চণ্ডালের চণ্ডিপাঠ

  • হাসান জামিল, কবি ও সাংবাদিক

অনেক মানুষ আছেন, যাদের আলাদা করে মনে করার কিছু থাকে না, জলবাতাসের মতো তারা বিরাজমান থাকেন। অভাব হলে টের পাওয়া যায়, নাই। এমন হয় খুব কম। নিয়মিত শ্বাসকষ্ট হয় এমন রোগ আমার নাই, আপাতত। ফলে অনুপ সাদি, মানে সাদি স্যারের সাথে আমার দেখা সাক্ষাত-কথা প্রায় হয় না বললেই চলে। কিন্তু তিনি থাকেন, খুব।

স্যারের সাথে আমার দেখা, খুব সম্ভব, ২০০৮ সালে গফরগাঁও রেলস্টেশনে। মাথায় লম্বা চুল এবং দশাসই জুলফির যুবক, যিনি যথেষ্ঠর চেয়ে বেশি ‘অশিক্ষকসুলভ’।  ‘অশিক্ষকসুলভ’ বর্গই যথেষ্ঠ ছিল তাকে পছন্দ করার জন্য, যেহেতু আমি ড্রপআউট থেকে আবার ইন করার চেষ্টা করছি এবং বেয়াদব হিশাবে মোটের ওপর কুখ্যাতি আছে। পরে কেমন কেমন করে যেন স্যারের সাথে যোগাযোগটা পোক্ত হয় গফরগাঁওয়ে, আমি তার খুপরিমতো ডর্মেটরিতে যাতায়াত শুরু করি। আঁধার হয়ে আসা সন্ধ্যার আগে আগে পৃথিবীর সব চাইতে বড় বড় মশা কলেজের ওই ডর্মে ছিল!

স্যার একটা বই দিলেন সেই কালে, অরনি অনুপ সাদি তিনি, কবিতা লেখা থেকে প্রায় অবসরের দিকে তিনি যাননি এবং বাসদ করার মৃদু গৌরবও ঝাড়তে পারেননি। অবশ্য তাতে দোষ ধরার মতো অবস্থা তো আমি কিংবা আমাদের বন্ধু সুলভের হয়েও ওঠেনি। চটকদার কথা বলার ওস্তাদ তিনি। যা বলেন, বেশ বেকায়দায় পড়ে যেতে হয়, নিজস্ব যুক্তির বলয় তখন অত শক্ত না, ভেঙে যায় এবং বিস্ময় ও বিপন্নবোধ করার মতো হয়। যদিও তার রসিকতায় সেগুলো আবার রিকভার হয় দ্রুত। বলার ভঙ্গি বা হাত নাড়ানো শিক্ষণের স্থানান্তরের মতো আমার কাছেও আসে কিছু। আবার আমি ফিরেও যাই নিজের বলয়ে, অনেক দিন দেখা হয় না। আবার দেখা হলে কুশল বিনিময়েরও দরকার থাকে না, যেন সকালেই দেখা হলো, বিকেলে ফের।

স্যার গফরগাঁওতে অনেক কাজ করলেন। হ্যাঁ, কাজ করলেন বললাম। কলেজে কী যেন একটা ঝামেলায় জড়ালেন। প্রিন্সিপালের সাথে। অন্য শিক্ষকেরাও। সেটার কথা না, থিয়েটারে যেতেন। টিটো ভাই, কাদির স্যার…উনারা। কলেজের শুরুর দিনে গাছ দেওয়ার একটা চল চালু করার চেষ্টা করলেন। নানা জায়গায় গাছ লাগানোর যজ্ঞ নিলেন। সরকারি কলেজের মাঠে বিচিত্র রকমের গাছ লাগালেন। সেগুলা এখন ফুলে ফলে ভরে ওঠে। সে সময় বা তার আগ-পরে ‘জীববিচিত্রা’ নামে একটা সংগঠন করলেন। উনার কিছু কলিগ বন্ধু ছিলেন। স্যার ওই প্রিন্সিপালের সাথে ঝামেলার জেরেই সম্ভবত বদলি হয়ে মমিসিং চলে গেলেন। নওমহলে বাসা। আমি ওই বাসায় একাধিক রাত থেকেছি। রাতে নানা গাছের নাম, উপকারিতা, বিদেশি গাছের সমস্যা নিয়ে লিফলেট লিখছি। স্যার তখনো ঘোরতর বিবাহবিরোধী, বললেন, আমরা দেখ এত রাইত জাইগা কী লাগাচ্ছি, লোকেরা নিশ্চয়ই এখন লাগাচ্ছে। সকালে আমরা পার্কে প্রদর্শনী করি। অনেক সাড়া পাই। স্যারও দ্রুতই আগের অবস্থান বাদ দিয়ে বিবাহের কাষ্ঠে ঝুলে পড়েন, নওমহলে ওই বাসাতেই।

এর আগপাছে আমিও মমিসিং থিতু। এই সময়টা দারুণ, দুর্দান্ত। স্মৃতি হাতড়াতে ভালো লাগে না। কারণ, ওই সময়টাতেই, যত সামান্যই হোক, তৈরি হওয়া যাকে বলে, আমি হয়েছি। এই আলাপটা, অন্য কোনোদিন, অন্য কোনোখানে করব। এমন স্মৃতির আলাপের অসুবিধা হলো, আপনার বিভ্রান্তি জন্মাইতেই পারে; এ যেন কোনো বুড়া বা বেহেশতবাসীর ব্যাপারে আলাপ করছি। আদতে আলাপ করছি দেশি কলা দেশি চাল খুঁজে খাওয়া জোয়ান অনুপ সাদির কথা। তিনি পরিশ্রমী, কাছিমের মতো কামড়ে পড়ে থাকতে পারা এক খরগোশ।

স্যার লেগে থাকতে পারেন। পরিকল্পনা ও সে মতো কাজ করা তার স্বভাবজাত। স্যার তখন গণতন্ত্র নিয়ে একটা সংকলন সম্পাদনা করলেন। বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা। ওই সময় বলতেন, এত বছরে গণতন্ত্র নিয়ে বাংলায় একটা ভালো বই না থাকার কথা। মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরের সম্পাদনায় মনে হয় একটা ছিল। তাহা ইয়াসিনের সাথে প্রেম নামে একটা সংকলন তৈরিতে ভূমিকা রাখলেন। বইটা আমার বিশেষ পছন্দের। ওনাদের করা নারী বইয়েও দেশ-বিদেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখা যুক্ত করলেন। স্যার এদেশে ফ্যাশন হয়ে ওঠার আগেই পরিবেশ সম্পর্কিত তৎপরতার সাথে খুব আন্তরিকভাবে জড়ান। বাঙালির গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা উৎসর্গ করেন ছোট-বড় মৃত-আধা মৃত নদীদের!

স্যার পরে, মমিসিংটাইমে, চিন্তা সিরিজের দুইটা বই লেখেন–মার্কসবাদ আর সমাজতন্ত্র নামে। ওই সময়টায় আমরা অনেক আড্ডা দিতাম। সিপিবি অফিসে একটা পাঠচক্র হতো, আমি অনিয়মিত যেতাম। তখন বিজন দার সাথে আলাপ হয়। পরে আমরাই একটা পাঠচক্র করি। মিতু ভাই (এহসান হাবীব) যুক্ত হন সেখানে। পুঁজির প্রথম খণ্ডের অনেকটা আমরা পড়ি তখন, বেশ ক’মাসে। বিজন দা খুব ভালো একটা আর্গুমেন্ট তোলেন বই দুইটা নিয়ে। রেফারেন্স হিসেবে স্তালিন যুগের পরের যে বইগুলো ব্যবহার করা হয়েছে, সেসব ব্যবহারে যে বই হয়েছে, তা আসলে কতটা মার্কসবাদ বা সমাজতন্ত্র ব্যাপারটার প্রতিনিধিত্ব করে–এমন একটা আলোচনা। বেশ আগ্রহোদ্দিপক। মার্কসবাদ বইটা নিয়ে আমার বেশ একটা বিব্রতকর ও মজার ব্যাপার আছে। ওই বইয়ের ভূমিকায় আছে, উনি বইটা লেখতে গিয়ে বিজন সম্মানিত, দোলন প্রভা আর আমার সাথে আলাপ করে উপকৃত হয়েছেন। এক লোক, স্যারেরই বন্ধুস্থানীয়, আমারে বাগে পেয়ে জিগ্যেস করলেন, আচ্ছা, সাদি ভাই ওই বই লেখতে গিয়া তোমার লগে আলোচনা কইরা কী উপকার পাইছে, আমারে বলোতো! আমি খানিক অপ্রস্তুত হয়া বললাম, উনারেই জিগায়েন, আমি তো জানি না।

অনুপ সাদির কয়েকটি বক্তৃতা দেখুন

 স্যার অনেক লেখেন। উনার এই অনেক লেখা কোনো না কোনোভাবে, পজেটিভলি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তিনি কখনোই লেখার জন্য লেখেন নাই, লেখেন না। সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে লেখেন না। এ ক্ষেত্রে তিনি তার ওস্তাদদের অন্যতম আবুল কাসেম ফজলুল হকের সমগোত্রীয়। স্যারের যত বই, অন্তত উদ্দেশ্যের দিক থেকে গণের দিকে মুখ করা। এইটা উনার সবচে বড় গুণ, সম্ভবত দোষও।

স্যার এখন কী কী পড়েন ঠিক জানি না। আগেও বিশেষ জানতাম না। বই তালা দেওয়া লোক তিনি। এই বিদ্যা নাকি রবীন্দ্রনাথের থেকে পাইছেন। স্যারের মধ্যে কম গণমুখি লেখকের প্রতি রাগ থাকলেও ঠাকুরের প্রতি বিশেষ প্রেম আছে। লেখাপত্র যে গুছিয়ে করা লাগে, এটা বলতে তিনি প্রায়ই ঠাকুর যে ১২ বছর বয়স থেকে দোয়াত-কালির যুগে চিঠির নকল কপি পর্যন্ত নিজের কাছে রাখতেন, এ-গল্প করতেন। জীবনানন্দের মতো কবিরে নিয়া তামাশাও করতে ছাড়েন না তিনি। এগুলা বেশ আয়রনি তার। বইয়ের কথা বলছিলাম। স্যার ক্ল্যাসিক্যাল ধারার মার্কসবাদ ও ব্যবহারিক মার্কসবাদ চর্চায় বেশি আগ্রহী। আগ্রহী না বলে বরং এ ব্যাপারে তার ডগমার কথাই বলা যায়। তার প্রায় কোনো আলাপেই ফ্র্যাঙ্কফুট স্কুল বা এ ধারায় এখন যারা চর্চা করেন তার-তাদের রেফারেন্স পাওয়া যায় না বা তিনি ব্যবহার করেন না। যদিও আমি বুঝি, এরা সবাই তার পাঠসীমার মধ্যেই।

এমন ডগমা আরও আছে। অনেক ক্ষেত্রেই তিনি ক্রিটিক্যাল হতে চান না। যেমন হুমায়ূন আহমেদ। তিনি কেমন লেখক সেই আলাপের চেয়ে তার প্রতি স্যার যেন রাগ ঢালতেই বেশি পছন্দ করেন। অথচ তার লেখা এতো তরুণ পড়ছে, সেটার সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক মূল্য তিনি সন্ধানেই আগ্রহী নন। স্যার একবার একটা উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিলেন, দুই হাতে আক্রমণ করার কথা বলেছেন মাও সেতুং। এখন লাগবে চার হাতপায়ে আক্রমণ করা। কিন্তু আমাদের হাতপায়ের জোরের জেরে কখনো লক্ষ্যবস্তু লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে আড়াল করে ফেলে।

স্যারের সাথে আমার সবশেষ কাজ ছিল ফ্যাসিবাদবিরোধী একটা কর্মসূচিতে। স্যার যদিও এই রেজিমকে থিউরিটিক্যালি ফ্যাসিবাদ বলতে চান না। তবু আমরা এক কর্মসূতিতে ছিলাম। ‘অবরুদ্ধ সময়ের কবিতা’ নামে সেই রাজনৈতিক তৎপরতা যদিও অবরুদ্ধ প্রায়, তবু সেই অভিজ্ঞতাও আমাদের কম জল খাওয়ায়নি। আমাদের ভাই বন্ধু সৌরভ এরই মধ্যে আমাদের ছেড়ে গেছে, আমরা একসঙ্গে কত হেঁটেছি!

আমি এই লেখাটা কেন লেখছি জানি না। কই ছাপা হবে, তা-ও না। সাদি স্যার বলছেন, লিখছি। আমি একটা বই পড়ছিলাম, গুরু ও চণ্ডাল নামে। লেখতে গিয়ে বইটার কথা মনে এলো। আমি যেমন গুরু না ধরা টাইপ, স্যার, আগেই বলছি, অশিক্ষকসুলভ। তাই আমাদের অল্পেই রফা হয়। মিতু ভাই একদিন বলেন, তোমার স্যার তো তোমারে ছাত্র হিশাবে মানে না। আমি কইলাম, কেন? মিতু ভাই কয়, তোমার সাথে যখন দেখা হইছে তখনই তোমার নজরুলের মতো চুল। আমি হো হো হাসলাম। চণ্ডালরে ছাত্র হিশাবে নেওয়ার আসলেও কিছু নাই। যদিও ছাত্র হিশাবে না নিয়েও অকৃতি-অধম চণ্ডালকে যা শিখাইতে চাইছেন, তার তার তালিকাও সামান্য নহে।

১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।

আরো পড়ুন

বিশেষ দ্রষ্টব্য: অনুপ সাদি সম্পর্কিত এই মূল্যায়নটি এনামূল হক পলাশ সম্পাদিত সাহিত্যের ছোট কাগজ অন্তরাশ্রম-এর অনুপ সাদি সংখ্যা, সংখ্যা ৪, পৃষ্ঠা ৭২-৭৪, ময়মনসিংহ থেকে ৩০ নভেম্বর ২০২২ তারিখে প্রকাশিত এবং সেখান থেকে ফুলকিবাজ.কমে প্রকাশ করা হলো।

Leave a Comment

error: Content is protected !!