সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের জন্ম ১৮ জানুয়ারি, ১৯৫১ সালে বাংলাদেশের সিলেটে। তিনি একজন গবেষক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার ও শিল্প সমালোচক। তিনি স্বাধীনতার পর থেকে নিয়মিত লেখালেখি করে আসছেন। দেশ, সমাজ ও রাজনৈতিক কলাম লেখায় সিদ্ধহস্ত আছেন বহুদিন থেকে। বিশ্বসাহিত্য ও বাঙলা সাহিত্য সম্পর্কে লিখেছেন অনেক প্রবন্ধ। বিশটিরও অধিক গ্রন্থের রচয়িতা তিনি। প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দল আওয়ামি লিগের সমর্থক হিসেবে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন শূন্য দশকে। ২০১৩ সালে তিনি সাম্রাজ্যবাদি সংস্থা টিআইবির সাথে জড়িয়ে পড়েন। পেশাগত দিক দিয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। তাঁর বর্তমান সাক্ষাতকারটি আমি ২০০০ সালের অক্টোবর মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে তাঁর রুমটিতে গ্রহণ করি।
অনুপ সাদি: অনেকেই বলেন এ সমাজকে নষ্ট সমাজ। আপনার কেমন মনে হয়?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: সমাজের একটা অংশ মাত্র নষ্ট-যে অংশটা সমাজ পরিচালনার দায়িত্বে সে অংশটা। পুরো সমাজ কিন্তু নয়; কারণ সমাজ অনেক বড়। আমরা শহরে থাকি, আমাদের চারদিকে দুর্নীতি দেখি, মানুষের বিকিকিনির ব্যাপারটা দেখি; কিন্তু যে সমস্ত মানুষ দূরে থেকে আমাদের পিছনে শ্রম দিচ্ছেন, নিঃশব্দে কাজ করে যাচ্ছেন, তারা কিন্তু পচেননি।
অনুপ সাদি: আপনি যে সমাজের মানুষ হতে চান সে সমাজের রুপরেখা দেবেন কি?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: আমি এমন এক সমাজ দেখতে চাই যা খুব সহনশীল এবং সংস্কৃতিবান; যেখানে মানুষে মানুষে শ্রদ্ধা আছে, সততা আছে, যে সমাজে দেশপ্রেম আছে। এই জিনিসটারই সবচেয়ে বেশি ঘাটতি আমাদের দেশে। দেশপ্রেমটা পুরোমাত্রায় থাকতে হবে; অপরিসীম আত্মপ্রেম থাকবে না; দল থাকবে, দলাদলি থাকবে না; শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকবে, মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করবে, শিক্ষকরা শিক্ষা দিবেন কিন্তু হানাহানি থাকবে না; যে সমাজে মানুষের মূল্য তার অবস্থান বা তার পেশা অথবা আয়ের ভিত্তিতে হবে না; মানুষের মূল্য হবে মানুষের ভিতরের যে বস্তু আছে তার নিরিখে।
অনুপ সাদি: আমাদের সমাজের মৌল কাঠামোতে কিরূপ পরিবর্তন ঘটছে এবং এ পরিবর্তনকে আরো গতিশীল করা যায় কীভাবে?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: ভালো প্রশ্ন। সময়োপযোগীও বটে। আমাদের সমাজটা কিন্ত বদলাচ্ছে, এই যে বলা হলো সমাজ নষ্ট হচ্ছে, পচে যাচ্ছে, এর কারণটা হচ্ছে যে তার ভিতরে প্রচণ্ড নাড়া এসেছে; এতে সমাজ গতিশীল হচ্ছে। গতিশীলতার সুযোগ নিয়ে কিছু মানুষ আখের গোছাচ্ছে বটে। তবে গতিশীলতার তিনটা ভালো লক্ষণ আমি দেখতে পাইঃ একটা হচ্ছে শিক্ষার বিস্তার। আমাদের দেশে যেভাবেই হোক, সরকারের উদ্যোগে এবং এনজিও’র সহযোগিতায় শিক্ষার বিস্তার ঘটছে এবং শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মধ্যে সচেতনতাও বাড়ছে। দ্বিতীয়টা হলো গত ১০ বছর ধরে আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চলছে, আমাদের প্রত্যাশা মতো না হলেও কিছুটা গণতান্ত্রিক তো; কাজেই এর একটা প্রভাব আমাদের জনজীবনে পড়ছে। আর তৃতীয়টা হলো মেয়েদের বড়ো সংখ্যায় কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ; এটা একটা বিশাল পরিবর্তন; মেয়েরা শিক্ষিত হচ্ছে, আত্মসচেতন হচ্ছে, সমাজের দায়িত্ব নিচ্ছে। সমাজের সমস্ত ব্যাপারে তাদের অংশগ্রহণ খুব গুরুত্বপূর্ন বলে আমি মনে করি। মেয়েদের এই সমাজের মৌল পরিবর্তনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার ফলে কিন্তু সমাজ কাঠামোর পরিবর্তন হচ্ছে। পরিবর্তন আরো আছেঃ বাঙালিরা স্বাধীনতার পর উদ্যোগী হওয়া শিখেছে। এখন গ্রামে গঞ্জেও দেখা যায় তরুনেরা ছোটখাটো ব্যবসা করছে, হয়তো মুরগীর ফার্ম করছে, নয় ফুলের চাষ। অনেকে বিদেশে যাচ্ছে, বিদেশে বিশাল একটা শ্রমবাজার বাঙালিরা দখল করে নিয়েছে এবং তারা টাকা পাঠাচ্ছে, দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করছে। এই যে বাঙালীদের উদ্যোগ ও উদ্যম এটি কিন্তু আরো একটা বিশাল পরিবর্তনের সূচনা বলে আমি মনে করি।
অনুপ সাদি: শ্রেণিহীন সমাজ ব্যবস্থা আমাদের জন্যে কতটা দরকার?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: আমরা সবাই স্বপ্ন দেখি যে সমাজ ব্যবস্থা শ্রেণিহীন হবে। আসলে কিন্তু সেটা সম্ভব নয়; কারণ সেই সোভিয়েত বা চিনের সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাও শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারলো না। আমার মনে হয় আমরা চাই না চাই সমাজের শ্রেণি থাকবেই; এটা একটা ঐতিহাসিক ব্যাপার; সমাজতাত্ত্বিকও। তবে শ্রেণিগুলোর ভিতর আমরা যদি বৈষম্য কমিয়ে আনতে পারি এবং শ্রেণিকে আমরা শ্রেণি না বলে উদ্যোগ বা পেশাগত বিচরণক্ষেত্র বলে চিহ্নিত করতে পারি, তাহলে ঐ সমস্যাটা থাকে না। আমরা ধনী এবং দরিদ্র কেন বলবো? আমরা দারিদ্র কমিয়ে আনবো। সেই লক্ষ্যে উদ্যোগ নিবো। এমন একটা সমাজব্যবস্থা তো গড়া যায় যেখানে কেউ খুব বেশি ধনী হবে না আবার গরিবও থাকবে না। আমরা যদি শ্রেণিচিন্তায় না যাই- শ্রেণি যে খুব গুরুত্বপূর্ণ জিনিস এবং আমি এটা শ্রেণিতে আছি, আমার নিচের শ্রেণিতে অন্যরা আছে-এই চিন্তা ভাবনা যদি ভাঙতে পারি, তাহলে কিন্তু শ্রেণি বিষয়টা গৌণ হয়ে পড়ে।
অনুপ সাদি: পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মুনাফার যে ব্যাপারটা তার নগ্ন চেহারাটা প্রকাশ করছে।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: অবশ্যই। শ্রেণির মতো মুনাফাও একট বাস্তবতা। মুনাফা না থাকলে উদ্যমটাও থাকে না। আমার মনে হয় মানুষের নৃতাত্ত্বিক বিবর্তনের সঙ্গে স্বার্থপরতার বিষয়টা জড়িত সেই সারভাইভ্যাল অফ দি ফিটেস্ট সিনড্রোম। লাভ ছাড়া নিঃস্বার্থভাবে কাজ করতে আগ্রহী ক’জন লোক? সেজন্য মুনাফাটা ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়িয়ে এখন ব্যাক্তির আদান-প্রদানেও ঢুকে পড়েছে।
অনুপ সাদি: কিন্তু মুনাফা কি এক রকম শোষণ নয়?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: মুনাফা তো অবশ্যই শোষণ। এই শোষণ একেবারে দূর করা সম্ভব নয়, তবে একে কমিয়ে আনা যায়, একটা সহনীয় পর্যায়ের নিয়ে আসা যায়। একজন ব্যবসায়ী যখন ব্যবসাপাতি করে সে লাভের জন্যেই করে-এটি চ্যারিটি ওয়ার্ক নয়, দান-খয়রাতের ব্যাপার নয়। লাভ না থাকলে ব্যবসায়ী এগিয়ে আসবে কেন? কিন্তু লাভ বা মুনাফাটা অমানবিক হয়ে দাঁড়ায় যখন শোষণটাই মুনাফার মাধ্যম হয়। যদি এমন একটা ব্যবস্থা করা যেত-আমি জানি না সম্ভব কি না, অর্থনীতিবিদরা শুনে অট্রহাসি হাসবেন-যে শোষণটা থাকবে না, মুনাফাটা থাকলেও। ধরা যাক, একজন ব্যবসায়ী ৪০ ভাগ মুনাফা করছে কোনো ব্যবসাতে। সে যদি মুনাফার ত্রিশ ভাগ শ্রমিকদের ফিরিয়ে দিতো, তাদের মৌলিক প্রয়োজনগুলো, তাদের সার্বিক কল্যাণ মেটাতে পারতো ঐ টাকায়, তা হলে মুনাফাটা একটা সহনীয় পর্যায়ে থাকতো। একে তার বিপরীতে স্বাভাবিক রিটার্ন বলে ধরা যেতো। এই ৪০ ভাগ, ১০ ভাগ অবশ্যই আমার বানানো হিসাব-শুধু অর্থনীতিবিদরাই পারেন মুনাফার ভালো মাপজোক করতে। কিন্তু মানুষের লোভটা প্রচন্ড না হলে, অমানবিক না হলে অন্যের জন্যে সামান্য ভালোবাসা থাকলেও মুনাফার সঙ্গে শোষণের এমন অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক তৈরি হত না।
অনুপ সাদি: বাঙালিদের মধ্যে গণতান্ত্রিক আচরণ গড়ে উঠেনি। এটা কি যুগ যুগ ধরে পরাধীন থাকার ফলে আমাদের জাতিগত সমস্যা?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: একটা কারণ হলো আমাদের এই উপমহাদেশে দীর্ঘকাল রাজা-রাজড়াদের শাসন চলেছে, উপনিবেশি শাসন চলেছে, যেখানে জনগণের অংশগ্রহণের কোনো প্রশ্নই ছিল না। এরপর আমরা চব্বিশ বছর ছিলাম পাকিস্তানি শাসনের অধীনে যেখানে বাঙালির নিজের ভবিষ্যত গড়ে তোলার সুযোগ ছিল না। তারপর আমরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গেলাম কিন্তু সেখানে গণতান্ত্রিক আচার-আচারণ গড়ে তুলতে পারিনি। তারপর পরই চলে আসলে সামরিক শাসন যা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে চললো ৯০ সাল পর্যন্ত। কাজেই আমরা খুব বেশিদিন নিজেদের শাসন নিজেরা করি নি। পালিত হয়েছি। পালিত হলে গণতন্ত্রের জন্যে আকুলতাটা বড়ো হয়ে দেখা দেয়; গণতান্ত্রিক আচার-আচরণ তৈরি হয় না।
অনুপ সাদি: দেখা যাচ্ছে পরোক্ষভাবে নির্বাচিত মহিলা আসন কয়টির কারণে আমাদের গণতন্ত্রকে সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রকৃত রুপ দেয় যাচ্ছে না।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: আমার মনে হয় সংরক্ষিত মহিলা আসন ব্যবস্থা খুব বেশিদিন থাকবে না, হয়তো আরো পাঁচ বছর, হয়তো দশ। আমরা অবশ্য সহজেই খুব ধৈর্যহীন হয়ে পড়ি, অতোটা ধৈর্য্যচ্যুতি ভালো নয়। আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ার কাজ শুরু হয়েছে মাত্র দশ বছর। একটা জাতির ইতিহাসে এই কয়েকটি বছর কিছুই নয়। গত দশ বছরে আমাদের অনেক ভুলভ্রান্তি হয়েছে, আমাদের এখনো যে রাষ্ট্রব্যবস্থা তা খুবই শোষণমূলক, গণতন্ত্রের নামে যেটা চলছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। তবুও মানুষ কিন্তু প্রশ্ন করতে শিখেছে। এ প্রজন্মের মানুষ যখন প্রশ্ন করতে শিখেছে, আমার মনে হয় দশ বছর পর দেখা যাবে যে আমাদের গণতান্ত্রিক আচার-আচরণ অনেক উন্নত হয়েছে। তখন হয়তো সংসদে মহিলারা সরাসরি নির্বাচিত হয়ে আসবেন, হয়তো তাদের প্রতিনিধিত্ব হবে কুড়ি শতাংশ। হয়তো আরো পঞ্চাশ বছর পর দেখা যাবে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার মতো অবস্থা হয়েছে আমাদের দেশে, যেখানে মহিলারাই অধিক সংখ্যায় আসছেন রাজনীতিতে।
অনুপ সাদি: একটু সংস্কৃতির দিকে যাই, “হাতে হাত ধরে-ধরে গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে/কার্তিকের মিঠে রোদে আমাদের মুখ যাবে পুড়ে;/ফলন্ত ধানের গন্ধে রঙে তার স্বাদে তার ভবে যাবে আমাদের সকলের দেহ;/ রাগ কেহ করিবে না আমাদের দেখে হিংসা করিবে না কেহ।[১] এ ধরনের একটিও উৎসব বাঙালির জীবনে নেই কেন?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: নেই বলেই কবিতাটি লেখা হয়েছে (হেসে); কবিতার ভবিষ্যতকালটা লক্ষ্যনীয়; নেই, কারণটা হচ্ছে এই যে, বাঙালি এখনো গোত্রভিত্তিক একটি সম্প্রদায় মাত্র। বাঙালি এখনো খুব বড়ো জাতি হয়ে উঠতে পারেনি; এটা বলায় কেউ কেউ আমার উপর রাগ করবেন, কেউ কেউ বিরক্ত হবেন, কিন্তু আমি ভেবে চিন্তেই কথাগুলো বলছি। একটি জাতির যে কতকগুলো বৈশিষ্ট্য থাকে সেগুলো আমরা এখনো অর্জন করতে পারিনি। তার জন্যে আরো সময় লাগবে আমাদের। এখনো খুব খন্ডিত আমাদের জীবনযাত্রা, আমদের চিন্তা-চেতনা। এখনো আমাদের প্রথম বিশ্বস্ততা পরিবার ও গোত্রের প্রতি, দেশের প্রতি নয়। সব ব্যাপারে আমরা নিজেদের লাভটা প্রথমে দেখি। আমি আমার নিজের লাভ খুব হিসাব করি, প্রতিবেশির কথা আমি চিন্তা করি না; ফলে বাঙালি জাতি নিজেকে এক গোত্রশাসিত, বর্ণশাসিত, শ্রেণিশাসিত সমাজ হিসেবে গড়ে তুলেছে। এ ধরনের সমাজে শ্রেণি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এক হওয়ার মতো অনুপ্ররণা বা সুযোগ সৃষ্টি হয় না। যখন হয় (যেমন মুক্তিযুদ্ধের সময়) ঐ ঐক্য শিগগিরই ভেঙে যায়। আবার সেই গোত্র, দল, পরিবার। কৃষকরা এক জায়গায় একত্র হয়ে গান গাইলে জমিদাররা ওইখানে থাকবে না; তারা নিজেরা একত্র হয়ে নিজেদের ফূর্তি করবে। জমিদার-কৃষকের মিলিত উল্লাস কখনো সম্ভব নয়। তাহলে জমিদার থাকতো না। এখানে জমিদার ও কৃষক বাঙালি সমাজব্যবস্থার দুই প্রান্তের দুই অবস্থানের প্রতীক। বাঙালি দীর্ঘদিন ধরে দরিদ্র, বাঙালি খুব নিষ্পেষিত নিজের দ্বারা; উচ্চবিত্ত শ্রেণি, শিক্ষিত শ্রেণি শোষণ করেছে দরিদ্র শ্রেণিকে। জীবনানন্দ নিজেও হয়তো কৃষকের সঙ্গে হাত ধরে ঘোরাঘুরি করে কার্তিকের মিঠে মুখ পোড়াতে পারতেন না। সমাজ ব্যবস্থাটা এর অনুকূল নয়। এটি ভাঙার চেষ্টাও সচেতনভাবে বেশি মানুষ করেননি। জীবনানন্দের এই ইউটোপিয়া কল্পনাতেই বেশি বৈধ, বাস্তবে নয়।
অনুপ সাদি: ‘বাঙালী সংস্কৃতি’ বলতে আপনি কী বোঝেন? এর রূপ কী চিরস্থির?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: না, কোনো সংস্কৃতির রূপ চিরস্থির নয়, শিল্পের মতো সংস্কৃতি পরিবর্তিত হয় না, সংস্কৃতির উপাদান পরিবর্তিত হয়। সংস্কৃতির উপাদান কী? অসংখ্য_ সাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, চিত্রকলা, প্রতিদিনের জীবনাচরণ, পারিবারিক মূল্যবোধ, শিক্ষা, ধর্ম-এ সমস্ত মিলে তৈরি হয় সংস্কৃতির শরীর। সংস্কৃতি বলতে আমি একটা জনগোষ্ঠীর সার্বিক জীবনাচরণ, শিল্পিত, চর্চিত এবং নান্দনিক দিকটাকে বুঝি। এই নান্দনিকতা মিনারবাসী নয়, এর সঙ্গে আছে জীবনের সম্পৃক্ততা। একজন মানুষ কীভাবে খাবার গ্রহণ করেন, সেখানেও সংস্কৃতি আছে, কীভাবে পোষাক পরছেন সেখানেও একট সৌন্দর্যের বিষয় থাকে। কাজেই প্রায়োগিক ও শৈল্পিক এই উভয় প্রকার জীবন যাত্রার সম্মিলিত রুপকে বলা যায় সংস্কৃতি। জীবনযাত্রার অপরিহার্য অংশ না হলে এবং শিল্পীত না হলে কোনো বিষয় একটা জাতির সংস্কৃতিতে ঠাঁই করে নিতে পারে না। যেমন_ আমাদের সংস্কৃতিতে ধর্ম বরাবরই একটা উপাদান; কিন্তু ধর্মন্ধতা নয়। উগ্রবাদ আমাদের সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য নয়। কিন্তু এখন কিছু মানুষ ধর্মকে ভিত্তি করে উগ্রবাদ সঞ্চার করার চেষ্টা করছে; এটি কিন্তু সংস্কৃতি গ্রহণ করেনি, করবেও না। গ্রামে-গঞ্জে এখনও দেখি যে, অতীতের সহনশীলতা মানুষের মধ্যে আছে। উগ্রবাদীরা চেষ্টা করছে তাদের সংস্কৃতির বীজ ঢোকাতে; কিন্তু এরা তা পারবে না। পারবে না এজন্য যে, এ সংস্কৃতির মানুষ ধর্মকে ভালবাসে, কিন্তু ধর্মের অন্ধতাকে পছন্দ করে না। এদেশের মানুষ সংগীতকে জীবনের অংশ মনে করে; কেউ যদি বলে গান গাওয়া চলবে না, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ উঠবে। এই যে ফসলের কথা একটু আগে বলা হলো, এই ফসল কাটাও সংস্কৃতির একটা অংশ, এই ফসল কাটার একটা উৎসব আছে; সেই উৎসব আদিকাল থেকে এখন পর্যন্ত একই রকম চলছে; নবান্নের উৎসবে এখনো গ্রামের মানুষ মেতে উঠে। বাঙালির কিছু চিরস্থায়ী সম্পদের একটি হলো তার সংস্কৃতি। তবে সংস্কৃতির উপাদান পরিবর্তিত হচ্ছে। যেমন- পশ্চিমা আকাশ সংস্কৃতির একটা প্রভাব পড়ছে আমাদের সংস্কৃতিতে; এটা মানতেই হবে। তেমনি আমদের বেশভূষায়, শিক্ষাব্যবস্থায়, ব্যবসা-বাণিজ্যে পশ্চিমের প্রভাব পড়েছে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু এই প্রভাবগুলো শেষ পর্যন্ত গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়েই সংস্কৃতির একটা অংশ হয়ে দাঁড়ায়। যে সংস্কৃতির ভিতরে শক্তি আছে তা বাইরের প্রভাবকে ভয় পায় না, তাকে সে আত্মস্থ করে নেয়। এভাবেই সংস্কৃতি এগুয়।
অনুপ সাদি: বর্তমান বাঙালি সংস্কৃতির কোন ধারা প্রবণতাগুলো একুশ শতকের বাঙালি সংস্কৃতিকে আত্মপ্রত্যয়ী ও শক্তিশালী করবে বলে আপনার মনে হয়?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: আমি মনে করি বাঙালির ভিতর একটি সৃষ্টিশীল ধারা সব সময়ই আছে, যেটি খুব আত্মপ্রত্যয়ী। যে কোনো দুর্যোগের সময় বাঙালি উঠে দাঁড়াতে জানে; এটি তার সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য। বাঙালি সংস্কৃতির একটি শক্তি হচ্ছে এর ব্যাপক ভিত্তিকতা এবং এর গ্রহণ-বর্জনের ক্ষমতা। একটু আগে যে তালেবান সংস্কৃতি ও আকাশ সংস্কৃতির কথা বললাম, সে দু’টি বাইরে থেকে আসা, চাপিয়ে দেয়া। বাঙালি দু’টোকেই দেখছে, যাচাই করছে। যদি গ্রহণ করার কিছু থাকে গ্রহণ করবে, না হলে পরিত্যাগ করবে। তালেবান চিন্তা এদেশে জায়গা পায়নি, কারণ সংস্কৃতির অর্ন্তনিহিত স্রোতের তা বিপরীত। এই স্রোতটি খুব প্রবল। আমর মনে হয় আমাদের নিজস্ব দেশজ যে সংস্কৃতি অর্থাৎ আমাদের গান, নৃত্য, জীবন-যাপন বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি সেগুলো সেই স্রোতের অন্তর্গত। পরিবর্তন আসবে কিন্তু স্রোতটা অগ্রসরমুখীই থাকবে। আমি মনে করি একুশ শতকের একদম শেষ মাথায় দাঁড়িয়েও আমরা বলতে পারবো এটি বাঙলা গান, এটি বাঙলা চিত্রকলা, এটি বাঙলা সাহিত্য, এটি বাঙলা সংস্কৃতি, যতই বাহ্যিক পরিবর্তন তাতে আসুক।
অনুপ সাদি: আমাদের সংস্কৃতির যে অংশ পশ্চিম থেকে যত কম নিয়েছে সে অংশ ততো দুর্বল। এই মতের সাথে আপনি একমত হলে সংস্কৃতির কোন অংশ পশ্চিম থেকে কম গ্রহণ করেছে বলে মনে করেন?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: আমি এ বক্তব্যের সঙ্গে মোটেও একমত নই। সংস্কৃতি হচ্ছে গ্রহণ এবং বর্জনের একটা যোগফল। আমি বলতে পারি না বাঙালি সংস্কৃতির কোনটা খাঁটি, আদি বাঙালি। কারণ বাঙালি শংকর জাতি, তার ভিতরে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব আছে- ব্যাপারটা নৃতাত্ত্বিকরাই ভালো বলতে পারবেন। বাইরে থেকে আসা এবং ভূমিপুত্রদের নিজস্ব নানা সংস্কৃতির উপাদানের সম্মিলনেই দীর্ঘদিনে গড়ে উঠেছে বাঙালি সংস্কৃতি।পশ্চিম থেকে বাঙালি প্রয়োজন হলে গহণ করবে। আমি অন্ধ অনুকরণে বা অন্ধ গ্রহণে বিশ্বাস করি না; কোনো সংস্কৃতিই সেটা করে না; যেখানে সংস্কৃতি গ্রহণ করছে সেখানে সে জেনেশুনেই গ্রহণ করছে। তার অন্তর্গত বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিলে গেলে তা থেকে যায়। শহরের বাঙালি পুরুষ যে কাপড় পরে সেটি পশ্চিমা, কিন্তু শহরের নারী এখনো যে শাড়ি পরে, সেটি এ অঞ্চলের নিজস্ব উৎপাদন। বাঙালি নারী পশ্চিমা পোশাক গ্রহণ করেনি। অর্থাৎ একটা জায়গায় গ্রহণ করা হয়েছে আর একটা জায়গায় হয়নি। কোনখানে গ্রহণ করছে কোনখানে গ্রহণ করছে না সে বিষয়টা নির্ধারণ করবে সংস্কৃতি নিজেই। কাজেই পশ্চিম থেকে ঠিক কোন বিষয়গুলো এখন গ্রহণ করা হচ্ছে অথবা হচ্ছে না-এ বিষয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করা হলে সঠিক বলতে পারবো না। সেটা কি আমাদের সার্বিক জীবন চর্চায়, নাকি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়? কারণ শিক্ষাব্যবস্থাতো পশ্চিম থেকে অনেক কিছু নিয়েছে এবং সেটিকে দুর্বল বলা যায় না; আবার নাচ যদি গ্রহণ না করে থাকে, তাহলে সেটিকে কি দুর্বল বলবো? সংস্কৃতিতে এই গ্রহণ বর্জন কারো আদেশক্রমে হয় না বা কেউ চাইলেই সেটি হয় না; বহু শত বছরের চর্চা ও ক্রিয়ার ফলে সংস্কৃতি গতিশীল হয়; সেখানে কখন কোন পর্যায়ে বাইরের কোন উপাদানগুলো গৃহীত হবে অথবা হবে না সেটা সে পর্যায়েই নির্ধারিত হবে।
অনুপ সাদি: আমাদের মধ্যবিত্ত সংস্কৃতির কোন কোন উপাদানগুলোকে খুব খারাপ বলে আপনার কাছে মনে হয়?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: স্বার্থপরতা, গোষ্ঠীপ্রিয়তা, ভন্ডামি। একজন মধ্যবিত্ত যখন চাকরি করে, আইন ব্যবসা করে, শিক্ষকতা করে, সে সবসময় সততার কথা বলে; কিন্তু সুযোগ পেলে সে-ই সবচেয়ে অসৎ হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশে মধ্যবিত্তই বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করে। যারা কোটিপতি, তারাও মধ্যবিত্ত আসলে, মনের দিক থেকে শিকড়ের দিক থেকে, বিত্তের দিকে থেকে আমার মধ্যবিত্ততায় কোনোই আপত্তি নেই; আমার প্রবল আপত্তি মনের দিক থেকে মধ্যবিত্ততায় এবং আমাদের মধ্যবিত্তরা মনের দিক থেকেই বেশি মধ্যবিত্ত।
অনুপ সাদি: আপনি ছোটোগল্প, প্রবন্ধ এবং নাটক লেখায় আগ্রহী হলেন কেন? এতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন না অন্য কারণে?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: ছোটো গল্প আমি ’৭৪ সাল থেকে লিখতে শুরু করেছিলাম। সে বছর একটা গল্প লিখেছিলাম ‘বিশাল মৃত্যু’, ‘বিচিত্রা’য় ছাপা হয়েছিলো; কিন্তু একজন বেশ প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক আমাকে বললেন যে, এ-গল্পের স্টাইলটা অদ্ভুত। এটি চলবে না। তিনি উপদেশ দিলেন গল্প না লিখে প্রবন্ধ লিখবে; অগ্রজের কাছ থেকে এরকম উপদেশ শুনে ভাবলাম, থাক গল্প লেখা, প্রবন্ধই লিখি বরং। পরে মনে হয়েছে ভুল করেছিলাম। যাই হোক, প্রবন্ধ লিখতে ভালোই লাগে। প্রবন্ধ জিনিসটা নিজের সঙ্গে বেশ উচুঁদরের কথাবার্তা বলার মতো। আর নাটক লেখায় বেশ পয়সা আসে। পয়সা দিয়ে বই কেনা যায়, বেড়ানো যায়। তবে আমার নাটকে যারা অভিনয় করেছেন, তারা এসব নাটক খুব পছন্দ করেছেন। অবাক কান্ড। আসলে আনন্দ পাই বলে লিখি। আমার মনে হয় এ প্রশ্নটি যে কোনো লেখককে করলে একই উত্তর দিবেন। তবে আমি লিখি মূলত নিজের আনন্দের জন্যে, নিজের জন্যেই।
অনুপ সাদি: বাংলা সাহিত্য কতোদূর এগিয়েছে বলে মনে হয়?
সৈয়দ মনুরুল ইসলাম: এগিয়েছে আবার এগোয়নি দু’ভাবেই বলা যায়। বাংলা সাহিত্য নিজের তুলনায় এগিয়েছে। কারণ রবীন্দ্রনাথের পর থেকে আমাদের যে সাহিত্য সেটি পৃথক রবীন্দ্রনাথ থেকে; চিন্তার ও মেধার এবং স্টাইলের দিক থেকে সম্মুখবর্তী। বাংলাদেশের নিজের যে সাহিত্য-নাটক, গল্প, ছোটগল্প, উপন্যাস, কবিতা ইত্যাদি গত পঞ্চাশ বছরে কোনো ক্ষেত্রে যথেষ্ঠ উন্নতি করেছে।
অনুপ সাদি: পাশ্চাত্যের তুলনায়?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: আমি এই তুলনায় বিশ্বাস করি না; কারণ পাশ্চাত্যের ভুগোল, জলবায়ু, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, শিক্ষা সবই আলাদা আমাদের থেকে। প্রযুক্তিতে তারা চাঁদ ছুঁয়েছে, আমরা আছি ধুলোবালিতে। পাশ্চাত্যের সাহিত্য স্বাভাবিকভাবেই অনেক সামনে। আমাদের মানুষের ভিতর যদি পাশ্চাত্যের মানুষের মতো চিন্তা-ভাবনা জন্ম নিতো, আচার-আচারণ গড়ে উঠতো, শিক্ষা পেতো, যদি আমাদের সমাজটা পাশ্চাত্যের সমাজের মতো স্বচ্ছন্দ, গতিশীল এবং উদ্ধাবনশীল হতো, তাহলে আমি বলতে পারতাম আমদের সাহিত্য পাশ্চাত্যের তুলনায় পিছিয়ে আছে বা এগিয়ে আছে। কাজেই ঐ বিচারে আমি যাই না, বাংলা সাহিত্যকে আমি বাংলা সাহিত্যের নিরিখেই তুলনা করি। আমি মনে করি আমরা কোনো দিক থেকে_ যেমন নাটক ও কবিতায় অনেকখানি এগুলেও, ছোটগল্পে আহলাদ করার মতো খুব একটা অর্জন নেই, উপন্যাসেও একই অবস্থা তবে সবচেয়ে দুর্বল আমাদের প্রবন্ধ সাহিত্য।
অনুপ সাদি: আমাদের দেশে শেকসপিয়র, সফোক্লিস, ইস্কিলাস, ইবসেন-এর নাট্যকারের জন্মের জন্য কিরুপ পরিবেশ দরকার?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: যে তালিকাটা এখানে দেয়া হলো তাদের সবাই কিন্তু পশ্চিমের। সেখানে নাটকের একটা ঐতিহ্য আছে এবং সে ঐতিহ্য ঐ পশ্চিমেরই ঐতিহ্য। সেটি আমাদের নয়; যদি এ প্রশ্ন করা হয় আমাদের দেশে শেকসপিয়র জন্ম নিচ্ছেন না কেন, তাহলে বলতে হয় ইংল্যান্ডে একজন জীবনানন্দ কেন জন্ম নিচ্ছেন না, অথবা একজন লালন ফকির। এটি বলার অর্থ এই যে, ইংল্যান্ডের নিজস্ব জীবনানন্দ আছেন, নিজস্ব লালন ফকিরও আছেন। তারা নিজেদের মতো লিখেছেন, গান গেয়েছেন। তবে এই তুলনাটা হাস্যকর। তবে সফোক্লিস, শেকসপিয়র প্রমুখের মতো প্রভাবশালী এবং মেধাবী লেখক যে আমাদের নেই বা ছিলেন না তা তো নয়। রবীন্দ্রনাথ বা নজরুল বা জীবনানন্দকে আমরা বড়ো বলবো না ছোটো? তবে প্রতিভার জন্ম আকাশ থেকে হয় না; মাটি ও সংস্কৃতি তার জন্ম দেয়, লালন করে। কিন্তু এই প্রতিভা যে জন্ম নেবে, সমাজটা কি শিক্ষিত? আমাদের দেশে ক’জন মানুষ পড়তে পারে? এই যে বাংলা সাহিত্য লেখা হচ্ছে, সমগ্র দেশের দশ ভাগ মানুষ কি অনুভব করতে পারে তার রসটুকু? এখন যদি আমাদের একশো ভাগ মানুষ শিক্ষিত হয়, যদি একশো ভাগ মানুষ বই কেনে, তাহলে অনেক প্রতিভা বেরিয়ে আসবে, সাহিত্য এগুবে। শেকসপিয়র, যখন নাটক লেখেন তখন তাকে জীবিকার জন্যে চিন্তা করতে হয়নি। আমাদের দেশে এতো বছর পরেও একজন লেখককে জীবিকার জন্যে চিন্তা করতে হয়। কাজেই প্রয়োজন হচ্ছে শিক্ষার, প্রয়োজন হচ্ছে সংস্কৃতির বিকাশের, প্রয়োজন হচ্ছে গোটা জাতির নতুন কিছু সৃষ্টি করার জন্যে প্রস্তুত হবার।
অনুপ সাদি: বাংলাদেশের অস্থিতিশীল অগণতান্ত্রিক পরিবেশ কি সাহিত্য রচনায় প্রতিবন্ধিকতা সৃষ্টি করছে? করলে কীভাবে?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: আমার মনে হয় না যে সাহিত্য খুব গণতান্ত্রিক পরিবেশের উপর নির্ভরশীল। রবীন্দ্রনাথের সমস্ত জীবনের বসবাস অগণতান্ত্রিক পরিবেশের মধ্যে, একটা উপনিবেশিক সময়ে। নজরুল উপনিবেশিক সময়ে সবচেয়ে হিংস্র রুপটা প্রত্যক্ষ করেছেন। তাদের সাহিত্য তো সেজন্যে থেমে থাকেনি। সাহিত্যের জন্য গণতন্ত্র একটি আবশ্যিক শর্ত নয়, বা স্থিতিশীল পরিবেশও অপরিহার্য কোন অবস্থা নয়, বড় বড় যুদ্ধের সময়, সংঘাতের সময় যারা লেখার তারা লিখেছেন। সাহিত্য হচ্ছে একটি শিল্পীত, বুদ্ধিগত, চিন্তাগত জিনিস, মনের ভিতরের একটা তাগিদ থেকে তার জন্ম, কল্পনায় তার বিস্তার। যুদ্ধ বা অস্থিতিশীল পরিবেশ নতুন প্রভাব রাখতে পারে তার উপর, কিন্তু তার গতি রুদ্ধ করতে পারে না।
অনুপ সাদি: তা হলে কি সাহিত্যে উন্নতির জন্যে প্রথম প্রয়োজন পাঠক এবং শিক্ষা?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: সাহিত্যের জন্য প্রথম প্রয়োজন একজন উদ্ভাবনক্ষম সৃষ্টিশীল কল্পনাপ্রবণ মানুষ; যিনি লিখবেন; তিনি লিখবেন পাঠকের জন্যে; তিনি তো শুধু নিজের জন্য লিখবেন না; আর পাঠক তৈরির জন্যে প্রয়োজন শিক্ষা, সেই শিক্ষা যাকে আমরা সাংস্কৃতিক শিক্ষা বলি। একটি ছোটো উদাহরণ দিইঃ পশ্চিমবঙ্গে কয়েক হাজার গণগ্রন্থাগার আছে, যারা প্রতিবছর অসংখ্য বই কেনে। সেখানে একজন লেখককে চিন্তা করতে হয় না বই লেখার পর বিক্রি হবে কি-না; সেখানে পাঠক তৈরিই থাকে। আমাদের দেশে একজন লেখককে প্রথম চিন্তা করতে হয় যে, বইটি বিক্রি হবে কি না? এটি কখনোই সাহিত্যের জন্যে উপকারী নয়।
অনুপ সাদি: বাংলা ভাষাকে কোন কোন ক্ষেত্রে প্রকৃত স্বাধীন হতে হবে? বাংলা ভাষার শত্রু দারিদ্র না অশিক্ষা?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: শেষ প্রশ্নটার উত্তর প্রথমে দিই, বাংলাদেশের দু’টোই শত্রু অশিক্ষা এবং দারিদ্র। দারিদ্রের জন্যে শিক্ষার বিস্তার হয় না, শিক্ষার বিস্তার না হওয়ার জন্যে দারিদ্র স্থায়ী হয়ে যায়। বাংলা ভাষার প্রথম শত্রু হচ্ছে আমাদের মানসিকতা। আমার মনে হয় বাংলা ভাষার উন্নতির জন্যে আমাদেরকে মাতৃভাষার উপর বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। মাতৃভাষার শুদ্ধ এবং ব্যাপক চর্চা না হলে একটা জাতি মনের দিক থেকে উন্নত হতে পারে না। আবারো উদাহরণ দিইঃ আমাদের দেশে যে কোনো আলোচনা অনুষ্ঠানে গেলে শোন যায়, অকাতরে ইংরেজি শব্দের ব্যবহার। ক্রিয়াপদটি শুধু বাংলায়, কিন্তু বহু ইংরেজি শব্দ, যেগুলোর প্রতিশব্দ বাংলায় আছে, সেগুলোর ব্যবহার করে আমরা ভাষাটাকে নষ্ট করে ফেলছি। বাংলাদেশের আবহাওয়া নিয়ে একটা আলোচনা শুনেছিলাম একবার, টেলিভিশনে। একজন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন, “আমাদের ‘ওয়েদার’টা খুব ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ হয়ে গেছে, এই ‘ফ্লাড’ হয়, ‘টাইডাল ওয়েভ’ হয়; তাতে ‘লাইফ এন্ড প্রপার্টি ড্যামেজ’ হয়” ইত্যাদি। এটা কী ধরনের বাংলা! এবং এই বাংলা শুধু টেলিভিশনে নয় সর্বত্রই চলছে। আমাদের হীনমন্যতা অপরিসীম। আমাদের ধারণা ইংরেজি বলতে পারলেই আমরা জগতে পা রাখতে পারবো। হয়তো পেশাজীবনে ইংরেজি ছাড়া চলে না, ঠিক আছে, ইংরেজিটা শিখে পেশায় উন্নতি ঘটানো যায়, কিন্তু ইংরেজি শিখলে বাংলা ভুলতে হবে কেন অথবা বাংলা ভাষাকে উন্নতির অন্তরায় ভাবতে হবে কেন! লন্ডনে একটা রাস্তার নাম বাংলায় লিখেছে এ কারণে যে এ অঞ্চলে বাঙালি জনগোষ্ঠীর বাস। বাংলা ভাষাকে সম্মান জানাবার জন্যে এ কাজটি হয়নি। কিন্তু কেমন হতো, যদি বাংলা ভাষায় ঘোষণা দেয়া হতো বিশ্বের সব বিমানবন্দরে, পণ্যের মোড়কে থাকতো বাংলায় বিবরণ? এই অবস্থায় যাওয়ার জন্যে চাই অর্থনৈতিক শক্তি। আমরা যদি অর্থনৈতিকভাবে সবল হই, আমাদের যদি অশিক্ষা না থাকে, দারিদ্র না থাকে, তাহলে বাংলা ভাষা সর্বত্র তার যোগ্য জায়গাটা পাবে। কিন্তু বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের মৌখিক ভালবাসা, ঠোঁট সেবা আছে, আন্তরিক ভালবাসা নেই।
অনুপ সাদি: একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে যাই, আমাদের দেশে দুর্নীতির আশ্রয় না নিয়ে উচ্চবিত্ত হওয়া অসম্ভব। আপনি কি বলেন?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: দেখে শুনে তাইতো মনে হয়। আমি বিত্তের সন্ধানে যাইনি কখনো (হাসতে হাসতে); কাজেই দুর্নীতি কতখানি আবশ্যক উচ্চবিত্ত হতে হলে, পরিমাপ করে বলতে পারবো না। তবে আমি দেখেছি, চারদিকে যারাই খুব ধনী, তাদেরই কোথাও না কোথাও দুর্নীতির চর্চা আছে; হয় ঘুষ খেয়ে বাড়ি তুলেছেন, ঘুষ খেয়ে অথবা দুর্নীতি করে টাকা বানিয়েছেন। আর এ দুর্নীতির শাদাকালো নানা রুপ।
অনুপ সাদি: দুর্নীতি সর্বগ্রাসী হওয়ার পেছনে প্রধান কী কারণ রয়েছে বলে মনে করেন?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: প্রচণ্ড আত্মাদর_ আত্মাদর হচ্ছে নিজের প্রতি অত্যধিক ভালবাসা_ লোভ এবং লালসা, গোষ্ঠীপ্রীতি, পরিবারপ্রীতি, স্বজনপ্রীতি। আরো কারণের মধ্যে আছে নৈতিকতার অভাব, ধর্মটাকে আস্তিনের মধ্যে পরে রাখার মানসিকতা, পরিবারের নীতিবোধের অভাব, আর প্রতিযোগিতামূলক মনোবৃত্তি। আমি দেখতে পাচ্ছি, অমুক ধনী হয়ে গেছে অথচ আমি ধনী হতে পারছি না, কাজেই আমাকেও ধনী হতে হবে; এই মনোবাসনাটা খুবই মারাত্বক।
অনুপ সাদি: বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিটি কখন থেকে মাথা তুলতে শুরু করে? এখন তাদের শক্তির পরিমাণ কতটা?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: বাংলাদেশ যখন পাকিস্তানে ছিলো, সেই ’৫২-র ভাষা আন্দোলন যখন শুরু হলো, বাঙালির জাতিসত্তার প্রকৃত স্ফূরণ ঘটলো যখন, তখন থেকেই দেখা গেছে, বাংলাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করেছে। ’৬৬ সালে, আমার মনে আছে, বঙ্গবন্ধু যখন ৬ দফা দিলেন, তখন এর শত্রুতা করছে অনেক বাঙালিই। আর ’৭১ সালে সেই শত্রুরা একট মহা সুযোগ পেয়ে গেল। তাদের ধারনা হলো, এখনই সময় ঝাঁপিয়ে পড়ার; কিন্তু পারলো না। একাত্তরের পর এই শত্রুদের ক্ষমা করে দেয়া হলো। বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে তারা জড়িত হলো, তারপর সামরিক শাসনের সময় তারা একেবারেই বাইরে বেরিয়ে এল, তাদের সমাবেশ ঘটলো। জেনারেল জিয়াউর রহমানের সময়, জেনারেল এরশাদের সময় সবচেয়ে শক্তিবৃদ্ধি হলো এই স্বাধীনতাবিরোধীদের। বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করাটা একটা বড় ভুল ছিলে বলে আমি এখন মনে করি; এটা উচিত হয়নি, পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করে ছেড়ে দেয়া হয় না। এখনো পৃথিবীর কোনো দেশে নাৎসীদের পেলে ধরে এনে তাদের বিচার করে। আমাদের দেশের কিছু মানুষ বলে যে, স্বাধীনতার এত বছর পর মুক্তিযোদ্ধা-রাজাকার এ বিভাজনে যাওয়া ঠিক নয়, এরকম কথা বলা অপরাধীদের সহায়তা করার শামিল। রাজাকার রাজাকারই থাকে সব সময়ের জন্যেই; মুক্তিযোদ্ধা রাজাকার হতে পারে; কিন্তু রাজাকার কখনো মুক্তিযোদ্ধ হতে পারে না। কাজেই এই বিভাজনটাও থাকবে। যে রাজাকার প্রত্যক্ষভাবে পাকিস্তানকে সাহায্য করেছে সে হয়তো মারা গেছে, কিন্তু রাজাকারী দীক্ষায় দীক্ষিত লোক থাকবে, বয়সে খুব তরুণ হলেও। রাজাকারী চিন্তার মানুষ যে আছেন চারদিকে, কই তাদের তো সে চিন্তা ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা গ্রহণ করার কথা কেউ বলেন না। অথচ মুক্তিযোদ্ধা বললেই বিভাজনের অজুহাতটা আসে! তবে আমি মনে করি স্বাধীনতা বিরোধীদের একটা শক্তি ছিল ’৯০ দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত, বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলো তারা; তবে গণতন্ত্র থাকলে তাদের শক্তিটা খুব বাড়তে পারবে না। ’৯১ সালের নির্বাচনে জামায়াতীরা ১৯ টা আসন পেয়েছিলো, ’৯৬ সালে সেখানে পেয়েছে মাত্র ৩টা। কারণ নারীরা বেরিয়ে এসেছে, ভোট দিচ্ছে; কাজেই স্বাধীনতা বিরোধীদের অবস্থানটা দুর্বল হয়ে পড়েছে বলেই মনে হয়েছে আমার।
অনুপ সাদি: প্রতিক্রিয়াশীলতা, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা বৃদ্ধির পেছনে আপনি কাদেরকে দায়ী করেন?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: আমার মনে হয় যে, আমরা সকলেই কোনো না কোনোভাবে দায়ী। আমাদের রাজনীতিবিদরা খুবই দায়ী। আমাদের তথাকথিত প্রগতিশীল রাজনীতিবিদরা তাদের সঙ্গে মোর্চা বাঁধেন; বিএনপি’র সময় বিএনপি-বিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগ জামাতকে সঙ্গে নিলো; এখন বিএনপি জামাতকে সঙ্গে নিয়েছে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্যে। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী এবং যুদ্ধাপরাধীরা বেশ গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে এদের কল্যাণে। তারা রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানেও যাচ্ছে, বঙ্গভবনেও দাওয়াত পাচ্ছে। এদের ব্যাপারে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলে চিহ্নিত আওয়ামী সরকারের অবস্থান পরিষ্কার নয়। আমরা নিজেরাও প্রশ্ন করি না, প্রতিরোধ করি না স্বাধীনতাবিরোধীদের; ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির যদি জন্ম না হতো বা জাহানারা ইমাম (১৯২৯-১৯৯৪) যদি না আসতেন তার মিশন নিয়ে, তা হলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটাও হয়তো হারিয়ে যেতো। কে জানে?
অনুপ সাদি: এ দেশে নির্বাচনের আগে দলগুলো প্রচুর প্রতিশ্রুতি দেয় এবং ক্ষমতায় গিয়ে সেসব তেমন একটা মনে রাখেনা। এক্ষেত্রে সরকার প্রতিশ্রুতি পূরণ করে না কেন?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কারণ প্রতিশ্রুতি দেয়া যতটা সহজ, প্রতিশ্রুতি পালন করাটা সে তুলনায় হাজার গুণ কঠিন। আমাদের সাধারণ মানুষ ভালো কথা শুনলেই খুশি হয়ে যায়; যখন শুনে এই পুলটা হবে, ওই রাস্তাটা হবে, তখন পুলকিত হয়ে ভোট দিয়ে দেয়। কিন্তু ভোটপ্রার্থি নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে গেলে আর ফিরে তাকান না, ওই মানুষের দিকে। এটি আমাদের সামষ্টিক চরিত্রের একটা বৈশিষ্ট্যও বটে- এই মিথ্যে বলা, প্রলোভন দেখানো, এই ঠকিয়ে প্রতারণা করা; এগুলো শোধরানো মুশকিল। আগামী নির্বাচনেও বহু প্রতিশ্রুতি শোনা যাবে।
অনুপ সাদি: আপনি একটি প্রবন্ধে বলেছেন, ‘আমাদের দেশের প্রধান দলগুলোর শত্রু তারা নিজেরাই’। কিভাবে তারা নিজেদের শত্রু বলবেন কি?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: এ দেশের প্রধান দলগুলো গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। কোনো দলের ভিতর গণতান্ত্রিক রীতিনীতি বা পরিবেশ নেই। দলগুলো ব্যক্তিকেন্দ্রিক; দল যদি ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয় তাহলে ব্যক্তিই প্রধান; দেখা যাচ্ছে বাস্তবেও তাই। আমাদের দেশের কোনো দলের মধ্যেই দেশপ্রেম নেই; তাদের আছে গোষ্ঠীপ্রেম, নেত্রীপ্রেম বা নেতাপ্রেম; জনগণের জন্যে তারা ভাবে না; তারা ভাবে নির্বাচনের জন্যে, নির্বাচনে যে কোনোভাবে জেতার জন্যে। এই মানসিকতাসম্পন্ন দলগুলো কখনো জাতিকে খুব বিশাল কিছু দিতে পারে না। এদেশের একটি দল জনগণের কাছ থেকে ম্যান্ডেট নিয়ে যখন ক্ষমতায় যাবে, সে দেশের সেবা করবে_ দেশের ভবিষ্যৎকে বর্তমানে নিয়ে আসবে। কিন্তু এ-কাজে দলগুলো পুরাপুরি ব্যর্থ। আমাদের কিছু দূরবর্তী প্রতিবেশী আছে_ যেমন মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, এরা অর্থনৈতিক ভাবে অনেক বলশালী। রাজনৈতিক দলগুলো সেখানে তাদের নিজস্ব ভূমিকা রেখেছে। কথা বলার অধিকার সেসব দেশে তেমন না থাকলেও দলগুলো আদর্শচ্যুত হয়নি। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো কাগজে-কলমে আদর্শের কথা বললেও ক্ষমতায় গিয়ে নিজেদের সেবা করে; কাজেই এই বিশাল ব্যর্থতার নিরিখে কি তারা নিজেদের শত্রু নয়?
অনুপ সাদি: ‘আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা যা স্বার্থের জন্যে নগ্নভাবে করেন, বুদ্ধিজীবিরা তা করেন চালাকির সাথে সুক্ষ্ম যুক্তি-তর্ক দিয়ে।’ আপনার এ বাক্যটি ব্যাখ্যা করে বলুন।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: (হেসে) ব্যাখ্যাটাতো দেয়াই আছে। রাজনীতিবিদরা কথা বলেন, কাজ করেন, বক্তৃতা দেন, দুর্নীতি করেন সবই মোটা দাগে। সূক্ষ্ম যুক্তি-তর্কে তারা যান না। রাজনীতিবিদদের মন্ত্রী হওয়ার বাসনা সব সময় প্রকাশিত। নেতা বা নেত্রী মন্ত্রী হওয়ার জন্যে একজনকে ডাকলে তিনি আনন্দে লম্ফ দিবেন। তারা তাদের প্রত্যাশা বা আনন্দ গোপন রাখেন না। কিন্তু গোপন রাখেন বুদ্ধিজীবীরা। আমাদের দেশে অনেক বুদ্ধিজীবী আছেন, যারা অনুক্ষণ কল্পনা ও কামনা করেন, তারা একটা প্রতিষ্ঠানের ডিজি হবেন, চেয়ারম্যন হবেন, ভাইস চ্যান্সেলর হবেন, পরিকল্পনা কমিশনে চাকরি পাবেন, পাবলিক সার্ভিস কমিশনে চাকরি পাবেন, রাষ্ট্রদূত হবেন; তাদের এই স্বার্থচিন্তা কিন্তু তারা করে যান খুব সুক্ষ্মভাবে। তারা শিক্ষকতা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ে, কিন্তু রাজনীতি করেন নানা দলের লেজুড় হয়ে। কেন তার এসব করছেন? দেশ ও জাতির সেবার জন্যে? ভূল। তাদের রাজনীতি পরিচালিত নিজেদের স্বার্থে। পদ ও প্রাপ্তির লক্ষ্যে।
অনুপ সাদি: আপনি অনেক দিন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে জড়িত। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোন কোন সীমাবদ্ধতা আপনাতে পীড়া দেয়।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: সীমাবদ্ধতা অনেক। শিক্ষাদানের সুযোগ সীমিত। লাইব্রেরী নেই, বই নেই, উন্নত শ্রেণিকক্ষ নেই; অনেক শিক্ষকের নিজস্ব অফিস কক্ষ নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা এসব ক্ষেত্রে অনেক ভালো, কিন্তু সিটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর, সিলেট বা কুষ্টিয়াতে অবস্থা নিতান্তই করুণ। শিক্ষার পরিবেশটাও পশ্চিমের মতো অনুকূল নয়। রাজনীতি কলুষিত করছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিবেশ। তারপর রয়েছে অর্থের প্রকট অভাব_ বস্তুত যেসব সীমাবদ্ধতার কথা এইমাত্র বললাম এর সবগুলোর সঙ্গে অর্থাভাবের সম্পর্ক রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বয়ত্তশাসন দেয়া হয়েছে। কিন্তু সরকারি অনুদানের উপর এদের প্রায় পুরোপুরি নির্ভর করতে হয়। তাতে স্বয়ত্তশাসন কতোটা থাকে? সরকার, সরকারের মন্ত্রী সুযোগ পেলেই তাই হস্তক্ষেপ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে। ছোটো বিশ্ববিদ্যাল্যগুলো এই হস্তক্ষেপ এড়াতে পারে না। যদি সরকারি আদেশ নির্দেশ না মান্য হয় তাহলে টাকার থলিতে টান পড়ে। আর যে অর্থ পায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, তা খুবই অপর্যাপ্ত। আসলে শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশে জিডিপি-জিএনপি হারে যে টাকা বরাদ্ধ করে, তা শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, পুরো তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের মধ্যে সর্বনিম্ন। শিক্ষাক্ষেত্রে টাকা বরাদ্দকে সরকার এখনো দেখে ‘বরাদ্দ’ হিসেবে_ কাজেই সুযোগ পেলেই কাটছাঁট করে। অথচ ভারত, শ্রীলংকাও দেখে ‘বিনিয়োগ’ হিসেবে। কাজেই সুযোগ পেলেই বাড়ায়। একজন স্কুল শিক্ষককে কতোটা বেতন দেয়া হয়? একজন প্রাইমারি শিক্ষককে কতো বেতন দেয়া হয়? আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তার মেধা অনুযায়ী কি বেতন পাচ্ছেন? কনসাল্টেন্সির কথা ওঠে খবরের কাগজে, আলোচনা-সমালোচনায়। কিন্তু কনসাল্টেন্সি না করে খাবেন কি করে একজন শিক্ষক, সংসার চালাবেন কি করে? সমস্যা হলো, একজন সামরিক বেসামরিক আমলাকে বেতনের অপর্যাপ্ততা নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বিভিন্নভাবে পুষিয়ে দেয়া হচ্ছে। আর বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে ধারণা হচ্ছে_ লোকটা গাছের নিচে থাকবে, এক বেলা খাবে, কিন্তু উৎকৃষ্ট শিক্ষা দান করবে, আদর্শ কপচাবে সারা জীবন। আমি নিজে শিক্ষকতায় এসেছি এ পেশার সীমাবদ্ধতা জেনে শুনেই। তারপরও কষ্ট হয় যখন লাইব্রেরীতে বই পাই না, অথচ নিজের বই কেনার পয়সা থাকে না। একটা কম্পিউটার কিনতে হলে দশ বছরের সঞ্চয় প্রয়োজন। অথচ আমলাদের টেবিলে অযথাই চারটা কম্পিউটার পড়ে থাকে। আমার মনে হয়, সীমাবদ্ধতার মধ্যে একটি হলো আমাদের মানসিকতার। আমরা শিক্ষাকে শুধু কাগজে-কলমে অগ্রাধিকার দিই, বাস্তবে দিই না।
অনুপ সাদি: আর কোনো কিছু পীড়া দেয় না?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলমাম: ছাত্রদেরকে রাজনীতিবিদরা ব্যবহার করেছেন দাবার গুটি হিসাবে, বিবেকহীন এবং অমানবিকভাবে। তাদের হাতে বন্দুক তুলে দিচ্ছেন; মুখে বলেছেন ছাত্রদের রাজনীতি করা উচিত নয়, তাদের কাজ পড়াশোনা, দেশগড়ার ইত্যাদি। কিন্তু বাস্তবে করেছেন উল্টো। সামনে নির্বাচন আসছে; ছাত্ররা না হলে নির্বাচন হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যে রাজনীতি করেন, সেটিও পীড়াদায়ক মনে হয় আমার কাছে।
অনুপ সাদি: এটা কি শিক্ষক ছাত্রদের রাজনীতি? এটা কি আওয়ামি লিগ, বিএনপি বা অন্যান্য দলেরই রাজনীতি নয়?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলমাম: এখন ছাত্র এবং শিক্ষক যে রাজনীতি করেন, তা বিএনপি, আওয়ামি লিগ বা অন্যান্য দলের রাজনীতি। আমি ছাত্র রাজনীতির বিপক্ষে নই। কোন ছাত্রের বয়স ১৬ হলে সে ভোট দেবে, তার রাজনৈতিক চিন্তা হয়তো থাকবে। সে একটা দলকে সমর্থন দেবে অথবা দেবে না_ এটি তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের বিষয়। কিন্তু দলের হয়ে অস্ত্রবাজী করবে কেন? একজন শিক্ষক একটি দলকে সমর্থন করতেই পারেন। কিন্তু প্রকাশ্যে ওই দলের রাজনীতিতে কেন জড়িয়ে পড়বেন? তিনি যখন ক্লাসে যাবেন, সেখানে সব দলের ছাত্রছাত্রীরাই থাকে, কিন্তু তিনি আওয়ামী লীগ বা বিএনপি বা অন্য কোনো দলের সমর্থক বলে বিবেচিত হন তাহলে ভিন্ন দলের সমর্থক ছাত্রছাত্রীরা কোন চোখে দেখবে তাকে? শিক্ষকরা রাজনীতি করবেন; কিন্তু তাদের রাজনীতি হবে দেশ ও জাতির জন্যে, শিক্ষা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতির জন্যে; দলের জন্যে নয়। ভিসি, প্রো-ভিসি হওয়ার জন্যে নয়; পাবলিক সার্ভিস কমিশনে চাকরি পাওয়ার জন্যে কিংবা রাষ্ট্রদূত হওয়ার জন্যে নয়।
অনুপ সাদি: স্বাধীনতা পরবর্তী সরকারসমূহের নেয়া কোন কোন ভুল পদক্ষেপগুলো দেশকে পেছনে ঠেলে দিয়েছে বলে মনে করেন?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: আমরা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে শুরু করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সমাজতন্ত্রের খোলসটাই শুধু আমরা নিয়েছিলাম, সারটা নিইনি। সে আগ্রহও ছিলো না। জাতীয়ভাবেই আমরা একটা ভুল নিয়ে শুরু করেছিলাম। আমরা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা চেয়েছিলাম, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ধাবিত হলাম পুঁজিবাদের রাস্তায়, কারণ সমাজতন্ত্রের ব্যাপারে আমরা মোটেই আগ্রহী ছিলাম না; বরং পুঁজির প্রতিই ছিলো অন্তর্নিহিত দুর্বলতা। গণতন্ত্র নিয়ে আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলাম, কিন্তু নানা অজুহাতে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চালু করলাম। আমরা মনে প্রাণে কখনো এবং এখনো গণতন্ত্রে বিশ্বাস করিনি। ১৯৭১ সালের পর যথেষ্ট সুযোগ থাকলেও গণতান্ত্রিক শাসনব্যাবস্থা, আচার-আচরণ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছি। কিছু কিছু প্রতিভাবান নেতা ছিলেন আমাদের দেশে; আমি একজনের কথা বলি, তাজউদ্দিন আহমদ। বঙ্গবন্ধুর বড় ভুল ছিলো তাজউদ্দিনের সংগে সম্পর্ক ছিন্ন করা। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আমরা অন্ধকার যুগে প্রবেশ করলাম; যে যুগ ছিলো সামরিক শাসনের। সামরিক শাসন কোনো দেশের জন্যেই মঙ্গল আনতে পারে না। এটা একটা অত্যন্ত স্বল্পমেয়াদী ব্যবস্থা; দীর্ঘমেয়াদী কোনো উপকার সামরিক শাসন দিতে পারে না। ফলে যা হবার তাই হলো। আমরা একটার পর একটা ভুল করতে থাকলাম। আমাদের সমাজ জীবনে দুর্নীতি দানা বাঁধলো; আমাদের লোভ-লালসা বেড়ে গেল; মানুষের ভিতরে দেশপ্রেমের যে মানসিকতা ছিলো তার স্ফুরণ ঘটলো না; দুর্নীতিবাজ আমলা, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ,দুর্নীতিবাজ বুদ্ধিজীবী, সবাই মিলে দেশটাকে কব্জা করে নিলো। আমি মনে করি, এখনো দেশটাকে এগিয়ে নেয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু যোগ্য নেতৃত্বের অভাব প্রকট। আমি মনে করি আমাদের নেতৃত্ব কখনো সে পর্যায়ে যায়নি যে পর্যায়ে গেলে দেশটা উন্নত হতে পারে। যে নেতৃত্ব মালয়েশিয়াতে ছিলো, যে নেতৃত্ব সিঙ্গাপুরে ছিলো, এখনো আছে সে রকম নেতৃত্ব আমরা এখনো পাইনি। কবে পাবো_ অথবা আদৌ পাবো কিনা_ জানি না। যতোদিন না পাবো ততোদিন পর্যন্ত এসব বড়ো-ছোট ত্রুটি থেকেই যাবে আমাদের সঙ্গে।
অনুপ সাদি: আমাদের এখন প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দল আছে। দেশের উন্নয়নে এ দল দু’টির ভূমিকা কিরূপ হওয়া উচিত?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: গণতন্ত্রে দলগুলোর মধ্যে পারস্পারিক যোগাযোগ, সহযোগিতা_ এসব থাকে, থাকা উচিতও। কিন্তু আমাদের দেশে এসবের ছিঁটে ফোঁটাও নেই। দশ বছর দুটো বড়ো দলই ক্ষমতায় গেছে; বিএনপি যে নীতিগুলো নিয়েছে, যে পলিসি বা পদক্ষেপগুলো নিয়েছে, সেগুলোতে ভুল-ভ্রান্তি প্রচুর ছিলো, আওয়ামি লিগের উচিত ছিলো সেসব ভুল ধরিয়ে দেয়া এবং বিএনপির উচিত ছিলো গঠনমূলক সমালোচনা হতে তা মেনে নিয়ে সেসব শুধরানো। তা হয়নি। আবার আওয়ামি লিগ যখন ক্ষমতায় আসলো, বিএনপি যে সমস্ত পলিসি নিয়েছিলো, সেগুলো দেশের জন্যে উপকারি প্রমাণিত হয়েছে, সেগুলো অব্যহত রাখা উচিত ছিলো। কিন্তু তা হয়নি। আমাদের দু’টো দলেরই সমস্যা হচ্ছে তারা মনে করে তারাই সবচেয়ে বেশি চালাক। একদল মনে করে অন্যদল নিকৃষ্ট, সে উৎকৃষ্ট; অন্যদল একই রকম ভাবে। ফলে দু’দল নিজদের ভেতর সামান্য সৌজন্যমূলক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেনি। দু’দলই ছুরি উঁচিয়ে বসে আছে একে অপরের গলা কাঁটার জন্যে। অথচ পৃথিবীর সবখানে রাজনৈতিক দলগুলো কন্টিনিউয়িটিতে বিশ্বাস করে। আমেরিকাতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হতে যাচ্ছে, ধরা যাক, জর্জ বুশ ক্ষমতায় আসলেন, তাহলে কি তিনি গোর/ক্লিনটনের সবগুলো পলিসি পাল্টে দেবেন? মোটেও না। তিনি ভালো ফলপ্রসু পলিসিগুলো বজায় রাখবেন নিজের পলিসিগুলোর পাশাপাশি। যেখানে যেখানে পরিবর্তন প্রয়োজন, সেখানে তা করবেন, কিন্তু পূর্বসুরীর গৃহীত নীতিগুলোকে ‘গত আট বছরের জঞ্জাল’ বলে ছুঁড়ে ফেলবেন না। এ শিক্ষাটা আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে আছে; কিন্তু তারা তা নেবেন না। না নেয়ার কারণ হচ্ছে, ওই গোষ্ঠীতন্ত্র, জাতি বা দেশ নয়, দলগুলো বিশ্বাস করে গোষ্ঠীতে। আওয়ামি গোষ্ঠী মনে করে বিএনপি গোষ্ঠী তার শত্রু; আবার বিএনপি গোষ্ঠী মনে করে আওয়ামি গোষ্ঠী তার শত্রু। এই গোষ্ঠী ছেড়ে তারা যখন জাতিতে সনাক্ত হবে, যখন তারা মনে করবে বাঙালি জাতির কল্যাণের জন্যে আওয়ামি লিগ এবং বিএনপি এবং সকল দলকেই কাজ করতে হবে, তখন হয়তো তারা দেখবে এজন্যে পারস্পারিক সহযোগীতার প্রয়োজন, একজনের সঙ্গে অন্যজনের কথাবার্তা হওয়া প্রয়োজন; তখনই উন্নতি হবে দেশের।
অনুপ সাদি: আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: তোমাকেও অনেক ধন্যবাদ। বাংলাবাজার পত্রিকার সংশ্লিষ্ট সবাইকে এবং অগণিত পাঠকদের ধন্যবাদ।[২]
তথ্যসূত্র ও টিকা
১. জীবনানন্দ দাশ; অবসরের গান কবিতা থেকে নেয়া কয়েকটি লাইন।
২. এই সাক্ষাতকারটি দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকায় ১৮ অক্টোবর, ২০০০ সালে প্রকাশিত হয়। আমি সেই সময় জাতিয়াতাবাদি চিন্তা দ্বারা আলোড়িত ছিলাম। এখন আমি জাতিয়তাবাদ ও উগ্র-জাতিয়তবাদের নিকৃষ্ট চেহারা সম্পর্কে সচেতন। এই সাক্ষাতকারটি আমার চিন্তাধারার বিকাশ সম্পর্কে সাক্ষ্য বহন করে বিধায় এখানে সংকলিত হলো। সাক্ষাৎকারটি অনলাইনে প্রাণকাকলি ব্লগে প্রকাশিত হয়। এরপর সেটি রোদ্দুরে ডট কমে ৪ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে প্রকাশিত হয়। বর্তমানে এটি ফুলকিবাজ ডট কমে ১৯ মে ২০২১ তারিখে প্রকাশ করা হচ্ছে।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।