মাহমুদুল আমীন খাঁন ছিলেন মালেমাবাদের লড়াকু সৈনিক

মাহমুদুল আমীন খাঁন (৯ জানুয়ারি ১৯৪৭-২২ জুন ২০১৯) ছিলেন শিক্ষক, বুদ্ধিজীবি, বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনের বিপ্লবী, মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদের আদর্শে বিশ্বাসী এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এই আদর্শের প্রতি আস্থাশীল একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি। রাজনৈতিক জীবনে তিনি ছিলেন নয়া গণতা‌ন্ত্রিক গণ‌মোর্চার জাতীয় ক‌মিটির সদস্য ও‌ ময়মন‌সিংহ জেলা শাখার সহ-আহ্বায়ক।

ব্যক্তিগত জীব‌নে মাহমুদুল আমীন খাঁন ছি‌লেন আত্মপ্র‌তিষ্ঠা বিমুখ, নিরহঙ্কারী সহজ সরল একজন মানুষ। তি‌নি আনন্দ‌মোহন ক‌লেজ, মুক্তাগাছা সরকারি ক‌লেজসহ বি‌ভিন্ন ক‌লে‌জে অধ্যাপনা ক‌র‌লেও শেষ জীব‌নেও কষ্টকর অভাবী জীবন‌কেই বে‌ছে নি‌য়ে‌ছি‌লেন। অন্যায়-জুলু‌মের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছি‌লেন সারা জীবন। ষা‌টের দশ‌কের বিপ্লবী রাজনী‌তি যেসব ছাত্র-বু‌দ্ধিজী‌বি‌দের তা‌ড়িত ক‌রে‌ছিল তা‌দের মা‌ঝে মাহমুদুল আমীন একজন। সত্তরের দশ‌কের প্রথম দি‌কে কম‌রেড সিরাজ সিকদার প্রতিষ্ঠিত পূর্ব বাংলার সর্বহারা পা‌র্টির সা‌থে সম্পৃক্ত হন।

মাহমুদুল আমীন খাঁনের জন্ম ১৯৪৭ সালের ৯ জানুয়ারি। পেশাগত জীবনে অধ্যাপক মাহমুদুল আমীন খাঁন লিবিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। পরবর্তীতে জগন্নাথ কলেজ, আনন্দমোহন কলেজ, মুক্তাগাছা সরকারি কলেজসহ বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতা করেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাথে যুক্ত ছিলেন। ৬৭ সালে ছাত্র ইউনিয়ন বিভক্তির সময় তিনি মেনন গ্রুপের সাথে যুক্ত থাকেন। এ সময় ক্রুশ্চেভ সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই হলে একই সময়ে থেকে রাজনীতি করতেন অধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ ও মাহমুদুল আমীন খাঁন।

মাহমুদুল আমীন খাঁন ২২ জুন ২০১৯ তারিখ শ‌নিবার দুপু‌রে ময়মন‌সিংহ শহ‌রের মাদ্রাসা কোয়ার্টারস্থ নিজ বাসায় মৃত্যুবরণ ক‌রে‌ন। তি‌নি দীর্ঘ‌দিন ফুসফু‌সের জ‌টিলতাসহ বার্ধক্যজ‌নিত নানান অসু‌খে ভুগ‌ছি‌লেন। মৃত্যুকা‌লে তাঁর বয়স‌ হয়েছিল বাহাত্তর বছর। তাঁকে ২২ জুন শহ‌রের না‌সিরাবাদ ক‌লে‌জি‌য়েট স্কুল মা‌ঠে জানাজা শে‌ষে‌ মাদ্রাসা‌ কোয়ার্টার গোরস্তা‌নে উনার মর‌দেহ কবরস্থ করা হয়।

একটি ভিডিও দেখুন

মাহমুদুল আমীন খাঁনের স্মরণে নয়াগণতান্ত্রিক গণমোর্চা ময়মনসিংহ জেলা শাখার আয়োজনে গত ১৩ জুলাই ২০১৯ ময়মনসিংহ মহানগরীর মুসলিম ইন্সটিটিউট মিলনায়তনে বেলা ৩ টা ৩০ মিনিটে শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। শোক সভায় সভাপতিত্ব করেন মোর্চার জেলা শাখার আহ্বায়ক আবুবকর সিদ্দিক রোমেল। সভায় অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকেন মাওবাদী বুদ্ধিজীবী কমরেড আমীনের দীর্ঘ দিনের সহচর অধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ, বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলনের সভাপতি শেখ আবেদ আলি, কৃষক নেতা মোস্তাক আহমেদ মনি, মার্কসবাদী তাত্ত্বিক ও লেখক অনুপ সাদি, মোর্চার কেন্দ্রিয় সংগঠক আকাশ বিশ্বাস ও নয়াগণতান্ত্রিক গণমোর্চার কেন্দ্রিয় সভাপতি জাফর হোসেন। সভায় ময়মনসিংহে আন্দোলন সংগ্রামের সাথে যুক্ত বিভিন্ন বাম সংগঠনের নেতা কর্মীরা উপস্থিত ছিলেনন। তাদের মধ্য বক্তব্য দেন সুবিধাবাদী বাসদের ময়মনসিংহের ইনচার্জ ইমাম হোসেন খোকন, সিপিবি সভাপতি এমদাদুল হক মিল্লাত, বিপ্লবী ওয়াকার্স পার্টির জেলা সাধারণ সম্পাদক মফিদুল ইসলাম সরকার প্রমুখ।

কমরেড আমীনকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ১ মিনিট নিরবতা পালনের মধ্য দিয়ে সভা শুরু হয়। সভার শুরুতে প্রয়াত মাহমুদুল আমীন খানের ছেলে মেহেদী আমীন খাঁন আপেল কথা বলেন। তিনি তাঁর পিতার ব্যক্তি জীবন, ব্যক্তি জীবনে পিতার নিষ্ঠা ও সততা তুলে ধরেন, সবার কাছে প্রয়াতের জন্য দোয়া কামনা করেন। তাঁর দীর্ঘ দিনের বন্ধু, পারিবারিক আত্মীয় চেচুয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক জনাব আমজাদ হোসেন তালুকদার তাঁর বক্তৃতায় আমীন খাঁন সাহেবের ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক ও শিক্ষক হিসাবে তাঁর জীবনের বিভিন্ন অংশ নিয়ে কথা বলেন।

অধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের সহকর্মী মাহমুদুল আমীনের কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তৎকালীন রাজনীতিতে তারা কেমন করে সর্বহারার রাজনীতি করতেন এবং বৈষয়িক সাফল্যের চেয়ে আমীন খাঁনের কাছে রাজনৈতিক জীবন তাঁর ছাত্র জীবন থেকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে গড়ে উঠেছিল– অধ্যক্ষ শহীদের বক্তব্যে এসব কথা উঠে আসে।

আকাশ বিশ্বাস তাঁর বক্তব্যে বলেন, কমরেড আমীন ছিলেন তাঁর মতাদর্শের প্রতি একজন দৃঢ়চেতা মানুষ। তিনি অনেকের সাথেই মিশতেন কিন্তু মতাদর্শিক প্রশ্নে কখনই আপোষ করতেন না। তিনি তাঁর এই যায়গা থেকে প্রেরণা হয়ে থাকবেন। কমরেড আবেদ আলি তাঁর সাথে কাজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। যে কোনো প্রোগ্রামে সঠিক সময়ে যাওয়া, নির্দেশনা দেয়া ইতাদি প্রসঙ্গে তিনি কথা বলেন।

কমরেড জাফর হোসেন তাঁর বক্তব্যে আমীন খানের মৃত্যুকে তাঁর দল নয়াগণতান্ত্রিক গণমোর্চাই শুধু না, শ্রমিক কৃষকের রাজনীতির এক বড় ক্ষতি হিসাবে চিহ্নিত করেন। কমরেড আমীন সবখানেই যেতেন, কিন্তু তিনি সবসময় রাজনৈতিক থাকতেন। তিনি তাঁর মতাদর্শের পথ বিস্তার করতে সব সময় সচেষ্ট থাকতেন। শোকসভায় বাম গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মী ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন কবি সাহিত্যিক বুদ্ধিজিবীরা। তাদের মধ্যে অন্যতম কবি সরকার আজিজ, কবি আশিক আকবর, কথাকার তালুকদার শাখাওয়াত বকুল, কবি সুরঞ্জিত বাড়ৈ, কবি দোলন প্রভা, কবি সৌরভ মাহমুদ প্রমুখ। কবি আশিক আকবর প্রয়াত কমরেডের স্মরণে একটি স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন। সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টায় সভাপতির ভাষণের মধ্য দিয়ে মাহমুদুল আমীন খানের শোকসভার সমাপ্তি ঘটে।

আমার সাথে তার প্রায় সময়ই কথা হয়েছে। উনার সাথে পরিচয় হয়েছে মালগুদামের বাসদ অফিসে। ২০১১ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত প্রায় দশ বছরের পরিচয় ছিল। তিনি অভাবে থেকেছেন, কিন্তু মেরুদণ্ডকে সোজা রেখেছিলেন। বহুদিন তাকে ময়মনসিংহের রাস্তায় আমি হাঁটতে দেখেছি। সঙ্গে দুএকজন ছাত্রও দেখেছি। ছাত্রছাত্রীদেরকে যত্ন নিয়ে ইংরেজি শেখাতেন। বাসায় বাসায় গৃহশিক্ষকতা করেই শেষ জীবনে সংসার চালিয়েছেন বলা যায়। আমি দেখেছি, কমরেড আমীন চলতি ব্যবস্থার আমলাতন্ত্রকে খুব ঘৃণা করতেন। তাঁর পেনশন আটকে ছিল, তবু তিনি ঘুষ দিতে রাজি ছিলেন না, আমলাদের পেছনে যেতে তিনি ঘৃণা করতেন।

আরো পড়ুন

Leave a Comment

error: Content is protected !!