নারী বই দুই বাংলার লেখকদের নারী মুক্তি বিষয়ক বিভিন্ন রচনার সংকলন

অনাবিলা অনা
অনাবিলা অনা, লেখক ও আলোচক

সম্পাদিত বই – নারী
ধরন- প্রবন্ধ
প্রকাশনা- কথাপ্রকাশ
প্রথম প্রকাশ – ফেব্রুয়ারী ২০০৮
প্রচ্ছদ – সব্যসাচী হাজরা 
পৃষ্ঠা – ৩০০
মূল্য- ৪০০ টাকা মাত্র

নারী বা নারী বই হচ্ছে অনুপ সাদিতাহা ইয়াসিন সম্পাদিত প্রবন্ধের একটি বই। এই গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে গত চারশো বছরের নারী বিষয়ক লিখিত শ্রেষ্ঠ রচনাসমূহ। নারীর জীবন ও বাস্তবতা, সংকট ও সংগ্রাম, শোষণ-বঞ্চনা-বৈষম্য প্রভৃতি বিচিত্র বিষয়ে আলোচনা রয়েছে বইটিতে। দুই বাংলার বিশিষ্ট চিন্তাবিদদের নারী বিষয়ক লেখার সমন্বয়ে রচিত এই বই।

নারী বই দ্বারা ফুটে উঠেছে নারী নির্যাতনের সুদীর্ঘ ইতিহাস, লৈঙ্গিক রাজনীতি ও নারীজাতির ঐতিহাসিক মহাপরাজয়। পুরুষতন্ত্রের বলপ্রয়োগকারীরা আইন, রাষ্ট্র, ধর্ম ও পরিবার কী করে কয়েক সহস্রাব্দ ধরে নারীকে বন্দি রেখেছে চার দেয়ালের মাঝে তার ব্যাখ্যা রয়েছে এই গ্রন্থে। দাসী যেমন দীর্ঘদিন দাসত্বের শেকলে আটকে থেকে একসময় গুণগান করে প্রভুর, তেমনি নারীদেরও এক বৃহদাংশ গেয়ে এসেছে পুরুষতন্ত্রের জয়গান।

নারী বই শুরু হয়েছে অম্লান দত্তের লেখা “নারী মুক্তি” দিয়ে যেটাতে দেখা যায় বিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য আন্দোলনের ভিতর দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে এ যুগের নব প্রজন্মের আন্তরিক ঝোঁক ও আকাঙ্খা; যখন এসবের কোনো প্রভাব ছিল না ইতিহাসের গতির উপর। ভবিষ্যতের সমাজের পক্ষে এরকমই গভীরভাবে তাৎপর্যপূর্ণ নারী মুক্তির আন্দোলন; যা যুদ্ধের মতো বিস্ফোরক নয়, কিন্তু সামাজিক ধ্যানধারণা ও অভ্যাসের সঙ্গে নতুন যুগের বিরোধ আছে।

জানা যায় এক সময় নারীদের ভোটের অধিকার ছিল না। সমাজের ধারণা ছিল যে, পরিবারের গৃহকর্তা ভোট দিলে, স্ত্রীকে আলাদাভাবে ভোট দেয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু সর্বসাধারণের জন্য ঐ অধিকার যেদিন প্রতিষ্ঠিত হয় নারীরাও সেদিন ভোটের অধিকারিণী বলে গণ্য হয়। শুধু ভোটের ক্ষেত্রেই নয় এদেশের সংবিধানে আরো নারী ও পুরুষের ভিতর সাম্যের কথা আইনত স্বীকৃত হয়েছে। কিন্তু সংবিধান আর সমাজ ভিন্ন বস্তু। সংবিধানে নাগরিক হিসেবে নারীর অধিকার পুরুষের সমান হলেও সমাজ অথবা প্রকৃতি নারী ও পুরুষকে অসমান করে গড়ে তুলেছে। আর তর্কের শুরু এখান থেকেই। সামর্থ্যের দিক থেকে যদি নারী ও পুরুষ সমান না হয় তবে অধিকারের বেলাতেও শেষ অবধি তারা অসমানই থেকে যায়। প্রাকৃতিক সূত্রে নারী পুরুষের ভিতর কিছু পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু তা অযথা বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। সাধারণত যে প্রভেদটা আমাদের চোখে পড়ে তা প্রকৃতির সৃষ্টি নয়, সমাজের সৃষ্টি। 

“নারীর বোরখা বোরখার নারী” রচনাটিতে লেখক আনু মুহাম্মদ বোরখা নিয়ে লিখেছেন। নারীর বোরখা বলতে আমরা সাধারণত বুঝি নারীদের এক ধরনের বহিরাঙ্গিক পোশাক যা সারা শরীর ঢেকে রাখে। ইসলামী শরিয়ত অনুযায়ী পর্দা বজায় রাখার স্বার্থে প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম নারীরা ঘরের বাইরে, বিশেষ করে পুরুষমহলে, যাওয়ার সময় এটি পরিধান করে থাকে। শুধু বোরখা নয়, অনেকে আবার বোরখার সঙ্গে যুক্ত করতেন হাত ও পায়ের মোজা।

বোরখাটা কিছু কিছু নারীদের সীমাবদ্ধ আটকে থাকা জীবনের প্রতীক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বোরখা মানেই ফ্যাসিবাদী বা যুদ্ধাপরাধীর রাজনীতি নয়। বোরখা মানেই মুসলিম পোশাক নয় বা অপশ্চিমী পোশাক নয়। বোরখার মতো পোশাক বরঞ্চ পশ্চিমেই আগে ব্যবহার হয়েছে। প্রাচ্যে বাংলায় বোরখা কখনোই সকল নারীর পোশাক ছিল না। হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে এটি বিভিন্ন ধরনের সম্পত্তিশালী অভিজাত পরিবারের নারীর পোশাক হিসেবেই ব্যবহৃত হতো। তাছাড়া বোরখা সবাই এক কারণেও পরে না। বোরখা পরার সঙ্গে সবসময় যে বোরখা পরিহিতারা তার নিজস্ব ধর্মবিশ্বাস বা মতাদর্শ সম্পর্কিত থাকে না সেটা এমনিতে খেয়াল না করলেও আশেপাশে একটু ভাল করে তাকালেই বুঝা যায়। অনেক ঘটনা, পর্যবেক্ষণ বিশ্লেষণ করে জানা যায় যে,পাঁচটি কারণে বোরখা একজন নারীর জন্য নিয়মিত পোশাক হয়ে উঠতে পারে; (১) আত্মরক্ষা বা আশ্রয়; (২) বিশ্বাস; (৩) জবরদস্তি; (৪) পছন্দ;(৫) আভিজাত্য অর্জন। 

সামাজিক জীবনে নারী এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি দৃশ্যমান। রাস্তায় এখন শ্রমিক নারী মধ্যবিত্ত নারী দুজনকেই বেশি দেখা যায়। বস্তুত নারী শ্রমিক এখন যেভাবে একটি  সামাজিক শক্তি হিসেবে দাঁড়ানোর অবস্থায় এসেছে সেটা আগে কখনোই ছিল না। কিন্তু এই অংশগ্রহণ বৃদ্ধির বিরুদ্ধে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতিরোধ এবং হামলাও আসছে বিভিন্নভাবে। তাই শুধু বোরখা দিয়েই কোনো সিদ্ধান্তে আসা যায় না। বোরখার মধ্যে যে পুরুষতান্ত্রিক আক্রমণের ছাপ আছে তাকে গ্রহণ না করলে এই পোশাক পরেও একজন নারী নিজের উপলব্ধির জগতকে ক্রমে প্রসারিত করায় নিয়োজিত থাকতে পারেন। এক্ষেত্রে রোকেয়াই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আবার অন্যদিকে বোরখা না পরেও নিজের ভেতর ধারণ করা যায় উল্লিখিত ভয়াবহ, আত্মপীড়নমূলক, আত্মঘাতী মতাদর্শ। 

আশালতা দেবীর “নারী”-তে উল্লেখ আছে প্রাচীন গ্রীসে ও রোমে একদা নারীকিরণ বর্ষনের জন্য দু-একটি বাতায়ন খোলা হয়েছিল। পুরুষের মনোবৃত্তির ওপর নারীর প্রেরণা অত্যন্ত কাজ করে এবং তার সৃষ্টিশক্তির পক্ষেও নারী লাবণ্য বর্ষণ অত্যাবশ্যক। অর্থাৎ এতে বোঝায় যে সৃষ্টি করার ক্ষমতা নারীর নেই। তার কাজ লালন ও রক্ষণ। কিন্তু তা স্বীকার করাও দুরাসাধ্য। প্রতিভা থাকলেও স্থায়ী সৃষ্টির জন্য বহু সাধনার প্রয়োজন। যার সুযোগ আমাদের দেশের স্ত্রীলোকরা পায় নি।

“নির্বাচিত কলাম”-এ তসলিমা নাসরীন লিখেছেন নারীদের বেড়াজালের পারিপার্শ্বিক অবস্থার কথা। একই রক্তে মাংসে গড়া তবুও কোথাও যেনো পার্থক্য রয়ে গেছে। একটা ছেলে বা পুরুষ যখন মাত্রাতিরিক্ত গরমের কারণে বাড়ির উঠোনে জামা খুলে ফেলতে পারে সেখানে একটা তেরো বছর বয়সী মেয়ে তার চেয়ে অধিক গরমে কাতর হয়েও পারেনা অবলীলায় জামা খুলে ফেলতে। যে মানুষ এত বন্ধন, এত প্রতিবন্ধকতা বহন করে জীবন শুরু করে সে খুব কম বিপত্তি কম গলি ঘুপচি, কম অন্ধকার, কম পর্বত অরণ্য পেরিয়ে বয়স্ক হয় না।

যে কোনও নারীই গায়ে একটি বেড়ি অনুভব করে, নারীত্ব বেড়ি। একজন নারী তার সীমিত অঙ্গণে পদচারণা করে পদক্ষেপকে সংযত এবং সংক্ষিপ্ত করে।পার্থক্যটা আমাদের তৈরি ।এ সমাজের তৈরি। সকল অন্যায়-অপবাদ এর দায়বদ্ধতা নারীদের মধ্যে ধারণ করে নিয়েছে। এ সমাজের বিপরীত লিঙ্গের অসভ্যতার জন্য নারীরা নিজেদেরই দায়ী করে। প্রাকৃতিক বিভেদ ছাড়া নারী ও পুরুষের আসলে কোনও বিভেদ নেই। আর প্রাকৃতিক বিভেদই এই সমাজের সবচেয়ে বড় পুঁজি। এই পুঁজি খাটিয়ে তারা ব্যবসা করছে, মুনাফা লুটছে। যে মাটিকে মানুষ পায়ে পিষে মারে, খোদাই করে, খুবলে তোলে সেই মাটির নাম দিয়েছে জননী। মাটিকে নারীর মত ভাবা হয়, যেহেতু সে ‘ধারণ’ করে, সেহেতু সে নিষ্পেষিত হতে, সে কর্তিত বিদীর্ণ ও চূর্ণ হতে দ্বিধা করে না। নারীকে এমন এক খেলনা বানানো হয় যে, চাবি দিলেই পুরুষের বেষ্টনীর মধ্যে একবার সে ঢোল বাজাবে, একবার বাঁশি। মূলত পুরুষকে সে স্বস্তি দেবে, একই সঙ্গে রকমারি আনন্দ।

মানুষ সম্পর্কে অনুপ সাদির আলোচনা শুনুন

আলোচনা করছেন লেখক অনুপ সাদি

“মনুষ্যজাতি ও স্ত্রীগণ” রচনাটিতে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে নারী পুরুষ উভয়ই আমরা মানুষ। যেখানে আমরা জানি যে সকল মানুষের সমান অধিকার। সেক্ষেত্রে একজন পুরুষের ক্ষেত্রে একজন স্ত্রীও মনুষ্যজাতি হিসেবে সমান অধিকার তুল্য। স্ত্রী পুরুষে প্রকৃতিগত বৈষম্য আছে ঠিকই কিন্তু তাই বলে যে অধিকারগত বৈষম্য থাকা ন্যায়সঙ্গত তা ঠিক নয়।এক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছেন যে স্ত্রীপুরুষে যেরূপ স্বভাবগত বৈষম্য, ইংরেজ বাঙালীতেও সেরূপ বৈষম্য বিদ্যমান। ইংরেজ বলবান, বাঙালী দুর্বল, ইংরেজ সাহসী বাঙালি ভীরু; ইংরেজ ক্লেশসহিষ্ণু, বাঙালি কোমল ইত্যাদি ইত্যাদি। যদি এই সকল প্রকৃতিগত বৈষম্য হেতু অধিকারবৈষম্য ন্যায্য হত, তবে আমরা ইংরেজ বাঙালির মধ্যে সামান্য অধিকার বৈষম্য দেখে এত চিৎকার কেন করি। তাছাড়া যে সকল বিষয়ে স্ত্রীপুরুষের অধিকারবৈষম্য দেখা যায়, সে সকল বিষয়ে স্ত্রীপুরুষের যথার্থ প্রকৃতিগত বৈষম্য দেখা যায় না। যা দেখা যায় তা কেবল সামাজিক নিয়মের দোষে।

নারী গ্রন্থটি অধ্যয়নের ফলে পুরনো অনেক চিন্তাধারা ভেঙ্গেচুরে গুড়িয়ে দিতে বাধ্য। নতুন চিন্তাধারার জন্য বইটিতে আছে মহৌষধেরই মতো কিছু তথ্য। হয়তো সময় লাগবে। কিন্তু চলবে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির নির্মাণ। “নারী” বইটি শুধু নারীর কথা বলেনি বলেছে সভ্যতার ভ্রান্ত ইতিহাসের কথা। যে ইতিহাসে ধর্ম আছে, রাজনীতি আছে, সাম্রাজ্য আছে, বিকাশের গল্প আছে অথচ নারী যেন থেকেও নেই তবুও সেই ইতিহাস নাকি পূর্ণাঙ্গ মানুষেরই ইতিহাস। 

দুই বাংলার লেখকদের লেখা নিয়ে সম্পাদিত নারী বিষয়ক এই বই বিভিন্ন রচনার সমন্বয়ে একটি চমৎকার কাজ যেটি সম্পন্ন করেছেন অনুপ সাদি ও তাহা ইয়াসিন। আমরা তাঁদেরকে নারী বই সম্পাদনার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।

আরও পড়ুন

Leave a Comment

error: Content is protected !!