আল ফারাবি বা আল ফারাবীর (ইংরেজি: Al-Farabi; ৮৭২-৯৫০ খ্রি.) সম্পূর্ণ নাম হচ্ছে আবু নসর মুহাম্মদ আল ফারাবি। তিনি একজন প্রখ্যাত প্রথম দিককার ইসলামী দার্শনিক এবং ফকীহ ছিলেন যিনি রাজনৈতিক দর্শন, অধিবিদ্যা, নীতিশাস্ত্র এবং যুক্তিবিদ্যার ক্ষেত্রে লেখনী চর্চা করেছিলেন। তিনি একজন বিজ্ঞানী, মহাজাগতিক, গণিতবিদ এবং সংগীত তাত্ত্বিকও ছিলেন।[১]
দর্শনের ইতিহাসে ইনি আল ফারাবী নামেই সুবিখ্যাত। ইসলামি দর্শনে আল ফারাবীকে সর্বশ্রেষ্ঠ ভাববাদী দার্শনিক বলে মনে করা হয়। মুসলিম দার্শনিকগন মনে করতেন, আল ফারাবীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ যদি কেউ থাকেন তিনি হচ্ছেন গ্রিক দার্শনিক এ্যারিস্টটল। মুসলিম দার্শনিক আল কিন্দী আল ফারাবীকে নিঃসন্দেহে ইবনে সীনা এবং ইবনে রুশদ-এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে স্বীকার করেছেন। আল ফারাবীর রচনাসমূহ জার্মান এবং ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়ে বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে।[২]
মোহাম্মদ আল ফারাবির আসল নাম হচ্ছে আবু নসর ইবনে মোহাম্মদ আল ফারাবি। আল ফারাবি ৮৭০ খ্রিস্টাব্দে তুর্কি সভ্যতার পীঠস্থান ফারাব শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জাতিতে তুর্কি ছিলেন। এ জন্য ফারাবি আল তুর্কি উপাধি ব্যবহার করতেন। তাঁর সম্পর্কে যতদূর জানা যায় তিনি ফারাবেই তঁর বাল্যজীবন ও শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করেন। অতঃপর তিনি বুখারায় কাজীর পদে নিযুক্ত হন। ঘটনা বৈচিত্রে তাঁর জীবন ছিল পরিপূর্ণ। তিনি জ্ঞান অর্জনের অদম্য বাসনা নিয়ে বাগদাদ শহরে গমন করেন। জ্ঞান বিজ্ঞানের কেন্দ্রভূমি বাগদাদে তিনি ৪০ বছর অতিবাহিত করেন। সেখানে তিনি বিভিন্ন শাস্ত্রে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি আরবী ও গ্রীকভাষা আয়ত্ত করেন। তিনি জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে অনেক দেশ ভ্রমন করেন।
আল ফারাবি রচনাবলি
আল ফারাবি দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, চিকিৎসা, সঙ্গীত, গণিত প্রভৃতি বিষয়ের উপর শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি সর্বপ্রথম ইসলামি তর্কশাস্ত্র ও ইসলামি বিশ্বকোষ রচনা করেন। তিনি ইসলামি দর্শনের জনক স্বরূপ ছিলেন। রাষ্ট্রতত্ত্বের উপর তাঁর নিম্ন লিখিত গ্রন্থগুলো খুবই উল্লেখযোগ্য যথাঃ আলমদিনাতুল ফাজিলাহ বা আদর্শ রাষ্ট্র, আলমদিনাতুল মাদানিয়া বা নগর রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা, জওয়ামিনুস সিয়াসাত, ইজতিমাউ মাদানিয়া, খাওয়ামি নিয়ামত।
উল্লেখ্য গ্রন্থগুলো ছাড়াও ফারাবি এরিস্টটলের দর্শন উত্তম রূপে পাঠ করেন এবং এরিস্টটলের পলিটিকস্ ও লজিকের উপর বিশ্লেষণ মূলক পুস্তক রচনা করেন। জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তিনি বিচরণ করলেও মূলত গ্রিক দর্শন সম্পর্কে তাঁর গভীর জ্ঞানই তাঁকে অমরত্ব দান করেছে। তিনি সিয়াসত ও আরা গ্রন্থে রাষ্ট্র সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে বিচার বিশ্লেষণ ও আলোচনা করেছেন।[৩]
আল ফারাবি প্লেটোর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘রিপাবলিক’ এবং ‘লজ’ বা ‘বিধান’-এর উপর নিজের অভিমত লিপিবদ্ধ করেন। আল ফারাবির সমধিক বিখ্যাত গ্রন্থের নাম হচ্ছে ‘উত্তম রাষ্ট্রের অধিবাসীদের ভ্রান্তি সম্পর্কিত গ্রন্থ’। এ গ্রন্থ আদর্শ নগর বা ‘মদিনাল ফাজিলা’ বলেও আখ্যাত। গ্রন্থের নামকরণ এবং বিষয়বস্তু থেকে বুঝা যায়, প্লেটো যেমন ‘রিপাবলিক’ বা আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনা করেছিলেন, আল ফারাবিও তেমন একটি আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনা করেছিলেন। আল ফারাবির আদর্শ রাষ্ট্র প্লেটোর রাষ্ট্রের ন্যায় সাধারণ মানুষের অসাধ্য বোধ হতো না। প্রকৃত পক্ষে আল ফারাবি যে সমস্ত মুসলিম রাষ্ট্রকে কার্যকর দেখেছে, তাদের উন্নত করার উদ্দেশ্য নিয়ে নিজের আদর্শ রাষ্ট্র কল্পনা করেছিলেন।
খ্রিস্টাব্দের নবম এবং দশম শতকে মুসলিম রাষ্ট্রসমূহে, বিশেষ করে বাগদাদে গ্রিক দর্শনের বিশেষ চর্চা হতো। এই সময়ে গ্রিসের প্লেটো এবং এ্যারিস্টটলের রচনাবলীর আরবি অনুবাদ হতে থাকে। আল ফারাবি প্রধানত শিক্ষালাভ করেন বাগদাদের এ্যারিস্টটল-এর দর্শন শিক্ষাদানকারী খ্রিষ্টান বিদ্যাকেন্দ্রে। প্লেটোর দর্শনের নতুনতর ব্যাখ্যাদাতা প্লাটিনাস-এর ব্যাখ্যার প্রভাবও আল ফারাবিকে এত প্রভাবিত করেছিল যে, উপরোক্ত দর্শনের এই দুই স্তম্ভ আল ফারাবী কাউকে বর্জন করতে পারেন নি। এ কারণে আল ফারাবি প্লেটো এবং এ্যারিস্টটলের সামঞ্জস্যের বিষয়ে একখানি পুস্তক রচনা করেন। আল ফারাবি শিক্ষাগত জীবনে কেবল দর্শনের চর্চা করেন নি। তিনি সে-যুগের জ্ঞানের অন্যান্য শাখাও আয়ত্ব করার চেষ্টা করেন। পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা এবং সঙ্গীতের বিচিত্র শাখাতে তিনি পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন।
ফারাবী শেষ জীবনে সিরিয়ার আলেপ্পাতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং জ্ঞান সাধনায় নিমগ্ন হন। তিনি প্রাচ্যের দ্বিতীয় মহাগুরু হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। ৯৫০ খ্রিস্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসূত্র
১. অনুপ সাদি, ২২ মার্চ ২০১৯, “আল ফারাবী ইসলামি দর্শনে এক গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক” রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/biography/al-farabi/
২. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; ৫ম মুদ্রণ জানুয়ারি, ২০১২; পৃষ্ঠা ৩৪-৩৫।
৩. হাসানুজ্জামান চৌধুরী, মো আব্দুর রশীদ, এ এমদাদুল হক ও অন্যান্য; রাষ্ট্রবিজ্ঞান দ্বিতীয় খণ্ড, রাষ্ট্রচিন্তা, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা, ত্রয়োদশ প্রকাশ, ২০২০, পৃষ্ঠা ৮৯।
রচনাকাল ২২ মার্চ ২০১৯, নেত্রকোনা, বাংলাদেশ।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।