- বাসুদেব বিশ্বাস, আলোচক, অধ্যাপক ও লেখক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি ভর্তির সুযোগ পাই ২০০১-০২ শিক্ষাবর্ষে। বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে একটি ছাঁটাই বা বাছাই পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। যদিও এ পদ্ধতিটিকে অনেকের নিকট লটারিতে পুরস্কার জেতার মতো ব্যাপার বলে মনে হয়। ক, খ, গ, ঘ প্রভৃতি ইউনিটে প্রতি বছর উচ্চ-মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হওয়া প্রায় দেড়-দুই লাখের উর্ধ্বে শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে এ যুদ্ধে। কিন্তু চান্স পায় মুষ্টিমেয় কতিপয় শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া ব্যাপারটি এজন্য অনেকটা লটারির সাথে তুলনীয় ব্যাপার, কারণ কেবল প্রথাগত মেধা থাকলেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়া যায়, এটা নিশ্চিত করে বলার কোনো উপায় থাকে না।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের আশির দশকে জন্ম গ্রহণের পর আমি দেশীয় পাঠশালা-প্রাইমারি স্কুল-মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি টপকে একদম গ্রাম্য জীবন থেকে সরাসরি রাজধানী শহরে অনুপ্রবেশ করি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ লাভের মাধ্যমে। শহর বাসের প্রাথমিক পাঠের ন্যূনতম অভিজ্ঞতা-অভ্যাস কোনোটিই আমার ছিল না। যদিও উচ্চ-মাধ্যমিক পড়েছিলাম খুলনা সরকারি মজিদ মেমোরিয়াল সিটি কলেজে। তখন বসবাস করেছি মূলত খুলনা শহরের রায়ের মহলের কাছে লাইন বিল পাবলা গ্রামে। যদিও আমি মাধ্যমিক পাশ করেছি বাগেরহাট জেলার চিতলমারি থানার বোয়ালিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় হতে ১৯৯৮ সালে। তখন আমি আমার গ্রাম কুড়ালতলায় বাস করতাম। মোটকথা উচ্চ-মাধ্যমিক, মাধ্যমিক স্তরে আমি মূলত গ্রামেই কাটিয়েছি। তবে একজন গ্রাম্য বালকের শৈশব-কৈশোরের প্রতিনিধিত্বশীল কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্য আমার ছিল না।
যখন গ্রামের আমি, শহরের পানে ছুটে চলার প্রস্তুতি-প্রক্রিয়া শুরু করছি তখন আমাদের গ্রামীণ জীবনের সামন্তীয় ব্যাপার-স্যাপারগুলো আমাদের যাপিত জীবনের নানা অভ্যাস, রুচি-সংস্কৃতির মধ্যে বেশ ছিল। যদিও রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে পুঁজিবাদী শাসন বহমানতা লাভ করেছে। উল্লেখ্য, আমার বাবা-মা গ্রামের খোদ ভূমিহীন ক্ষেতমজুর-কৃষক শ্রেণির লোক। কৃষিকাজেও পুঁজিবাদী পদ্ধতিতে চাষাবাদ চালু আছে যদিও আমার বাবা-মা বর্গা চাষের কাজও করেন। এক্ষেত্রে শহরে আমার ভর্তি হওয়া বলে দেয় কোন্ বিশেষ ব্যাকগ্রাউন্ড বা আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে বা ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে বা উচ্চশিক্ষার সনদ লাভে সমর্থ হচ্ছে।
এমন একটি বাস্তবতায় অনার্সে ভর্তির পর আমি দেখেছি বাগেরহাটের চিতলমারি এলাকা থেকে প্রায় আরো চার-পাঁচ জন শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছে। প্রত্যেকের অবস্থা কম-বেশি আমারই মতো। মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক দুটো পরীক্ষার সনদে ফার্স্ট ডিভিশনের (৬০% নম্বর) উপর নম্বর আছে, আর ভর্তি পরীক্ষায় টিকেছে সবাই। আমারই মতো– না গণিত, না ইংরেজি-বাংলা, কোনো বিষয়েই খুব একটা বিশেষ দখল তাদের কারোরই নেই। টেক্সট বইয়ের বাইরে কোনো ধরনের বিন্দুমাত্র পাঠাভ্যাস নেই। কবিতা বা গল্পের বই পড়া নেই, বিতর্ক-আবৃত্তি-বক্তৃতা, অভিনয়, রচনা লেখা এমন কি খেলাধুলার বিশেষ কোনো ইভেন্টেও অংশগ্রহণ নেই। এলাকার ‘ভালো ছাত্র’ এই টাইপের শিক্ষার্থী আর কি! কেবল টেক্সট বই পড়তে পারা, আর তা পরীক্ষার খাতায় লিখে ভালো(!) একটা নম্বর পাওয়া। জীবন-জগতের ভিন্ন কোনো খোঁজ জানার প্রয়োজনও তাদের নেই।
পড়ালেখা শেষে একটা এনজিও-র চাকরি বা অন্তত টিউশনি করে খেতে পারবো এটি আমাদের জীবনের প্রায় একমাত্র লক্ষ্য। স্বাবলম্বী হতে হবে, নিজে উৎপাদন করে অর্থাৎ নিজেই নিজের ভাগ্যের নির্মাতা হয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে হবে এমন ভাবনা কারো মনে জন্ম নেয় নি। ভবিষ্যতে একজন কবি-লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিক, রাজনীতিক, সাংবাদিক বা অভিনেতা প্রভৃতি হওয়ার অভিপ্রায় আমাদের কারো মধ্যে ছিল না। বৃটিশ কলোনি শাসনোত্তর নব্য-উপনিবেশ আমলে এদেশের তরুণ-যুবাদের জীবন-ভাবনা, স্বপ্ন-পরিকল্পনা এমন হওয়ার কথা কি?
এরকম পরিমণ্ডলের মাঝ দিয়ে ভেসে চলা জীবনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর–বিশ্ববিদ্যালয় কী, বিশ্ববিদ্যালয় কেন প্রভৃতি সেসব জানতে হয়েছে বা জানতে শিখেছি মূলত এম.এ. ডিগ্রির সনদ লাভের পর। জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় কেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয় তা আমাদের জিজ্ঞাসায়ও আসে নি কোনো দিন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পড়তে একজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ‘জুনিয়র স্কলার’ কীভাবে জগতের নানা মতের সাথে পরিচিত হতে হতে নিজেই মতামত প্রকাশে গণতান্ত্রিক হয়ে ওঠে বা উঠার পদ্ধতি চর্চা আত্মস্থ করার মতো বিষয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠন-পাঠনকালীন তা আমাদের চেতনার বাইরের ব্যাপারই থেকে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় মূলত সিনিয়র স্কলার ও জুনিয়র স্কলারদের মিলিত জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার সম্মিলিত প্রতিষ্ঠান।
তবে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের পড়াশুনার একটি কার্যকর বুনিয়াদী ভিত্তির অনুপস্থিতির মাঝেও একাডেমিক পাঠ গ্রহণকালীন বা তার পরবর্তী বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া যেসব অগ্রজদের সান্নিধ্যে নিজের বোধ ও বীক্ষণকে সংস্কার-পরিমার্জন-পরিবর্ধন, সর্বোপরি পরিবর্তন করতে সমর্থ হয়েছি, আবার যা মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞান লাভের পদ্ধতি-প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত। জ্ঞান লাভের এ প্রক্রিয়ায় অগ্রজরাও নানাভাবে একজন শিক্ষার্থীকে প্রাণিত করে। কেবল শ্রেণিকক্ষের শিক্ষক বা গ্রন্থাগারের পাঠাভ্যাসের বাইরেও আমি পরিশীলিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম যে-সকল অগ্রজদের সান্নিধ্যে, তাদের মধ্যে অনুপ সাদি মানে সাদি ভাইয়ের কথা উল্লেখ্যযোগ্যভাবে স্মরণীয়।
সাদি ভাই, অরনি অনুপ সাদি, এখন শুধু অনুপ সাদি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে উনার সাথে প্রথম দেখা ২০০৩ সালের দিকে। দেখতে সুদর্শন কোনো চেহারার মানুষ তিনি নন। পাতলা দেহের গড়ন। মাথার চুলও দেহায়বয়ের ন্যায় অনেকটা পাতলা। কাঁধে একটা ঝোলা-ব্যাগ সারাক্ষণ সঙ্গী। কথাবার্তায় দারুণ আক্রমণাত্মক, ক্ষুব্ধ ও অনেকটা বেপরোয়া ধরনের। রাষ্ট্র-রাজনীতি, শিল্প-সাহিত্যের নানা দিক নিয়ে কথা বলে চলেছেন তিনি। বক্রতা-শ্লেষে পরিপূর্ণ ক্ষিপ্রতর বাক্যবিন্যাসে তার সুউচ্চ কথাবার্তার কোনো কোনো বিষয় আমার মাথার উপর দিয়ে যায়। শুরুতে তার সাথে আলাপ করতে একটু ভয়ও হচ্ছিল আমার। তবে চাহনিতে একটা হাসি হাসি ভাব আর নতুনদের প্রাণিত করবার প্রয়াস যা অভয়ও জুগিয়েছিল।
সাদি ভাইয়ের সাথে প্রথম সাক্ষাত মধুর ক্যান্টিনে বামপন্থী-প্রগতিশীলদের টেবিলে, যেখানে উনার সাথে প্রাথমিকভাবে পরিচিত হয়েছিলাম। উনি ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র, উত্তরবঙ্গের মানুষ, আমি বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী, দক্ষিণবঙ্গের মানুষ। ২০০৪ সাল, তখন আমি অনার্স ২য় বর্ষে পড়ি। ঐ বছর টিএসসি সংলগ্ন বাংলা একাডেমি এলাকায় অমর একুশে গ্রন্থমেলা চলাকালে ড. হুমায়ুন আজাদ স্যার মৌলবাদীদের দ্বারা নৃশংস, রক্তাক্তভাবে আক্রান্ত হন। বিবিসির সন্ধ্যার খবর শুনে আমরা ক্ষোভে-ক্রোধে নির্বাক হয়ে গিয়েছিলাম। আবেগাপ্লুত আমি যেন ফুপিয়ে কান্নায় ফেটে পড়ছিলাম। হুমায়ুন আজাদ স্যারকে আমরা ভালোবাসতাম। স্যারের আক্রান্তের ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে আন্দোলন যেন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। আমরা তখন নিয়মিতই ক্যাম্পাসে মিছিল-শ্লোগানে উদ্দীপ্ত সময় পার করেছি। সকালে মিছিল কলাভবনে, দুপুরে সাংবাদিক সম্মেলন মধুর ক্যান্টিনে আর সন্ধ্যায় মিছিল টিএসসি চত্বরে। তারপর বের হচ্ছি পরের দিনের মিছিল-সমাবেশ প্রস্তুতির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে যোগাযোগ করতে।
অনুপ সাদির কয়েকটি বক্তৃতা দেখুন
সাদি ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ বা পরিচয়ের শুরুটা তখন থেকে। এ সময় সাদি ভাইকেও নিয়মিত মিছিলের পাশে বা সমাবেশে দেখেছি। মাঝে-মধ্যে নানা প্রসঙ্গে আমাদের মধ্যে কথাবার্তাও হোতো। সাদি ভাইকেও ঐ আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে দেখে আমি দারুণভাবে আপ্লুত হয়েছি। একদিন উনার হাতে নিজের লেখা কবিতার বই পৃথিবীর রাষ্ট্রনীতি আর তোমাদের বংশবাতি দেখলাম। তার মানে সাদি ভাই রীতিমতো কবি, আমি বিস্মিত হলাম, কেননা উনি কবিতা লেখেন এটা আমি জানতাম না। আমি ক্লাসের পাঠ্য কবিতার বইয়ের বাইরে তখনও কবিতা পড়তে অভ্যস্ত হই নি। তিনি তার কবিতার বইয়ের একটা কপি সৌজন্য সংখ্যা হিসেবে পড়তে দিলেন। কয়েকটি কবিতা পড়ে তখন আমার মনে হয়েছিল–উনার কবিতা ত্রিশের দশকের কবিদের প্রভাব মুক্ত নয়। অর্থাৎ কবি হিসেবে তিনি আধুনিকতাবাদী। পরবর্তীতে উনার উন্মাদনামা, মনোজগতে মঙ্গা উপরিকাঠামোতে লেহেঙ্গা, বৃষ্টির ফোটায় আসে আমাদের ঠোঁটে ঠোঁটে কবিতাবাগান প্রভৃতি কবিতার বইয়ে দেখতে পাই উনি সাম্যবাদী ঘরাণার কবি বা লেখক হয়ে উঠছেন।
এভাবে একদিকে ক্যাম্পাসের চলমান আন্দোলন, অন্যদিকে প্রতি শুক্রবার সকাল দশটার পর ড. আহমদ শরীফ স্যারের ধানমণ্ডির বাসায় ‘স্বদেশ চিন্তা সঙ্ঘে’ আড্ডার জন্য যাওয়া চলছে প্রতিনিয়ত আমাদের। এ আড্ডা আমার জীবনে একটা নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে দিল, আমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণ পর্বে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করলো। বাংলা বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর আবুল কাসেম ফজলুল হক স্যার আড্ডায় সভাপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। অনার্স ১ম বর্ষের ক্লাসে ফজলুল হক স্যারের ক্লাসও আমরা উপভোগ করেছি। চার্বাক সুমন, রণজিৎ সরকার ও আমি নিয়মিত সঙ্ঘে যেতাম। আর সঙ্ঘে গিয়ে নিয়মিত পেতাম সুভাষ ভট্টাচার্য, হাসান ফকরী, ইবাইস আমান, সুরঞ্জিত দা, তাহা ইয়াসিনসহ আরো অনেককে। সাদি ভাইকেও বিশেষভাবে নিয়মিত পেয়েছি সঙ্ঘের আড্ডায়।
বাক্ স্বাধীনতা উদযাপনের একটি দুর্দান্ত স্থান ছিল ‘সঙ্ঘ’। জগত-জীবনের হেন কোনো বিষয় নেই যা এখানে আলোচনার বিষয়বস্তু হতে পারে না। আলোচনা-পর্যালোচনা, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, তুমুল তর্ক-বিতর্ক শেষে সব বিষয়ের একটা রাজনৈতিক সমাধান এখানে খোঁজ করা হোতো। এখানকার প্রায় সবাই মুক্তমনা তবে সাম্যবাদী-প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার মানুষ। বাংলাদেশের কোনো প্রচলিত সাম্যবাদী-কমিউনিস্ট বা বামপন্থী দলের পক্ষে আস্থা স্থাপনকারী কেউ ছিলেন বলে মনে হোতো না। প্রচলিত বাম দলগুলোর প্রতি সঙ্ঘের প্রায় সব সদস্যই দারুণভাবে ক্ষুব্ধ ছিলেন। যদিও ব্যক্তিগতভাবে সঙ্ঘের কোনো কোনো সদস্য তাদের পছন্দের বামপন্থী-কমিউনিস্ট দলের সাথে কোনো না কোনো মাত্রায় যুক্তও ছিলেন।
সঙ্ঘের আড্ডা শেষে কোনো কোনো দিন সাদি ভাইয়ের সাথে নীলক্ষেতে পুরাতন বইয়ের দোকানে বই খুঁজেছি দীর্ঘ সময় ধরে। চারুকলার সামনের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বই দেখতে দেখতে গেছি আজিজ সুপার মার্কেটে। তারপর বিকেলে ‘বিজ্ঞান চেতনা পরিষদের’ আলোচনা চক্রে অংশগ্রহণ করছি। পরে খোঁজ নিচ্ছি ‘সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রের’ পাঠচক্র কবে হবে, কোন বিষয়ের উপর আলোচনা হবে। আবার অন্য একদিন যাচ্ছি বাংলা মটর ‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের’ আলোচনা সভায়। কোনো একদিন শাহবাগ গণ-গ্রন্থাগার চত্বরে যাচ্ছি তারেক মাসুদ বা অন্য কোনো পরিচালকের ফিল্ম ফেস্টিভেলে। অন্যদিন ক্যাম্পাসের লেকচার থিয়েটার ভবনের আরসি মজুমদার অডিটরিয়ামে যাচ্ছি অন্য কোনো সেমিনারে অংশ নিতে। সাথে সাথে খোঁজ রাখছি বিজনেস ফ্যাকাল্টির অডিটরিয়ামে কবে, কোন্ সংগঠনের সেমিনার বা আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। তারপরে বিকেলে পল্টনে মুক্তাঙ্গনে বামপন্থীদের ডাকা কোনো না কোনো প্রতিবাদ-কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করছি।
নানা ব্যস্ততার মাঝে প্রতি শুক্রবারে ‘স্বদেশে’র আড্ডা আমাদেরকে দারুণভাবে টানতো। সাদি ভাইকে পেতাম নানা বিষয়ে তার তেজদীপ্ত, উদ্দীপ্ত, কখনো সখনো উত্তেজিত, তথ্য-প্রমাণ-দলিলসহ অভিমত ব্যক্ত করতে। কোনো একদিন শুনেছি–তসলিমা নাসরিন, দাউদ হায়দার, সালমান রুশদি, হুমায়ুন আজাদ বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে আহমদ শরীফের উগ্র নাস্তিকতা প্রচারের মাধ্যমে আমাদের রাষ্ট্র-সমাজের কতটা ক্ষতি হয়েছে। সাদি ভাইয়ের মতামতে উঠে এসেছে তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি–রাষ্ট্রের নিজস্ব কোনো ধর্ম নেই, ধর্মীয় রীতি-পদ্ধতি চর্চা ব্যক্তির একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। রাষ্ট্র কোনো বিশেষ ধর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা বা বিশেষ সুযোগ দিতে পারে না। পরে দেখেছি তার অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তার পরিণত রূপ উনার সম্পাদিত বাঙালির ধর্মরিপেক্ষতাবাদ নামে একটি চমৎকার সংকলন গ্রন্থে।
কোনো একদিন নারী মুক্তি প্রসঙ্গে আলোচনায় বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, বেগম রোকেয়া, শরৎ চন্দ্র, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, হুমায়ুন আজাদ, তসলিমা নাসরিন, দাউদ হায়দার, সেলিনা হোসেন প্রমুখের লেখার প্রসঙ্গ তুলে নারীবাদ প্রসঙ্গে মার্কসীয় পদ্ধতির ব্যাখ্যা প্রথা-শাস্ত্র-সংস্কার মুক্ত হয়ে আলোচনা করতে। আলোচনায় তার মতামতে উঠে এসেছে নারাী-পুরুষের সম্পর্ককেও দেখতে হবে উৎপাদন সম্পর্কের আধারের মধ্য দিয়ে। তিনি তার বক্তব্যে নারী-পুরুষের সম্পর্ক সমতা ও ন্যায্যতা ভিত্তিক সম্মান-মর্যাদাময় ও প্রেমপূর্ণ সম্পর্ক হিসেবে তুলে ধরছেন। এখানে সাদি ভাইকে একজন নারীবাদী হিসেবেও খুঁজে পেয়েছি। নারী শিরোনামে তাহা ইয়াসিনকে সাথে নিয়ে উনি একটা গুরুত্বপূর্ণ বইও সম্পাদনা করে বের করেছেন।
বাংলাদেশের বামপন্থী-ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো তাদের পার্টির অভ্যন্তরে কোন অর্থে কতটা গণতন্ত্র চর্চা করছে, জনগণের সত্যিকার কল্যাণ করার জন্য কোন ধরনের গণতন্ত্র সত্যিকার অর্থে প্রয়োজন তা নিয়ে সঙ্ঘে নানাদিন চুলচেরা বিতর্ক-বিশ্লেষণ হয়েছে। উনাকে তখন ইউরোপীয় বুর্জোয়া মানবতাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করতে দেখেছি। জাতীয়তাবাদে তিনি আস্থাশীল নন, পক্ষান্তরে আন্তর্জাতিকতাবাদে তিনি আস্থা রাখেন। শ্রেণিবিরোধ নিষ্পত্তিমূলক সাম্যবাদী মানবতায় তিনি মানবতার মুক্তি খুঁজে পান। সাদি ভাইয়ের বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা সম্পাদনা গ্রন্থে যে বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপস্থাপনা দেখতে পাওয়া যায়।
দেশের শিক্ষা নীতি বিষয়ে ‘টাকা যার শিক্ষা-স্বাস্থ্য তার’ এই নীতির তীব্র বিরোধী তিনি। পক্ষান্তরে ‘একই ধারার বিজ্ঞানভিত্তিক সেক্যুলার অবৈতনিক শিক্ষানীতি’কে তিনি কার্যকর বলে মনে করেন। বিদেশি ভাষা উচ্চতর গবেষণা বা প্রয়োজনে আমরা শিখতে পারি তবে এদশের শিক্ষার একমাত্র মাধ্যম হবে বাংলা, এ বিষয়েও তিনি বলিষ্ঠ মতামত ব্যক্ত করেন।
রাষ্ট্রের তথাকথিত উন্নয়নের প্রসঙ্গে তুলে, তিনি উল্লেখ করেন–ব্রিজ, বহুতল ভবন, রাস্তা-ঘাট প্রভৃতির গড়া-ভাঙাকেই প্রকৃত উন্নয়ন বোঝায় না। গণতন্ত্র, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়ের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত যথার্থ মনুষ্যত্ববোধের উদ্বোধনের উন্নতিকেই রাষ্ট্রের প্রকৃত উন্নয়ন বলে বলে তিনি মতামত দেন। তার বক্তব্যে উন্নয়নের নামে প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ-জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের রাজনীতির বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রামের দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করতেও শুনেছি।
লেখক সাদি ভাইয়ের অধ্যয়ন-গবেষণা-অনুশীলনের মাঝে একজন নিরন্তর সাম্যবাদী জীবনবীক্ষার, নিসর্গপ্রেমী যোদ্ধাকে খুঁজে পাওয়া যায়। তিনি নিজের মুক্তি খুঁজে ফেরেন ক্ষেতমজুর-কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি-সংগ্রামী জনতার মুক্তির সংগ্রামে নিজেকে আত্মনিয়োগ করার মাধ্যমে। ‘স্বদেশ চিন্তা সঙ্ঘে’ দীর্ঘদিনের বিচরণ তার সাথে আমাকে আলাদা একটা বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করতে সমর্থ হয়েছিল। যে যোগাযোগ সাদি ভাইয়ের সাথে এখনও নানা মাত্রায় অক্ষুন্ন রয়েছে। সাদি ভাইয়ের সাহচর্যে কখনো বড় ভাই, কখনো অভিভাবকের নিবিড় স্পর্শ খুঁজে পেয়েছি। জগত-জীবনের নানা ঘটনা নিয়ে ছোট ছোট আকারে হলেও যেন কিছু লিখে মতামত প্রকাশ করি অর্থাৎ একজন লেখক হওয়ার নিরন্তন প্রয়াস অব্যাহত রাখি এ বিষয়ে তিনি আমাকে যার পর নাই প্রতিনিয়ত তাগাদা দিতে থাকেন এবং বিষয়টি তিনি প্রতিনিয়ত মনিটরিংও করেন। মানুষ হিসেবে কেবল রুটি রুজির জন্য ছুটলে মানে চাকুরি/ব্যবসায় নিয়ে ব্যস্ত থাকলে কতটা সামাজিক দায়িত্ব বা দায়বদ্ধতা পালন করা হয়, তাও তিনি প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দেন। পূর্বের মতো এবারও সাদি ভাইয়ের বিশেষ তাগাদার কারণে এ লেখাটিও লিখতে সমর্থ হলাম। সবশেষে আমি এ লেখার মাধ্যমে আমার এ বন্ধু বয়োজ্যেষ্ঠের সুস্থ্যতা ও দীর্ঘজীবন কামনা করি।
১০-১৫ অক্টোবর, ২০২২, খুলনা।
আরো পড়ুন
- জাগো বাহে, কোনঠে সবাই
- সাহিত্য প্রসঙ্গে গ্রন্থ সম্পর্কে একটি আলোচনা
- সমাজতন্ত্র ও বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অবস্থা
- অনুপ সাদি মার্কসবাদের একজন সবিশেষ কর্মি
- অনুপ সাদি, নিবেদিতপ্রাণ একজন চিন্তক নিয়ে কথকতা
- শব্দ শ্রমিক অনুপ সাদি
- অনুপ সাদির দুই দশকের কাজকর্ম
- অনুপ সাদি অবিরাম চলেন সমাজবিজ্ঞান ও প্রকৃতিবিজ্ঞানের অঙ্গনে
- অনুপ সাদি একজন সংগ্রামী কলমযোদ্ধা
- নিজকথায় লোককথায় হুমায়ুন আজাদ গ্রন্থের আলোচনা
- বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা হচ্ছে অনুপ সাদি সম্পাদিত গণতন্ত্র বিষয়ক গ্রন্থ
বিশেষ দ্রষ্টব্য: অনুপ সাদি সম্পর্কিত এই মূল্যায়নটি এনামূল হক পলাশ সম্পাদিত সাহিত্যের ছোট কাগজ অন্তরাশ্রম-এর অনুপ সাদি সংখ্যা, সংখ্যা ৪, পৃষ্ঠা ২৩-২৭, ময়মনসিংহ থেকে ৩০ নভেম্বর ২০২২ তারিখে প্রকাশিত এবং সেখান থেকে ফুলকিবাজ.কমে প্রকাশ করা হলো।
ফুলকিবাজ ডট কমে অতিথি লেখক হিসেবে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, কলাম, অনুবাদ, নিবন্ধ ও প্রবন্ধ লেখায় সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন পূরবী সম্মানিত, ইভান অরক্ষিত, রনো সরকার, দিল আফরোজ, অনাবিলা অনা এবং রণজিৎ মল্লিক। এছাড়াও আরো অনেকের লেখা এখানে প্রকাশ করা হয়।