
সম্পাদিত বই – বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ
ধরন- প্রবন্ধ
প্রকাশনা- কথাপ্রকাশ
প্রথম প্রকাশ – ফেব্রুয়ারী ২০১২
প্রচ্ছদ – সব্যসাচী হাজরা
পৃষ্ঠা – ২৪০
মূল্য- ৩০০ টাকা মাত্র
লেখক অনুপ সাদি সম্পাদিত বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ২৪০ পৃষ্ঠার বইটি বাংলাদেশের সমসাময়িক দার্শনিক ও প্রকৃত মানবিক বিকাশের ধারক হিসেবে প্রথম বস্তুনিষ্ট যুক্তিবাদী চিন্তাশক্তির অধিকারী এই বইটি বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বিষয়টিকে তুলে ধরেছে। আর এই চির মানবিক ও রাজনৈতিক মতবাদটিকে নিয়ে এই বইয়ে যুক্ত করা হয়েছে বাঙ্গালির প্রধান বুদ্ধিজীবীদের প্রবন্ধ।
প্রথমেই বইয়ের প্রচ্ছদের ভেতরের পৃষ্ঠায় অনুপ সাদি লিখেছেন “বাঙালির উন্নতর আদর্শ, পরিকল্পনা ও কর্মসূচিভিত্তিক বিজ্ঞান সম্মত রাজনৈতিক ধারাকে সক্রিয় অ গতিশীল ও বিকশিত করতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বিষয়ে আলোচনা জরুরি। … … ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ হচ্ছে জনগণের সাথে রাষ্ট্রের ধর্মসংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের রাজনৈতিক মতবাদ এবং এইটি জনগণের পার্থিব বিষয়ের আদর্শ।” এই বুদ্ধিবৃত্তি প্রভাবক ব্যক্তির সদূদ্দেশ্যপূর্ণ বক্তব্যটির ভেতরে ঢুকতে হলে বা আলোচনা করতে হলে আমাদের এই বইটির প্রতিটি প্রবন্ধের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বিশ্লেষণমূলক ভাবে পড়তে হবে এবং যৌক্তিক চিন্তার মাধ্যেমে গ্রহণ করতে হবে।
একটি বিশেষ দার্শনিক চিন্তা হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের সাথে পরিচিত হতে হলে, আত্মগত মানবিক বোধ জাগ্রত করতে হলে এই বইটি পড়া উচিত আমাদের সকলের। সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে মানব সমাজের সমস্যা ও সমাধানের উপর বিভিন্ন মতবাদ ও দার্শনিকতার আবির্ভাব ঘটেছে। তারই ধারাবাহিকতায় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের উদ্ভব। এর মতবাদের সংজ্ঞায়ন করতে গিয়ে বিশিষ্ট যুক্তিবাদি লেখক প্রবীর ঘোষ ‘ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গড়তে হলে কি করনীয়’ প্রবন্ধে লিখেছেন,
“নিরপেক্ষ শব্দের অর্থ কোন পক্ষের নয় ধর্মনিরপেক্ষ শব্দের অর্থ কোন ধর্মের নয়। অর্থাৎ – সমস্ত ধর্মের সংগে সম্পর্ক বর্জিত। সেকুলারিজম শব্দের আভিধানিক অর্থ – একটি মতবাদ, যা মনে করে রাষ্ট্রের প্রতিটি নীতি, শিক্ষা , প্রভৃতি ধর্মীয় শাসন থেকে মুক্ত থাকা উচিত।” এই সংজ্ঞায়নের পর ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে সংজ্ঞায়ন করার প্রয়োজনীয়তা নেই।
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের উদ্ভব ও সেই সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক ইতিহাস আমাদেরকে খোঁজ করতে হয় মানুষের ইতিহাসের সাথে সম্পৃক্ত করে। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ নিবন্ধে অধ্যাপক সনত কুমার সাহা বলেছেন যে, “প্রাক রেনেসাঁর যুগে যে অঞ্চল সেকুলার জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্রস্থল ছিল, তা ইউরোপ নয় সেটি ছিল আরব ভূখণ্ড ।” হ্যাঁ সত্যি তাই। আপনি আশ্চর্য হচ্ছেন? বিখ্যাত আধুনিক ইতিহাসবিদ এডুয়ার্ড গিবন লিখেছেন , “ইসলাম যদি না আসত তাহলে পৃথিবীর সভ্যতা এক হাজার বছর পিছিয়ে যেত।” আর যারা আধুনিক বিজ্ঞানের জগতকে আলোকিত করেছেন তারা হলেন ইবনে খালদুন, ইবনে সিনা, ইবনে রুশদ প্রমুখ। এই মুক্তবুদ্ধির সৃজনশীল মানুষগুলোর কাছে পৃথিবী চির ঋণী। যখন ইউরোপ জুড়ে ইঙ্কুইজিশনের নামে মানুষ পুড়িয়ে মারা হচ্ছে তখন আরব সমাজ এগিয়ে যচ্ছিল মুক্তবুদ্ধির পথে।
আপনাদের সামনে কতগুলো তথ্যমূলক ও বক্তব্য উপস্থাপন করা যাক। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ নিবন্ধে সনত কুমার সাহা লিখেছেন,
“মুসলমানদের মানবিক মূল্যবোধ, সহনশীলতা, জ্ঞান চর্চা সব পণ্ড করে দেয় ক্রুসেড নামের রক্তক্ষয়ী ধর্ম যুদ্ধ। শতশত বছরের রক্তক্ষয়ী দীর্ঘস্থায়ী ধর্মযুদ্ধ মুসলমানদের মানসিক বিকাশের আর সুযোগ দেয়নি। মুসলমানরা হয়ে পরে আত্মকেন্দ্রীক, জীর্ণ ও অন্তঃসার শূন্য। তাদের জ্ঞান আহরণ করে রেনেসাঁর নায়কেরা আর তারা ধর্মান্ধতার খোলস থেকে বের হতে পারেনি। তারা পরে থাকে অপরিসীম অহংকারের কূপমণ্ডূকতাকে আত্মরক্ষার পরম পথ বলে বেছে নেয়।”
কিন্তু আশ্চর্য হতে হবে এইখানে যে, মুসলমানেরা তখন ধর্মীয় গণ্ডির বাইরের জগতে নেই। তখন ভারতীয় উপমহাদেশে তাদের বিজয় পতাকা উড়ছে। দিল্লির মসনদে বসে কোন মুসলমান রাজবংশ ইসলামি সরিয়া আইন বাস্তবায়ন করেননি। তারা রাজনীতি ও রাজ্যনীতি থেকে ধর্মকে দূরে রেখেছেন সম্পূর্ণ ইহজাগতিক কারণে।
এই ধরনের যুক্তিপূর্ণ অনেক আলোচনা রয়েছে বইটিতে। তবে চলুন আপনাদের সামনে কতগুলো মূল্যবান তথ্য উপস্থাপন করি। মধ্য যুগের বিখ্যাত ইতিহাসবিদ জিয়াউদ্দীন বরানি তারিখ-ই-ফিরোজশাহীতে সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবনের উদ্ধৃতি করে বলছেন – “আমাদের প্রভু ইলতুতমিশ বলতেন সুলতানের পক্ষে ধর্মবিশ্বাস মেনে দীনদারি বা রাষ্ট্র শাসন করা সম্ভব নয়। ধর্মবিশ্বাস রক্ষা করা বা দীনপানাহি করতে পারাই যথেষ্ট।” বারানি আলাঊদ্দীন খিলজির মত উদ্ধৃতি করে লিখেছেন যা আমরা পাই শামসুজ্জামান খানের নিবন্ধে, “শরিয়তে কি লিখা আছে তার উপর নির্ভর না করে রাষ্ট্রের স্বার্থে যা করা উচিত বলে মনে করবেন, সুলতানের তাই করা উচিত।”
তখনকার সময় অর্থাৎ ১২০০ এর পর ভারতের মুসলিম শাসনের অবসান হওয়ার আগ পর্যন্ত সুলতান অথবা বাদশাহকে ইহজাগতিক কারণ বশত সমাজে ন্যায়বিচার ও কোন ধর্মসম্প্রদায়ের এক অংশ যেন অন্য অংশের উপর আধিপত্যবিস্তার না করতে পারে।
অন্যদিকে ইউরোপ ইনকুইজিসন এবং ধর্মীয় গোঁড়ামির ধর্মযুদ্ধ থেকে সরে আসতে শুরু করে ষোড়শ শতাব্দির রেফরমেশন এর ফলে। কখনো রাজা নিজেই নিজেকে সর্বেসর্বা মনে করে। এই সব চরম অমানবিক দ্বন্দ্ব থেকে ইউরোপীয় সমজের মানুষ বেরিয়ে আসতে শুরু করে। আর সেই রেফর্মেশনের যুগেই ইহজাগতিক কারণে সমাজের মানুষের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য যেমন রাষ্ট্রের জন্ম হয় ঠিক ধর্ম্নিরেপেক্ষতার দার্শনিক ও রাজনৈতিক যৌক্তিকতাও বেড়ে যায়।
আমরা যখন পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের দেশগুলোর দিকে তাকাই তখন দেখি পৃথিবীর বেশির ভাগ রাষ্ট্র নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে পরিচিত করায়। কারণ সংবিধানে তারা এই শব্দটির উল্লেখ রেখেছে। কিন্তু আদতে এইসব রাষ্ট্রগুলো ধর্মনিরপেক্ষ কিনা প্রশ্ন জাগে। আমরা যদি ভারত, বাংলাদেশ, তুরস্ক ও আমেরিকার দিকে তাকাই তাহলে স্পষ্ট ধারনা পেতে পারি। ‘ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ও ধর্মনিরপেক্ষ ধর্ম’ প্রবন্ধে যতীন সরকার লিখেছেন,
“ধর্মনিরপেক্ষতাকে যারা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সংবিধানের অন্যতম স্তম্ভরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তারা সবাই যে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রকৃত তাতপর্য সম্পর্কে অবহিত ছিলেন, তেমন মনে হয় না। ভাসা ভাসা ধারনার বেশি কিছু তাদের ছিলনা বলেই ধর্মনিরপেক্ষতার শত্রুদের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে তারা সুদৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করতে পারেননি, এখনো পারছেন না।”
বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে প্রগতিশীল মানুষদের মধ্য যে প্রশ্ন তার উত্তর উপরের সংশ্লিষ্ট বক্তব্যে। যারা ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে এবং যারা রাষ্ট্রীয় সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার সংস্কৃতি, গণতান্ত্রিক মনোভাব ও সহনশীলতা ধারণ করেন কি? হতে পারে ক্ষমতার জন্য নাম মাত্র বুলি আওড়ানো।
এই বইটি প্রথমেই আপনাকে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা, উদ্ভব, বিকাশ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারনা ও যুক্তি তুলে ধরবে। বইয়ের প্রথম পাঁচটি প্রবন্ধে এই বিষয়টি উল্লেখ করা আছে। এরপর বইটিতে ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র কেন প্রয়োজন, ধর্মনিরপেক্ষতার গুরুত্ব কেন এখন পৃথিবীর দেশে দেশে আলোচিত হচ্ছে ইত্যাদির বিশ্লেষণাত্মক বক্তব্য নিয়ে আটটি প্রবন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। একটি রাষ্ট্র কেন ধর্মনিরপেক্ষ হবে বা রাষ্ট্রকে কেন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের সংস্কৃতি গ্রহণ করা উচিত সেই প্রশ্নের উত্তর আপনার সামনে ভেসে আসবে রোদ্রালোকজ্জল দিনের মত। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও বাংলাদেশ, ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা কি? বাংলাদেশ কি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র? নাকি নাম মাত্র ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করতে চায় ক্ষমতা লিপ্সু শোষক শ্রেণীর রাজনৈতিক দলগুলো? বাঙ্গালির ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারনা পাবেন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও বাংলাদেশ, ধর্মনিরপেক্ষতার শিক্ষা বিষয়ক প্রবন্ধগুলোতে। বাংলাদেশ কি ধর্মনিরপেক্ষতার শিক্ষা গ্রহণ করতে পেরেছে? কেন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ সম্পর্কে মানুষের মনে অসন্তোষ? ধর্মচর্চার ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতি কি মানুষের ব্যক্তি মানসের সঠিক ভাবে গ্রহণ করেছে বা করতে পেরেছে? আর এই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বা সেকুলারিজম নিয়ে মানুষের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া ও উৎসব অনুষ্টানে কেন ধর্মনিরপেক্ষ চর্চা হতে পারছে না এই সব প্রগতিশীল চিন্তার আলোকপ্রাপ্তি ঘটবে পাঠকের বইটি পাঠ করার পর। এ প্রসঙ্গে অমর্ত্য সেন লিখেছেন,
“ধর্মীয় সংগঠন সংক্রান্ত অর্থে নয়, রাজনৈতিক অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতা একটি বিশেষত ধর্মীয় সংস্থা থেকে রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নতা দাবি করে। এটিকে অন্ততপক্ষে দুভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।প্রথমত দৃওষ্টিভঙ্গিটির যুক্তিতে ধর্মনিরপেক্ষতা সকল ধর্ম থেকে সমদুরত্ব দাবি করে- কোনও বিশেষ পক্ষের দিকে ঝোকার প্রবণতা প্রত্যাখান করে সকলের প্রতি নিরপেক্ষ মনোভাবের উপর জোর দিয়ে বলে যে, রাষ্ট্রের কোনও ধর্মের সঙ্গেই কোন সম্পর্ক রাখা উছিত নয়। অতএব সমদুরত্বের রূপ হবে সকল ধর্ম থেকে সম্পুর্ণ আলাদা হয়ে থাকা।”
ধর্মনিরপেক্ষতার প্রকৃত রূপটি কি হওয়া উচিত সেই ক্ষেত্রে অমর্ত্য সেনের এই বিশ্লেষণি ব্যাখ্যা আমাদের স্পষ্ট ধারনা দিচ্ছে। বিশেষ করে রাষ্ট্র নামের যন্ত্রটিকে মতাদর্শিকভাবে, সাংবিদানি আইন দ্বারা এবং যে কোন ধর্মের প্রতি কোন রকম ঝোক না রেখে ধর্মনিরপেক্ষ সদংস্কৃতি বজায় রাখতে হবে। কিন্তু বর্তমান সময়ের আধুনিক জাতি রাষ্ট্রগুলো কতটুকু ধর্মনিরপেক্ষতার সংস্কৃতি চালু রাখতে পেরেছে? বা ভাবাদর্শিকভাবে জনগণের মধ্যে কি ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনা জাগরিত করতে পেরেছে? অমর্ত্য সেন তার ‘ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কিত অসন্তোষ’ প্রবন্ধে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে এইসব বিশ্লেষণ করেছেন।
১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে রাষ্ট্রে প্রতিষ্টিত হয়েছে বাংলাদেশ নামে, সেই প্রতিষ্টার অন্যতম একটি মুল লক্ষ্যছিল এই রাষ্ট্র হবে ধর্ম নিরপেক্ষ। কিন্তু সুবিধাভোগী রাজনৈতিক দল গুলো মুক্তিযোদ্ধের চেতনার প্রকৃত তাতপর্যকে হত্যা করেছে।বিএনপি সংবিধান থেকে বন্দুকের নলের ডগায় নিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতাকে উচ্ছেদ করে ছিল আর আওয়ামী লীগ তার রাজনৈতিক স্বার্থে রাষ্ট্রের ফুলদানিতে সাজিয়ে রেখেছে সুগন্ধী মানবতার ফুল হিসেবে। কিন্তু হায়! দুঃখ এইভেবে যে সেই ফুলদানির ভেতর ফুল আছে ঠিকিই কিন্তু কাচ দিয়ে চার দিক আঠকানো এবং বিদেশি সুবিধাভোগী বন্ধুদের দেখানো হয়। সেই ফুল থেকে কোন সুগন্ধ বের হতে পারে না।
ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতি ও সাহিত্যের দিকে যদি লক্ষ করি তাহলে যে সব বিখ্যাত চরিত্রগুলো আমাদের সামনে আসে তাদের মধ্যে অনেকেই ধর্মনিরপেক্ষতার ক্ষেত্রে কুখ্যাত ছিলেন। প্রথমেই বলি মোহনদাস গান্ধী, মিস্টার জিন্নহা, রামমোহন রায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অরবিন্দ ঘোষ, ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানী — এই লোক গুলো রাজনীতি, ব্যক্তিত্ব, সাহিত্য দ্বারা সমাজকে প্রভাবিত করেছেন। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারেননি। তাদের ধর্মনিরপেক্ষতাকে নিয়ে যতেষ্ট প্রশ্ন আছে ও বিতর্কিত। আবার একমাত্র বাঙ্গালী ব্যক্তি হিসেবে ইতিহাস থেকে কাউকে ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে খুজে পাওয়া কঠিন। বাঙালির তেভাগা আন্দোলন ছিল ধর্মনিরপেক্ষ। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লিখেছেন,
“তে-ভাগা আন্দোলনে সাম্প্রদায়িক বিরোধ ছিল না। কে হিন্দু কে মুসলমান তার হিসেব করে দেখেনি; ঠিক তেমনি ভাবে জোতদারদের কার কি ধর্মীয় পরিচয় সে-জিজ্ঞাসা ওঠেনি; জোতদারেরা সবাই জোতদার, কৃষকেরা সবাই কৃষক, সত্য ছিল এটাই। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনও তাই, বাংলাভাষায় হিন্দু-মুস্লিম স্বাত্নত্রের যে- বিষয়টি এতকাল বিরোধের সৃষ্টি করে এসেছে, বায়ান্ন সালে সে-বিরোধ আর সত্য ছিলনা, পাকিস্তানি রাষ্ট্রের চেষ্টা সত্ত্বেও নয়।”
আর এই সব আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে তৈরি হয় ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক চেতনার মুক্তিযুদ্ধ।যার মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্টিত হয়েছে। এবং আওয়ামীলীগ সরকার ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার জন্যে ৫৭ দ্বারা প্রণয়ন করেছে। বিএনপি তো তাদের ধর্মকে ব্যবহারের ক্ষেত্রে দাদা। ইতিহাস বলে দেয় আওয়ামী লীগ কতটুকু ধর্মনিরপেক্ষ। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার প্রবন্ধে লিখেছেন,
“পিছনে ফিরে তাকালে দেখব যে মধ্যবিত্ত তরুন যতটা এগিয়েছে, নেতৃত্ব ততটা এগোয়নি। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূচনা ঘটেছে ১৯৪৮-এ আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্টা ১৯৪৯-এ। সংগঠনের নামে মুসলিম শ্বব্দটি লক্ষ্য করার মত।মুসলিম লীগের বিরোধী সে, কিন্তু নিজে সে মুসলিম লীগই, জনগণের মুসলিম লীগ। মুসলিমত্ব সে বর্জন করেছে আরো পরে। বায়ান্নতে রাষ্ট্রভাষা যখন একটি গুরুত্বপুর্ণ রুপ নেয় তখনো নয়, চুয়ান্নতে যুক্তফ্রন্ট যে জয়ী হয় তখনও নয়; মুসলিম পরিচয় ছাড়ল সে পঞ্চান্নতে এসে।”
তিনি আরো লিখেছেন “ছয় দফার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শাসনতন্ত্রের দুটি খসড়া তৈরি করা হয়েছিল- একটি ১৯৬৯-এ, অন্যটি ১৯৭১-এ। উভয় খসড়াতেই রাষ্ট্রের নাম ছিলো ইসলামি প্রজাতন্ত্র।” [বাঙ্গালির ধর্মনিরপেক্ষতা, পৃষ্টা- ১১৩]
আমাদের দেশের তথাকতিত বাম ও কমিউনিস্টরা তাদের বক্তব্য দিয়ে খালাস। আর আমাদের বড় দুইটি রাজনৈতিক দল ধর্মনিরপেক্ষতাকে নিজেদের হাতেই হত্যা করেছে। দুটি দলই ক্ষমতায় ছিল কিন্তু ধর্মীয় সহনশীলতার শিক্ষা, ধর্মনিরপেক্ষতার চিন্তা, এমনকি প্রগতিবাদী চেতনাকেও জাগরত করতে কোন দায়িত্ব নেয়নি। তারা ধর্মনিরপেক্ষতাকে পুঁজি করে ক্ষমতায় যেতে চেয়েছে।
কাজী নজরুল ইসলাম এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, এই দুজন মানুষ ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। রবীন্দ্রনাথ নিজে ধার্মিক ছিলেন এবং তিনি কোন অবস্থাতেই ইহজাগতিকতাকে অস্বীকার করেননি। কাজী নজরুল ইসলাম একজন ব্যক্তিই যিনি হিন্দু পুরাণ ও মুসলিম ঐতিহ্যকে এক করতে পেরেছিলেন তার কাজ দিয়ে। কিন্তু সমাজ বাস্তবতা কত যে সমস্যা তৈরি করে সৃষ্টিশীল মানুষদের তা আমরা সবাই জানি।
সবশেষে বলা প্রয়োজন ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র এবং ধর্মকে পুঁজি করে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করা কমবেশি পৃথিবীর সকল জায়গায় প্রচলিত।ভারতকে ভাগ করা হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে।হাল আমলের মধ্যপ্রাচ্য, মিশর, আফগানিস্তান এবং নামে বৃহত্তর দেশ ভারত। এর মধ্যে সবচেয়ে দুঃখজনক হলো এক সময়ের কমিউনিস্ট দেশগুলো আজ মৌলবাদিদের আখড়া। পোল্যান্ড, আলবেনিয়া, রাশিয়া, ইউগোস্লাভিয়া, আজারবাইজান ইত্যাদি দেশে মৌলবাদ প্রকট, তাছাড়া তাজাকিস্তান বর্তমান সময়ের উদাহরণ হতে পারে।
ফুলকিবাজ ডট কমে অতিথি লেখক হিসেবে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, কলাম, অনুবাদ, নিবন্ধ ও প্রবন্ধ লেখায় সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন পূরবী সম্মানিত, ইভান অরক্ষিত, রনো সরকার, দিল আফরোজ, অনাবিলা অনা এবং রণজিৎ মল্লিক। এছাড়াও আরো অনেকের লেখা এখানে প্রকাশ করা হয়।