মওলানা ভাসানী ছিলেন মজলুম জনগণের সাম্রাজ্যবাদবিরোধি নেতা

মওলানা ভাসানী বা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী (ইংরেজি: Abdul Hamid Khan Bhashani; ১২ ডিসেম্বর, ১৮৮০ – ১৭ নভেম্বর, ১৯৭৬) ছিলেন বিশ শতকের ব্রিটিশ ভারতের অন্যতম তৃণমূল রাজনীতিবিদ ও গণআন্দোলনের নায়ক, যিনি জীবদ্দশায় ১৯৪৭-এ সৃষ্ট পাকিস্তান ও ১৯৭১-এ প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি বাঙলার মানুষের কাছে ‘মজলুম জননেতা’ হিসাবে সমধিক পরিচিত।[১]

মওলানা ভাসানী যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন উপমহাদেশের মানুষ সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হয়ে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত হওয়ার আন্দোলন সংগ্রামে অগ্রসর হচ্ছিল। আর তাই জননেতা ভাসানী একদিকে যেমন জমিদার মহাজনদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন অন্যদিকে তেমনি ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন। আসামের লাইনপ্রথা, দেশবিভাগের পর পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামেও তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তায় তাঁর অবদান কিছুটা গুরুত্বপূর্ণ।[২]

মওলানা ভাসানীর জন্ম, শৈশব ও শিক্ষা

ব্রিটিশ-ভারতে পাবনা জেলার একটি মহকুমা ছিল সিরাজগঞ্জ। প্রমত্তা যমুনা নদীর তীরে সিরাজগঞ্জ শহরের অদূরে ধানগড়া গ্রামে ১৮৮০ সালে (মতান্তরে ১৮৮৫) এক সাধারণ মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে মোহাম্মদ আবদুল হামিদ খান জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা হাজী শরাফৎ আলী খান এবং মাতা মোসাম্মদ মজিরন বিবি। তিনি ছিলেন চার ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয়। শৈশবে মাতাকে হারিয়ে অসহায় আবদুল হামিদ খান চাচা ইব্রাহিম খানের আশ্রয়ে কিছুকাল লালিতপালিত হন। তার শৈশবের জীবন ছিল ছন্নছাড়া। তিনি গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে বেড়িয়েছেন, আনাহারে দিন কাটিয়েছেন, অজানা-অচেনা মানুষের গৃহে আশ্রয় নিয়েছেন। যমুনা নদীতে জেলে নৌকায় কেটেছে তার কত রাত। মাছ ধরেছেন জেলেদের সঙ্গে। মাঠেঘাটে ক্ষেতখামারে কাজ করেছেন কৃষকের সঙ্গে।[৩]

আবদুল হামিদ খানের পিতা ছিলেন ধর্মপরায়ণ, ন্যায়নিষ্ঠ, শিক্ষিত ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। যে কারণে আবদুল হামিদ খান ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। তবে অস্থির স্বভাবের আবদুল হামিদ খানের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনার বাধাধরা নিয়ম ভালো লাগত না। চাচার আগ্রহে মাদ্রাসায় ভর্তি হলেও লাঠি খেলা, গান গাওয়া, বৃক্ততা নকল করা ইত্যাদি গুণের কারণে তার কিছু শ্রোতা ও গুণগ্রাহী জুটে যায়।

বিদ্যাশিক্ষার জন্য আবদুল হামিদ খান ইরাক থেকে আগত আধ্যাত্মিক সাধক সৈয়দ নাসির উদ্দিন বোগদাদীর সাহচর্য পান এবং পীর সাহেব তাকে আসামে নিয়ে যান। এই আধ্যাত্মিক গুরুর কাছে তিনি আরবি-ফারসি, কুরআন, হাদিস, ফিকাহ প্রভৃতি বিষয়ের জ্ঞানার্জন করেন। কঠোর পরিশ্রমী ও ধর্মের প্রতি অনুরাগী আবদুল হামিদের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে নাসির উদ্দিন বোগদাদী তাকে ইসলাম ধর্মীয়শাস্ত্রে জ্ঞান অর্জনের জন্য দেওবন্দে পাঠান। কিন্তু দেওবন্দে গিয়ে তার বিদ্যাশিক্ষার চেয়ে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামী রাজনৈতিক দীক্ষাই বেশি হয়। তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বহু ইসলামি চিন্তাবিদের সংস্পর্শে আসেন এবং নিপীড়িত মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে সংগ্রামী চেতনায় উজ্জীবিত হন।

তার জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে আসামে এবং সংগ্রামী ভূমিকার কারণে কেটেছে কারাগারে। তিনি ১৯২৫ সালের শেষের দিকে জমিদার শামসুদ্দিন আহমদ চৌধুরীর প্রথমা কন্যা বেগম আলেমা খাতুনকে বিবাহ করেন। বেগম আলেমার গর্ভে তিন পুত্র ও দুই কন্যা জন্মগ্রহণ করে।

মওলানা ভাসানীর মৃত্যু

তিনি একদিকে যেমন কৃষকদের দুঃখ-দুর্দশা, জমিদার জোতদার শ্রেণির অত্যাচার-নির্যাতন স্বচক্ষে দেখেছেন তেমনি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির শোষণ-বঞ্চনার চিত্র প্রত্যক্ষ করেছেন। কাজেই তাঁর রাজনৈতিক জীবনে এ সকল ঘটনা রেখাপাত করেছে একথা বলা যায়। তিনি ছিলেন এদেশের মাটি ও মানুষের সাধারণ নেতা। তিনি উৎপীড়িতের দরদি বন্ধু। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি অনেক সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ১৭ নভেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এই দেশ বরেণ্য নেতা মৃত্যুবরণ করেন।

তথ্যসূত্র

১. অনুপ সাদি, ৩০ অক্টোবর ২০১৭, “মজলুম জনগণের সাম্রাজ্যবাদবিরোধি নেতা মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক চিন্তাধারা” রোদ্দুরে ডট কম, লিংক: https://www.roddure.com/biography/bhashani/.
২. সৈয়দ আবুল মকসুদ, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী; বাংলা একাডেমী, প্রথম প্রকাশ, মে ১৯৯৪ ঢাকা পৃষ্ঠা-১৪
৩. অধ্যাপক একেএম শহীদুল্লাহ ও এম রফিকুল ইসলাম, প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা, গ্রন্থকুটির ঢাকা, প্রথম পুনর্মুদ্রণ জানুয়ারি ২০১৮/১৯, পৃষ্ঠা ২৬৪-২৬৫।

Leave a Comment

error: Content is protected !!