প্রাচ্য স্বৈরতন্ত্র এবং তার অনুসারীরা সাধারণভাবে জনগণের সংগেই কেবল অনৈক্য করে তাই নয়, তারা জনগণের বিভিন্ন অংশের সংগেও অনৈক্য জিইয়ে রাখে। স্বৈরতন্ত্র শক্তি অর্জন করে অনৈক্য করে, আর সাম্যবাদীরা শক্তি অর্জন করে ঐক্য করে। একটি উদাহরণ দেয়া যাক, যেমন ১৯৭২ সালে মওলানা ভাসানী মুজিবকে জাতীয় সরকারের কথা বললে মুজিব খুব নোংরাভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাত। একবার মুজিব বলেছিল, আপনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন, জাতীয় সরকার হয়ে যাবে।
২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানেও ডানপন্থীরা একই কাজ করেছে। জাতীয় সরকারের কথা শুরুতেই বলা হয়েছিল, কিন্তু বৈষম্যবিরোধী মেধাবীরা শোনেনি। মার্কিনপন্থী এই সরকার বামপন্থীদের শত্রু জ্ঞান করে দূরে সরিয়েছে। আনু মুহম্মদের মতো দেশপ্রেমিককে এই মেধাবীরা চোখে দেখেনি। মাঝেমাঝে কেউ কেউ ছাত্রজনতার ঐক্যমত্যের সরকার বা জাতীয় সরকার গঠনের কথা গত ছয় মাসে বলেছে। কিন্তু জাতীয় সরকারের কথা কোনো গুরুত্ব পায়নি।
তবে সব আমলেই স্বৈরতন্ত্র অনৈক্য করতে পারঙ্গম ছিল। জুলাই অভ্যুত্থানের পরে প্রথমে ডানপন্থীরা মাইর দিয়ে আহত করে আদিবাসীদের। এরপর বিভিন্ন মিছিলে পুলিশ বামপন্থী ও বামপন্থী ছাত্রদের আহত করে। এতে প্রথমেই অনৈক্য তৈরি করে ডানপন্থীরা। আনু মুহম্মদের নেতৃত্বের সংগে অনৈক্য করে ডানপন্থীরা পুরোনো স্বৈরতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনছে।
তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম গত ২১ মার্চ ২০২৫ তারিখে অভ্যুত্থানের জাতীয় ঐক্য কারা ভাঙলেন সেই প্রশ্ন উত্থাপন করে এবং অনেকগুলো কথা ফেসবুকে লেখে। সে লেখে, ‘বিভাজনের পথ বেয়েই আওয়ামী লীগ আসবে’।[১] অর্থাৎ এরাও জুজু দেখাচ্ছে, আওয়ামী লীগ দেখাত মৌলবাদীদের, এরা দেখাচ্ছে আওয়ামী লীগের জুজু। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে উপদেষ্টা মাহফুজসহ সরকারের সব উপদেষ্টারা অনৈক্য সৃষ্টি করছে। বাস্তবে জুলাই অভ্যুত্থানের এই ঐক্য রক্ষায় বামপন্থীরা অনেকগুলো বাস্তব উদ্যোগ নিয়েছিলো; বলা বাহুল্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের সংকীর্ণ গোষ্ঠীস্বার্থেই এই ঐক্য তারা ধ্বংস করেছে। আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পাতি নেতাদেরকে আবার পেছনের ঘটনাগুলো মনে করিয়ে দিতে চাই।
বাংলাদেশে গত প্রায় হাজার বছর প্রাচ্য স্বৈরতন্ত্রী শাসন চালু রয়েছে। এই স্বৈরতন্ত্র জনগণের মধ্যে অনৈক্য করেই টিকে থেকেছে। গত পাঁচ দশক এই স্বৈরতন্ত্র এক ভয়ংকর শাসনের ধারাবাহিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়। আওয়ামি লিগের দীর্ঘ স্বৈরতন্ত্রী শাসনের বিপরীতে এদেশের মানুষও দীর্ঘ লড়াই করেছেন। দীর্ঘ লড়াইয়ের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরতন্ত্রী হাসিনার পতন হয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থান বাংলাদেশের জনগণের সমস্ত বিভাজন ভেঙে দিয়ে হাসিনার বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলো। আর এই ঐক্য টিকিয়ে রাখাকে বাংলাদেশের সাম্যবাদী, সমাজতন্ত্রী ও বামপন্থীরা সবসময় অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। কিন্তু অভ্যুত্থানের পরদিন থেকেই অভ্যুত্থানের রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে বিভেদের পথে ঠেলে দেয় ডানপন্থিরা এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বরা। শুরুতেই এই নঞর্থক প্রভাব পড়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর মাঝে।
১৩ আগস্ট, ২০২৪ তারিখে ছাত্র সংগঠনগুলোর সাথে বৈঠকে বসে লিয়াজোঁ কমিটি। সেই বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বিষয়ে ছাত্র সংগঠনগুলো মতামত দেয়।[২] সেখানে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে অন্তত ২ মাস টিকিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত হয় এবং পরবর্তীতে প্রয়োজনে এই সময় আরো বর্ধিত করা যেতে পারে সে প্রস্তাবনাও রাখা হয় তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কি ধরণের কর্মসূচী গ্রহণ করবে, ঐক্যমত্যের ভিত্তি কি হবে সেসব বিষয়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর মতামত নেবার কথা জানানো হয়। কিন্তু পরবর্তী দুমাসে তারা এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেনি। আলোচিত সেই বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লিয়াজোঁ কমিটির পক্ষে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, সাবেক উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামসহ অন্য সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন।
পরবর্তীতে ঢাকার কলেজগুলোর ২৫ নভেম্বর ২০২৪ তারিখের সংঘর্ষের ঘটনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন পুনরায় ছাত্র সংগঠনগুলোর সভা আহ্বান করে; জরুরী পরিস্থিতি বিবেচনায় অত্যন্ত কম সময়ের আহ্বানে সে বৈঠকে ছাত্র সংগঠনের উল্লেখযোগ্য অংশ অংশগ্রহণ করে। সেই বৈঠকে জাতীয় ছাত্র সংহতি সপ্তাহ ঘোষণা করা হয়। সেই বৈঠকেই ছাত্র সংগঠনগুলোর দুজন করে প্রতিনিধি নিয়ে ছাত্র ফেডারেশনের পক্ষ থেকে ছাত্ররা জাতীয় ছাত্র কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন; যা সেখানে উপস্থিত ছাত্র সংগঠনগুলো সমর্থন করে। পরবর্তী বৈঠকে সেটার গঠনতন্ত্র ও এর কার্যাবলী নির্ধারিত হবার কথা ছিলো। কিন্তু পরবর্তী বৈঠকের দিনে কোনো ছাত্র সংগঠনকে না জানিয়ে ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে প্রধান উপদেষ্টার সাথে বৈঠকে শুধু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দলনের নেতারা অংশ নেন। এমনকি বৈঠকটি যে অনুষ্ঠিত হচ্ছে না সেটা জানানোর সৌজন্যতাও তারা অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের সাথে দেখান নি। যার প্রতিবাদে পরেরদিন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা বৈঠক ছাত্র সংগঠনগুলো (শিবির বাদে) বয়কট করে এবং পরের দিন ২৮ ছাত্র সংগঠন একটি মতবিনিময় সভা করে সেই সভা থেকে সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের আহ্বান জানানো হয়। সেই বৈঠকের প্রতিক্রিয়ায় উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ছাত্র সংগঠনগুলো আমন্ত্রণ জানানোর কথা বললেও পরবর্তী সময়ে সেটি করা হয় নাই।
এর ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সময়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে অভ্যুত্থান সংগঠিত করতে কাজ করা ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দকে হয় ছাত্র সংগঠন বা ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’র মাঝে একটিকে বেছে নিতে বলা হয়। সেসময় এই অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তৎকালীন নেতৃত্ব তো বটেই এমনকি ছাত্র উপদেষ্টাদের কারো কারো সাথেও কথা বলেও কোনো ফল হয় না, যা ফেসবুক লেখায় সৈকত আরিফ নামের ছাত্র ফেডারেশনের এক নেতা উল্লেখ করেছেন।[৩] এইখানে মজাটা দেখুন, ঠিক মুজিবীয় স্বৈরতন্ত্র যা জনগণের ভেতরে অনৈক্য জিইয়ে রাখত; মুজিব যেমন বলেছিল, আওয়ামী লীগে যোগদান করলেই জাতীয় ঐক্য হয়ে যাবে। অর্থাৎ হয় মুজিবের দলে যাও, নতুবা তফাত যাও।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব ও ছাত্র উপদেষ্টাগণ এটি অস্বীকার করলেও এরপরে ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বে থাকা কাউকে আর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে থাকতে দেয়া হয় নাই অথচ এই ঐক্য টিকিয়ে রাখতে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের ছাত্রনেতৃত্বদের ব্যাপক আগ্রহ দেখা গেছে। এর মধ্য দিয়েই অভ্যুত্থানের শহীদের রক্তের উপরে গড়ে উঠা ঐক্যকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পাতি নেতারা ভেঙেছে। এর পিছনে তাদের উদ্দেশ্যও ছিলো অত্যন্ত স্পষ্ট, সকলকে বের করে দিয়ে যারা থাকবে তাদের নিয়ে রাজনৈতিক দল গঠন করার তাদের দরকার ছিল। সেই দল তারা জাতীয় নাগরিক পার্টি নামি আরো একটি স্বৈরতন্ত্রী পার্টি তারা শেষ পর্যন্ত গঠন করেছে। কিন্তু ৫ আগস্টের পরে যে দায়িত্ব তারা নিয়েছিল তা পালনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিলো অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠা ঐক্যকে রক্ষা করা কিন্তু সেই ঐক্য রক্ষায় তারা মনোযোগ দেয়নি। কারণ ডানপন্থী গণশত্রুদের ইতিহাস হচ্ছে জনগণকে বিভক্ত করো এবং শাসন করো, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের গর্ভজাত এই রুগ্ন সংগঠন জাতীয় নাগরিক পার্টিও স্বৈরতন্ত্রের যে ধ্বজা বাংলাদেশে ওড়াতে চাইছে তা ধ্বংস হবেই।
রচনাকাল ২৪ মার্চ, ২০২৫।
তথ্যসূত্র:
১. যুগান্তর প্রতিবেদন, “বিভাজনের পথ বেয়েই আ.লীগ আসবে, বিরোধ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হোন: মাহফুজ”, ২১ মার্চ ২০২৫, দৈনিক যুগান্তর, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.jugantor.com/national-others/932226.
২. বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক, ১৩ আগস্ট ২০২৪, “ঢাবিতে সব ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠক”, ঢাকাপোস্ট, অনলাইন নিউজ পোর্টাল, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.dhakapost.com/campus/298779.
৩. সৈকত আরিফ, ২২ মার্চ ২০২৫, শিরোনামহীন ফেসবুক পোস্ট, ইউআরএল: https://web.facebook.com/saikatarif00/posts/2858892584272458
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা উনিশটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।