মধ্যবিত্তদের অপভাষা এবং জনগণের লড়াই

সাধারণভাবে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত অপভাষা বা অপশব্দ (ইংরেজি: Slang) পছন্দ করে না। বাংলাদেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত অনেকটা রাবীন্দ্রিক শুদ্ধতাবাদী। সামন্তবাদ ক্ষয়িষ্ণু হলে এবং নিম্নবিত্ত অশিক্ষিত মানুষ শহুরে হলে মধ্যবিত্তের ক্ষমতার বদলে পপ কালচার বা জনসংস্কৃতির প্রভাব বাড়লে অপভাষা বা অপশব্দের ব্যবহার বাংলাদেশের সমাজে বেড়েছে। বিশেষভাবে ফেসবুকে অপভাষা যথেষ্ট ব্যবহৃত হয়।

বাংলাদেশের এই টাকাপূজারি সমাজে টাকার নানা কিসিমের ভূমিকায় কিছু মানুষ সামাজিক প্রচার মাধ্যমে জনপরিচিতি পায়। সেই পরিচিতরা আবার একেকটা দেশের প্রতিনিধি হয়ে পরিচিতিগিরি ফলায়। সেরকম বাংলাদেশের এক পরিচিত ব্যক্তি হলো ড. ইউনুস বেপারি যে ব্যবসাকে সামাজিক করে টাকাকে নিজ পশ্চাতে সেলাই করেছে। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের পরে ছাত্রদের সুবিধাবাদী অংশটি তাকেই বাংলাদেশের প্রধান চেয়ারটাতে বসিয়ে দেয়।  

আরো পড়ুন

দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পুরষ্কার পেয়ে ফিলিম-টিভির নায়ক-নায়িকারাও মাঝে মধ্যে দেশের মুখ উজ্জ্বল করে। সেরকম মুখ উজ্জ্বল করা এক ব্যক্তি হচ্ছে তাপস বাল। নায়ক নামের নর্দমার কীটটা ২০১৪ সালে সিপিএমের নারীদের ধর্ষণ করতে পাঠাচ্ছিলো তার চ্যালাদের।[১]

একদিন শুনলাম বাংলাদেশের মহামানব ক্রিকেটার আশরা বাল কী এক দোষে দশ বছরের জন্য নিষিদ্ধ হলো। আবার পরে দেখি সাকি বাল ছয় মাসের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। তাকে শাস্তি দিছে পাপন আর আকরাম বাল। তবে বাংলাদেশে সব চেয়ে বড় যে BAL, হচ্ছে বাংলাদেশ আওয়ামি লিগ, তারা ছিল আমাদের সব কিছুর নিয়ন্তা।

বাংলাদেশে গত গত চার দশকে প্রতিক্রিয়াশীলদের সবচেয়ে বিখ্যাত কবি হিসেবে জনপ্রিয় ছিল বাল মাহমুদ। সে একসময় জায়নামাজে বসে নারীধর্ষণের স্বপ্ন দেখত বলে কৌতুক করেছিলেন হুমায়ুন আজাদ। প্রায় ৮ সন্তানের জনক বাল মাহমুদ গোটা দুনিয়াকে ভোগ করতে গিয়ে জামাতে ইসলামির পা চেটে জীবন নির্বাহ করেছে।

আর অতি বিখ্যাত এক বালের কথা না বললে বাঙালি মধ্যবিত্তের বালপ্রিয়তা অসমাপ্ত থেকে যাবে। সেই বিখ্যাত লোকটি হচ্ছে BAL-এর উপদেষ্টা জাফ্রিক বাল। তার বালের সাহিত্য এবং বাল ফিকশন গত দুই দশকে মধ্যবিত্ত ছাগুদের কাঁঠালপাতা হিসেবে কাজে লেগেছে ব্যাপকভাবে।

এই যে বালময় বাংলাদেশ তার নিয়ন্তা হলো সর্ব শক্তিমান পুঁজি। এই পুঁজির বিরুদ্ধে কোনো কথা কী কোনো এক এক সেলিব্রেটি বালও উচ্চারণ করে। যে ফুটবল ও ক্রিকেট আজ ব্যবসা আর মুনাফার পা চাটতেছে তার দীর্ঘ জিহ্বা দ্বারা, তা কী দেশপ্রেমের কোনো ধার ধারে। এই বালের খেলা কি কোনো শ্রমিক, কৃষকের খেলা হয়েছে। গরিবেরা কী কোনো খেলায় অংশ নিতে পারে? বাংলাদেশের কোনো শহরে কী খেলার মাঠ আছে? শহরগুলোতে একটু হাঁটার রাস্তাও যেখানে নাই সেখানে মধ্যবিত্ত বেকুবেরা খেলায় অংশগ্রহণ করা তো দুরের কথা একটু স্বচ্ছন্দে হাঁটতে বা দৌড়াতেও পারে না। এরকম খেলায় এই পুঁজির ধামাধরা বালের খেলোয়াড়েরা ধ্বংস হয়ে গেলেও জনগণের কিছু যায় আসে কী?

স্যামুয়েল জনসন (১৭০৯-১৭৮৪) বলেছিলেন ‘প্যাট্রিয়োটিজম ইজ দ্য লাস্ট রিফিউজ অফ দ্য স্কাউন্ড্রেল’ বা ‘বদমায়েশদের শেষ আশ্রয়স্থল হচ্ছে দেশপ্রেম’। তো এই দেশপ্রেমি বদমাশ সেলিব্রেটি গণশত্রু বালেরা যত তাড়াতাড়ি ধ্বংস হয় ততই মঙ্গল।

প্রেম আর ক্ষমা দিয়ে বাচ্চা কিংবা পুননৈকট্য হতে পারে কিন্তু শ্রেণিসংগ্রাম ও সমাজবিপ্লব হয় না। জনগণের ভুলকে অসীম ক্ষমায় দেখলে জনগণের কাছ থেকে শেখা এবং তাদেরকে শেখানোর কাজটি বাদ পড়ে যায়। আর গণশত্রুদের ক্ষমা করে দেয়ার অর্থই হলো জনগণের বিপক্ষে দাঁড়ানো। আর জনগণের ক্ষুদ্রতাকে কী ভালোবেসে আলিঙ্গন করা যায়?

যারা শুধু মানববাদ, মানবমুক্তি, মানবপ্রেম ইত্যাদির কথা বলেন তারা শ্রেণির কথা আড়াল করেন। তারা আড়াল করেন শ্রমিক কৃষকের লড়াইয়ের কথাও। শ্রেণিবিভক্ত সমাজে শুধু ‘মানুষ ধরলে মানুষ ভজলে’ প্রলেতারিয়েতের মুক্তি পিছে পড়ে যায়।

আসল বিষয় হচ্ছে, লেখকের লেখা জনগণের কাজে লাগলো কিনা? জনগণের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কত হাজার পৃষ্ঠা আধুনিক কবি বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন? আজকে বাঙলার কটা তরুণ ঐ কবিরে চেনে? আজকের উত্তরাধুনিকতাবাদী কবিরা এবং কিছুকাল আগের কতিপয় আধুনিকতাবাদী কবিরা তাদের দুনিয়ায় তারা নিজেরাই হিরো সেজে জীবিতকালে মহাকবি সেজে বগল বাজালেও ঐসব রদ্দি ভুষি জনগণের কোনো কাজে লাগে না বিধায় সেগুলো তার কবি গোত্রের সদস্যরা ছাড়া কেউ ফিরেও দেখে না। এইসব কবি নামক গোত্র সদস্যদের জনগণ করুণাও করে না। কারণ জনগণ যুদ্ধে আছে, আর এই সুবিধাবাদী কবিরা আছে জনগণবিরোধিতায়।

শুধু মানুষ দেখে গেলে আর সমাজ দেখা হয় না, শ্রেণি দেখা হয় না। শ্রমিকেরাও পচা শামুক এড়িয়ে চলে। ঐসব জনগণবিরোধী রদ্দি ভুষি উদ্ধারের জন্য কোনো হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এবং গোয়ালঘর এই পৃথিবীতে থাকে না।

এতসব কথা বলার একটি কারণ হচ্ছে ঢাকার বালপ্রিয় লেখককুল ভাবালুতাকে ইতিহাস বানায়।  ভাবালুতাপ্রিয় লড়াইহীন মধ্যবিত্তকে বুঝতে হলে তাদের বাগাড়ম্বরগুলো একটু দেখা দরকার।

আমরা যারা শ্রেণিসংগ্রামের রাজনীতিতে যুক্ত, যারা প্রলেতারিয়েতের মুক্তির জন্য কাজ করতে চাই, তারা এই একুশ শতকের প্রথম দশকের উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের কিছু বৈশিষ্ট্য জানতে পারবো সেসব ছেলেমেয়েদের দেখে যারা কেবল শরীর নিয়ে বাঁচে। একুশ শতকের প্রথম দশকের উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের কিছু বৈশিষ্ট্য জানতে পারবো এইসব শরীরী ছেলেমেয়েদের দেখে। তারা জানিয়ে দেবে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের সংকটটা কোথায়। এরা যেন শরীরঅলা অশরীরী কিছু মানুষ যারা প্রেতের মতো এই দুনিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।

আমার মনে পড়ছে পুতুল নাচের ইতিকথার একটি উক্তি ‘শরীর, শরীর, তোমার মন নাই কুসুম’। এরা যেন অশরীরী সেই প্রেতাত্মা যারা বিবেক, দায়িত্ব, জ্ঞান, মন সবকিছুকে বিলুপ্ত করে দিয়ে মৌজের ভেতর এক নিরর্থক শরীরী জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে।

কমিউনিস্টদের গালি সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে সে ব্যাপারে আমাদের চিন্তা করার আছে। কারণ গালির বিপক্ষে দাঁড়ানো মানে শ্রমিক কৃষকের সামান্য ক্ষমতার বিপক্ষে দাঁড়ানো যা মার্কসবাদী লেনিনবাদি নীতি নয়। শ্রমিক কৃষক যখন বিদ্রোহ করতে পারেন না, তখনই তারা হয়ত সামান্য একটু গালি দিয়ে নিজেদের হাল্কা করেন। গালিকে খারাপ মনে করার সুবিধাবাদী নীতিটি মূলত রাবিন্দ্রিক সাংস্কৃতিক মার্জিত ভাষাচিন্তা থেকে এই বাঙলার ভুয়া-কমিউনিস্টদের ভেতরে ঢুকেছে। তবে জনগণকে কোনোভাবেই গালি দেয়া যাবে না।

গালি শুধুমাত্র ভুয়া-কমিউনিস্ট, সংশোধনবাদি, সুবিধাবাদি, কথিত মুক্তমনা নামধারি এবং বুর্জোয়া এবং সাম্রাজ্যাবাদের দালালদের প্রাপ্য। দালাল বুর্জোয়া শ্রেণি ও তার লেজুড়রা প্রতিনিয়ত শ্রমিক শ্রেণিকে নানাভাবে কথ্য অকথ্য অশালীন ভাষায় গালি দিচ্ছে, শারীরিক মানসিক নির্যাতন চালাচ্ছে। সেখান শ্রমিক যদি অশালীন শব্দ চয়ন করে ধনীদের উদ্দেশ্যে কথা বলে তাতো তার ক্ষোভের বর্হিপ্রকাশ মাত্র। এতে দোষের খুব বেশি কিছু নেই।

যে মানুষ আসমানে থাকে, তারা গালি দেয় না, কিন্তু যে মানুষ জমিনে আছে, শ্রেণিভিত্তিক সমাজে আছে, ওই মানুষ তো গালি দেবেই। ফলে উদার মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে আমরা শ্রদ্ধা জানাতে পারি, কিন্তু তা নিয়ে আগাতে পারি না।

যুক্তিহীন ব্যক্তিগত গালাগাল সমাজে আছে। তবে বিশ্লেষণমূলক আলোচনায় লেনিন যে ভাষায় সুবিধাবাদী, সংশোধনবাদীদের আক্রমণ করেছেন, কোথায় কোথাও গালিও দিয়েছেন তার এক দশমাংশও আমরা দেই না। ভুয়া কমিউনিস্টদের বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তুলতে লেনিন ঐসব গরুর গা ভালোমতো ধুইয়ে দেয়াই উচিত, এটাই লেনিনবাদী নীতি। তবে, ‘ব্যক্তিক দোষত্রুটিকে যারা অতিক্রম করতে চায়, তাদেরকে সহানুভূতির সাথে সহায়তা করতে হবে।

সংস্কৃতি যদি উপরিকাঠামো হয়, তাহলে উন্নততর সংস্কৃতি নির্মাণ করতে হলে ভিত্তি পাল্টাতে হবে, নতুবা চেষ্টাটা হবে সাময়িক এবং ব্যর্থ। কলতলার কাজিয়া পেটি বুর্জোয়া হিংসার প্রকাশ বা সামন্তীয় সংস্কৃতির ভূমিদাসের আর্তনাদ হতে পারে। কিন্তু যারা গালির বিরোধিতা করছেন রুচি-সংস্কৃতির কথা তুলে তারা আসলে প্রলেতারিয়েতের শ্রেণিযুদ্ধ, শ্রেণিসংগ্রাম, কর্তৃত্ব ইত্যাদি মহত্তম কাজগুলোকে চেপে যাচ্ছেন, কারণ এগুলো গালির চেয়ে শতগুণ শক্তিশালী। এটুকু মনে রাখা দরকার সংস্কৃতি দিয়ে অর্থনীতি বদলায় না, বরং অর্থনীতিই সংস্কৃতির নির্ধারক। গালিটা তেমন কোন সমস্যা মনে হয় না। সমস্যার সমাধানটা হচ্ছে কাকে গালি দিচ্ছি, তা নির্ধারণ করতে পারবার দক্ষতায়।

তথ্যসূত্র

১. শুভজ্যোতি ঘোষ, বিবিসি বাংলা, দিল্লি, ২ জুলাই ২০১৪, ইউআরএল: https://www.bbc.com/bengali/news/2014/07/140702_mb_tapas_paul_rape_delhi_action রচনাকাল ১৪ জুলাই, ২০১৪, চৌরঙ্গী মোড়, ময়মনসিংহ।

Leave a Comment

error: Content is protected !!