অনুপ সাদি : ব্যক্তি ও ব্যক্তিসত্ত্বা

  • সুব্রত রায়, বাংলা উইকিপিডিয়ান

নামটি মনে আসলেই বিখ্যাত ফার্সি কবি শেখ সাদি কিংবা বাংলাদেশী প্রখ্যাত ও স্বনামধন্য সুরকার শেখ সাদী খানের কথা সর্বাগ্রে চলে আসে মানসপর্দায়। বাংলা উইকিপিডিয়ায় যুক্ত আছি ২০০৮ সাল থেকে। এই সুবাদে তিনিসহ আরও অনেকের সাথেই পরিচিত হবার সৌভাগ্য হয়েছে কেবলমাত্র সময়েরই প্রয়োজনে। দুইবার ঢাকায় উইকি সম্মেলনে সরাসরি কথোপকথন ও একবার অনলাইনে উনার উপস্থিতি টের পাই। তবে, তিনি যে বন্ধুবৎসল তা নিয়ে কিন্তু মনে মোটেই প্রশ্ন চলে আসেনি। অর্থাৎ, অচেনাকে আপন করে নেয়ার মানসিকতা নিয়ে ও সহজাত প্রবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর মাঝেই তিনি নিজেকে গড়ে তুলেছেন বলে ধারনা করি।

ভালো-মন্দ নিয়েই আমাদের জীবন, জগৎ-সংসার গড়ে উঠেছে। মানুষকে আপন করে নেয়ার কিংবা অপরকে কাছে টেনে নেয়ার যে সকল গুণাবলী একজন ব্যক্তির থাকা দরকার তা উনার মাঝে যথেষ্ট আছে বা ধারনা করি তার চেয়ে বোধ হয় অধিকই রয়েছে। উইকিপিডিয়ার বাইরেও যে স্বতন্ত্র ব্যক্তি পরিচয় বা ব্যক্তিসত্ত্বা থাকতে পারে তা উনার সাথে পরিচিতি না হলে বোধ হয় অজানাই থেকে যেতো। ৩০ মে, ২০১৫ তারিখে মোহাম্মদপুরে সতীর্থদের সাথে রাত্রিযাপনকালে রচিত ‘সমাজতন্ত্র’ গ্রন্থ উপহার দেন। প্রথম স্বাক্ষাতেই তিনি পছন্দের মানুষে পরিণত হন। হয়তোবা প্রায় একই বয়সী হবার কারণেই এমনটি হতে পারে। মার্কসবাদ তথা সমাজতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা ও ভাবধারায় নিজেকে গড়ে তুলেছেন। নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গী তুলে ধরার অদম্য সাহস ও সর্বোত্তম প্রয়াস চালিয়েছেন ঐ গ্রন্থে। এছাড়াও, আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারকল্পে রোদ্দুরে.কমের গর্বিত স্বত্তাধিকারী তিনি। তা সত্তেও, প্রাচীন ধ্যান-ধারনার বাহক হিসেবে কাগুজে নির্ভর গ্রন্থের সাথে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন ওতপ্রোতভাবে। ছাপাখানায় মুদ্রিত গ্রন্থের যে অপর কোনো বিকল্প থাকতে পারে না, তার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ তিনি স্বয়ং।

অনুপ সাদির কয়েকটি বক্তৃতা দেখুন

মুষ্টিমেয় স্বাক্ষাৎ কিংবা অনলাইনে উনার বক্তব্য শোনার সৌভাগ্য হয়েছে। তন্মধ্যে, অনলাইনের আলোচনায় উইকিপিডিয়া সম্পর্কে উনার বাস্তব অভিজ্ঞতা, পারিপার্শ্বিক সমস্যা ও উদ্বেগের বিষয়টি লক্ষ্য করি আকস্মিকভাবে। অনেকটা অবাক বিস্ময়েই লক্ষ্য করি উইকিপিডিয়ার প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসার তাৎপর্য্যপূর্ণ ব্যাখ্যামূলক প্রতিক্রিয়াকে। তবে, তাঁর এ উদ্বেগ অপরাপর ব্যবহারকারীর প্রতি প্রচ্ছন্নভাবে খোঁচা বা আক্রমণ কি-না বা বিরূপ ও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে কি-না তার দিকেও নজর রাখা উচিৎ বলে মনে করি।

আমার চেয়ে অনুপ সাদি বোধ হয় দুই/এক ইঞ্চি খাঁটো গড়নের ও তামাটে বর্ণের অধিকারী। টেরাকাটা পরিপাটি চুল। এছাড়াও, কবি ও প্রকৃতিপ্রেমী হিসেবেও তাকে জানি। আমার ন্যায় তিনিও ছবি তুলতে বেশ পছন্দ করেন ও ভালোবাসেন। তবে, খেলাধূলোর প্রতি তার মাঝে কতটুকু আগ্রহ রয়েছে তা নিয়ে আমি যথেষ্ট সন্দীহান। বেশ স্পষ্টভাষী ও সদালাপী তা জানতে ও বুঝতে বাকি নেই। একবারতো ফোনালাপে নিজের ক্ষোভ আমার উপর চালিয়ে যান অনেকটা শিশুসূলভ আচরণের মাধ্যমে যে কেন আমি কেবলমাত্র খেলাধূলা বিশেষতঃ ক্রিকেটের দিকে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছি। অর্থাৎ, অন্য কোনো বিষয়ের প্রতি কেন ঝুঁকছি না! উনার সহকর্মীর অনুযোগেরই যে বিরূপ প্রতিফলন কেন যে আমার উপর ক্ষোভ হিসেবে ঝাড়লেন তা আজও জানতে পারিনি বা জানার চেষ্টাও করিনি। কিন্তু, স্বীয় দৃষ্টিভঙ্গীতে উইকিপিডিয়ায় প্রত্যেকের অবদানকেই মর্যাদা দেয়াই বোধ হয় সমীচীন হবে বিশেষতঃ স্বেচ্ছাশ্রমে গড়া অনলাইন নির্ভর বাংলা বিশ্বকোষ সমৃদ্ধকল্পে। আর এ বিষয়ে জড়িত বা যুক্ত না হলে বোধ হয় আমরা একে-অপরকে আদৌ জানতেই পারতাম না বা চিনতেই পারতাম না। একত্রে কাজ করার ফলেই হয়তোবা অদৃশ্য বন্ধন কিংবা অধিকার বোধ আমাদের মানসপটে গড়ে উঠেছে অবলীলাক্রমে। আর, খেলাধূলার প্রতি তাঁর যে বিরাগ তা আরও টের পাই রোদ্দুরেতে এ বিষয়ে কোনো তথ্য না থাকায়।

কিছুটা বয়সে বড়ো হওয়া সত্বেও মাঝবয়সী হিসেবে হয়তোবা একই দৃষ্টিভঙ্গী ও অধিকার বোধ গড়ে উঠেছে ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের নাগপাশকে ছিন্ন করে মানবমূখী আচরণের মাধ্যমে। যতদূর জানি, তিনি ভ্রমণপ্রিয়। সেজন্যেই বোধ হয় অগণিত বন্ধুত্বের হাতছানি নাড়া দেয় তার মাঝে দেশ-কাল-সীমানার গণ্ডী পেরিয়ে। যতটুকু জানি, তিনি বেশ কয়েকবার প্রতিবেশী বৃহৎ রাষ্ট্র ও তীর্থক্ষেত্র ভারত গমন করেছেন। পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, উইকিতে যুক্ত থাকার ফলে প্রকারান্তরে একে-অপরের প্রতি প্রচ্ছন্ন অধিকার বোধ গড়ে উঠে মনের অজান্তেই। অনেকাংশে দায়বদ্ধতার প্রসঙ্গও জড়িয়ে পড়ে। এছাড়াও, বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক জন্মায়। কোভিড-১৯ বৈশ্বিক অতিমারীর পূর্বে তামিলনাড়ুর চেন্নাইয়ে স্বীয় তনয় সুপ্রিয় দীপ রায়ের চিকিৎসার্থে অবস্থানকালে ফেসবুক পোস্টে ভারতীয় উইকিপিডিয়ান পিনাকী বিশ্বাসের কলিকাতার মদ্যপান: সেকাল ও একাল গ্রন্থ প্রকাশের সংবাদ পাই। কলকাতায় শুভেন্দু খাঁ ও তার সাথে সৌজন্য স্বাক্ষাতে গ্রন্থের সৌজন্য কপি দাবী করি। পরবর্তীতে তিনি গ্রন্থটি বাংলাদেশে নিয়ে আসেন ও নিজ উদ্যোগে ডাকযোগে আমার ঠিকানায় প্রেরণ করেন। বিষয়টির প্রতি গুরুত্বারোপ করে ও উভয়ের প্রতি কৃতজ্ঞচিত্তে ৩ নভেম্বর, ২০১৯ তারিখে এ সংক্রান্ত ফেসবুকে পোস্ট দেই।

এই যে দাবি বা অধিকার বোধ–তা কিন্তু একদিনে গড়ে উঠেনি। আস্থা, বিশ্বাস কিংবা সুগভীর ভালোবাসারই প্রতিফলনের মাঝেই ক্রমান্বয়ে সৃষ্টি করে আন্তরিকতাপূর্ণ মানবীয় পরিবেশ। ‘কর্মই ধর্ম’–এ নীতি বা জীবনদর্শনে গড়ে তুলেছি নিজেকে। আবার, এ দর্শনবোধ তার মাঝেও দেখতে পেয়েছি বা খুঁজে পাই বাস্তব জীবনের পারিপার্শ্বিকতায়। এক কথায়, ব্যস্ততাপূর্ণ কর্মময় পরিবেশে নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে তুলেছেন যেখানে-সেখানে, যে-কোনো পরিবেশে। প্রকৃত অর্থেই তা বেশ প্রশংসার যোগ্য, অতীব গুরুত্বতা ও তাৎপর্য্যতার দাবীদার।

১২ আগস্ট, ২০২২ তারিখ শুক্রবার ঢাকার মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে অপর উইকিপিডিয়ান দোলন প্রভা সহযোগে পুনরায় সাক্ষাৎ হলো। পবিত্র ঈদ-উল-আযহার পর নরসিংদীতে তাদের সাথে একত্রিত হবার কথা ছিল। কিন্তু তার অসুস্থতার কারণে স্বাক্ষাৎ না হলেও উইকিম্যানিয়া সম্মেলনে তাদের সাথে দেখা হবার বিষয়টি বেশ তাৎপর্য্য বহন করে। শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থটি যৌথভাবে তারা আমায় উপহার দেন ও স্থিরচিত্রে অংশ নেন। অল্প কিছুদিনের পরিচয়ের সূত্র ধরে লেখা প্রদানের দৃঢ় অথচ উদার আহ্বানকে সম্মান জানিয়েই আমার এ লেখনী সৃষ্টি হয়েছে। যতটুকু উনার সম্পর্কে আমি জানি তা-ই তুলে ধরলাম। পরিশেষে, ‘অনুপ সাদি সংখ্যা’র স্বার্থকতা ও সফলতা কামনা করছি এবং তাদের সুখী-সমৃদ্ধ দাম্পত্য জীবন চিরকাল যেন বহমান থাকে তারও প্রার্থনা করছি।

১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২, নরসিংদী।

আরো পড়ুন

বিশেষ দ্রষ্টব্য: অনুপ সাদি সম্পর্কিত এই মূল্যায়নটি এনামূল হক পলাশ সম্পাদিত সাহিত্যের ছোট কাগজ অন্তরাশ্রম-এর অনুপ সাদি সংখ্যা, সংখ্যা ৪, পৃষ্ঠা ৭৭-৭৮, ময়মনসিংহ থেকে ৩০ নভেম্বর ২০২২ তারিখে প্রকাশিত এবং সেখান থেকে ফুলকিবাজ.কমে প্রকাশ করা হলো।

Leave a Comment

error: Content is protected !!