আমাদের সাদি স্যার

  • সেলিম খান, লেখক

অনুপ সাদি স্যারকে আমরা সংক্ষেপে সাদি স্যার ডেকে থাকি। তিনি ২৪তম বিসিএসের মাধ্যমে সরকারি কলেজে শিক্ষকতায় যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি নেত্রকোণা সরকারি মহিলা কলেজে অধ্যাপনা করছেন। তাঁর জন্ম ঠাকুরগাঁও জেলার দামোল গ্রামে। শৈশব ও কৈশোর গ্রামেই কাটিয়েছেন।

স্যারের মা শাহেরা খাতুন একজন স্বশিক্ষিত মহীয়সী নারী। তাঁর দুই পুত্র সন্তান বাংলাদেশের সিভিল সার্ভিসে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা। স্যারের মাকে রত্নগর্ভা মা হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। সদালাপী মিষ্টভাষী নারীদের একজন ছিলেন। স্যারের মা সুরেলা কণ্ঠে গান গাইতে পারতেন। ঘরে বসেই তিনি মাঝে মাঝে মনের সুখে গান ধরতেন; গল্প শোনাতেন। স্যার অত্যন্ত মা ভক্ত। স্যার মুখে সব সময় মায়ের অকুণ্ঠ ভালোবাসা, মায়ের সোহাগ-যত্ন এগুলোর কথা বলেন।

সাদি স্যার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একজন ক্যাডার কর্মকর্তা, আবার ইংরেজি বিষয়ে। বর্তমান সময়ে এমন মানুষের জাঁকজমক আর কৌলীন্য কোনোটাই কম থাকে না। কিন্তু এমন একজন ক্যাডার কর্মকর্তা হয়েও তাঁর পরনের পোশাক আশাকে তেমন কোনো ছাপ নেই। তাঁকে প্রথম দেখে চেনাই মুশকিল যে তিনি ক্যাডার কর্মকর্তা।

সাদি স্যার শুধু ইংরেজি বিষয়ের বিভাগীয় প্রধান বা ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নন। তাঁর প্রতিভা বহুমুখী। স্যারের কথা শুনলে মনে হয়, মগজের পরতে পরতে জ্ঞানের রেখাগুলো ভাঁজ করা রয়েছে। কোত্থেকে কথা আসছে, কথা বলছেন তার কোনো শেষ নেই। শুনতেই ইচ্ছে হয়। কম্পিউটার ল্যাপটপের আদলে গড়া যেন মস্তিষ্ক। স্মৃতি এতো শক্তিশালী যেন গোটা পৃথিবী এর মধ্যে আবদ্ধ। স্যার যদিও ইংরেজিতে শিক্ষিত, বাংলা ভাষায় লেখা তাঁর অনেক কবিতা, গল্প, জীবনকাহিনী রয়েছে। তিনি মা, মাটি ও মানুষের সঙ্গে মিশে কাজ করতে পছন্দ করেন।

আজকাল বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মাইক্রোফোন হাতে পেলে লোকজন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ভাষণ দেয়। কিন্তু এই বিষয়ে স্যার ভিন্ন। উনি মৃদুস্বরে ভেঙ্গে ভেঙ্গে বুঝিয়ে গুছিয়ে বক্তৃতা পেশ করেন। কারো বুঝতে কষ্ট হয় না।

আমরা স্যারকে সুযোগমতো পেলেই কোনো একটা প্রসঙ্গ স্যারের সামনে উপস্থাপন করি। অর্থাৎ স্যারের মুখ থেকে গোছানো ছন্দময় কথাগুলো শোনার জন্য। একটা প্রসঙ্গ তুলে ধরলেই ব্যাস। আর কিছু বলার প্রয়োজন হয় না। স্যার এ প্রসঙ্গটা একেবারে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অকপটে বলে চলছেন আর আমরা শুনছি।

অনুপ সাদির কয়েকটি বক্তৃতা দেখুন

সাদি স্যার এমন মানুষ যিনি অন্যের কথা মন দিয়ে শোনেন। তিনি ম্যাডামকে নিয়ে যে বাসায় থাকেন সেখানে গেলে অবাক না হয়ে স্বাভাবিকভাবে কেউ ফিরতে পারবেন না। একটা সংসারে হাঁড়ি পাতিল থালা বাসন চেয়ার টেবিল আসবাবপত্র ছাড়া চলা যায় না। কিন্তু স্যারের বাসায় ঢুকলেই মনে হবে এটা বোধ হয় বিশ্রামের জায়গা। একটি পানির বোতল ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়বে না। প্রশ্ন জাগবে, এখানে কি কোনো দম্পতি বসবাস করে। ঠিক তাই। বসবাস করলেও এগুলোর প্রয়োজন হয় না। খাবার যখন দরকার, বাহির থেকে নিয়ে আসেন। সঞ্চয় করে রাখার প্রয়োজন হয় না। এমনটা হাজারে-লাখেও দেখা মিলে না। খাট-পালঙ্ক, চৌকি কোনো কিছুর প্রয়োজন হয় না স্যারের। এ যেন এক আজব মানুষ।

স্যারের নিকট থেকে সুন্দর সুন্দর কথা শোনার জন্য হঠাত বলে ফেললাম, আমার বাচ্চাটাকে জিংক ক্যাপসুল খাওয়াতে হবে। উনি বললেন কেন, জিংক ক্যাপসুল কেন? একটা শালগমে কি পরিমাণ জিংক থাকে সেটা জানেন। প্রশ্ন করে বসলেন। এবার উত্তর দেয়া কঠিন। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনলাম, জবাব দেয়ার মতো নয়। এমন আরো অনেক গল্প আছে।

একদিন দুপুর দেড়টার সময় আমি সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছি। বাহিরে যাব নাস্তার উদ্দেশ্যে। স্যারও আমার পিছনে নিচে চলে আসলেন। জিগ্যেস করলেন, কোথায় যাবেন। আমি বললাম নাস্তা করতে বাইরে যাব। স্যার বললেন, চলেন আমিও যাব। দুজনে দুর্গা কেবিনে নাস্তা করলাম। বিল আসলো দুইশ নাকি কত মনে নেই। যা হোক দুজনের খরচটা আমার কাছে বেশি মনে হলো। স্যারকে বললাম টাকাটা বেশি খরচ করে ফেললাম। উত্তরে তিনি বললেন, সরকার এতো টাকা বেতন কি জন্য দিচ্ছে? চলার জন্য এতো টাকা তো লাগে না। খরচ করব না তো কি করব।

সাদি স্যার গল্প, কবিতা, জীবনকাহিনী ইত্যাদি লিখনীতে খুবই পারদর্শী। ইংরেজি, বাংলা দু’ভাষাতেই লিখেন। ক্ষুরধার লিখনী। বিভিন্ন সেমিনারে যোগদান করেন এবং সেগুলোর দলিলাদি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ক্যামেরায় ছবি ধারণ করা স্যারের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কোনো অনুষ্ঠান হলে সেখানকার প্রতিটা ইভেন্টের ছবি তোলা হচ্ছে স্যারের প্রধান কাজ।

নান্দনিক কথাবার্তা, সদালাপী এবং মিষ্টভাষী একজন হাস্যোজ্জ্বল মানুষ তিনি। স্যার বাস্তব জীবনে প্রদর্শন করবার মতো কোনো স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণ করেন না। কিন্তু তাঁর লেখাগুলো স্মৃতিচিহ্ন হয়ে স্তব্ধ বিস্ময়ে নিঃশব্দে রয়ে যাবে সারা জীবন, অনন্তকাল।

আরো পড়ুন

১০-১১ অক্টোবর ২০২২, নেত্রকোণা।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: লেখাটি এনামূল হক পলাশ সম্পাদিত সাহিত্যের ছোট কাগজ অন্তরাশ্রম-এর অনুপ সাদি সংখ্যা, সংখ্যা ৪, পৃষ্ঠা ১১-১২, ময়মনসিংহ থেকে ৩০ নভেম্বর ২০২২ তারিখে প্রকাশিত এবং সেখান থেকে ফুলকিবাজ ডট কমে প্রকাশ করা হলো।

Leave a Comment

error: Content is protected !!