শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ-এর একটি মূল্যায়ন

পলি বিশ্বাস, লেখক, শিক্ষার্থী।

বইয়ের নাম থেকে মূলত এ বইয়ের বিষয়বস্তু উপলব্ধি করা যায়। সৎ, কর্মঠ, নিষ্ঠাবান, সমাজসেবী, পরোপকারী, শিক্ষানুরাগী, প্রকৃতিপ্রেমী, সংস্কৃতিপ্রেমী ও পরিব্রাজক ইত্যাদি বহু গুণে গুনান্বিত শাহেরা খাতুনের স্মৃতি বিজড়িত ঘটনা নিয়ে অনুপ সাদি, দোলন প্রভার লেখা এই বই, “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”।

অনুপ সাদি বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও জেলার হরিপুর থানার দামোল গ্রামে ১৯৭৭ সালে ১৬ জুন জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একাধারে কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক এবং সমসাময়িক রাজনীতি, সমাজনীতি বিষয়ক প্রবন্ধ লিখে খ্যাতি অর্জন করেছেন।

‘শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ’-এর প্রথম প্রবন্ধটি লেখক অনুপ সাদি মূলত শাহেরা খাতুনের জীবনবোধ ও চিন্তাধারা নিয়ে আলোচনা করেছেন। লেখক অনুপ সাদি বাইশাল কুমিরের বর্ণনা শুনেছিলেন শাহেরা খাতুনের মুখে। শাহেরা খাতুন বন্যপশু পাখিকে চোরাচালানকারীদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য চেষ্টা করতেন। শাহেরা খাতুন সবসময় চাইতেন বৈচিত্র্যপূর্ণ খাবার খেয়ে শরীরকে সুস্থ রাখতে। অসুস্থ অবস্থায় তিনি ঔষধের চেয়ে পথ্যকে গুরুত্ব দিতেন। এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞানের কথা আমরা এই বইটি পড়ে জানতে পারি।

শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থে দোলন প্রভা উল্লেখ করেছেন দেশ ভাগ থেকে গণযুদ্ধ ও দূর্ভিক্ষ পর্যন্ত যারা দেখেছেন তারা অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে প্রাণপণ চেষ্টা করেছে। শাহেরা খাতুন তাদের মধ্যে একজন। তিনি শুধু নিজ পরিবারের কথা চিন্তা করতেন না। যুদ্ধ  ও দুর্ভিক্ষের চরম অভাবের সময়ও তিনি পাড়া-প্রতিবেশীদের সাহায্য সহযোগিতা করতেন।

পথিক সেলিম লিখেছেন যে শাহেরা খাতুন নিজ সন্তানদের মতো প্রকৃতির যত্ন নিতেন। প্রকৃতির পশু পাখি ও গাছপালাদের সঙ্গে শাহেরা খাতুন এমনিই গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন যে বাঁশ ঝাড়ে বিষধর সাপের ভয়ে এলাকার মানুষ সেই অংশটির আশেপাশে যেত না। তিনি প্রতিনিয়ত সেই অংশেরই পাশে দিয়ে যাতায়াত করতেন। তিনি কখনো মৌচাক ভাঙতে দেন নি। শাহেরা খাতুনের আঙ্গিনায় ১২০ থেকে ১৫০ প্রজাতির উদ্ভিদ ছিলো।

মো আবদুল ওদুদ বর্ণনা করেছেন শাহেরা খাতুন যেমন যৌতুক, ঘুষ, প্রতারণা, দুর্ণীতির বিরুদ্ধে সর্বদাই সোচ্চার ছিলেন তেমনি তিনি বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা ও ব্যাধিকেও দূর করার চেষ্টা করতেন। নেশাখোর, ঠক, বাটপারদের তিনি সুপথে আনার চেষ্টা করতেন। এছাড়া শাহেরা খাতুন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শিক্ষাকে সুন্দর জীবনের প্রস্তুতি পর্ব হিসাবে গ্রহণ করেছেন।

রেজাউল করিমের লেখায় বর্ণনা করেছেন শাহেরা খাতুন কীভাবে ১৯৪৭ সালে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার টানাপড়েন ও ভাঙনের সময় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় কঠিন বাস্তবতা থেকে শিক্ষা নিয়ে উঠেছিলেন বাস্তববাদী।

রফিকুল হাসান-এর “একজন সার্থক নারীর গল্প” প্রবন্ধে শাহেরা খাতুনকে একজন সার্থক ও রত্নগর্ভা মহিলা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। কারণ তিনি নিজ কষ্টগুলোকে ছাপা দিয়ে অনেক শ্রম, অর্থ ও ধৈর্যের বিনিময়ে দুই ছেলে ও ছেলের বউকে করেছেন বিসিএর ক্যাডার।

মাহাবুব আলম আপেল তার লেখা প্রবন্ধে পুরো পরিবারের তথ্যভাণ্ডার শাহেরা খাতুনের কাছে থেকে শুনেছেন। তাদের আদি বাসস্থানের কথা উল্লেখ করেছেন।     

মনিমুল হক তার প্রবন্ধে ডাক্তারের চেম্বারে বসে শাহেরা খাতুনের সঙ্গে হওয়া কিছু জ্ঞানমূলক কথোপকথনের বর্ণনা করেছেন। যেখানে শাহেরা খাতুন বিভিন্ন ভেষজ উদ্ভিদের গুণাবলি, শিক্ষার মাধ্যমে নারীদের চারদেয়ালের মধ্যে থেকে মুক্তির আকুতি, দেশভাগের কারণে আত্নীয়-স্বজন, প্রতিবেশীদের হারানোর দুঃখ ও মুক্তিযুদ্ধের সময় তার পরিচিত লোকদের মারা যাওয়ার শোক-দুঃখের কথা বলেছেন।

শিউলি আকতার সাজিয়া তার প্রবন্ধে বাঙালি যে মাছে ভাতে বাঙালি হয় তেমন কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। তার প্রবন্ধের আকর্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে গাছ থেকে ফল পাড়ার সময় কিছু ফল শাহেরা খাতুন গাছেই রেখে দিতেন পাখিদের জন্য। এমনকি ঝড়ের দিনে পাখির বাসা ভেঙ্গে গেলে তিনি বাচ্চাগুলোর যত্ন করতেন বাঁচানোর জন্য।

সমকালীন কবিতা সম্পর্কে একটি আলোচনা দেখুন

শাহেরা খাতুনের মৌসুমী ফসল সম্পর্কে জ্ঞান ও বাস্তব জীবনে তার প্রয়োগ, প্রতিবেশীদের প্রতি পরোপকারী মনোভাব, মিত্যয়ীতা এবং সবশেষে শাহেরা খাতুনের মুখ  থেকে শুনা কিছু ধাঁ ধাঁ ও তার উত্তর নিয়ে আলোচনা করেছেন শেফালি আকতার ইরা।

শাহেরা খাতুন কীভাবে সারা জীবনব্যাপি এমনকি মৃত্যুশয্যা অবস্থায় সাহস ও আত্নবিশ্বাস নিয়ে কথা বলেছেন। এই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করেছেন আবুল কালাম আজাদ।

ডা. মাহাবুবা আখতার তার লেখা প্রবন্ধে ফুটিয়ে তুলেছেন যে শাহেরা খাতুন বিভিন্ন কাজে দক্ষ ছিলেন যেমন: পিঠা বানানো, আমের আচার, আমচুর, আমসত্ব বানানো, নকশি কাঁথা সেলাই, বিভিন্ন রকমের গান গাইতে পারা ইত্যাদি।

নেকজান বিবি শাহেরা খাতুন কীভাবে নিজ জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে সারাজীবন অতিবাহিত করেছেন তা উল্লেখ করেছেন। তিনি জোড় করে কারো উপকার করতে চাইতেন না কিন্তু সবার ভালো হোক তাই চাইতেন।

শামাউন কবির শাহেরা খাতুন সম্পর্কে বলেছেন, ‘অভাব অনটনের সময় তিনি এক সংসার চালানোর মতো দক্ষ ছিলেন’। গুলশানারা বর্ণনা করেছেন শাহেরা খাতুন সবসময় নিজ হাতের তৈরি করা খাবার খেতেন। এমনকি ফলমূল, সবজি, বাড়ির জমিতে চাষ করতেন। ডিম ও মাংশের জন্য বারিতে হাঁস, মুরগী, গরু, ছাগল পালন করতেন। শাহেরা খাতুনের লোকশিল্পী ও পরিব্রাজক হয়ে ওঠার বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন সমীর অধিকারী।

শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থের নিবেদিত কবিতাগুচ্ছ অংশের লেখক অনুপ সাদি, দোলন প্রভা, সন্ধ্যা থাপা, পথিক সেলিমসহ আরো ১৬ জন আছেন এবং তার গাওয়া ৩টি গীত লিখিত আকারে দেওয়া আছে।

আরো পড়ুন

বইটি পরিশিষ্ট অংশে শাহেরা খাতুন ও তার স্বামী সাবের আলীর সংক্ষিপ্ত জীবনীপঞ্জি দেওয়া আছে। ১ অক্টোবর ২০১৯ সালে লেখক অনুপ সাদি ও শাহেরা খাতুনের কিছু কথোপকথন ও ভিডিও করা হয়েছিলো। সেই ভিডিওটি স্মারক গ্রন্থে লিখিত আকারে প্রকাশ করা হয়েছে।

শাহেরা খাতুনের সাথে মাত্র ১২০ পৃষ্ঠার বর্ণনামূলক এই বইয়ের মাধ্যমে পাঠকের সখ্যতা গড়তে অনেক সহজ হবে। বলা বাহুল্য এই কৌশলে লেখক অনেক পারদর্শী। এই বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে গপ্ল বলার মতো করে লেখকের মনের আবেগ, বিনোদন ও গভীরতা প্রকাশ করেছে। যা শিক্ষামূলক, স্পষ্ট ও যথাযথ। পরিশেষে আমার মতামত এই যে, বইটি পড়ে মানুষ অনেক অজানা তথ্য সম্পর্কে অবগত হবে। পাঠকের মনে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ, জীবে দয়া, পরোপকারীর মতো নৈতিক গুণাবলি অর্জন করতে আগ্রহ বাড়বে। আমার মতে যে কেউ বইটি পড়ার জন্য বাছাই করতে পারে।

পলি বিশ্বাস, ফেব্রুয়ারি-মার্চ, ২০২৩
নেত্রকোনা

Leave a Comment

error: Content is protected !!