ্ সাহেবের ১১ আগস্ট তারিখের বক্তৃতায় বর্ণিত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র সম্পর্কিত মতবাদ বাতিল হয়ে গেছে বটে কিন্তু আদর্শ-প্রস্তাব গ্রহণের ফলে ইসলামি রাষ্ট্রও স্থাপিত হয়নি, পাকিস্তান ধর্মনিরপেক্ষই থেকে গেছে। এ সম্বন্ধে পাকিস্তান সৃষ্টির প্রায় সাত বছর পর উক্ত আদালত তাঁদের রিপোর্টে বলেন: “সাধারণ মানুষ মনে করছে পাকিস্তান একটি ইসলামি রাষ্ট্র- যদিও তা সেরকম কিছুই নয়। এই বিশ্বাসকে ফেনিয়ে তুলেছে প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে ইসলাম ও ইসলামি রাষ্ট্রের জন্য চতুর্দিকের গলাফাটানো চিৎকার”।[১৯] 

পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত হয় বলা যেতে পারে ১৯৫৬ সালের মার্চ মাসে নয়া সংবিধান কার্যকর হওয়ার দিন থেকে। ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই ছিল পাকিস্তান আন্দোলনের উদ্দেশ্য অর্থাৎ “আমরা ইসলামি রাষ্ট্র স্থাপন করব এজন্য পাকিস্তান চাই”- একথা ঠিক নয় আমরা দেখেছি। তবে ‘আমরা পাকিস্তান পেয়েছি এবং পাকিস্তানে আমরা ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই” এরূপ আন্দোলন প্রথম থেকেই আছে একথা ঠিক। ১৯৫৬ সালের সংবিধানে নেই দাবি পূরণ করা হয়। কিন্তু সত্যিই তা হয়েছিল একথা কি নিঃসন্দিগ্ধভাবে বলা যায়? জমিয়তে ওলেমায়ে পাকিস্তানের সাধারণ সম্পাদক মওলানা মুফতী মাহমুদ একবার বলেছিলেন, ১৯৫৬ সালের সংবিধান অনৈসলামিক, কেননা এতে দেশের সার্বভৌমত্বের মালিক আল্লাহর পরিবর্তে জনসাধারণকে বলা হয়েছে।[২০] যে-রাষ্ট্র তার সংবিধানে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ইসলামি প্রজাতন্ত্র’ ঘোষিত হওয়া সত্ত্বেও ইসলামি রাষ্ট্র হয় না তা আর কোন উপায়ে ইসলামি রাষ্ট্র হতে পারে? মওলানাদের একটি দলের এই অভিমতই প্রমাণ ১৯৫৬ সালের সংবিধান কার্যকর হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান নিঃসন্দিগ্ধভাবে ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত হয়নি। তথাপি ধরা যাক ঐ সংবিধান পাকিস্তানকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র বানিয়েছিল, কেননা কারো কারো সেইরূপই অভিমত। কিন্তু তার পরেও পাকিস্তানের ইতিহাস ইসলামি রাষ্ট্রের অবিচ্ছিন্ন ইতিহাস নয়। পাকিস্তান ইসলামি রাষ্ট্র হওয়া উচিত কিনা এই মতবিরোধ অব্যাহত থাকে; পরবর্তীকালে সংঘটিত কয়েকটি বড় বড় ঘটনায় তার প্রমাণ রয়ে গেছে। পাকিস্তান ‘ইসলামি প্রজাতন্ত্র’ ঘোষিত হওয়ার আড়াই বছর পরেই সামরিক শাসন জারি হয় এবং তখন শুধু সংবিধানই বাতিল করা হয়নি, রাষ্ট্রের ‘ইসলামি’ বিশেষণটাও বাতিল করা হয়। এটি একটি স্বৈরাচারী সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষের কীর্তি বললে সব কথা বলা হবে না, কেননা একথা ঠিক যে উক্ত সামরিক শাসন-কর্তৃপক্ষকে জনসাধারণ প্রথম অবস্থায় বিপুলভাবে সংবর্ধিত করেছিল, রাষ্ট্রের ‘ইসলামি’ বিশেষণটা বাদ দেওয়ার জন্য ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেনি। সামরিক শাসন জারির প্রায় সাড়ে তিন বছর পরে ১৯৬২ সালের ১ মার্চ তারিখে আইয়ুব-সংবিধান জারি করা হয়, কিন্তু এতে পাকিস্তানের ‘ইসলামি’ বিশেষণটা ছিল না। ৩৩ দিনে আইয়ুব সরকার জনপ্রিয়তা হারিয়েছিল, কিন্তু সরকার যতই জবরদস্ত হোক কোনো না কোনো মহলের সমর্থন তার চাই, অতএব কয়েকমাস পরে ‘ইসলামি’ বিশেষণটা পুনরায় সংযুক্ত করা হয়। কিন্তু আইয়ুব সংবিধান একজন ব্যক্তির কীর্তিমাত্র, অতএব এতে ‘ইসলামি’ বিশেষণটা সংযুক্ত করলেও সে-সংবিধান যে ইসলামি সংবিধান এবং পাকিস্তান সত্যিকারের ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে গিয়েছিল এ-সম্বন্ধে মওলানাদের মধ্যেই মতভেদ বর্তমান। (আইয়ুব আমলে ইসলামের কিরূপ অপব্যবহার হয়েছিল তার কিছু বিবরণ আমরা পরে দেব)। ১৯৬৯ সালের মার্চ মাসে দ্বিতীয় বার সামরিক শাসন জারির ফলে সে-সংবিধানও বাতিল হয়ে যায়। অতএব স্বাধীনতার দিন থেকে ঐ তারিখ পর্যন্ত পাকিস্তান অবিচ্ছিন্নভাবে ইসলামি রাষ্ট্র ছিল এ-কথা ভেবে কেউ কেউ রোমান্টিক আনন্দ পেতে পারেন; বাস্তবে কিন্তু তা ছিল না।

পাকিস্তানের জনসংখ্যার কি পরিমাণ অংশ ইসলামি রাষ্ট্র কামনা করতো? এ প্রশ্নের সঠিক জবাব দেওয়া সম্ভব নয়; তবে প্রভাবশালী অংশ কামনা করতো, পাকিস্তানের ‘ইসলামি’ বিশেষণটাই তার প্রমাণ, কিন্তু তাতে এটা প্রমাণ” হয় না যে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট যারা কামনা করেছেন তাঁরা। তাঁরা যে নগণ্য নন, ইসলামি রাষ্ট্র সম্পর্কিত বিতর্কই তার প্রমাণ’। 

পাকিস্তান আন্দোলনের উদ্দেশ্যই ছিলো ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, ঐতিহাসিকভাবে এ- কথা ঠিক নয় আমরা দেখেছি। তথাপি স্বীকার্য, যে উদ্দেশ্যেই হোক, ভুল করে হলেও গণতন্ত্রের নীতি অনুযায়ী পাকিস্তানের যে কোনো নাগরিক ইসলামি রাষ্ট্রের দাবি করতে পারেন। সে-অধিকারেই পাকিস্তানি নাগরিকদের একাংশ ইসলামি রাষ্ট্র দাবি করেছেন। নানা কারণে শাসকবর্গ এদের দাবি উপেক্ষা করেন নি, বরং সহর্ষে এ-রাষ্ট্রের নামের সঙ্গে ইসলামি বিশেষণটি সংযুক্ত করেছেন এবং ইসলামি রাষ্ট্রের কতিপয় মূলনীতি সংবিধানের অঙ্গীভূত করেছেন। কিন্তু এ-ও আমরা দেখেছি এ-বাদি সকল পাকিস্তানির নয়, আর এর স্বীকৃতিও কোনো অবিচ্ছিন্ন নিঃসন্দিগ্ধ ব্যাপার নয়। তথাপি ইসলামি রাষ্ট্রের দাবির পেছনে যে অন্তত কিছু লোকের প্রবল আবেগ, করুণ প্রার্থনা এবং সকাতর আকাঙক্ষা বর্তমান তা স্বীকার করে নেওয়া যাক। তাঁদের জন্যে এ একথা রোমান্টিক দাবি। কিন্তু আরো কিছু লোকের জন্যে এ হচ্ছে বিশুদ্ধ রাজনৈতিক দাবি। এ-দাবির স্বরূপ তাই আমাদের জানা দরকার। জিন্নাহ্ সাহেব তার ১১ আগস্ট তারিখের ভাষণে যে-একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের কথা বলেছিলেন, পাঞ্জাব গোলযোগ তদন্ত আদালত সে- সম্বন্ধে আলেমদের মতামত জিজ্ঞাসা করলে, সব আলেমই সাফ জবাব দেন যে, রাষ্ট্র সম্বন্ধে এই মতবাদ তাদের গ্রহণীয় নয়। জামাতে ইসলামের পক্ষ থেকে এমন কথাও বলা হয় যে এই মতবাদের উপর ভিত্তি করে গঠিত রাষ্ট্র হবে শয়তানের সৃষ্টি।[২১] 

অতএব স্বভাবই ধরা যেতে পারে ইসলামি রাষ্ট্র হওয়ার কথা ফেরেশতাদের সৃষ্টি। এখন দেখা যাক মওলানাগণ “ফেরেস্তাদের সৃষ্টি” এই ইসলামি রাষ্ট্র বলতে কী বুঝতেন ও বোঝাতেন; এবং যার জন্য এত উচ্চকণ্ঠ দাবি সেই ইসলামি রাষ্ট্রের স্বরূপ কী। 

পাকিস্তানের বিভিন্ন ইসলামি রাষ্ট্রবাদী দল ও মওলানার লক্ষ্য ও কর্মসূচি সম্বন্ধে সবচেয়ে প্রামাণ্য আকর-গ্রন্থ ‘পাঞ্জাব গোলযোগ তদন্ত রিপোর্ট’। সঠিক অর্থে এটি গ্রন্থ নয়, রিপোর্ট। ব্যক্তিগত ও সমাজজীবন থেকে ইসলামকে রাজনীতিতে ও রাষ্ট্রব্যবস্থাপনায় টেনে আনলে তার ফলাফল কি হতে পারে, এমনকি কতটা বিপর্যয়ের সৃষ্টি হতে পারে তা এই রিপোর্ট পড়লে বোঝা যায়। এটি সবচেয়ে প্রামাণ্য এই কারণে যে, সরকার নিয়োজিত একটি তদন্ত আদালত কর্তৃক এ রিপোর্ট প্রণীত। এর প্রধান ভিত্তি উক্ত আদালতে গৃহীত মওলানাদের সাক্ষ্য-জবানবন্দী এবং তাঁদের দাখিলীকৃত দলিল। এটি একটি ক্লাসিক রিপোর্টে পরিণত; এবং একটি রাজনৈতিক দলিল, বটে; পাকিস্তানি রাজনীতি এবং বিশেষ করে ইসলামি রাষ্ট্র সম্পর্কে উৎসুক দেশীবিদেশী পাঠক এবং লেখকগণ এ রিপোর্ট ব্যাপকভাবে পাঠ করে থাকেন।

ইতিপূর্বে বলেছি, ইসলামি রাষ্ট্রবাদীদের সম্পর্কে প্রথমেই যে-মন্তব্য করতে হয় তা হচ্ছে, তারা নানা দলে বিভক্ত এবং ইসলামি রাষ্ট্রের নানা ব্যাপারেই তাদের মধ্যে মতবিভেদ বর্তমান। নিজেদের নায়েবে-নবী এবং সনাতন ইসলামি আদর্শের অভিভাবক বলে দাবি করা সত্ত্বেও রাজনৈতিক অরাজনৈতিক সব রকম মওলানাই বহু দলে- উপদলে বিভক্ত। পাঞ্জাব গোলযোগ তদন্ত আদালত তাঁদের রিপোর্টে রাজনৈতিক মওলানাদের অন্তত ১৪টি প্রতিষ্ঠানের তালিকা দিয়েছেন। এর পরেও মওলানাদের আরও অনেক রাজনৈতিক উপদল গঠিত হয়েছিল। এ ছাড়াও ছিল আধুনিক শিক্ষিতদের দ্বারা পরিচালিত মুসলিম লীগ এবং অন্যান্য সাম্প্রদায়িক দল। মুসলিম লীগ আবার একটি নয়, তিনটি। সাম্প্রদায়িক লেবেল-আটা সব কয়টি দলই, এমনকি অসাম্প্রদায়িক ছাপমারা পাকিস্তান ডেমোক্রাটিক পার্টি এবং পাকিস্তান পিপলস্ পার্টিও ইসলামি রাষ্ট্রের কথা বলতো। রাজনৈতিক ব্যাপারে এরা প্রত্যেকে অপরের থেকে স্বতন্ত্র অভিমত পোষণ করতো এবং একে অন্যের নিকুচি করতো। ইসলাম তো একটাই- কিন্তু ইসলামের সেবকরা ছিল বহুরূপী। 

পাঞ্জাব গোলযোগ তদন্ত আদালত বিভিন্ন দলীয় আলেমদের জেরা করে ইসলামি রাষ্ট্রের বিভিন্ন দিক সম্বন্ধে তাঁদের অভিমত লিপিবদ্ধ করেন। তাঁদের মতামতের পূর্ব পরিচয় লাভের জন্য উক্ত রিপোর্ট পড়া দরকার; আমরা এখানে তাঁদের মাত্র কয়েকটি মতামতের উপর আলোকপাত করব। তাহলেই বোঝা যাবে এ-কালের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের রাষ্ট্রধারণা কিরূপ উদ্ভট। তাঁদের মতে, ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ এবং ত্রুটিহীন ধর্ম। এ শুধু মানুষের আধ্যাত্মিক জীবন সম্বন্ধেই বিধান দেয়নি, ঐচ্ছিক ও বাস্তব জীবন সম্বন্ধেও বিধান দিয়েছে। মানবজীবনে এবং মানবসমাজে এমন কোনো কিছু থাকতে পারে না যার জন্য বিধান, ইসলামে পাওয়া যাবে না। বস্তুত “ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা, মানুষের কার্যাবলীর যে-কোনো ক্ষেত্রে যে-কোনো প্রশ্নের জবাব এর মধ্যে রয়েছে নতুন করে আইন তৈরি করে ভরাট করার মতো কোনোখানেই ফাঁক নেই”। অতএব নতুন কোনো আইন করা হবে কুফরের তুল্য।’ কোনো কোনো মওলানা শুধু এটুকু কনসেশন দিয়েছেন যে, ‘কোরআন, সুন্না বা পূর্ববর্তী ইজমায় যে-সব বিষয় সম্পর্কে বিধি নেই, সে-সব বিষয়ে ইসলামি রাষ্ট্রে আইন তৈরি করা যেতে পারে। 

এই আইন তৈরিও প্রকৃত আইন তৈরি নয়- কেননা মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় যা কিছু আইন সবই কোরআন ও হাদিসেই আছে। বিজ্ঞ আলেমরা প্রয়োজনানুযায়ী সে- সব আইন বের করে দেবেন মাত্র। অতএব ইসলামি রাষ্ট্রে-আইন তৈরির অর্থ হচ্ছে যে- কোনো বাস্তব প্রয়োজনে বিজ্ঞ আলেমগণ কর্তৃক কোরআন ও হাদিসের বিধানের ব্যাখ্যা মাত্র। কয়েকজন আলেম সম্মিলিতভাবে ইসলামি বিধানের ব্যাখ্যা দিলে, তাদের এই বিধান ব্যাখ্যাকে ইসলামি পরিভাষায় বলা হয় ইজমা। রাষ্ট্রপ্রধান ইজমার উদ্দেশ্যে বিজ্ঞ আলেমদেরকে তাঁর উপদেষ্টা নিয়োগ করবেন। ইজমা একমাত্র বিজ্ঞ আলেমদের দ্বারাই সম্ভব, অতএব ইসলামি রাষ্ট্রে আইন-পরিষদ ও গণতন্ত্র অবান্তর এবং অপ্রয়োজনীয়। শুধু তাই নয়, ‘পাকিস্তানে যদি ইসলামি আদর্শ অনুযায়ী সরকার গড়তে হয় তবে সে-সরকার গণতান্ত্রিক হতে পারবে না।’’[২১](ক) তদন্ত আদালত লিখেছেন: ইসলামি রাষ্ট্রের আইন-পরিষদ যদি ইজমার মতো কোনো কিছু হয়, তবে জনসাধারণ এতে অংশ গ্রহণ করারই উপযুক্ত নয়; কেননা ইসলামি আইনে একমাত্র বিজ্ঞ আলেম এবং মুজতাহিদের মধ্যেই ইজমা সীমাবদ্ধ।’ শুধু অমুসলিম জনগণের প্রতিনিধি নয়, মুসলিম জনসাধারণের প্রতিনিধিদেরও এই ‘আইন পরিষদে’ কোন স্থান নেই। ইসলামি রাষ্ট্রে বস্তুত আইন পরিষদেরই কোনো স্থান নেই। ইসলামি রাষ্ট্রে সংবিধান এবং সাধারণ আইনের মধ্যে কোনো পৃথক অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় না। তথাপি যদি কোনো সংবিধান থাকে তবে তাতে এই বিধানও অবশ্যই থাকতে হবে যে এর কোনো ধারা কোরআন বা সুন্নার বিরোধী হলে নাকচ হয়ে যাবে। ফলে, সংবিধানের কোনো ধারা অনুযায়ী যদি দেশে আইন-পরিষদ গঠন করা হয়, তাহলে সুপ্রীম কোর্টে এই বলে সে-ধারার ‘বৈধতা চ্যালেঞ্জ’ করা যাবে যে, ‘আইন-পরিষদ গঠন করাই কোরআন ও সুন্নার বিরোধী’।[২২] অতএব উক্ত আইন পরিষদ বাতিল হয়ে যাবে এবং দেশে কোনো আইন-পরিষদই থাকবে না। থাকবেন শুধু রাষ্ট্রপ্রধানের উপদেষ্টা বিজ্ঞ আলেমগণ। 

অমুসলিমদের মর্যাদা সম্বন্ধে আলেমগণ যে-অভিমত প্রকাশ করেছেন তা হচ্ছে, সংক্ষেপে (তদন্ত আদালতের ভাষায়): “ইসলামি রাষ্ট্রে অমুসলিমদের মর্যাদা হবে জিম্মীদের মতো। তারা রাষ্ট্রের সত্যিকার নাগরিক হবে না, কেননা তারা মুসলমানদের মতো সমান অধিকার ভোগী হবে না। আইন তৈরির ব্যাপারে বা আইন কার্যকর করার বেলায় তাদের কোনো অধিকার থাকবে না। সরকারি চাকুরি করাও তাদের পক্ষে হবে নিষিদ্ধ।[২৩] আরও কিছু পরে তদন্ত আদালত জানাচ্ছেন, আলেমদের মতে, “ইসলামি রাষ্ট্র হচ্ছে দারুল ইসলাম অর্থাৎ যেখানে ইসলামি আইন-কানুনের শাসন চলে এবং যার শাসনকর্তা হচ্ছে মুসলিম। এর অধিবাসীগণ হচ্ছে মুসলমান অমুসলমানও হতে পারে যদি তারা মুসলিম শাসনের কাছে নতি স্বীকার করে থাকে। ইসলামি রাষ্ট্র জান-মাল রক্ষা করবে, তবে তারা পূর্ণ নাগরিকত্বের অধিকার পাবে না। তাদের অবশ্য কেতাবে বিশ্বাসী হতে হবে- মূর্তিপূজক হতে পারবে না”।[২৪] এর অর্থ এই যে পাকিস্তানে শুধু সেইসব অমুসলিম থাকতে পারবে যারা মূর্তিপূজা করে না, যেমন ইহুদী, খৃষ্টান, পার্সি। অন্য যারা মূর্তিপূজা করে তাদের পাকিস্তান ছেড়ে চলে যেতে হবে। 

পাকিস্তানে অমুসলমানদের প্রতি এই অবিচারের পৃথিবীময় কি প্রতিক্রিয়া হবে, এবং বিশেষ করে ভারতীয় মুসলমানদের অবস্থাটা কি রকম দাঁড়াবে তা বোঝা কঠিন নয়, কিন্তু আলেমরা সে-সমস্যারও সমাধান দিয়েছেন। তদন্ত আদালতের সামনে জমিয়তুল উলামায়ে পাকিস্তানের সভাপতি এবং জামাতে ইসলামি প্রধান উভয়েই বলেছেন যে, পাকিস্তানে ইসলামি রাষ্ট্র গঠনের অনুরূপ ভারতেও যদি হিন্দু ধর্মীয় রাষ্ট্র গঠন করা হয় এবং মনুর আইন অনুসারে মুসলমানদের প্রতি শূদ্রের ন্যায় ব্যবহার করা হয় তাহলেও তাতে তাঁদের কোনোই আপত্তি নেই। ভারতের হিন্দুদের সে-অধিকার আছে।[২৫] অবশ্য একজন ‘গাজী’ মওলানা এ অধিকার স্বীকার করেন নি। তিনি বলেছেন ভারত যদি হিন্দু ধর্মীয় রাষ্ট্র গঠন করে এবং সেখানে ইসলাম প্রচারে বাধা দেয় তাহলে তিনি যুদ্ধ করে ভারত জয় করে নেবেন।[২৬] তবে শুধু এই বীর মওলানারই নয়, তদন্ত আদালত জানাচ্ছেন, সাধারণভাবে মওলানাদের অভিমত হচ্ছে, “থিওরি অনুসারে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিবেশী অমুসলিম রাষ্ট্রের সঙ্গে অনুক্ষণ যুদ্ধে লিপ্ত। প্রতিবেশী রাষ্ট্র যে কোনো সময় দারুল-হরবে পরিণত হতে পারে এবং সে-ক্ষেত্রে সেখানকার মুসলিম অধিবাসীদের কর্তব্য হবে সে-দেশ ছেড়ে ইসলামি রাষ্ট্রে চলে আসা। পাকিস্তান যদি ইসলামি রাষ্ট্র হয় এবং ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের যুদ্ধ বাধে, তবে ভারতের চার কোটি মুসলমানকে পাকিস্তানে জায়গা দেয়ার জন্য আমাদের তৈরি থাকতে হবে। প্রকৃতপক্ষে, জমিয়তুল উলাময়ে পাকিস্তানের সভাপতি মনে করেন ভারতে মুসলমানদের এখনই হিজরত করা উচিত।” এই রিপোর্ট যখন লিখিত হয় তখন, ১৯৫৩-৫৪ সালে, ভারতে মুসলমানদের সংখ্যা বোধহয় ছয় কোটির বেশী। 

তদন্ত আদালত জানাচ্ছেন, “ইসলামি রাষ্ট্রের অন্যান্য ব্যাপার হচ্ছে, সব রকমের ভাস্কর্য, তাসখেলা, মানব প্রতিকৃতি অঙ্কন, মানুষের আলোকচিত্র তোলা, গান-বাজনা, নাচ, পুরষ-নারীর মিলিত অভিনয়, সিনেমা এবং থিয়েটার বন্ধ করতে হবে।”[২৭] একজন বিশিষ্ট আলেমের মতে, “মুসলমানদের মৃতদেহ কেটে ছাত্রদেরকে (শরীরের) গঠন বুঝিয়ে অস্থিবিদ্যার অধ্যাপকেরা পাপের কাজ করে থাকেন।[২৮] তদন্ত আদালত আরেকটি কথা উল্লেখ করেননি, কিন্তু এ কথা সর্বজনবিদিত যে সাধারণভাবে মওলানা সমাজ পরিবার-পরিকল্পনার বিরোধী। 

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কিছুকাল পরে সংবিধান প্রণয়নে পরিষদকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য সরকার বিজ্ঞ আলেমদের নিয়ে একটি “তালিমাত-ই-ইসলামি বোর্ড” গঠন করেছিলেন। 

এই বোর্ডেরও দু’একটি সাংবিধানিক সুপারিশের এখানে উল্লেখ করছি। এই বোর্ড তাঁদের শাসনতান্ত্রিক সুপারিশে প্রধানত রাষ্ট্রপ্রধানের যোগ্যতা, নির্বাচন পদ্ধতি, তাঁর ক্ষমতা ইত্যাদি নিরূপনেই মনোনিবেশ করেছিলেন। তাঁদের মতে রাষ্ট্রপ্রধানকে হতে হবে মুসলমান, পুরুষ, তিনি নির্বাচিত হবেন, তবে আজীবনের জন্য। তাঁকে ইসলাম ধর্মশাস্ত্রে সুপণ্ডিত হতে হবে, তিনি জুম্মা ও ঈদের নাজামে ইমামতি করবেন (অর্থাৎ তাঁকে আলেম হতে হবে); তাঁকে নির্বাচন করবেন ফেডারেশন পরিষদের সদস্যগণ” এবং শরীয়ত-অভিজ্ঞ আলেমগণ; সরকারি বিলসমূহ তাঁরই নির্দেশে রচনা করবেন একটি কাউন্সিল এবং এ কাউন্সিল নিয়োগ করবেন তিনিই; কাউন্সিলের সঙ্গে মতবিরোধ হলে তাঁর অভিমতই কার্যকরী হবে; দেশে ও বিদেশে ইসলামি নীতি প্রচার করা তাঁর একট প্রধান কাজ হবে প্রদেশের শাসন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে তাঁর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা থাকবে; মন্ত্রিসভা তিনিই গঠন করবেন। আইন পরিষদে কোনো মহিলা নির্বাচিত না হওয়াই উচিত; তবে আধুনিক যুগের দাবির দিকে নজর রেখে মহিলা নির্বাচন করা যেতে পারবে; কিন্তু মহিলা সদস্যদের পঞ্চাশ বছরের বেশি বয়সী হতে হবে এবং বোরখা পড়ে তাঁদেরকে আইন পরিষদে আসতে হবে। 

ইসলামি রাষ্ট্রের রূপরেখা সম্বন্ধে মওলানাদের এইসব অভিমত এতই প্রতিক্রিয়াশীল, হাস্যকর ও উদ্ভট যে এ সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। এসব পড়লে মনে হয় একটা প্রহসন রাষ্ট্রের সংক্ষিপ্তসার পড়ছি। এখানে প্রশ্ন শুধু এই, পাকিস্তান সৃষ্টির গোড়ার দিকে তাঁরা, যেসব অভিমতই পোষণ করতেন, এখনও কি তাঁরা সেইসব অভিমতই পোষণ করেন? মতামতের আর যার কাছেই আশা করা যাক, মওলানাদের কাছে নয়। তাঁরা বলেন, ইসলামি রাষ্ট্র সম্পর্কিত যেসব মতবাদ তাঁরা পেশ করেছেন তা ইসলাম-নির্দেশক, চৌদ্দশ’ বছর আগেই এগুলো রূপলাভ করেছে; অতএব সামান্য বিশ-পঁচিশ বছরে তাঁরা এসব মতবাদ পরিবর্তন করবেন এ আশা দুরাশা। বস্তুত ষাটের দশকের শেষেও জমিয়তুল উলামায়ে ইসলামের শীর্ষস্থানীয় একজন নেতা বলেছেন, গণতন্ত্র ইসলামের পরিপন্থী জমিয়ত নিয়ন্ত্রিত-গণতন্ত্রে বিশ্বাসী”[২৯] 

উপরের আলোচনা থেকে সহজেই বোঝা যায় যে, তালিমাত-ই-ইসলামিয়া বোর্ডের সুপারিশের অনুরূপ ব্যবস্থা যদি আলেমগণ পাকিস্তানে কায়েম করতে সমর্থ হতেন তবে এমন একজন ব্যক্তি রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হতেন যিনি একাধারে আলেম এবং বাদশাহ, ক্ষমতার দিক দিয়ে তিনি স্বৈরাচারী, কেন্দ্রে এবং প্রদেশে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী। আইন পরিষদের মতো একটা সংস্থা থাকতো তবে তা হতো নুলো সাক্ষী-গোপালের মতো। পক্ষান্তরে পাঞ্জাব গোলযোগ তদন্ত আদালতে সাক্ষ্যদানকারী মওলানাদের অভিমত অনুযায়ী পাকিস্তানে কখনো ইসলামি আদর্শের অনুরূপ সরকার গঠিত হলে সে সরকার আমলাতান্ত্রিক হতো না, অথবা হতে পারবে না, কেননা গণতন্ত্র ইসলামের পরিপন্থী (অর্থাৎ তাঁদের মতে ইসলামে গণতন্ত্র নিষিদ্ধ) এবং পাকিস্তানে কোনো আইন পরিষদের অস্তিত্ব থাকতো না, কেননা আইন পরিষদ গঠনই কোরআন ও সুন্নার বিরোধী। এর ফলাফল পূর্ব-পাকিস্তানিদের জন্য কি রকম মারাত্মক হতো তা দেখা যাক। 

 ইসলামি রাষ্ট্রে রাষ্ট্রপ্রধানই সর্বোচ্চ ক্ষমতাশালী ব্যক্তি। রাষ্ট্র পরিচালনে তাঁকে মন্ত্রিবর্গ সহায়তা করবেন এতে ইসলামি রাষ্ট্রবাদীদের আপত্তি নেই, তবে দেশে কোনো আইন পরিষদ থাকবে না, বিজ্ঞ আলেমদের সহায়তায় তিনি আইন প্রণয়ন ও জারি করবেন। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলি ব্যতীত সারা পৃথিবীর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এই যে, প্রায় সার্বজনীনভাবেই দেশের অধিবাসীদের মধ্যে যে অংশ বা শ্রেণী রাজনৈতিক অর্থনৈতিকভাবে প্রতিপত্তিশালী, প্রকৃত রাষ্ট্রক্ষমতা সেই অংশেরই করায়ত্ত থাকে, দেশে গণতন্ত্র থাকুক বা না থাকুক। প্রশাসনযন্ত্র, পুলিশ, সামরিকবাহিনী এবং অন্যান্য সংস্থার মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা সংযুক্ত হয়ে থাকে এই কারণে এই সমস্ত সংগঠনেও উক্ত পতিপত্তিশালী অংশেরই প্রাধান্য কায়েম হয়ে থাকে। পাকিস্তানেও এর ব্যতিক্রম হয়নি এবং হতো না। এ রাষ্ট্রে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে পশ্চিম-পাকিস্তানিদেরই প্রাধান্য ছিল, এই কারণে স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রী সাধারণত (যখন প্রধানমন্ত্রীর পদ ছিল) পশ্চিম-পাকিস্তান থেকেই হয়েছেন, কেন্দ্রীয় প্রশাসনযন্ত্রের সর্বোচ্চ পদগুলি সামান্য ব্যতিক্রম ব্যতীত পশ্চিম-পাকিস্তানের অধিকৃত ছিল, বিভিন্ন বিভাগ ও মন্ত্রীদফতরের চাকুরিতে পশ্চিম-পাকিস্তানিদের প্রাধান্য ছিল, সামরিকবাহিনীতেও তাই এবং রাজধানীও ছিল পশ্চিম-পাকিস্তানে। রাজধানী অপসারণের অজুহাতস্বরূপ করাচির প্রতিকূল আবহাওয়া সম্বন্ধে আইয়ূব সাহেব যাই বলে থাকুন, সব রাষ্ট্রেরই সাধারণ নিয়ম হচ্ছে রাষ্ট্রের যে-অঞ্চলের অদিবাসীরা প্রতিপত্তিশালী তাদের সুবিধার জন্য সেই অঞ্চলেই রাজধানী স্থাপিত হয়, পশ্চিম-পাকিস্তানে পাকিস্তানের রাজধানী স্থাপিত হয় এই কারণেই এবং করাচি থেকে রাওয়ালপিন্ডিততে ইসলামাবাদেও রাজধানী স্থানান্তরিত হয়েছে ঐ একই কারণে। এতে পূর্ব-পাকিস্তানি অথবা সিন্ধীদের অসুবিধা হলেও তা অবান্তর। কোন্ এলাকার লোকদের সুবিধার জন্য এটা করা হয়েছে সেটাই আসল কথা।

মোটকথা, পাকিস্তানে অর্থনীতি, রাজনীতি, প্রশসনযন্ত্র ও সামরিক বাহিনীকে পশ্চিম-পাকিস্তানিদের সর্বময় প্রাধান্য ছিল। একথা ঠিক যে অল্প সময়ের জন্য খাজা নাজিমুদ্দিন গভর্ণর-জেনারেল ও প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন এবং বগুড়ার মোহাম্মদ আলী অল্প সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, কিন্তু সকলেই জানেন এরা প্রকৃত বাংলাভাষী ছিলেন না। কোনো বাঙালি কখনো পশ্চিম-পাকিস্তানের অথবা ঐ অংশে কোনো প্রদেশের গভর্ণর নিযুক্ত হননি, কিন্তু সাতচল্লিশের পর থেকে পূর্ব-পাকিস্তানে নিযুক্ত কুড়িজন গভর্ণরের মধ্যে মাত্র পাঁচজন ছিলেন বাঙালি, তাদের মধ্যে একজন (ড. এম এন হুদা) মাত্র আড়াই দিনের জন্য নিযুক্ত হয়েছিলেন, মোটের ওপর, পূর্ব-পাকিস্তান শতকরা ছাপান্নজন জনসংখ্যা দাবী করলে কি হবে, সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্রে তার ক্ষমতা ছিল খুবই সামান্য। 

এই রাষ্ট্র একমাত্র জাতীয় পরিষদেই সদস্য-সংখ্যার দিক দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে সমতা মঞ্জুর করা হয়েছিল। প্রথম সামরিক শাসকামলের প্রায় পৌনে চার বছর সে পরিষদেরও অস্তিত্ব ছিল না। তার আগে ও পরে এই পরিষদের পূর্ব-পাকিস্তানি সব সদস্যেরই সর্বদা এ-প্রদেশের স্বার্থ নিয়ে মাথা-ব্যথা ছিল না, সামান্য ব্যক্তিগত স্বার্থে অনেকেই ক্ষমতাসীনদের স্বার্থকে সমর্থন করতেন, তবু কিছু পূর্ব-পাকিস্তানি সদস্য জাতীয় পরিষদে চাকুরি-শিল্প-বাণিজ্য প্রতিরক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাঙালিদের প্রতি অবিচারের সমালোচনা করেছেন, তার ফলে কেন্দ্রীয় সরকার কিছু কিছু বিব্রত বোধ করেছেন এবং তাঁদের হাত থেকে কুচিৎ-কখনো কিছু কিছু খসেছে, তাঁরা একেবারে বধির থাকতে পারেননি। মওলানাদের পরিকল্পিত ইসলামি রাষ্ট্র গঠিত হলে সে প্রদত্ত রাষ্ট্রপ্রধান পশ্চিম-পাকিস্তানিই হতেন এবং অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে পশ্চিম-পাকিস্তানিদের সর্বাত্মক প্রাধান্য অক্ষুণ্ণ থাকতো (উল্লেখ করা যেতে পারে যে ইসলামি রাষ্ট্রবাদী সকল উলামা-প্রতিষ্ঠানের প্রধানই পশ্চিম-পাকিস্তানি), শুধু লাভ হতো এই যে, রাষ্ট্রে কোনো আইন পরিষদ বা জাতীয় পরিষদ থাকতো না, অতএব বাঙালিরা যে প্রতিবাদ জানাবার সুযোগ পেত তা আর সম্ভব হতো না, বাঙালির মুখ উত্তমরূপেই বন্ধ হয়ে যেত। পশ্চিম-পাকিস্তানি কায়েমী স্বার্থবাদীদের আর বিব্রত হতে হতো না এবং হাত থেকে কিছু খসাতেও হতো না। 

এই বিশ্লেষণ থেকে সহজেই বোঝা যায়, ইসলামি রাষ্ট্রের পরিকল্পনা ছিল অবিমিশ্রভাবে বাঙালি স্বার্থবিরোধী। যাঁরা ইসলামি রাষ্ট্রের কথা বলতেন তাঁরা একেবারে না বুঝে-সুঝেই এ দাবি করতেন তা নয়। যাঁরা পূর্ব-পাকিস্তানের স্বার্থ-বিরোধী তাঁরা ভাল করেই বুঝতেন। আর এই কারণেই এটা লক্ষ্য করার মতো ব্যাপার যে পূর্ব- পাকস্তানি এবং পূর্ব-পাকিস্তানের অবাঙালি রাজনীতিক ও পুঁজিপতিরা ইসলামি রাষ্ট্রের সমর্থক এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের বিরোধী ছিলেন।

তালিমাত-ই-ইসলামিয়া বোর্ড ফেডারেল পরিষদ গঠনে সম্মতি দিয়েছিলেন কিন্তু এটা যে সাক্ষীগোপাল হবে মাত্র এ কথা আগেই বলেছি (আইয়ূবী আমলের জাতীয় পরিষদও প্রায় সেই রকমই ছিল), অতএব বাঙালিরা সেরূপ পরিষদে কিছু চেঁচামেচি করতে পারতেন এই পর্যন্ত সে চেঁচামেচিতে বিশেষ কাজ হতো না। সার্বজনীন ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধি ব্যতীত আর কেউ গণস্বার্থ নিয়ে মাথা ঘামায় না। 

ইসলামি রাষ্ট্রবাদীগণ বলতেন, ইসলামি রাষ্ট্র গঠনের প্রতিক্রিয়ায় ভারত যদি হিন্দু ধর্মীয় রাষ্ট্র গঠন করে এবং মনুর আইন অনুযায়ী ওদেশের মুসলমানদের প্রতি শূদ্রের ন্যায় ব্যবহার করে তবে তাতেও মওলানাদের আপত্তি নেই। যে রাষ্ট্রীয় আদর্শ দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে একটি রাষ্টের এক কোটি অমুসলমানকে নাগরিক অধিকারহীন জিম্মিতে পরিণত করতে দ্বিধা করে না এবং এর প্রতিক্রিয়ায় অন্য রাষ্ট্রের পাঁচ-ছয় কোটি মুসলমান শূদ্রে পরিণত হবার সম্ভাবনা দেখা দিলেও বিচলিত হয় না, তা কি সভ্য আদর্শ? জানি না এঁরা সভ্যতার কোন্ স্তরে অবস্থান করছেন। 

কিন্তু সে-কথা মওলানাদের বোঝানো ছিল বৃথা। ব্যাপারটা অন্যদিক দিয়ে, বাঙালি স্বার্থের দিক দিয়ে দেখা যাক। কোনো কোনো মওলানা ইসলামি অন-ইসলামি রাষ্ট্রের চিরন্তন যুদ্ধ সম্ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের সব মুসলমানের “এখনই” পাকিস্তানে হিজরত করা বাঞ্ছনীয় বলেছেন। এটা একটা উদ্ভট পরিকল্পনা। মোহাজের-জীবন যে কতো অবর্ণনীয় দুঃখশোকে আকীর্ণ তা সাতচল্লিশের পরে-পরেই পশ্চিম-পাকিস্তানে দেখা গেছে। তথাপি ঐ অভিজ্ঞতা সামনে রেখেই কোনো কোনো মওলানা ভারতীয় মুসলমানদের হিজরতের কথা বলেছেন। অতএব কথাটা উদ্ভট হলেও এক মুহূর্তের জন্য বিবেচনা করা যাক। পাকিস্তানে যেহেতু জায়গা কম এইজন্যে অমুসলমানদেরও সেখান থেকে চলে যেতে বলতে হতো। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে লোক-বিনিময় করলে অবস্থাটা দাঁড়াতো এই পাকিস্তানে জনসংখ্যা ষাটের দশকের শেষ দিকে ছিল আনুমানিক এগারো কোটি, তার মধ্যে পশ্চিম-পাকিস্তানে পাঁচ কোটি এবং পূর্ব- পাকিস্তানে ছয় কোটি। এই ছয় কোটির মধ্যে চার কোটি, বাঙালি মুসলমান, এক কোটি বাঙালি অমুসলমান এবং এক কোটি অবাঙালি মুসলমান (অন্তত মোহাজের নেতারা তাই দাবি করতেন)। দুই রাষ্ট্রের লোক বিনিময় হলে পাকিস্তান থেকে এক কোটি অমুসলমান চলে যেত এবং পাকিস্তানে ছয় কোটি মুসলমান আসতো। তখন পাকিস্তানের জনসংখ্যা হতো ষোল কোটি। পশ্চিমবঙ্গ ইত্যাদি ভারতীয় এলাকায় লাখ পঞ্চাশেক বাঙালি মুসলমান ছিল। অতএব তখন সমগ্র পাকিস্তানের ষোল কোটি জনসংখ্যার মধ্যে বাঙালির সংখ্যা হতো সাড়ে চার কোটি এবং অবাঙালির সংখ্যা হতো সাড়ে এগারো কোটি। স্পষ্টতই ভারত-পাকিস্তানে লোক বিনিময় হলে সমগ্র পাকিস্তানে বাঙালি কোণঠাসা হয়ে যেত। এমনকি পূর্ব-পাকিস্তানেই বাঙালি সংখ্যালঘু হয়ে যেত।[২৯](ক) এই কারণেই ভারত-পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক হানাহানি এবং পাকিস্তানে ইসলামি রাষ্ট্রের শ্লোগান ছিল বাঙালি স্বার্থের বিরোধী- দুই রাষ্ট্রের সংখ্যালঘুদের দুর্গতি ছাড়াও।  

আমরা দেখেছি প্রকৃত ইসলামি রাষ্ট্রে গণতন্ত্র থাকতো না, জাতীয় পরিষদ থাকতো না, থাকলেও তার কোনো ক্ষমতা থাকতো না, কিন্তু শক্তিশালী কেন্দ্র থাকতো এবং রাষ্ট্রপ্রধানই হতেন সে-রাষ্ট্রে সর্বময় কর্তা; জাতীয় পরিষদ মারফত পূর্ব-পাকিস্তানিরা অবিচারের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ জানাতো তার আর কোনো উপায় থাকতো না; এবং বিজ্ঞ মওলানাদের সহায়তায় যেহেতু রাষ্ট্রপ্রধান আইন প্রণয়ন করতেন অতএব তা হতো ইজমার অনুরূপ এবং ইজমা নির্বিবাদে মেনে নেওয়াই স্বীকৃত নিয়ম, কেননা বাধ্যবাধকতার দিক দিয়ে কোরআন-হাদিসের পরেই ইজমার স্থান, অতএব সংবাদপত্রেও এর সমালোচনা হতো অসঙ্গত; অর্থাৎ বাঙালির মুখ রুদ্ধ করার যাবতীয় আয়োজন, মওলানাদের দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্রে সুসম্পন্ন হতো। এই শক্তিশালী ক্ষেত্র সমন্বিত রাষ্ট্রে পূর্ব-পাকিস্তানের পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসনের প্রশ্ন তো উঠতোই না। অতএব এটা খুবই স্বাভাবিক যে ইসলামি রাষ্ট্রবাদী মানেই আওয়ামী লীগের ছয়-দফা, ছাত্র-সমাজের প্রিয় এগারো দফা অথবা পূর্ব-পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসনমূলক সকল দফার রফা করতেন। মুখে তাঁরা যাই বলুন, নীতিগতভাবে তাঁরা পূর্ব-পাকিস্তানের দাবি সমর্থন করতে পারেন না। এ-প্রদেশের স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবির প্রতিরোধই ইসলামি রাষ্ট্র আন্দোলনের একটা বড়ো উদ্দেশ্য ছিল। একথা তাঁরা চেপেও রাখেননি। পূর্ব-পাকিস্তান নিজের অভিযোগের কথা, এবং ভৌগোলিক দূরত্ব ও বিচ্ছিন্নতার জন্য স্বায়ত্ত্বশাসনের কথা বললেই একে বলা হতো ‘সঙ্কীর্ণ আঞ্চলিকতা’। তাঁদের মতে ইসলামে স্বায়ত্ত্বশাসন দাবির পরিপোষক আঞ্চলিক মনোভাব, ভৌগোলিক জাতীয়তা ইত্যাদির স্থাপনেই। শেষ পর্যন্ত তাই পূর্ব-পাকিস্তানকে নিরজ্জ্বল স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে হয়েছে সমস্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। 

৭ 

আধুনিক শিক্ষিতদের ইসলামি রাষ্ট্রধারণা মওলানাদের থেকে আলাদা। আলোচনার শুরুতে বলেছি আলেম-সম্প্রদায়ের নজর অতীতের বিভিন্ন কেতাব ও ইতিহাসে বর্ণিত

সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ধারণার প্রতি এবং আধুনিক-শিক্ষিতদের দৃষ্টি স্বৈরাচারী থেকে গণতান্ত্রিক সব রকম আধুনিক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ধারণার প্রতি। তফাৎ এই: 

(১) আলেম-সম্প্রদায় তাঁদের ইসলামি রাষ্ট্রধারণায় কিছু আধুনিক রাষ্ট্রধারণার ভেজাল দিয়ে থাকেন- যেমন নির্দিষ্ট সময় অন্তর সীমাবদ্ধ ক্ষমতাসম্পন্ন বিভিন্ন পরিষদের নির্বাচন; কোনো কোনো মওলানা অবশ্য এই নিয়ন্ত্রিত * গণতন্ত্রও বৈধ বিবেচনা করেন না। 

(২) আধুনিক শিক্ষিতরা আধুনিক রাষ্ট্রধারণায় কিছু ইসলামি ভেজাল দিয়ে থাকেন- যেমন রাষ্ট্রের ইসলামি নামকরণ ধর্মসংক্রান্ত ক্রিয়াকলাপ সম্পাদনের জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে মুসলিম সম্প্রদায়কে কিছু বিশেষ সুবিধা দান (যথা রমজান মাসে সাইরেন বাজানো, চাঁদ দেখার সংবাদ ঘোষণা), আইন প্রণয়নে পরামর্শ দেওয়ার জন্য ওলামা-বোর্ড গঠন ইত্যাদি। 

কিন্তু এই সবই বাইরের ব্যাপার ও অন্যান্য সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে আধুনিক- শিক্ষিতদের আদর্শ পশ্চিমের আধুনিক সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা। পশ্চিমী সুস্থসম্মত একজন শিক্ষিত ব্যক্তি মাথায় টুপি পরলে তাঁকে দেখে যতটা মুসলমান বলে মনে হয়, আধুনিক-শিক্ষিতদের পরিকল্পিত রাষ্ট্র ততটাই ইসলামি রাষ্ট্র। আলেমদের মতে কোরআন-হাদিস-ফেকাহ্ ইত্যাদিতে সুপণ্ডিত ওলামা ব্যতীত আর কারো পক্ষে ইসলামি রাষ্ট্রের ধারণা করাও সম্ভব নয়। আলেমদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে তাঁদের এই যুক্তিই সঠিক যুক্তি। এই কারণে আলেম-সম্প্রদায় লিয়াকত আলীর আমলে ১৯৪৯ সালে গণপরিষদে গৃহীত আদর্শ-প্রস্তাবকে ভাঁওতা মনে করতেন এবং ১৯৫৬ সালের সংবিধানকেও তাঁরা ইসলামি সংবিধান মনে করতেন না। তাঁদের একটা প্রধান আপত্তি ঐ প্রস্তাবে এবং সংবিধানে পাকিস্তানের জনগণের সার্বভৌমত্ব, মৌলিক অধিকার এবং গণতন্ত্রের কিছু স্বীকৃতি ছিল।

আলেম-সম্প্রদায় আধুনিক শিক্ষিতদের ইসলামি রাষ্ট্রধারণাকে ভেজাল মনে করেন, তথাপি যেহেতু পাকিস্তানের সংবিধানে এরূপ রাষ্ট্রধারণারই প্রতিফলন ঘটেছে এই কারণে এ সম্বন্ধে দু’একটা কথা বলা আবশ্যক। এঁদের কিছু অংশ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, কিছু অংশ স্বৈরাচারী একনায়কত্বে। এই কারণেই সামরিক বাহিনীর বাইরেও কিছু লোক, এমনকি কিছু মওলানা এবং রাজনৈতিক নেতাও আইয়ুব খানকে সমর্থন করেছিলেন। এঁদের মধ্যে পশ্চিম-পাকিস্তানিদের সংখ্যাই ছিল বেশি। স্বভাবতই একনায়কত্বে অথবা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সব ইসলামি রাষ্ট্রবাদীই ছিল ‘শক্তিশালী কেন্দ্রে’ বিশ্বাসী, এবং পূর্ব-পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসনের বিরোধী। 

স্বায়ত্ত্বশাসন তো অনেক বড় কথা, ইসলামি রাষ্ট্রবাদীরা অন্যতর রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলার দাবিও একসময় স্বীকার করতেন না। লিয়াকত আলীর আমলেই ১৯৪৯ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে ‘আদর্শ-প্রস্তাব’ গৃহীত হয় এবং এই প্রস্তাবে আধুনিক শিক্ষিতদের ধারণা অনুযায়ী ইসলামি রাষ্ট্রের কতিপয় মূলনীতি ব্যক্ত হয়। পরে “পাকিস্তান-হার্ট অব এশিয়া” নামক গ্রন্থে (এটি আমেরিকায় প্রদত্ত তাঁর বক্তৃতার সংকলন) তিনি ইসলামি রাষ্ট্রের আদর্শ সম্বন্ধে অনেক কথা বলেছেন। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে ঢাকায় জিন্নাহ্ সাহেব বাংলা ভাষার দাবি সম্বন্ধে যে-সব কথা বলেন তা সুবিদিত; তার এক মাস আগেই লিয়াকত আলী সাহেব পাকিস্তান গণপরিষদে অনুরূপ কথাই বলেছিলেন। অর্থ্যাৎ নীতিগতভাবে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত পাকিস্তান সরকার আগেই নিয়ে রেখেছিলেন। গণপরিষদের একজন বাঙালি সদস্য বাংলা ভাষায় বক্তৃতার অনুমতি দেওয়ার জন্য পরিষদের নিয়মাবলী সংশোধনের প্রস্তাব করলে জনাব লিয়াকত আলী বলেন: “পাকিস্তান একটি মুসলিম রাষ্ট্র এবং অবশ্যই মুসলিম জাতির ভাষাই হবে এর ‘লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা” (প্রস্তাব উত্থাপনকারীর) উপলব্ধি করা উচিত যে এই উপমহাদেশের দশ কোটি মুসলমানের ভাষা উর্দু …. একটি জাতির জন্য একটি ভাষাই যাহা দরকার এবং সে- ভাষা শুধু উর্দুই হতে পারে, আর কোনো ভাষা নয়।”[৩০] 

লিয়াকত আলী সাহেবের এই বক্তৃতা পড়ে হতবুদ্ধি হতে হয়। তিনি ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, দেশের সব অঞ্চলের অধিবাসী সম্বন্ধে তাঁর অন্তত মোটামুটি প্রাথমিক জ্ঞান থাকা উচিত ছিল। তিনি কি জানতেন না যে পাকিস্তানের অধিকাংশ অধিবাসী ছিল পূর্ব-পাকিস্তানের এবং তাদের ভাষা উর্দু নয়, বাংলা, তাঁকে কি এ- ব্যাপারে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রাখা হয়েছিল, অথবা সব কথা জেনেও তিনি মিথ্যা কথা বলেছিলেন? ইসলামি রাষ্ট্রের একজন প্রধানমন্ত্রী এরূপ মিথ্যা কথা বললে ইসলামি রাষ্ট্র সম্বন্ধে বাঙালিদের কি রকম ধারণা হওয়া সম্ভব? যাই হোক, এর এক বছর পরে ইসলামি আদর্শবাদকে রাষ্ট্রের লক্ষ্য হিসাবে নিয়ে গণপরিষদে ‘আদর্শ প্রস্তাব’ গৃহীত হয়।

পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসন এবং অন্যান্য স্বার্থের বিবোধিতাই শুধু ইসলামি রাষ্ট্র আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল না, পূর্ব ও পশ্চিম উভয় পাকিস্তানের গণচেতনাকে বিভ্রান্ত করাও এর লক্ষ্য ছিল। কোনো কোনো নেতা কথাটা চেপে রাখতে পারেননি। ১৯৬৮ সালের শেষে এবং ১৯৬৯ সালের প্রথমে সারা পাকিস্তানে যে গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয় তার মূলে ছাত্রসমাজের বিশেষ দাবি ছিল, পূর্ব-পাকিস্তানের বিশেষ দাবি ছিল, পশ্চিম-পাকিস্তানের সংখ্যালঘু অঞ্চলগুলির বিশেষ দাবি ছিল, কিন্তু সেই সঙ্গে সকল অঞ্চলের কৃষক-শ্রমিক-চাকুরীজীবীদের বাঁচার দাবিও ছিল। ছয়-দফার সঙ্গে আরো দফার দাবিও ছিল। এসব দাবি পুরণ করা নাকি ইসলামি রাষ্ট্রের কাজ নয়। পশ্চিম- পাকিস্তানের বিশিষ্ট নেতা নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ্ বলেছিলেন: “পাকিস্তান আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল সাধারণ মানুষের অবস্থা উন্নত করা, এ-কথা বলার অর্থ হচ্ছে ইতিহাসকে বিকৃত করা। এ-আন্দোলনের অপ্রধান উদ্দেশ্যগুলির মধ্যে ঐ উদ্দেশ্যও ছিল বটে, তবে আসল উদ্দেশ্য ছিল ইসলামি নীতি অনুযায়ী পরিচালিত একটি রাষ্ট্র অর্জন করা।”[৩১] ইসলামি রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য যে সাধারণ মানুষের অবস্থা উন্নত করা নয়, এ-কথা বোধ হয় এর চাইতে স্পষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। এ-ধরনের কথা অনেক আগে থেকেই ইসলামি রাষ্ট্রবাদীদের মুখ দিয়ে বলানো হয়েছিল। 

পূর্ব-পাকিস্তানের ইসলামিক একাডেমী স্থাপনের উদ্দেশ্য ছিল জনসাধারণের মধ্যে ইসলামের নীতিসমূহ প্রচার করা। ইসলামিক একাডেমীর পরিচালক জনাব আবুল হাশিম ১৯৬৬ সালে তাঁর এক প্রবন্ধে পাকিস্তান আন্দোলনের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে লিখেছিলেন: “গণতন্ত্রের প্রতি যার কিছুমাত্র শ্রদ্ধা আছে তিনি অস্বীকার করতে পারবেন না যে, দশ কোটি মুসলমান পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করেছিল রাজনৈতিক অথবা অর্থনৈতিক উচ্চাশার জন্য নয়, ইসলামি জীবনপদ্ধতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবশত।[৩২] জনাব আবুল হাশিমও ইসলামি রাষ্ট্রের কথা খুব রেখে ঢেকে বলেননি। মনে রাখা দরকার, ১৯৬৮-৬৯ সালের পাকিস্তান ব্যাপী গণ-আন্দোলন নওয়াবজাদা নসরুল্লাহর উক্তির মাত্র পাঁচ মাস আগে সংঘটিত এবং ১৯৬৬-তে আওয়ামী লীগের ছয়-দফা আন্দোলন ও ৭ জুনের হরতাল উপলক্ষে ঢাকায় নারায়ণগঞ্জে রক্তাক্ত ঘটনাবলী আবুল হাশিম সাহেবের প্রবন্ধে প্রকাশিত হওয়ার মাত্র দু’মাস আগের কথা। জনসাধারণের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক দাবি অর্থাৎ বাঁচার দাবীকে পূর্ব ও পশ্চিম উভয় অঞ্চলের দু’জন বিশিষ্ট ব্যক্তি যখন তিরষ্কার করেছেন তখন এ-সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করা যেতে পারে। 

মুসলিম লীগের পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার কিছু আগে থেকেই বঙ্গদেশের কোনো কোনো অঞ্চলে, বিশেষত উত্তরাঞ্চলে তেভাগা আন্দোলন চলছিল, এবং পাকিস্তান আন্দোলনকালেও এই আন্দোলন চলেছিল। এই আন্দোলন যারা করেছিল সেই চাষীদের অধিকাংশ ছিল মুসলমান। পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার আড়াই বছরের মধ্যে বঙ্গদেশে মন্বন্তর হয়েছিল- ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ছাড়া এমন মন্বন্তর বঙ্গদেশে এর আগে আর কখনো হয়নি। পাঞ্জাবে মন্বন্তর দূরে থাক, খাদ্যাভাবের প্রশ্নই তখন ছিল না, বিশেষ করে নওয়াবজাদাদের; কিন্তু এ-মন্বন্তর যখন হয় তখন জনাব আবুল হাশিম বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সেক্রেটারি, অসংখ্য নরনারী তখন “ফ্যান দাও মা ফ্যান দাও মা” বলে বাড়ির দুয়ারে দুয়ারে মাথা ঠুকেছিল, রাস্তায় ওদের অনেকেই প্রায় প্রতিদিন মরে পড়ে থাকতো। ওদের বেশির ভাগ ছিল মুসলমান। সেদিন ওদের অনেকেই মরেছিল কিন্তু স্বামীহারা হয়ে, স্ত্রীহারা হয়ে, পুত্রকন্যাহারা হয়েও অনেকে বেঁচে গিয়েছিল। বেকার মুসলমানের সংখ্যা তখন অনেক, কেননা চাকুরির সুযোগ সেদিন আজকের তুলনায় অনেক কম ছিল। কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারের বিভিন্ন অফিসে এবং সংস্থায় কতজন বাঙালি এবং কতজন অবাঙালি তার হিসেব যেমন পূর্ব-পাকিস্তানের সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতো, তেমনি সেই চল্লিশের দশকেও কোন অফিসে কতজন হিন্দু এবং কতজন মুসলমান ছিল তার হিসেব সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতো। এই সবই সেই পাকিস্তান আন্দোলনের সময়ের কথা। এগুলো মূলত অর্থনৈতিক দাবি না ধর্মনৈতিক দাবি? তখন বাংলাদেশে যেহেতু জমিদারেরা প্রায় সকলেই ছিল হিন্দু এবং প্রজারা ছিল অধিকাংশ মুসলমান, এই কারণে পাকিস্তান আন্দোলন কতকটা শ্রেণী- সংগ্রামের রূপ নিয়েছিল। আর এই কারণেই সেই সময় ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টি পাকিস্তান আন্দোলনকে কয়েক বছরের জন্য সমর্থন করেছিল, জনাব আবুল হাশিমের সে-ইতিহাস ভুলে যাওয়ার কথা নয়, কেননা পাকিস্তান আন্দোলনের তিনি তখন যে- ব্যাখ্যা দিতেন তা সমাজতন্ত্রের মতো শোনাতো, এবং এই ব্যাখ্যাও ছিল ঐ, আন্দোলনের প্রতি ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টির আকৃষ্ট হওয়ার অন্যমত হেতু। ১৯৬৬ সালে তিনি পাকিস্তান সরকার প্রতিষ্ঠিত ইসলামিক একাডেমীর সর্বোচ্চ কর্মচারি হিসেবে যাই বলুন, চল্লিশের দশকে বাংলার তরুণ মুসলিম-সম্প্রদায়ের মনে তিনি যে উদ্দীপনা এনে দিয়েছিলেন তা ইসলামি উদ্দীপনা নয়, অনেকটা শ্রেণী-সংগ্রামের উদ্দীপনা এবং বামপন্থী উদ্দীপনা তো নিশ্চয়ই। ১৯৪৬ সালের দেশব্যাপী নির্বাচনে পাকিস্তান দাবির ইস্যুতে মুসলিম লীগকে যারা জয়ী করেছিল ভোট দেওয়ার সময় সেই তেভাগা আন্দোলনকারী চাষী তার দাবি পুরণ আশা করেনি, “ফ্যান দাও মা ফ্যান দাও মা’ বলে যারা মাথা ঠুকে মরতেও বেঁচে গিয়েছিল তারা পাকিস্তানে দু’বেলা ডালভাত আশা করেনি, বঞ্চিত বেকার মুসলমান তরুণ যুবক পাকিস্তানে চাকুরির আশা করেনি, এরা সবাই নওয়াবজাদাদের মতোই শুধু ইসলামি উদ্দীপনার ভোট দিয়েছিল একথা বলা তাদের প্রতি মর্মান্তিক বিদ্রূপের মতো। 

কিন্তু এটা পুরোপুরি বিদ্রূপও নয়। যাঁরা ইসলামি রাষ্ট্রের কথা বলতেন তাঁদের মধ্যে এমন কিছু লোক থেকে থাকতে পারেন যাঁরা জানতেন না কোন্ রাজনৈতিক শ্লোগানের উদ্দশ্য কী, তবে অন্যান্যরা ভালো করে জানতেন বলেই এরূপ শ্লোগান দিতেন। বহু শতাব্দী যাবৎ সব দেশেরই শাসক ও শোষক সম্প্রদায় যে-উদ্দশ্যে ধর্মকে ব্যবহার করে এসেছে পাকিস্তানেও ইসলামকে সেই উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করা হয়েছে: যেন কৃষক জমি না চায়, শ্রমিক বেতনবৃদ্ধি দাবি না করে, বেকার চাকুরি না চায়, নিঃস্ব ক্ষুধার্ত বিনা প্রতিবাদে নিয়তির নিকট আত্মসমর্পণ করে, এবং এরা সবাই মিলে নানারূপ দাবি তুলে নওয়াবজাদা ও ভাগ্যবান অন্যান্য ব্যক্তির শান্তিতে বিঘ্ন উৎপাদন না করে, তাঁদের স্বার্থে ভাগ বসাতে না চায়। তখন সবচেয়ে ভয় ছিল পূর্ব-পাকিস্তানিদের দাবি নিয়ে। অশান্ত মুসলমানকে শান্ত করার জন্য, সচেতন মুসলমানকে ঘুম পাড়াবার জন্য এবং ঘুমন্ত মুসলমানকে স্বপ্ন দেখাবার জন্য এর চাইতে ভাল পন্থা আর কী হতে পারে? 

এই কারণেই ইসলামি রাষ্ট্রবাদীরা সকলেই সমাজতন্ত্রের বিরোধী ছিলেন। সমাজতন্ত্রী মাত্রেই তাঁদের কাছে ঘৃণিত; তাদের জিভ কেটে ফেলতেও তাঁরা কেউ কেউ প্রস্তুত ছিলেন। মওলানা মওদুদী এরকম হুমকি দিয়েছিলেন। যে-সব হতভাগ্য শ্রমিক কৃষক ও খেটে-খাওয়া মানুষ অর্থনৈতিক সুবিচার প্রার্থনা করে তাদের সবাইকে নির্বিচারে তাঁরা সমাজতন্ত্রী আখ্যায়িত করতেন, যদিও তাদের অধিকাংশই কোন ‘তন্ত্রে’ দীক্ষিত নয়, নিছক প্রাণের দায়েই সম্পদের ন্যায্য বন্টন দাবি করতো। সমাজতান্ত্রিক সাহিত্যে নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই তারা পাঠ নেয় মুনাফা কার সৃষ্টি এবং কে তা লুট করে নিয়ে যায়। অনেক ইসলামি রাষ্ট্রবাদী সমাজতন্ত্রের এরূপ বিরোধী ছিলেন যে তাঁরা “ইসলামি সমাজতন্ত্রের” কথাও উচ্চারণ করতে দিতে নারাজ ছিলেন; তাঁদের মতে “আলোকিত অন্ধকার”-এর মতোই “ইসলামি সমাজতন্ত্রও স্ববিরোধী উক্তি”। এটা ছিল মওলানা মওদুদীর উক্তি। একই কারণে ইসলামি রাষ্ট্রবাদীরা পূর্ব-পাকিস্তানের মৌলিক দাবিসমূহের, বিশেষত পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসনের বিরোধী ছিলেন। আর এইজন্য সমাজতন্ত্রের জানী-দুশমন জামাতে ইসলামির জনপ্রিয়তা পশ্চিম-পাকিস্তানের যতটা ছিল, পূর্ব- পাকিস্তানে ততটা ছিল না। 

আমরা এখন পাকিস্তান আমলের রাজনীতিতে ইসলামের অপব্যবহারের কয়েকটি উদাহরণ দেব। এজন্য আমরা বেছে নেব আইয়ুবী আমলের সেই সময়টিকে যে- সময়টিকে ইসলামি রাষ্ট্রের জমানা বলা যেতে পারে, পাকিস্তানের নামের সঙ্গে ইসলামি বিশেষণটি সংযুক্ত করার পর থেকে। ইসলামি রাষ্ট্রবাদী আধুনিক-শিক্ষিত এবং অনেক আলেম ইসলামি রাষ্ট্র বলতে যা বোঝান, ঐ সময়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্রগঠনপদ্ধতি ছিল তারই নিকটতম। রাষ্ট্রের নামটাই শুধু ইসলামি ছিল না, শক্তিশালী কেন্দ্র ছিল। যে- আইন-পরিষদে (তথা জাতীয় পরিষদে) মওলানাদের আপত্তি তা ছিল বটে কিন্তু সে- পরিষদ ছিল পরোক্ষভাবে নির্বাচিত এবং তার ক্ষমতা ছিল সামান্য। আর এই কারণে বিনা দ্বিধায় বলা যায়- এবং এটা স্বীকৃত সত্যও যে, দেশে একনায়কতন্ত্র কায়েম ছিল। জাতীয় পরিষদকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য বিজ্ঞ আলেমদের নিয়ে গঠিত ইসলামি আদর্শ উপদেষ্টা পরিষদও ছিল। মোটের উপর ইসলামি রাষ্ট্রের সর্বাধিক সংখ্যক লক্ষণের সমাবেশ ঘটেছিল ঐ আমলে শুধু একটুখানি খুঁত ছিল এই যে আইয়ুব কোনো দারুল উলুম থেকে পাস করা মওলানা ছিল না, তিনি কুচিৎ শেরওয়ানী পরতেন এবং তাঁর দাড়ি ছিল না। 

কোনো কোনো মওলানা বলতে পারেন আইয়ুবী আমলের উল্লিখিত পর্যায়ে পাকিস্তান প্রকৃত ইসলামি রাষ্ট্র ছিল না। কিন্তু তা’হলে রাষ্ট্রের ইসলামি বিশেষণটা ছিল কেন? ইসলামি রাষ্ট্র না হওয়া সত্ত্বেও যদি ইসলামি বিশেষণটা ব্যবহার করা হয়ে থাকে তবে এটাই একটা প্রমাণ যে রাজনৈতিক অসদুদ্দেশ্যে, জনসাধারণকে ধোকা দেওয়ার জন্য ইসলামের অপব্যবহার করা হয়। কিন্তু কোনো কোনো মওলানা আপত্তি করলেও আমরা সেকথা শুনবো না, কেননা জাতীয় পরিষদকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য নিয়োজিত ‘ইসলামি আদর্শ উপদেষ্টা পরিষদ’ মওলানাদের নিয়েই গঠিত ছিল, এবং তাঁরা স্বেচ্ছায় এই বোর্ডে চাকুরি নিয়েছিলেন। অধিকন্তু স্মরণীয় ১৯৬৩ সালের মার্চ মাসে স্বয়ং আইয়ুব খান সদলবলে বরিশালের শর্ষিনায় গিয়েছিলেন, শর্ষিনার মাদ্রাসায় এক লক্ষ টাকা দান করেছিলেন এবং শর্ষিনার পীর সাহেবের আর্শীবাদ পেয়েছিলেন। এ ছাড়াও অনেক মওলানাই আইয়ুব সরকারকে সমর্থন করতেন। মওলানাগণ আইয়ুব খানকে তাঁদের প্রতিষ্ঠানে বক্তৃতা দিতেও আমন্ত্রণ করতেন।[৩৩] 

আইয়ুবী আমলকে, অতএব, আমরা ইসলামি রাষ্ট্রের আমল বলব। এই আমলে ১৯৬৪-৬৫ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন উপলক্ষ্যে বিরোধী দলসমূহ মিস ফাতেমা জিন্নাহকে মনোয়ন দিয়েছিল। মিস জিন্নাহ্ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে গণতন্ত্র তখনই পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতো, ক্ষমতার বহুলাংশে বিকেন্দ্রীকরণ ঘটতো এবং পূর্ব-পাকিস্তানের অনেক দাবি তখনই আদায় করা যেত। কিন্তু আলেম-সমাজ তখন ফতোয়া দিয়েছিলেন, ইসলামি রাষ্ট্রে নারী রাষ্ট্রপ্রধান হতে পারে না। বিজ্ঞ রাষ্ট্রনীতিবিদগণ অবশ্য আরও একটা কথা বলেছিলেন যে ভারতের সঙ্গে কোনো কারণে যুদ্ধ বাধলে, এবং নারী রাষ্ট্রপ্রধান থাকলে পাকিস্তান হেরে যাবে। এ প্রসঙ্গে দু’টি প্রশ্ন ওঠে; প্রথমত ঐ নির্বাচনের অল্পদিন পরেই ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বেঁধেছিল কিন্তু পুরুষ রাষ্ট্রপ্রধান ক্ষমতাসীন থাকা সত্ত্বেও তিনি তখন ভারত জয় করে কিংবা অন্তত কাশ্মীর জয় করে নিতে পারলেন না কেন? দ্বিতীয়ত ঐ যুদ্ধের পর এক বছরের মধ্যে ভারতে একজন নারী প্রধানমন্ত্রী হলেন, এবং তারপর সমগ্র আইয়ুবী আমলে তিনিই ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন (প্রেসিডেন্ট-পদ্ধতিতে যেমন প্রেসিডেন্ট, পার্লামেন্টারী পদ্ধতিতে তেমনি প্রধানমন্ত্রী সর্বোচ্চ ক্ষমতাশালী ব্যক্তি), তথাপি পাকিস্তানের পুরুষ রাষ্ট্রপ্রধান অন্তত কাশ্মীর জয় করে নিতে পারলেন না কেন? (পরবর্তী কালে ১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধারী রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন পুরুষ (ইয়াহিয়া খান), ভারতের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধারী সরকার-প্রধান ছিলেন নারী (ইন্দিরা গান্ধী); তথাপি পাকিস্তান হেরে গিয়েছিল)। অতএব পুরুষ-নারীর যুক্তিটা কিছু না; আইয়ুব খানকে বিজয়ী করাই ছিল আসল কথা, এবং তাঁকে বিজয়ী করার জন্য আলেম-সমাজই ইসলামকে ব্যবহার করেছেন। 

এই আইয়ুব খান বরাবরই ইসলাম সম্বন্ধে বড় বড় কথা বলতেন কিন্তু অপ্রতিহত ও দ্রুত গতিতে সৃষ্টি করেছিলেন কার্টেল এবং পশ্চিম-পাকিস্তানের মাত্র ২২টি পরিবারের হাতে পাকিস্তানের অধিকাংশ সম্পদ কেন্দ্রীভূত করেছিলেন। সরকারি অর্থে স্থাপিত কর্ণফুলী পেপার মিলস পশ্চিম-পাকিস্তানির হাতে অর্পণ করা হয়েছিল। রাজধানী করাচিতে যাওয়া পূর্ব-পাকিস্তানিদের জন্য এমনিতেই অসুবিধেজনক ছিল, আইয়ুব খান এই অসুবিধেকে আরও বাড়িয়ে রাজধানী নিয়ে গেলেন নতুন একটা জায়গায়, এবং এ নিয়ে পূর্ব-পাকিস্তানিরা সমালোচনা যাতে না করে সেজন্য এর নাম রেখে দিলেন ইসলামাবাদ। যেখানে ইসলামেরই আবাদ হচ্ছে সেখানে আপত্তি করার কি থাকতে পারে? এতে এবং পূর্ব-পাকিস্তানিদের খুশি হওয়ারই তো কথা। হ্যাঁ, ১৯৭১ সালে ইসলামাবাদ থেকে পরিচালিত যুদ্ধের সময় কিছু পূর্ব-পাকিস্তানি খুশি হয়েছিল, তাদের অনেকেই ছিল আলেম-সম্প্রদায় লোক। 

১৯৬৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রমনা উদ্যানে নিখিল পাকিস্তান মৌলিক গণতন্ত্রী সম্মেলনে ভাষণ দিতে গিয়ে আইয়ুব খান মৌলিক গণতন্ত্র-ব্যবস্থা ইসলামানুগ বলে বোঝাবার চেষ্টা করেন।[৩৪] পূর্ব-পাকিস্তানের সকল দল মিলে যখন ১৯৬৮ সালের ১৩ই ডিসেম্বর হরতাল ঘোষণা করলো তখন তৎকালীন লাট সাহেব মোনেম খান তাঁর বেতার ভাষণে এক মওলানার উদ্ধৃতি দিয়ে হরতালকে ইসলামে নিষিদ্ধ বলে শ্রোতাদের বোঝাতে চেয়েছিলেন। 

ইসলামকে এভাবে অপব্যবহারের আরও উদাহরণ দেওয়া যায়, অনেকেরই সেসব মনে আছে, আমরা আর বিস্তারিত বিবরণে যাব না। আমরা এবার রাষ্ট্র-ব্যবস্থাপনার উচ্চতম মহলে ইসলামের আবরণে একটি বিকৃতির কথা স্মরণ করিয়ে দেব। 

আইয়ুব খান ইসলামের কথা গুরুগম্ভীর স্বরে বলতেন, গ্রন্থ-প্রদর্শনীতে কোরআন শরীফ চুম্বন করতেন, পত্র-পত্রিকায় তার ছবি বেরিয়েছে। এদেশের নাগরিকেরা এখনও সে-সব কথা স্মরণ করতে পারবেন। টুপি পরা লাট সাহেব মোনেম খানের নির্দেশে অথবা অনুমোদনক্রমে এই টুপি পরা রাষ্ট্রপ্রধানের সংবর্ধনার জন্য কিভাবে পূর্ব- পাকিস্তানের ডাঁশা তরুণীগণকে ইসলামি রাষ্ট্রের প্রকাশ্য রাজপথে ও অন্যত্র নামানো এবং নাচানো হতো পুরণো সংবাদপত্র থেকে আমরা তার কিছু বিবরণ দিচ্ছি। (বিমান- বন্দরে সংবর্ধনার জন্য অফিসারদের মেয়ে পাঠাতে বলা হতো, কেউ পাঠাতে সক্ষম হতেন, কেউ অসম্মত হয়ে বিরাগভাজন হতেন। এসব কথা তখন সংবাদপত্রে বেরোয় নি, কিন্তু বিস্তারিত ভাবে বলার সময় একদিন আসবে।) 

১৯৬৭ সালের ২১ আগস্ট তারিখে আইয়ুব এসেছিলেন পাঁচদিনের জন্য পূর্ব- পাকিস্তান সফরে। উপলক্ষটা ছিল চাঁদপুরের আই-ডব্লিউ-টি-এর টার্মিনাল এবং চট্টগ্রামের ইস্পাত কারখানা উদ্বোধন। ২২ আগস্ট তারিখে ঢাকা থেকে চাঁদপুর যাওয়ার পথে তাঁকে যে তরুণী-সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল ২৩ আগস্ট তারিখে ‘পাকিস্তান অবজার্ভর’ পত্রিকায় তার নিম্নরূপ বিবরণ বেরিয়েছিল: 

তরুণীরা নেচে নেচে গান গেয়ে ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে এবং হাততালি দিয়ে নারায়ণগঞ্জ ঘাটে প্রেসিডেন্টকে সম্বর্ধনা জানায়…. নদীপথ বরাবর…. নদীর দু’তীরেও পল্লী-তরুণীদের নাচতে এবং গান গাইতে দেখা যায়।

“পাথ-ফাইন্ডার” ষ্টিমার থেকে প্রেসিডেন্ট যখন নামলেন তখন স্কুলের ইউনিফর্ম- পরিহিতা একদল ছাত্রী তাঁর পথে ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে দিল। প্রেসিডেন্টকে সংবর্ধনা জানাবার জন্য কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট গার্লস স্কুল থেকে এই ছাত্রীদের আনা হয়েছিল। 

২৪ আগস্ট তারিখে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরেও তরুণীদের দ্বারা একইভাবে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। অধিকন্তু মেয়েদের দ্বারা ফুলের পাপড়ি ছড়ানো যথেষ্ট চমকপ্রদ মনে না হওয়ার একটি বিমান চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের উপরে ঘুরে ঘুরে ফুলের পাপড়ি বর্ষণ করেছিল। 

২৩ আগস্ট তারিখে ঢাকায় প্রেসিডেন্ট-ভবনে আইয়ুব খান এক বুদ্ধিজীবী- সমাবেশে মুসলিম সংস্কৃতি-চর্চার জন্য উদাত্ত আহবান জানান। ২৪ আগস্ট তারিখের “পাকিস্তান অবজার্ভার” পত্রিকায় পাঁচ-কলম ব্যাপী শিরোনাম দিয়ে এই বক্তৃতা ছাপা হয়েছিল। শিরোনামের কথাগুলি ছিল “আপহোন্ড মুসলিম কালচার।” ঐ বক্তৃতার পাশে, ঐ শিরোনামের নীচেই ছাপা হয়েছিল নারায়ণগঞ্জ ষ্টিমার-ঘাটে সংবর্ধনারতা সুসজ্জিতা ডাঁশা-তরুণীবেষ্টিত আইয়ুব খানের ছবি। 

ষ্টিমার ঘাটে-নদীতীরে-পথিপার্শ্বে ডাঁশা তরুণীদের নাচিয়ে রাষ্ট্রপ্রধান অথবা যে- কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তির সংবর্ধনা কোনো সংস্কৃতি নয় একথা বলতে গিয়েও এক মুহূর্তের জন্য থমকে যেতে হয়, মনে হয়, হয়তো এইটেই মুসলিম সংস্কৃতি অর্থাৎ “তমদ্দুন”- কেননা পরের দিনই সেই সংবর্ধিত রাষ্ট্রপ্রধান বাজে লোকদের সমাবেশে নয়, বুদ্ধিজীবীদের সমাবেশে উদাত্ত ভাষায় মুসলিম তমদ্দুন “আপহোন্ড” করতে বলছেন। এবং ঐ সংবর্ধনার প্রয়োজন যাঁরা করেছিলেন তাঁদের শিরোদেশে ছিলেন স্বয়ং মোনেম খান, যিনি মুসলমান মেয়ের কপালে টিপ দেখলেই হিন্দু-সংস্কৃতিপনার জন্য তিরস্কার করতেন- যদিও শাড়ী কোন্ ইসলামি দেশের পোষাক তা কোনো তমদ্দুনপন্থীই আজ পর্যন্ত বলেননি। (মোনেম খান হয়তো এটাও জানতেন না যে বিহার অঞ্চলের মুসলিম মেয়েরা, এবং ঢাকার মীরপুরের বহু মুসলিম অবাঙালি মহিলা সিঁথিতে সিঁদুর দিয়ে থাকেন)। অতএব অন্তত এক মুহূর্তের জন্য ধরা যেতে পারে রাস্তায় রাস্তায় ডাঁশা তরুণীদের নাচিয়ে গাইয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সংবর্ধনা মুসলিম তমদ্দুনেরই পরিচয়: কিন্তু তাহলে প্রশ্ন ওঠে, ইসলামি রাষ্ট্রে এ কোন্ ধরনের সাম্য যে সেই সংবধিবিশিষ্ট ব্যক্তির নিজ এলাকায় তাজা-তরুণীদের দ্বারা কখনো তাঁর অনুরূপ সংবর্ধনার ব্যবস্থা করা হয়নি এবং তাঁর নিজ এলাকায় তরুণীদের ঐ মহৎ তমদ্দুন-চর্চা থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছিল এবং এ কোন্ ধরনের প্যারিটি যে যখন কেন্দ্রীয় চাকুরির ব্যাপারে পূর্ব-পাকিস্তানি তরুণেরা প্যারিটির অভাবের জন্য অভিযোগ করছিল তখন ঐ ব্যক্তির নিজের এলাকার মেয়েদের টেক্কা দিয়ে এ-প্রদেশের মেয়েরা কর্তাভজার সুযোগ পেয়ে গেল? 

কিন্তু এটা কোনো সংস্কৃতি নয়, আমরা আগেই বলেছি এ একটা বিকৃতি, অথবা দুর্নীতি। ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানের মনোরঞ্জনের জন্যই তাঁর সহকারীরা এ আয়োজন করেছিল। এ ছাড়াও আইয়ুবী আমলে উচ্চপদস্থ অফিসারেরা কিরূপ দুর্নীতি-আসক্ত ছিলেন, এহিয়ার আমলে ৩০৩ জন অফিসারকে বরখাস্ত করা থেকেই তা বোঝা যায়। এঁদেরও উচ্চতর এবং নিম্নতর পর্যায়ে অসংখ্য দুর্নীতিবাজকে শাস্তি দেওয়া হয়নি এটাও স্বীকৃত সত্য। আমরা এসব ঘটনার উল্লেখ করে বলতে চাই: রাষ্ট্র-ব্যবস্থাপনার উচ্চতম মহলে, ইসলামের দুর্গের অভ্যন্তরে ইসলামের আবরণেই দুর্নীতির কীট সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। যেহেতু পারে, যেহেতু ইসলামি রাষ্ট্রেও ইসলামের অপব্যবহার সম্ভব, এই কারণে নির্যাতিত বঞ্চিত মানুষ রাষ্ট্র-ব্যবস্থাপনায় প্রশাসকবর্গের সঙ্গে সঙ্গে ইসলামের প্রতিও সন্দিহান হয়ে উঠতে পারে। ইউরোপে আমেরিকায় এসব কারণে ধর্মের প্রতিও অসংখ্য মানুষ বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছে। আর এই কারণেই রাষ্ট্র-ব্যবস্থাপনা থেকে ধর্মকে স্বতন্ত্র রাখাই সঙ্গত। 

অবশ্যই অনেকে আইয়ুবী জমানাকে ইসলামি রাষ্ট্রের জমানা বললেন না, কিন্তু এও তো ঠিক অনেক ইসলামি রাষ্ট্রবিদ একেই ইসলামি রাষ্ট্র বলে স্বীকার করে নিয়েছিলেন? মওলানাদের রাষ্ট্রপরিকল্পনা অন্য রকম হতে পারে; কিন্তু একথা কোনো ক্রমেই বলা চলে না যে মওলানাগণ কোনো সর্বসম্মত রাষ্ট্র পরিকল্পনা প্রণয়নে সমর্থ। ইসলামি রাজনীতি অর্থনীতি রাষ্ট্র ইত্যাদি সংক্রান্ত বিষয়ে আবহমানকাল ধরে যাঁরা ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করে এসেছেন, সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় প্রায়শই যাঁদের বিতর্ক প্রকাশিত হয় তাঁদের পক্ষে তা সম্ভব নয়। রাষ্ট্রের মতো জটিল ব্যাপার দূরে থাক, মুসলমানের সংজ্ঞা সম্পর্কেই তাঁরা একমত নন; মুসলমানত্ব এবং অমুসলমানত্বের চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে গিয়েই তাঁরা পাঞ্জাবে সংঘর্ষ বাধিয়ে তুলেছিলেন। মুসলমান বলতে কী বোঝায় সে সম্বন্ধে প্রাপ্ত আলেমদের জবাব সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে পাঞ্জাব গোলযোগ তদন্ত আদালত তাঁদের রিপোর্টে বলেছেন: “প্রত্যেক আলেমের মতো আমরাও যদি আমাদের নিজস্ব একটা সংজ্ঞা দিতে চাই এবং সে সংজ্ঞা যদি অন্য সব আলেমদের দেওয়া সংজ্ঞা থেকে আলাদা হয়, তবে বিনা মতভেদে আমরা ইসলাম- বহির্ভূত হয়ে যাই; এবং যদি আমরা যে-কোন আলেমের সংজ্ঞা গ্রহণ করি, তাহলে তাঁর মতে আমরা মুসলিম থাকি; কিন্তু অন্য সবার মতে কাফের হয়ে যাই”।[৩৫] 

কিন্তু শুধু কাফের হলেই ইসলামি রাষ্ট্রে নিস্তার নেই। “ইসলামি রাষ্ট্রে ধর্ম পরিবর্তনের শাস্তি হচ্ছে মৃত্যু,” এই অভিমতের আলোচনা প্রসঙ্গে তদন্ত আদালত বলেছেন, এক মজহাব বা মতাবলম্বীর মতে অন্য সব মজহাব ও মতাবলম্বী কাফের, “এ-সবের মোট ফল এই দাঁড়িয়েছে যে শিয়া, সুন্নী, দেওবন্দী আহলে হাদিস, ব্রেলভী- কেহই মুসলিম নয়; ইসলামি রাষ্ট্রে এর কোনো এক বিশ্বাস থেকে অন্য বিশ্বাসে পরিবর্তন করলেই তার শাস্তি অবশ্যই মৃত্যু- যদি রাষ্ট্রের ক্ষমতা এমন দলের হাতে থাকে যাঁরা অন্য দলকে কাফের বলে মনে করেন।” [৩৬] 

ইসলামি রাষ্ট্রে সত্যি সত্যি এ-রকম ব্যাপার নাও ঘটতে পারে; ইসলামি রাষ্ট্রবাদীরা যে পরস্পর কতটা বিভক্ত এবং তাঁদের মতামত যে বিরূপ উদ্ভট এইটেই হয়তো তদন্ত আদালত বোঝাতে চেয়েছেন। কিন্তু ও-রকম ব্যাপার একেবারে অসম্ভব নাও হতে পারে; ১৯৫৩ সালে পাঞ্জাবে তা সম্ভব হয়েছিল। 

ইসলামি রাষ্ট্রবাদীদের মতামতের উগ্রতা শেষ দিকে কমে এসেছিল। কিন্তু তাদের এবং বস্তুত সকল পশ্চিম-পাকিস্তানির মতামতের আবার আরেকটি দিক ছিল মুসলমান হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানি মুসলমানদের মর্যাদা সম্পর্কে তারা অনেকে তাদেরকে নিম্নশ্রেণীর মুসলমান মনে করতো। ফিরোজ খান নুন এবং আইয়ুব খান কতকটা খোলাখুলিভাবেই সেকথা বলেছিলেন। একাত্তরে পশ্চিম-পাকিস্তানিরা প্রায় সকল পূর্ব- পাকিস্তানিকে কাফের বানিয়ে ফেলেছিল। আর এই কারণেই ঐ বছরে সম্ভব হয়েছিল অতো নিষ্ঠুরতা এবং পাশবিকতা। একাত্তরের পঁচিশে মার্চের পর ইসলামি রাষ্ট্রের প্রকৃত স্বরূপ উদ্‌ঘাটিত হয়েছে। যা ছিল বিরোধী লেখক ও রাজনীতিকদের সাধ্যের বাইরে, ইসলামি রাষ্ট্রের নায়ক ও সৈনিকেরা পঁচিশে মার্চের পর বহু গুণ দক্ষতার সঙ্গে তার নগ্নরূপ প্রকাশ করে দিয়েছে।

তথ্যসূত্র :
১. পাকিস্তান সরকার কর্তৃক গঠিত তালিমাত-ই-ইসলামিয়া বোর্ডের শাসনতান্ত্রিক সুপারিশসমূহ এবং বিভিন্ন আলেম কর্তৃক ব্যক্ত ইসলামি রাষ্ট্র সংক্রান্ত মতবাদ ঘর্তব্য। উল্লিখিত বোর্ডের সুপারিশসমূহের জন্যে Leonard Binder প্রণীত Religion and Politics in Pakistan (University of California Press, U.S.A) দ্রষ্টব্য। তিনি পাকিস্তান সরকারের দলিলপত্র থেকে সুপারিশসমূহ তাঁর গ্রন্থের পরিশিষ্টরূপে মুদ্রি করেছেন। ইসলামি রাষ্ট্র সম্বন্ধে বিদেশে প্রকাশিত পুস্তকসমূহের মধ্যে এটিই বোধ হয় সব থেকে সুলিখিত এবং প্রামাণ্য। এ সম্বন্ধে একজন আমেরিকান লেখকের উৎসাহ লক্ষণীয়।
২. যথা ১৯৪৯ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে গৃহীত আদর্শপ্রস্তাব, ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র, সংশোধিত আইয়ুবী শাসনতন্ত্র ইত্যাদি
৩ ‘সামাজিক সুবিচার’, ‘মুসলমানেরা স্বাধীনভাবে জীবন-যাপন করতে পারবে’, ইত্যাদি কয়েকটি কথা ছাড়া। জিন্নাহ সাহেব এবং আরও কোনো কোনো নেতা ‘একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের’ কথাই বরং বলেছিলেন, ইসলামি রাষ্ট্রের কথা নয়।
8 পাকিস্তান আন্দোলনে আলেমদের বিরোধিতার ঈষৎ বিস্তারিত বিবরণের জন্য দ্রষ্টব্য “১৯৫৩ সালের পাঞ্জাবের গোলযোগ সম্পর্কিত তদন্ত আদালতের রিপোর্টের সংক্ষিপ্তসার”, পাকিস্তান সরকারের ঢাকাস্থ আঞ্চলিক প্রচার-দফতর কর্তৃক প্রকাশিত (১৯৫৪)। এরপর আমরা সংক্ষেপে এর উল্লেখ করব “পাঞ্জাব গোলযোগ তদন্ত রিপোর্ট” বলে। ইংরেজীতে এ আদালত এবং রিপোর্টকে যথাক্রমে মুনীর কমিশন এবং মুনীর রিপোর্টও বলা হয়। এ-প্রবন্ধে এ-সম্পর্কিত উদ্ধৃতিসমূহের ভাষা উক্ত সংক্ষিপ্ত বাংলা সংস্করণের। ৫ “পাঞ্জাব গোলযোগ তদন্ত রিপোর্ট”, পৃঃ ৪। ৬ Md. Wahiduzzaman প্রণীত Toward Pakistan. App2ridDS ৫৫৭০ 24 2:55 ডক্টরেট থীসিমূলক গ্রন্থ।
৭ পূর্বোক্ত গ্রন্থে উদ্ধৃত। K. Callard প্রণীত Pakistan A Political Study গ্রন্থেরও ২০২ পৃঃদ্রঃ।
৮. L. Binder প্রণীত Religion and Politics in Pakistan. ৯৩ পৃষ্ঠা, উদ্ধৃতি।
৯. K. Callard প্রণীত Pakistan, A Political Study, ১৯৯০-২০০ পৃষ্ঠা, উদ্ধৃতি।
১০. পাঞ্জাব গোলযোগ তদন্ত রিপোর্ট, ৩৪ পৃষ্ঠা।
১১. পাঞ্জাব গোলযোগ তদন্ত রিপোর্ট, ৩৫-৩৬ পৃঃ।
১২. Pathway to Pakistan, ৩২০-২১ পৃঃ
১২ (ক) অবশ্য জিন্নাহ সাহেব এ নিয়ে আর উচ্চবাচ্য করেননি। হয়তো তিনি মনে মনে আপোষ করেছিলেন। তবে ঐ তারিখে হঠাৎ তিনি সেকুলারিস্ট হলেন কেন তার কয়েকটি কারণ থাকতে পারে। চৌধুরী খালিকুজ্জামানের গ্রন্থ পড়ে মনে হয়, অদূর ভবিষ্যতে পাঞ্জাবে একটা ভয়াবহ দাঙ্গা হতে যাচ্ছে এরূপ আভাস জিন্নাহ সাহেব পেয়েছিলেন এবং বিশেষ করে গোটা ভারতের মুসলিম সংখ্যালঘুদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধেই তিনি চিন্তিত হয়ে উঠেছিলেন। তাই তিনি সেকুলারিজমের কথা বলে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন। কোনো কোনো বৃটিশ লেখকের অভিমত, পাকিস্তান থেকে যাবতীয় অমুসলিম পুঁজিপতি পুঁজি প্রত্যাহার করে চলে যাবে এটাও তিনি চান নি, কেননা সেটা পাকিস্তানের পক্ষে ক্ষতিকর। তিনি চাচ্ছিলেন, যে-সব হিন্দু-পার্সি ইত্যাদি অমুসলিম পুঁজিপতি পাকিস্তানে পুঁজি বিনিয়োগ করেছিল তারা থেকে যাক।
১৩. Democracy, Liberty, Equality, Fraternity. Social Justice.
১৪. দ্রষ্টব্য স্বাধীনতা উত্তরকালীন জিন্নাহ সাহেবের বক্তৃতা ও বাণীসমূহের সংকলন Speeches as Governor General of Pakistan 1947-48, পাকিস্তান সরকার কর্তৃক প্রকাশিত।
১৫. Speeches as Governor General of Pakistan, ১৪ পৃষ্ঠা। ১৬. Speeches and writing of Mr. Ginnah, শেখ মোহাম্মদ আশরাফ, লাহোর, কর্তৃক প্রকাশিত। দ্বিতীয় খণ্ড, ২৩২ পৃষ্ঠা। “What the League has done is to set you free from the Reactionary elements of Muslims ……. It has certainly freed you from the undesirable elements of Moulavi & Moulana” মোহাম্মদ নোমান কৃত Muslim India, ৩৩৮ পৃষ্ঠা।
১৮. পাঞ্জাব গোলযোগ তদন্ত রিপোর্ট, ৩৬ পৃঃ। ১৯. পাঞ্জাব গোলযোগ তদন্ত রিপোর্ট, ৫৬ পৃঃ। ২০. দৈনিক ‘পূর্বদেশ’, ১৯ অক্টোবর, ১৯৬৯।
২১. পাঞ্জাব গোলযোগ তদন্ত রিপোর্ট, ৩৬ পৃঃ।
২১. (ক) পাঞ্জাব গোলযোগ তদন্ত রিপোর্ট, ৪২ পৃষ্ঠা।
২২. পাঞ্জাব গোলযোগ তদন্ত রিপোর্ট, ৪৪ পৃষ্ঠা। ২৩. ঐ, ৪৪ পৃষ্ঠা।
২৪. ঐ, ৫০ পৃষ্ঠা।
২৫. ঐ, ৫২-৫৩ পৃষ্ঠা।
২৬. ঐ, ৫৪ পৃষ্ঠা।
২৭. ঐ, ৫৫ পৃষ্ঠা।
২৮. পাঞ্জাব গোলযোগ তদন্ত রিপোর্ট, ৫৫ পৃঃ
২৯. দৈনিক ইত্তেফাক, ১৫ই অক্টোবর ১৯৩৯
২৯. (ক) মুক্তিযুদ্ধের সময় মওলানাদের এই ইচ্ছা প্রায় পূর্ণ হয়েছিল আর কি। বাংলাদেশ থেকে কোটিখানেক বাঙালি ভারতে গিয়েছিল; মুক্তিযুদ্ধ না হলে আরো বাঙালি বিতাড়িত হতো এবং ভারত থেকে অবাঙালি জনস্রোত এসে বাংলাদেশ প্লাবিত করে দিত, বাঙালির ফিরে আসার পথ বন্ধ হয়ে যেত এবং এইভাবে বাঙালির চরম সর্বনাশ হতো।
৩০. Pakistan is a Mushim State and it must have as its lingua franca the language of the Muslim Nation [The Mover) should realize that Pakistan have been created because of the demand of a hundred million Muslim in the Sub-continent and the language of a hundred million Muslim is Urdu…… It is necessary for a nation to have one language and that language only be Urdu and no other language (italis mine)…. Constituent essembly of Pakistan. Debata, Vol. II. Feb. 25 1948. পৃঃ ১৫। উদ্ধৃতি: Keith Callard প্রণীত Pakistan: a Political Study.
৩১. পাকিস্তান অবজার্ভার, ৪ অক্টোবর, ১৯৬৯। ৩২. “….any one who has any respect for the spirit of democrasy connot ignore that (the) movement of Pakistan was supported by one hundred million (Muslims) who had no political or economic ambition but had deep respect and admiration for Islamic way of life.” Concept of national Integration. Morning News. 14 August, 1966.
৩৩. দ্রষ্টব্য Speeches and Statements of Ayub Khan, পাকিস্তান সরকার কর্তৃক প্রকাশিত, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ৪২-৪৪ পৃঃ।
৩৪. পাকিস্তান অবজার্ভার, ২১ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৮।
৩৫. পাঞ্জাব গোলযোগ তদন্ত রিপোর্ট, ৪৯ পৃঃ।
৩৬. পাঞ্জাব গোলযোগ তদন্ত রিপোর্ট, ৪৯ পৃঃ।

Leave a Comment

error: Content is protected !!