সেলিনা হোসেনের সাক্ষাৎকার — আদর্শবিহীন রাজনীতি দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়

সেলিনা হোসেন কথাসাহিত্যিক। তাঁর জন্ম ১৪ জুন, ১৯৪৭ সালে রাজশাহী শহরে। তিনি মূলত গল্প-উপন্যাস লেখক। বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়াশীল ধারার রাজনৈতিক দল আওয়ামি লিগের সমর্থক হিসেবে তিনি ২০১০’র বছরগুলোয় পরিচিত হয়ে উঠেছেন। ষাটের দশকের মধ্যভাগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে লেখালেখির সূচনা। তার রচিত উপন্যাসের সংখ্যা ২০টির অধিক। গল্পগ্রন্থ এবং শিশুসাহিত্যও লিখেছেন। শিশুদের আর্থসামাজিক বিষয়ে ইউনিসেফের জন্য দুটি বই সম্পাদনা করেছেন।

সেলিনা হোসেনের লেখার জগত বাঙলাদেশের মানুষ, তার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। ভ্রমণ তার নেশা। তিনি দেশের আনাচে কানাচে নিয়ত ঘুরে বেড়ান। পেয়েছেন দেশের উল্লেখযোগ্য সব পুরস্কার। ইংরেজি, হিন্দি, মারাঠি, রুশ, মালে, ফরাসি প্রভৃতি ভাষায় তার লেখা অনূদিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ‘যাপিত জীবন’ এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি’ উপন্যাসদ্বয় বাঙলাদেশ পত্রে পাঠ্য। আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে তার দুটি উপন্যাস পাঠ্য। কর্মজীবনে তিনি বাংলা একাডেমির পরিচালক ছিলেন।

অনুপ সাদি: স্বাধীনতা পরবর্তী সরকারগুলো কোন কোন ভূল পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল যেগুলোর কারণে দেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হয়েছে বলে আপনি মনে করেন।

সেলিনা হোসেন: দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রাথমিক শর্ত একটি স্বাভাবিক, শান্ত, সুস্থির সামাজিক পরিস্থিতি। এই পরিস্থিতির অভাবে দেশের উন্নয়ন কর্মকান্ড ব্যাহত হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে এই ধরনের পরিস্থিতি বিরাজমান ছিল না। বঙ্গবন্ধু সরকার গৃহীত উন্নয়ন কর্মকান্ড কোন কোন ক্ষেত্রে সামাজিক রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার কারণে ব্যাহত হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের পরবর্তী সময়ে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকে তিগ্রস্থ করে। ৭৫ পরবর্তী সরকার একটি স্বাধীনতা বিরোধী সরকার ছিলো। এ সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধুলিস্মাৎ করে মুক্তিয্দ্ধু বিরোধী লোকদের নিয়ে  দেশ পরিচালনা করেছে যা প্রকৃত অর্থে জনগনের কল্যাণে কাজে লাগেনি। তারা সংবিধান থেকে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে একটি চরম ভুল পদক্ষেপ গ্রহণ করে। সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা জনগণের মৌলিক অধিকার। এই অধিকার খর্ব করে দিয়ে সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রক্ষা করার জন্যে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স করে আইনের শাসনকে ব্যাহত করা হয়েছে। এসব কিছু আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পরিপন্থী বলে আমি মনে করি।

এ পরিপ্রেক্ষিতে আরো একটি প্রধান বিষয় বিবেচ্য যে আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত প্রকল্পসমূহের বাজেট কমিয়ে সামরিক খাতে বাজেট বরাদ্ধ বাড়িয়ে দেয়া জনগণের কল্যাণে গৃহীত কর্মসুচি ছিল না। দেশের সিংহভাগ বাজেট একটি বিশেষ বাহিনীর খাতে ব্যয় হলে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ব্যাহত হতে বাধ্য। এটি নিঃসন্দেহে একটি ভুল পদক্ষেপ। আরো বলা যায় বৈদেশিক ঋণ বা সাহায্য গ্রহণ করে গৃহীত প্রকল্পসমূহের বাস্তবায়ন ঠিকমত সম্পন্ন না করা ছিল উন্নয়ন পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারণ। অনেক সময় দেখা গেছে সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন না করতে পারার জন্য দাতাগোষ্ঠি অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। এটি একটি জাতির জন্য অত্যান্ত লজ্জার ও গ্লানির। কাজের অগ্রগতিকে সার্বিকভাবে ত্বরান্বিত না করা, কাজের সমন্বয়হীনতা এবং লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য তাগাদার অভাব আমাদের উন্নয়নকে পিছিয়ে দিয়েছে একইভাবে। এর বাইরে রয়েছে শাষকগোষ্টির দুর্নীতি, আমলাতন্ত্রের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতার অভাব, রাজনীতিবিদদের নৈতিকতা বর্জিত সততাহীনতা, সংসদের নিজ নিজ এলাকার প্রতি অবহেলা ও গণবিচ্ছিন্ন থাকা, সন্ত্রাস, হানাহানি ইত্যাদি এমন আরো অনেক কিছুর বিরুদ্ধে কোনো সরকারই এমন কোনো দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি যার দ্বারা দেশের উন্নয়নের ইতিবাচক ভুমিকা রাখা সম্বভ ছিলো।

অনুপ সাদি: সব সরকার এসেই দূর্নীতি দমন করার কথা বলে। কিন্তু দুর্নীতি দুর করার বদলে আত্মসমর্পণ করে দুর্নীতির কাছে। কেন এমনটি ঘটছে?

সেলিনা হোসেন: সত্যি কথা বলতে কি, ক্ষমতায় থাকা এবং ক্ষমতার বাইরে থাকা দু’রকম ব্যাপার। আমাদের এটি একটি অন্যরকম চারিত্রিক দিক। এই যে আমরা যে যে অবস্থানে থাকি না কেন তার উপর নির্ভর করে কথা বলি। মুখে বড় কথা, কাজে বিভিন্ন আচরণ, আমদের দুর্নীতির একটি সামাজিক প্রশ্রয়। আমার তো মনে হয় আদর্শবিহীন রাজনীতি দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়। সে জন্য যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন দুর্নীতি তার হাতে বৈধতা পায়। আরো দেখা গেছে, সামাজিক মানসিকতায় এ-দুর্নীতি অশোভন এবং অনৈতিক হিসেবে এখন আর ধিকৃত হয় না। এখন তো অনেকের সাথে কথা বলে দেখি ঘুষ গ্রহণ তাদের কাছে অধিকার। কোন কোন ক্ষেত্রে কাজ করে দেবার জন্য সম্মানী। এই অবস্থা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে গ্রাস করেছে।

অনুপ সাদি: আমাদের উচ্চবিত্ত শ্রেণিটি সৎ থেকেছে বলে কি আপনার মনে হয়?

সেলিনা হোসেন: মনে হওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। আমদের উচ্চবিত্ত শ্রেণি কালো টাকা দিয়ে বিত্তের পাহাড় গড়েছে। আর যারা বিত্তের পাহাড় গড়ে তাদের সততা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ করা যায় যে, উচ্চবিত্ত শ্রেণির নৈতিক মূল্যবোধের অভাবে দুর্নীতির জন্ম দেয়, ঋণখেলাপীর জন্ম দেয়, কালো বাজারীর জন্ম দেয় এবং তা ধীরে ধীরে গ্রাস করে সমাজের মুল্যবোধের সুস্থতা এবং সাধারণ মানুষের স্বস্তির জীবন। উপরন্তু সমাজ বিভক্ত হয়ে যায়। ব্যবধানটা অনেক বড় হলে এমন একটা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি হয় যেটা সুস্থ সমাজের ভারাসাম্য রক্ষা করে না। এই ভারসাম্যহীনতা বর্তমানে বাংলাদেশে চলছে এবং এটি আমাদের দেশের উন্নতির জন্য বড় অন্তরায়।

অনুপ সাদি: দুর্নীতি দূর করতে হলে মানসিকতার পরিবর্তন করাকেই কি আপনি যথেষ্ট বলে মনে করেন?

সেলিনা হোসেন:  দূর্নীতি দূর করার জন্য মানসিকতার পরিবর্তনকে যথেষ্ট বলে মনে করি না। এই পরিবর্তন করার জন্য কঠিন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যেটা দেখে যে কেউ দূর্নীতি করতে সাহস পাবে না। মানসিকতার পরিবর্তনের জন্য আইন একটি বড় হাতিয়ার। দূর্নীতি এ সমাজের কন্ঠরোধ করে ফেলেছে। মানুষকে নৈতিকভাবে শক্তিশালী করতে হলে মানসিকতার পরিবর্তন ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই।

অনুপ সাদি: … … … … … [একটু অন্য প্রসঙ্গে যাই] আমি খুব সংক্ষেপে জানতে চাচ্ছি, নারীরা বন্দি কোথায় কোথায়?

সেলিনা হোসেন: নারীরা বন্দি সমাজ প্রথার কাছে; এ প্রথা পুরুষের তৈরি, এ প্রথা যে ক্ষেত্রগুলোকে পরিচালিত করে সে ক্ষেত্রগুলোর সর্বত্র নারীরা বন্দি। জন্মের পর থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত নারীরা এই বন্দিত্বের শিকার; শিশু জন্মের পরে যে ধর্মীয় অনুষ্ঠানটি করা হয়, আযান দেয়া কিংবা উলুধ্বনি দেয়া, সেখানেও দুধরনের রীতি প্রচলিত, ছেলেশিশুর জন্য একরকম, মেয়েশিশুর জন্য অন্য রকম। এভাবে ধরে যদি এগুই তাহলে দেখবো বয়স বৃদ্ধির প্রতিটি ক্ষেত্রে অর্থাৎ খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিনোদন, খেলাধুলা, বিয়ে, চাকরি, চাকরির প্রমোশন এবং সামাজিক অবস্থানের নানা ক্ষেত্রে নারীরা বন্দি। কিছু সংখ্যক নারী নানা প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে বেরিয়ে আসলেই সেটা পুরো সমাজের চিত্র নয় কিংবা সমতাভিত্তিক সমাজব্যবস্থার প্রতিফলন নয়। এই একপেশে চিত্র নারীর বন্দিত্ব মুক্তির কথা বলে না।

অনুপ সাদি: একজন মুক্ত নারীর প্রত্যাশিত বৈশিষ্ট্যগুলো আপনার মতে কী ধরনের হবে?

সেলিনা হোসেন: প্রথমে পরিবারে তার স্বতন্ত্র সত্ত্বার স্বীকৃতি থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, সমাজের মানুষ হিসেবে সমঅধিকার নিশ্চিত হতে হবে। সমাজের রক্তচক্ষু তাকে নারী হিসেবে শাসন করার জন্য তাকে তাড়া করবে না, সামজিক প্রথার মধ্যেই পুরুষ ও নারীর যে সম্মিলিত জীবন যাপন নারী হিসেবে সেই জীবনের অধস্তনতা তাকে স্বীকার করতে হবে না; না, ধর্মের নামে তার উপর পুরুষের নানাবিধ নির্দেশ চাপিয়ে দেয়া চলবে না, নারী এবং পুরুষের প্রতি রাষ্ট্র দ্বিমুখি আচরণ করে সেই আচরণ রাষ্ট্রীয় কাঠামো হতে দূর করতে হবে।

অনুপ সাদি: নারীমুক্তি, নারী অধিকার, নারী স্বাধীনতা এসবের মধ্যে আপনি কোনটিকে কীভাবে দেখেন?

সেলিনা হোসেন: প্রতিটি শব্দই পরস্পরের সাথে সংযুক্ত, কোনোটিকেই আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। নারীমুক্তি তো প্রথার অর্গল ভেঙে বেরিয়ে আসার আকাঙ্খা, নারী অধিকার, নারী স্বাধীনতা ব্যক্তির স্বাধীনতার সাথে সংগতিপূর্ণ। একজন ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছ থেকে যে স্বাধীনতা পায়, নারীরও সে স্বাধীনতা প্রাপ্য।

অনুপ সাদি: নারীবাদ বলতে আপনি কী বোঝেন? তা কতটুকু গ্রহণযোগ্য?

সেলিনা হোসেন: নারী সংক্রান্ত যাবতীয় সুস্থ স্বাভাবিক আইনগত যে ধারনা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়া প্রয়োজন সেটাকে নারীবাদ বলে ব্যাখ্যা করা যায়। তবে মনে রাখতে হবে যে, সমাজ নারী-পুরুষের যৌথ সৃষ্টি। এই দুই ভাগের কোনোটিতে বাড়াবাড়ি করলে সমাজের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে। সে অর্থে নারীবাদ সমাজের সামগ্রিক কল্যাণের ভারসাম্য রক্ষার একটি দিক।  

অনুপ সাদি: নারী-পুরুষের সম্পর্ক কতটুকু রাজনৈতিক?

সেলিনা হোসেন: পরিপূর্ণভাবেই রাজনৈতিক। এই রাজনীতির সূত্রপাত পরিবারে, সমাজে এবং রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায়। পরিবারে নারী পুরুষের সম্পর্কের মধ্যে রাজনৈতিক অবস্থান তখনই তৈরি হয়, যখন পরিবার প্রধান তার অর্থনৈতিক ক্ষমতার জোরে এবং পুরুষতান্ত্রিক আচরণের মাধ্যমে নারীকে অধস্তন করে রাখার চেষ্টা করে। অর্থাৎ, সম্পর্কের ভেতরে ক্ষমতার লড়াই শুরু হয়। এখানে লড়াইও বলা যাবে না, সম্পর্কটা হয়ে দাঁড়ায় ক্ষমতাবান এবং শোষিতের সম-মর্যাদা। এই ক্ষমতার লড়াই তো রাজনীতির প্রধান শর্ত। রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে রাষ্ট্র, যে নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রব্যবস্থা নারী-পুরুষের সম-অধিকারকে স্বীকার করে না, যে রাষ্ট্রব্যবস্থা সমাজে বঞ্চিতদের দলিত করে রাখে, সেই রাষ্ট্রব্যবস্থার রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হয় মুষ্টিমেয় ক্ষমতাধরদের হাতে। এই ক্ষমতাধারীদের কেউ কেউ নারীও হতে পারে, কিন্তু সে পরিপূর্ণভাবে ক্ষমতাধর হয় না যতক্ষণ সে পুরুষের হাতের ক্রীড়নক থাকে। এক অর্থে সে নারী থাকে না, সে হয় পুরুষের প্রতিনিধি। এভাবেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার নীতি-নির্ধারণের ক্ষেত্রে নারী-নারীর পক্ষে বড় কোনো ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে না। রাজনীতির এই প্রক্রিয়ার কথা মনে রাখলে আমরা নিঃসন্দেহে বুঝতে পারব যে, নারী-পুরুষের সম্পর্ক ক্ষমতা এবং অধস্তনতার লড়াইয়ের সম্পর্ক।    

অনুপ সাদি: নারীমুক্তির প্রেক্ষিতের সংগে রাজনীতির সম্পর্কটি কেমন হবে এবং রাজনৈতিক আদর্শগুলোর মধ্যে কোনটিতে আপনি আস্থাশীল?

সেলিনা হোসেন: নিঃসন্দেহে বাম রাজনীতির; কারণ বাম রাজনীতির আদর্শগত ধারনায় মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের যে পাঁচটি অন্যতম দিক আছে, যেমন, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা এই পাঁচটি মৌলিক দিক থেকে নারী ব্যাপকভাবে বঞ্চিত হয় বলে সমাজের বেশিরভাগ নারী প্রান্তিক নারিতে পরিণত হয়। সমাজতান্ত্রিক আদর্শ এই পাঁচটি বিষয়কে অন্যতম চাহিদা হিসেবে চিহ্নিত করেছে বলে আমি এই রাজনৈতিক আদর্শকে নারীমুক্তির একটি খোলা দরজা বলে মনে করি। 

অনুপ সাদি: নারীর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি করতে কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে?

সেলিনা হোসেন: প্রথমত হলো নারীকে শিক্ষিত হতে দেয়ার সবটুকু সুযোগ তৈরি করা। নারী সচেতন হলে তার অধিকার বুঝতে শিখবে এবং এই অধিকার বুঝতে শিখা এবং বাস্তবায়ন করা রাজনৈতিক পদক্ষেপ ছাড়া সম্ভব নয়। কারণ রাজনীতির অন্যতম প্রতিনিধি জাতীয় সংসদের নির্বাচিত সদস্যরা, তারাই গঠন করে সরকার। আর রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার কলকাঠি নাড়ে নির্বাচিত সরকার। জাতীয় সংসদে নারী যদি ব্যাপকভাবে নির্বাচিত হয়ে না আসতে পারে, তবে নীতি নির্ধারকরা পুরুষই থাকেন এবং নারীর অগ্রগতির পথটা তাদের হাতে সুগম হয় না। সেজন্য কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি করার ক্ষেত্রটিকে যদি উন্মুক্ত রাখা যায়, তাহলে রাজনীতি শেখার একটি পদক্ষেপ নারীর সামনে খোলা থাকে। এছাড়া তৃণমূল পর্যায়ে ইউনিয়ন পরিষদে সংরক্ষিত আসনে নারীর নির্বাচন যে বর্তমানে বাংলাদেশে প্রচলিত হয়েছে, এই ব্যবস্থাটি নারীর অনুকূলে কার্যকর রাখলে রাজনীতি সম্পর্কে নারীর ধারনা স্পষ্ট হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। তবে অধিকার বিষয়ে আমার মনে হয়, অধিকার আদায় করা যত সহজ, অধিকার রক্ষা করা তত সহজ নয়। নারী যদি নিজের অধিকার বুঝতে না শিখে, তাহলে রাজনীতির ফলাফল তাদের জীবনে ব্যর্থ হতে বাধ্য। কাকে ভোট দিচ্ছি, সে আমাদের জীবনে কতোটা পরিবর্তনের সহায়ক শক্তি সেটা যদি না বুঝতে পারি, তাহলে সেটাও হয় নিষ্ক্রিয় প্রতিনিধি নির্বাচনের নজির। এই রাজনীতিও নারীকে বুঝতে হবে।   

অনুপ সাদি: আপনি নারীকে শিক্ষিত হতে দেয়ার সুযোগ তৈরি করার কথা বলছেন। কিন্তু বাংলাদেশে এম.এ. পাস অনেক নারী সংসারে সন্তান পালন করেন কোনো চাকরি করেন না। এই যে সরকার তাদের পিছনে এতো টাকা খরচ করলো, এতে ফল কী হলো?  

সেলিনা হোসেন: নারীর গৃহশ্রম যে মজুরি হিসেনে স্বীকৃত নয়_এ প্রশ্নটা তার প্রমাণ। একটি মেয়ে শিক্ষিত হলে তার নিজের ঘরকে, তার প্রতিবেশীর ঘরকে নানাভাবে সহযোগিতা দিতে পারে এবং দেয়। ছেলে-মেয়েদের খাদ্য, পুষ্টি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, অসুস্থতা, শিক্ষা, বিনোদন ইত্যাদি বিষয়ে একজন শিক্ষিত নারী যেভাবে একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে পারে একজন নিরক্ষর নারীর পক্ষে সেটা সম্ভব না। শিক্ষার মূল্য শুধু চাকরির মধ্যে সীমাবদ্ধ করা যায় না, বিশেষ করে আমাদের মতো সেই দেশে যেখানে বেকার সমস্যা অত্যন্ত ভয়াবহভাবে তীব্র। তাই বলি শিক্ষিত হয়ে নারী যদি পরিবার ও সমাজের পরিবেশকে সুন্দর রাখতে পারে সেটাও জীবনের জন্য বিশাল আয়োজন। এ প্রয়োজনকে অস্বীকার কোনো মানবিক কাজ নয়। তাই নারীর শিক্ষা মানবিক মূল্যবোধ তৈরিতে নিয়োগ করা হলে সমাজ সুস্থ হবে, সন্ত্রাসমুক্ত হবে, দুর্নীতিমুক্ত হবে এবং জাতি একটি আত্মমর্যাদাশীল অবস্থানে পৌঁছতে পারবে।  

অনুপ সাদি: অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন না হলে সংসারে তিনি কীভাবে স্বাধীন হবেন?  

সেলিনা হোসেন: এক্ষেত্রে তিনি যদি বাইরে কাজ করার সুযোগ পান এবং রাষ্ট্র যদি তার কোনো ধরনের কাজ করার সুযোগ তৈরি করে না দেয়, তাহলে তার গৃহ শ্রমকে মজুরি হিসেবে অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে এবং এই মজুরি প্রদান করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের এবং সেই মজুরি হবে তার আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার প্রাথমিক শর্ত। সংসারের ঘানি টানতে টানতে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যার কোনো সময় থাকে না, তার চেয়ে বড় শ্রমিক আর কে আছে। এই নারী শ্রমিক অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বাবলম্বী হতেই পারে না। নানা কারণে তার মানসিক বিনোদনও পরিবারের কাছ থেকে উপেক্ষিত হয়। সুতরাং গৃহশ্রমের মজুরির প্রশ্নের দায়টি অনেক বড়। পরিবারের ভালোবাসার বন্ধন এই মজুরির মধ্যে তলিয়ে যায় বলে নারীর হিসাবের খতিয়ান ভিন্ন। এর পরিমাপ করা সাধ্যের অতীত।  

অনুপ সাদি: একজন ক্রীতদাসির তো বাজারমূল্য ছিল। আজকের অনেক মেয়ের তো বাজারমূল্যও নেই। একজন মেয়েকে বিয়ে দিতে হলে যৌতুক দিতে হচ্ছে। এই যৌতুককে কীভাবে দেখছেন?

সেলিনা হোসেন: যে সমাজব্যবস্থা নারীর প্রতি বৈষম্যকে গর্ব ভ্রে মেনে নেয় সেই সমাজব্যবস্থায় বিয়ের সংগে যৌতুক গ্রহণ নারীর প্রতি পুরুষের অবমাননাকর সম্পর্কের প্রমাণ। যারা যৌতুক গ্রহণ করে বিয়ে নামক পারিবারিক বন্ধন স্থাপনের সময়, সে বন্ধন সন্তান উৎপাদনের মধ্য দিয়ে সভ্যতার ধারাবাহিকতা রক্ষা করে, সে সব পুরুষেরা বর্বর এবং এই বর্বরতা সমাজব্যবস্থা প্রসূত। সুতরাং বিয়ের সংগে যৌতুকের প্রশ্নটি যতটা না পুরুষতান্ত্রিকতার দম্ভ ততটা নারীর বিবেচনার সংগে সম্পর্করহিত। নারী এ-ব্যবস্থার শিকার। সমাজের সুস্থ ধারার মানুষেরা এ-ব্যবস্থাকে ঘৃণা করে।   

অনুপ সাদি: আপনি বিবাহকে পারিবারিক বন্ধন বলছেন। বন্ধন স্বাধীনতার বিপরীত, তাহলে বিয়ে কী স্বাধীনতা, সাম্য, মৈত্রীর সংগে সংগতিপূর্ণ?  

সেলিনা হোসেন: বিয়ের মধ্য দিয়ে একটি পারিবারিক বন্ধন সূচিত হয়। সেটা কিন্তু দুজন নারী-পুরুষের দৈহিক মিলনের বৈধতা মাত্র নয়, পারিবারিক বন্ধনের সীমানাটা অনেক বড়। এই সীমানা সম্পর্কের ধারাবাহিকতার ক্ষেত্র থেকে বিস্তৃত হয় যেখানে দাদাদাদি, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজনের সবাই অন্তর্ভুক্ত। পরবর্তী সময়ে সে দুজন মানুষের উৎপাদিত সন্তানের ধারাবাহিকতার জের এই সীমানাকে বাড়াতে থাকে। এই অর্থে বিয়ের ভূমিকা সামাজিক এবং রাষ্ট্রিক। কিন্তু বিয়ের ভূমিকাকে যদি শুধু নারী দুজন নারী-পুরুষের সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ করি, তাহলে বলতে হবে এই বন্ধন সবসময় সরলভাবে চলে না এবং অনেক ক্ষেত্রে আপোষ করে চলতে হয় সন্তান ও সামাজিক নানাবিধ অনুষঙ্গের কারণে। আমার দেখি পীড়াদায়ক হলে সম্পর্ক ভাঙতে হয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীদের পক্ষে ভাঙাটা কঠিন হয় কারণ অর্থনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক বিবেচনা তাকেই স্বীকার করতে হয় পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে। অন্যদিকে স্বামীর অধস্তনতা তাকে ন্যাকারজনকভাবে মানতে হয়। যেমন, প্রচুর বিধিনিষেধ তার উপর চাপানো হয়, ইচ্ছেমত কোথাও যেতে দিতে না চাওয়া, পোষাকের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ তৈরি করা, চাকরি করতে না দেয়ার মানসিকতা ইত্যাদি নানা কিছু বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠান নারীর উপর চাপায়। খর্ব করে তার স্বাধীনতা এবং স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার নানা দিক। এই অর্থে বিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বাধীনতার সংগে সংগতিপূর্ণ নয়। বিয়ের অর্থ যদি হয় অন্যের কাছে নতিস্বীকার, তাহলে স্বাধীনতা থাকে কি?  

অনুপ সাদি: নারীমুক্তির ক্ষেত্রে কোন ধরনের নারীরা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে?  

সেলিনা হোসেন: নারীমুক্তির ধারনা স্বচ্ছ নয়, যারা পুরুষের প্রতিক্রিয়াশীল ধারনার নিচে বড় হয়ে সেই ধারনাকেই নিজের ভেতরে সক্রিয় রেখেছে, যারা নিজেদের অধস্তনতাকে বোঝার ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে এবং যারা প্রবলভাবে ধর্মীয় অনুশাসনকে অনুসরণ করে, তারাই প্রতিবন্ধকতার হোতা।  

অনুপ সাদি: কিছু নারীর উপর কিছু পুরুষের আচরণ সহিংস; নারী নির্যাতন, নারী হত্যা, ধর্ষণ তাই প্রমাণ করে। উল্টোটা খুব কমই দেখা যায়। এক্ষেত্রে নারীরাও সহিংস হবে কি বা নারী-পুরুষের গেরিলা যুদ্ধ টাইপের কিছু ঘটার সম্ভাবনা কতটুকু?  

সেলিনা হোসেন: নারীরাও সহিংস হবে এটা আমি সমর্থন করি না। নারীরা সহিংস হলে শুভবোধের শেষটুকুও নিঃশেষ হয়ে যাবে। কোনো অন্যায়কে আরেকটি অন্যায় দিয়ে প্রতিরোধ করা যায় না। তাতে সমাজে অনাচারই বাড়ে।  দেশের আইন নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ করার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু আইনের যথাযথ প্রয়োগ নেই, তাই এ দুরবস্থা। আইনকে যথাযথভাবে প্রয়োগ করার জন্য রাষ্ট্রের প্রশাসনিকব্যবস্থাকে যথেষ্ট তৎপর এবং সৎ হতে হয়। এক্ষেত্রে আমরা দেখেছি প্রশাসনের দুর্নীতি। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সততাহীনতা নারী নির্যাতনকে স্থায়ী রূপ দিতে চলেছে। অনেক সময় হাইকোর্ট থেকে ফাঁসির রায় পত্রিকার পাতায় দেখতে পাই। কিন্তু সে রায় কার্যকর করার খবর প্রায়শই পত্রিকার পাতায় অনুপস্থিত থাকে। বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিচারহীনতায় পর্যবসিত হয়।    

অনুপ সাদি: রাষ্ট্র কী নারীকে প্রকৃত মানুষ করার পদক্ষেপ নিয়েছে? নারীকে নারী করে রাখায় রাষ্ট্রের লাভ কী?

সেলিনা হোসেন: রাষ্ট্র সংবিধানে নারী-পুরুষের সমানাধিকার নিশ্চিত করেছে, কিন্তু অন্যদিকে জাতীয় সংসদ নারীদের আসন সংরক্ষিত করে রেখেছে। তাই প্রমাণিত হয় যে, নারীর প্রতি রাষ্ট্র বিভ্রান্তিকর মনোভাব দেখাচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে মেয়েদের সুযোগ তৈরি করে দেয়ার জন্য রাষ্ট্র বিভিন্নভাবে নানা ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে, কিন্তু পরিবেশ মেয়েদের অনুকূলে নয়। স্কুলে যাওয়ার পথে অনেক মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয় এ খবর অহরহ পাওয়া যায়। মুসলিম বিবাহ আইনে নানা ধরনের বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়, হিন্দু বিয়েতে তালাক নেই, বৌদ্ধ বিয়েতেও তালাক নেই ইত্যাদি নানা কিছুতে নারীর প্রতি রাষ্ট্রের বৈপরীত্য পরিলক্ষিত হয়। সুতরাং, রাষ্ট্রের ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্যেই নারীর প্রতি যে দ্বিধা, সেই দ্বিধা নারীকে মানুষ হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে।  

অনুপ সাদি: বর্তমানে বাংলাদেশে যে শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত সেই শিক্ষাব্যবস্থা নারী মুক্তির কতটুকু বিরোধী?  

সেলিনা হোসেন: বাংলাদেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা নারীকে মানুষ হওয়ার ধারনা থেকে বঞ্চিত রেখেছে, ছেলে-মেয়ে উভয়ের কাছে। এই শিক্ষাব্যবস্থা অত্যন্ত গৎবাঁধা ধারনা তৈরি করে ছেলেমেয়ের মনে। ফলে নারীর প্রতি যে সামাজিক বৈষম্য দীর্ঘ সময় ধরে তৈরি হয়ে আছে সেই বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে এই শিক্ষাব্যবস্থা মোটেই সহায়ক নয়। এই ব্যবস্থার ভেতরে নারীমুক্তির প্রশ্নটি অনুচ্চারিত থাকে। উপরোক্ত শিক্ষাব্যবস্থা সমুন্নত নয়; অর্থাৎ সরকারি বিদ্যালয়, কিন্ডারগার্টেন, মাদ্রাসা ইত্যাদি মিলিয়ে একটি অসম শিক্ষাব্যবস্থা জাতির মননের বিকাশের ক্ষেত্রকে পিষ্ট করেছে। শিক্ষাব্যবস্থা সমুন্নত নয় বলে মানুষের চেতনার বিকাশ স্থবিরতায় পর্যবসিত এবং সাংস্কৃতিক বোধ রুচিহীন ও সন্ত্রাসী আগ্রাসনের শিকার। এতো কিছু প্রতিকূলতার ভেতর নারীমুক্তি একটি অসম্ভব ব্যাপার।  

অনুপ সাদি: নারীর সবচেয়ে শোচনীয় পেশা যৌনকর্মী; এ-পেশাটির উচ্ছেদ কী প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় সম্ভব?

সেলিনা হোসেন: প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় এটা সম্ভব নয়। অসংখ্য অসহায় নারী এ-পেশাটিকে বেছে নেয়। জীবিকার প্রয়োজন যেখানে অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায় সেখানে, উপায়হীন নারী এর বাইরে যেতে পারে না। কিন্তু রাষ্ট্র ইচ্ছা করলে এ-পেশাটিকে মর্যাদা দিতে পারে। বিশেষ করে সেইসব নারীদের জন্য সামাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রটিকে বাড়িয়ে দিতে পারে। তার মজুরি নিশ্চিত করতে পারে।   

অনুপ সাদি: অর্থ ও বাণিজ্য নারীকে গজফিতা দিয়ে মাপছে, মিস ওয়ার্ল্ড, মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতা ও পণ্যের বিজ্ঞাপনে নারীর ব্যবহার তাদের মানুষ পরিচয়কে গ্রাস করছে। নারীর এই শোচনীয় অমানবিক পরাজয়ের শেষ কোথায়?   

সেলিনা হোসেন: এই পরাজয়ের শেষ নেই। সাম্রাজ্যবাদী চক্রের আগ্রাসি ভূমিকা যতদিন নারীকেন্দ্রিক বাণিজ্য অব্যাহত রাখবে ততদিন এর শেষ নেই। জোর করে বলা যাবে না যে, নারীরা নিজেরা উদ্যোগী হয়ে পণ্য হওয়ার হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করবে। বিশ্বজুড়ে ব্যবস্থাটা এমন দাঁড়িয়ে গেছে। আমি নিশ্চিত নই যে নারীকে পণ্য হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করার কোনো উপায় কেউ খুঁজে বের করবে, এক্ষেত্রে আরেকটি বিপ্লব প্রয়োজন।

অনুপ সাদি: নারীর যে অধীনতা দেখা যায়, তাদের নাম লেখার বা বলার ধরনের ক্ষেত্রে নারীরা বাবার ও পরে বিবাহিত স্বামী পুরুষটির নামের অংশবিশেষ নিজের নামের সংগে জুড়ে দেয়। শুধু তাই নয়, কোনো কোনো নারী স্বামীর নামের পুরোটাই জুড়ে দেন, যেমন, মিসেস আবদুল জব্বার, এই যে নারীর নিজের অস্তিত্বকে হারিয়ে ফেলা; এটি সম্পর্কে মন্তব্য করুন।    

সেলিনা হোসেন: এটা দীর্ঘ সময় ধরে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীকে তার নিজের সম্পর্কে ভাবার সুযোগ দেয়নি। তাকে যেভাবে শিখিয়েছে সে সেইভাবে ভাবতে শিখেছে। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার ফলে এই নির্যাতন নারী দীর্ঘ সময় ধরে বয়ে বেড়িয়েছে। এটা নারীর দোষ নয়, দোষ ব্যবস্থার। তাকে অবরোধে রেখে, তাকে নিরক্ষর রেখে, তাকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে না দিয়ে এবং সর্বোপরি পুরুষ তাকে নিজের সম্পত্তি হিসেবে বিবেচনা করায় নারীর সামনের দরজাগুলো বন্ধ ছিল। তারপরও এই ব্যবস্থার ভিতরে যারা সুযোগ পেয়েছে তারা অসাধারণ মেধা ও প্রজ্ঞা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। গুটিকয়েক নারী সমাজের সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পেরেছিল বলে, নারী আজকে নিজের ভাবনাকে সমৃদ্ধ করে বেড়ি ভাঙছে। তারপরও সময় লাগবে।  

অনুপ সাদি: বৈষম্য বা নির্যাতন তো শুধু লিঙ্গভিত্তিক নয়। নারী-পুরুষ উভয়ই তো নির্যাতিত হচ্ছে। দ্বন্দ্বটি আসলে ক্ষমতার, ক্ষমতাবানেরা তো ক্ষমতাহীনদের নির্যাতন করেই। এক্ষেত্রে শুধু নারীমুক্তির কথা বলা একরৈখিক নয় কী?

সেলিনা হোসেন: মোটেই না, কারণ নারীপুরুষের নির্যাতন যে অর্থে সামগ্রিক সেটি একটি ভিন্ন চিত্র। সুবিধাবঞ্চিতদের নারী পুরুষ ভাগ নেই। এটা রাষ্ট্রব্যবস্থার সত্য। তারপরও সুবিধাবঞ্চিত পুরুষরা আরো বেশি সুবিধাবঞ্চিত নারীদের উপর চড়াও হয়। নানাভাবে তারা নারীদের নির্যাতন করে পরিবারে এবং সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। যেমন, গৃহে নির্যাতন, মজুরি বৈষম্য, যৌন কর্মীর পেশা, ধর্ষণ বা গণধর্ষণ, যৌতুকের নির্যাতন ইত্যাদি অসংখ্য পথে সুবিধাবঞ্চিত পুরুষরাই নারীকে নির্যাতন করে। তখন তারা সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছ থেকে যে অবিচার পায় তার কথা ভুলে যায়। ভুলে যায় রাষ্ট্র সামগ্রিক অর্থে যে নিপীড়ন করে সে বৈষম্যের কথাও। এখানেই নারীমুক্তির প্রশ্ন।  

অনুপ সাদি: আমাদের অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রচার করিয়াছেন। রোকেয়ার (১৮৮০১৯৩২) এই উক্তিটি মূল্যায়ন করুন।   

সেলিনা হোসেন: বেগম রোকেয়া যে উক্তিটি করেছেন সেটিকে আমি সত্য বলে মানি। ধর্ম নারী নির্যাতনের অন্যতম হাতিয়ার। পুরুষের তৈরি বলেই পুরুষরা বেহেশতে নারী এবং সুরা পাবে, এই বিধান পুরুষেরই তৈরি। ঈশ্বরের কাছে তো নারী পুরুষ সমান। তাহলে নারীর জন্য এমন একটি বিধান নেই কেন? প্রত্যেক ধর্ম ঘাঁটলে দেখা যায় নারীর বিরুদ্ধে অসংখ্য রকমের বিধি নিষেধ তৈরি করে পুরুষ সমাজের উপরতলের ভোগটুকু কব্জা করে নারীকে ঘরের কোণে ঠেসে রেখেছে। হিন্দু বিধবাদের ভালোভাবে পুষ্টিকর খাবারও খেতে দেয়া হতো না, এক সময় তাদের চুলও ছেঁটে রাখতে হতো, লক্ষ্য ছিল যুবতী নারী বিধবা হলে তার যৌবন যেন প্রস্ফুটিত না হয়, তার সৌন্দর্য যেন বিকশিত না হয়। এভাবেই প্রতিটি ধর্মে নারীর কঠিন অনুশাসন রাখা হয়েছে। রাখলটা কে? সবটুকু ভোগ করার আকাঙ্ক্ষা যাদের, তারাই তো! বেগম রোকেয়া ঠিকই তো বলেছেন।    

অনুপ সাদি: সমস্ত সংসার সমাজ রাষ্ট্র-ধর্ম-নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম ব্যতীত নারী কী স্বাধীন হতে পারবে? সংগ্রামের পথটি কেমন হবে?  

সেলিনা হোসেন: পারবে না। সংগ্রামের রূপটি হবে সমাজ এবং রাষ্ট্রকে নারীর পক্ষে আনার চেষ্টা করা। সেই জন্য তাকে ভেতরে বাইরে নীতি-নির্ধারণী জায়গায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লড়াই করে যেতে হবে।  

অনুপ সাদি: গৃহস্থালির কর্মকাণ্ড, সন্তান লালনের কর্মকাণ্ড থেকে মুক্তি ছাড়া নারীমুক্তি অসম্ভব। সমাজতান্ত্রিকরা এসব কাজকে সমাজের উপর ন্যস্ত করার পক্ষপাতী, মার্কসিয় নারীবাদীরাও তাই চান, ঘরোয়া দাসত্ব ও কর্তার পরাধীনতা থেকে মুক্তির উদ্দেশে সমাজতন্ত্রের এ-পথটি তো গ্রহণযোগ্য।  

সেলিনা হোসেন: হ্যাঁ, অবশ্যই গ্রহণযোগ্য। যে কথাগুলো বললেন তার সবগুলোই স্বামীর সংগে ভাগ করাটাই সংগত বলে নারীর বিবেচনায় থাকা উচিত। সংসার নারীর একার নয়, সন্তানের লালন-পালনও নারীর একার দায়িত্ব নয়। দায়িত্ব যত বণ্টন করা হবে নারীর প্রতি নিষ্পেষণ তত কমবে। আর দায়িত্ব ভাগ করে না নেয়া পুরুষের জন্যই অবমাননাকর। এটা পুরুষের পলায়নি মনোবৃত্তি। দায়িত্বটা কীভাবে ভাগ করা হবে সেটা যেমন ব্যক্তি বিশেষের উপর নির্ভর করে, তেমনি রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল।

অনুপ সাদি: বিশ্বে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বাড়ছে। ধনী-দরিদ্রের বৈষম কমাতে হলে কি নারী-পুরুষের অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানোকেই আপনি প্রধান পদক্ষেপ বলে বিবচনা করবেন? বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে আপনার প্রস্তাবনা থাকলে বলুন। 

সেলিনা হোসেন: নারী-পুরুষের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করাই হবে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য কমানোর প্রধান পদক্ষেপ। কারণ নারী-পুরুষের অর্থনৈতিক বৈষম্যের মাঝেই নিহিত আছে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য। একটি পরিবারের নারী যদি অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হয় তাহলে বৈষম্য বাড়ে বৈ কমে না। এই পরিবারকে কেন্দ্র করেই সমাজ এবং রাষ্ট্র। সে জন্যই নারী-পুরুষের বৈষম্য আমার কাছে অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ন বিষয়। বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে আমার একটি প্রস্তাব হলো নারীকে অর্থনৈতিক ভাবে স্বনির্ভর করা।

অনুপ সাদি: বাংলাদেশের নারীদের সমান অধিকার বা পুরুষের পাশাপাশি অবস্থান নির্ধারণে পুরুষরা কি করতে পারে?

সেলিনা হোসেন: এ ক্ষেত্রে পুরুষরা পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পরিবর্তন ঘটিয়ে নারীকে তার সমান অধিকার দেয়ার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। পুরুষদের পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের কারণে নারীকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এর একটি অন্যতম দৃষ্টান্ত পিতার সম্পত্তিতে মেয়ের সমান অধিকার না থাকা। এ ধরনের বিষয়গুলোকে পরিবর্তন করলেই পুরুষরা এ সমাজকে আরও সহনশীলতা এবং বাসযোগ্য করতে পারে।

অনুপ সাদি: বিয়ে থেকে মুক্তি ছাড়া কি নারী মুক্তি সম্ভব?

সেলিনা হোসেন: বিয়ে থেকে একজন নারীর মুক্তি একক ধারনা হতে পারে কিন্তু সমষ্টি হতে পারে না। বিয়ে একটি সামাজিক বন্ধন। বিয়ের মধ্য দিয়েই সমাজের অগ্রগতি হয়েছে। এবং একটি নিয়ম কানুনের ভিতর দিয়ে এখনও সভ্যতা এগিয়ে যাচ্ছে। নারী মুক্তি মানে যদি হয় বিয়েহীন স্বাধীন জীবন সেটা সামাজিক সুস্থতা নয়। কেউ যদি মনে করে বিয়ে না করে একক জীবনের ভিতর দিয়ে সবটুকু স্বাধীনতা ভোগ করা যায় তাহলে আমি বলবো সেটা তার ব্যক্তিগত বিশ্বাস। এ বিশ্বাস খন্ডিত। জীবনের পূর্নতা নয়। এটাও সত্যি বিবাহিত জীবনকে সুস্থ ও সাচ্ছন্দ রাখার জন্য নারী এবং পুরুষের দায়িত্ব সমান। পুরুষের সমান দায়িত্ব পালনের ভেতর দিয়ে নারী তার স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করতে পারে।

অনুপ সাদি: জন ষ্টুয়ার্ট মিল বলেছেন, ‘আজকের দিনে বিবাহই হলো একমাত্র ক্ষেত্র যেখানে আইনত দাসপ্রথা টিকে আছে’ এ মতের সাথে আপনি কতটুকু একমত?

সেলিনা হোসেন: অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটা সত্যি। যতক্ষণ পর্যন্ত না গৃহস্থালীকে মেয়েদের পেশা হিসাবে বিবেচনা করা হবে এবং তার জন্য একটি নির্ধারিত মজুরীর ব্যবস্থা করা হবে ততক্ষণ পর্যন্ত এটাকে এক ধরনের দাসপ্রথাই বলতে হবে। কারণ আজকের দিনে গৃহস্থালীতে মেয়েদের সময় এবং শ্রমকে ভিন্নভাবে মূল্যায়নের সময় এসেছে। এতদিন ধরে যে একতরফা মূল্যবোধের ভিতরে স্বামীর অর্থনৈতিক ভিত্তিকে মেয়েদের বিবাহিত জীবনের শর্ত হিসেবে দেখতে শেখানো হয়েছিল সেটা এখন আর সত্য নয়। এই শ্রম বিনিয়োগের প্রায়োগিক ক্ষেত্র নিরুপন অর্থনৈতিক ভারসাম্যের একটি অন্যতম দিক। আমরা এই প্রথাগত মুল্যবোধকে ভেঙে মূলোবোধের নতুন ক্ষেত্র তৈরি করতে চাই যেটা দিয়ে বিবাহিত জীবনে নর-নারীর সম্পর্ক নতুন করে নিরুপিত হবে নইলে এই দাসপ্রথা শব্দটি মেয়েদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতেই থাকবে।

অনুপ সাদি: আমাদের দেশে নারী নির্যাতন বিষয়টির জন্য অনেকেই পুরুষতন্ত্রকে দায়ী করে এটা কতটুকু ঠিক?

সেলিনা হোসেন: এটা একশত ভাগ ঠিক। তবে এর ক্ষেত্র দু’টি। নির্যাতনের ৯৫ ভাগ পুরুষরা করে এবং বাকী ৫ ভাগ নারীরা করে। তবে কতিপয় নারীর এই নির্যাতনের মানসিকতা ছোট বেলা থেকে দেখে আসা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা থেকেই শেখা এবং নারী যখন নারীর উপর নির্যাতন করে দেখা গেছে এই নির্যাতনের মাত্রা নারীর সাথে নারীর সম্পর্কের বিভিন্ন দিক থেকেই হয়। যেমন, শ্বাশুড়ির সাথে পূত্রবধুর বিরোধ, আবার পূত্রবধু কর্তৃক শ্বাশুড়ির অবহেলা এবং অমর্যাদা করা, ননদ এবং ভাবীর মধুর সম্পর্ক না হয়ে ঈর্ষা এবং হীনমন্যতার সম্পর্ক তৈরি হওয়া; গৃহকর্ত্রী কর্তৃক বাড়ির কাজের মেয়েকে নির্যাতন করা; পতিতালয়ের সর্দারনী কর্তৃক কিশোরী মেয়েকে নির্যাতন করা; আমার অভিজ্ঞতায় দেখা মা কর্তৃক মেয়েকে শারীরিক মানসিক নির্যাতন করা কিংবা মেয়ে কর্তৃক মাকে অবহেলা করা ইত্যাদি নারী নির্যাতনের বিভিন্ন পর্যায়। এসব কিছু এসেছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় বসবাস করা এবং তাদের নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে লাভ করা মূল্যবোধ থেকে। এই অর্থে পুরষতান্ত্রিক সমাজ ব্যাবস্থা নারী নির্যাতনের জন্য মূলত দায়ী। এবং পুরুষতান্ত্রিক প্রক্রিয়া দীর্ঘ সময় ধরে তাদের নিজেদের প্রয়োজনেই নারীকে পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধি হিসেবে তৈরি করেছে।

অনুপ সাদি: উন্নত অনুন্নত উন্নয়নশীল প্রতিটি দেশেই নারী নির্যাতনের হার প্রায় কাছাকাছি। এটা কেন?

সেলিনা হোসেন: আগের যে প্রশ্নটি ছিল সে প্রসঙ্গের জের টেনেই বলতে চাই একইভাবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা নারীকে দেখবার যে দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলেছে সেটা উন্নত-অনুন্নত সব দেশেই প্রাই একই রকম। সভ্যতার বড়াই করি আমরা ঠিকই, কিন্তু নারী এবং পুরুষকে যদি দু’টি শ্রেণি হিসেবে বিভাজন করি তাহলে দেখতে পাচ্ছি সব দেশেই সুবিধাভোগী পুরুষেরা নারীকে তাদের প্রয়োজন মাফিক ব্যবহার করে। নারী পণ্য হয়, পতিতা হয় এবং বাড়িতে ক্রীতদাস হয় সবটায় একটিরই যোগফল। অন্য অর্থে নারীর অর্থনৈতিক শক্তিটি এবং আমি বলবো রাজনৈতিক ক্ষেত্রের শক্তিটিও পুরুষের সমান নয় বলে এই অবিচার এবং নির্যাতন উন্নত দেশগুলোতেও একেবারে মুছে যায়নি। এটা বিরাজ করেছে শিক্ষা, রুচি এবং মানবিক বোধকে পাশ কাটিয়ে রাখার কারণে। পৃথিবীর সব মানুষকে প্রকৃত মানুষ হতে আরো সময় লাগবে।

অনুপ সাদি: সাহিত্যে নারীকে মা পত্নীরুপে আদর্শায়িত করা হয়েছে। এ মানসিকতার পরিবর্তন করা কি প্রয়োজনীয় বলে আপনি মনে করেন? মনে করলে সাহিত্যে কি ধরনের নতুনত্ব আনা দরকার আপনার দৃষ্টিতে?

সেলিনা হোসেন: সাহিত্যে নারীকে মা পত্নীরূপে আদর্শায়িত করা হয়েছে কথাটি একদম ঠিক নয়। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ, এখানে একটি চরিত্র আছে ডোম্বী নামে। এই নারী পদ্মাখালে নৌকা বাইতো। অষ্টম শতাব্দীতে একজন নারীর এমন দুঃসাহসী চরিত্র বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শনে প্রতিফলিত হয়েছে। পরবর্তী সময়ের ‘শ্রীকৃঞ্চ কীর্তন’-এর রাধা চরিত্রটি একটি অসাধারণ প্রেমিকাচরিত্র। এভাবে যদি আমরা এগুতে থাকি তাহলে দেখতে থাকবো এই ২০০০ সাল পর্যন্ত সাহিত্যে নারী চরিত্র সংগ্রামের, ত্যাগের, সহিঞ্চুতার, বিদ্রোহের, ভালোবাসার ইত্যাদি। আরো অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিনিধিত্ব করে। এমনকি আজকের সাহিত্যে বহু নারী চরিত্র নিজেদের অস্তিত্বের প্রশ্নে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসছে। আপনি সাহিত্যে নারী চরিত্রের ক্ষেত্রে নতুনত্ব আনার কথা বলেছেন। আমি মনে করি নারী চরিত্রগুলো আপন প্রয়োজনে বিভিন্ন মাত্রা লাভ করে নতুন চরিত্রই হয়ে উঠেছে।

অনুপ সাদি: প্রতিক্রিয়াশীলতা কি সাহিত্য রচনায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে? করলে কী ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে?

সেলিনা হোসেন: আমি মনে করি না সাহিত্য রচনায় প্রতিক্রিয়াশীলতা কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারেছে। আমরা প্রতিক্রিয়াশীলতার দুষ্টচক্রকে উপেক্ষা করে সাহিত্য রচনা করছি। প্রতিক্রিয়াশীলতা যদি রাষ্ঠ্র্রীয় সমর্থন পায় তবে সাহিত্য রচনা বাধাগ্রস্থ হয়। রাষ্ট্র তাদের হাতকে শক্তিশালী করলে লেখকের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি, সংস্কারমুক্ত চিন্তা এবং সৃজনশীলতা বাধাগ্রস্থ হয়। কিন্তু বর্তমানে দেশে প্রতিক্রিয়াশীলতা কার্যকর থাকা সত্বেও সাহিত্য চর্চায় তারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়নি।

অনুপ সাদি: স্বাধীনতার পর সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, প্রতিক্রিয়াশীলতা আধিপত্য বিস্তার করেছে গোটা দেশ জুড়ে। প্রতিক্রিয়াশীলতা বৃদ্ধির পেছনে মৌলবাদীরা না রাজনীতিবিদরা দায়ী বলে আপনি মনে করেন।

সেলিনা হোসেন: আমি মনে করি রাজনৈতিক সংস্কৃতির ব্যর্থতার কারণে এ দেশে মৌলবাদীরা মাথা তুলে দাঁড়াবার সুয়োগ পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পরে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সরকার এবং সামরিক সরকার মৌলবাদীদের উত্থানকে সহজ করে দিয়েছে। সংবিধান থেকে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির একটি ধর্মনিরপেক্ষতা উঠিয়ে দেয়ার ফলে মৌলবাদীরা এ সুযোগটা গ্রহণ করেছে। তার কুফল বহন করতে হচ্ছে আজ জাতিকে। এ পরিস্থিতেতে অসাম্প্রদায়িক চেতনাসম্পন্ন রাজনৈতিক দলগুলো মৌলবাদীদের মোকাবেলা করার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারেনি।

অনুপ সাদি: মৌলবাদীরা মানুষকে ইহজাগতিকতা থেকে দূরে রাখছে এবং করে তুলছে অতীতমুখী। আপনার কি মনে হয় মানুষকে ইহজাগতিক কর্মের সাথে সম্পৃক্ত করতে পারলে এবং তাদের জীবনমানের উন্নতি ঘটলে মৌলবাদের শক্তি কমবে?

সেলিনা হোসেন: অবশ্যই আমি এটা মনে করি। এক সময় ধর্মকে আফিমের মতো ব্যবহার করা হয়েছে মানুষের জীবনে। ফলে মানুষ ইহজাগতিক চেতনা থেকে দূরে সরে গিয়ে অদৃষ্টবাদী হয়ে উছেঠিল। ফলে সেসব ধর্মান্ধ মানুষেরা সুযোগ নিয়েছিল নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের। মানুষ যতো বেশি ইহজাগতিক কর্মকান্ড এবং ইহজাগতিক চেতনার সাথে সম্পৃক্ত হবে ততোই মৌলবাদ পিছু হাটতে বাধ্য হবে। ইহজাগতিকতাই একজন সম্পন্ন মানুষের বিবেক বলে আমি কনে করি। তাহলে মানুষ তার বিবেককে ইহজাগতিক কল্যাণে কাজে লাগবে।

অনুপ সাদি: গণতন্ত্রের বিকাশ ও চর্চার জন্য কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন আপনার দৃষ্টিতে?

সেলিনা হোসেন: আমি মনে করি গণতন্ত্র মিথ। গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের সংজ্ঞা নানাভাবে নিরুপণ করা যায়। তবে গনতন্ত্রের বিকাশ ও চর্চার জন্যে প্রাথমিক শর্ত মানুষের মৌলিক অধিকারকে স্বীকার করে নেয়া। যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষের মৌলিক অধিকার স্বীকৃত হবে না ততক্ষণ পর্যন্ত গণতন্ত্রের বিকাশ ও চর্চার পথ উন্মুক্ত হবে না। গণতন্ত্র চর্চাকে ইন্সটিটিউশন হিসেবে দাঁড় করিয়ে যদি একে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দেয়া যায় তবেই এ চর্চার  একটি সুফল আমরা পেতে পারি, অন্যথায় নয়।

অনুপ সাদি: বাংলাদেশে প্রকৃত গণতন্ত্র না আসার কারণ হিসেবে কি আপনি সামরিক শাসনকে দায়ী করেন?

সেলিনা হোসেন: হ্যাঁ, অবশ্যই আমি বাংলাদেশে প্রকৃত গণতন্ত্র না আসার কারণ হিসেবে সামরিক শাসনকে দায়ী করি। দীর্ঘ সময় ধরে সামরিক শাসন এ দেশের গণতন্ত্রের চর্চাকে ব্যাহত করেছে। দেখা গেছে সামরিক শাসকরা গণতন্ত্র চর্চার নামে রাজনৈতিক দল গঠন করেছে, কিন্তু আসলে এসব রাজনৈতিক দলের মধ্যেই গণতন্ত্রের চর্চা নেই। দলগুলো একনায়কত্বের প্রতিভূ। এসব দলের সদস্যদের স্পষ্ট মতামত ব্যক্ত করার অধিকারও নেই। এসব আর যাই হোক গণতন্ত্রের শিক্ষা নয়।

অনুপ সাদি: দেশের অনেক রাজনীতিবিদও দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, মাস্তানদের সাথে সংশিষ্ট থেকে অন্যায় করছে। এসব থেকে মুক্তি পেতে হলে দেশের সুশীল সমাজ (সিভিল সোসাইটি) কী করতে পারে?

সেলিনা হোসেন: সুশীল সমাজ একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে এই ভূমিকা পালন খুব সহজ নয়। সুশীল সমাজের ক্ষুদ্র অংশ একটি বৃহৎ অংশের সাথে লড়তে গেলে যে শক্তির প্রয়োজন সেই শক্তি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সুশীল সমাজের থাকে না। তাই বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে সুশীল সমাজের ভূমিকা হয়ে পড়ে নিষ্ক্রিয়। তবে এটাও কি নিস্ক্রিয় থাকা জাতির জন্য মঙ্গলকর নয়, সে কারণেই বলছি বড় ভূমিকা পালনের কথা, বড় দায়িত্বের কথা। কেননা কোনোভাবে সুশীল সমাজকেই এ দায়িত্ব পালন করতেই হবে। এ দায়িত্ব পালন করে সফল হয়েছে এ উদাহরণও আমাদের সমাজে আছে। বিদেশের অনেক মনীষী আন্তর্জাতিক দায়িত্ব পালন করেছেন নিজ উদ্যোগে এবং তা সফলও হয়েছে।

অনুপ সাদি: একটি সমাজে বা রাষ্ট্রে আইনে শাসন প্রতিষ্ঠিত করতে হলে প্রথমত অপরাধীদের চিহ্নিত করা ও তাদের বিচারে সম্মুখীন করা প্রয়োজন। তবে কি স্বাধীনতার পর রাজাকার ও তাদের সহযোগীদের চিহ্নিত না করে মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করার জাতির জন্য মারাত্বক ভূল পদক্ষেপ ছিলো?

সেলিনা হোসেন: স্বাধীনতার পর রাজাকার ও তাদের সহযোগীদের চিহ্নিত না করা ভূল পদক্ষেপ ছিল। কারণ এ সব স্বাধীনতাবিরোধী ছাড়া দেশের আপামর মানুষ ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। কেউ সরাসরি যু্দ্ধে অংশ গ্রহণ করেছেন কেউ নেপথ্যে থেকে মুক্তিযোদ্ধার ভূমিকা পালন করেছেন। এই মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। প্রয়োজন ছিল রাজাকারদের মতো মানুষদের চিহ্নিত করে নির্মুল করা। তবে এটা সত্যিই একটি যুদ্ধবিধ্বস্থ দেশ পূর্নগঠনে শক্তি ও সামর্থে নিয়োগ করতে হয়েছিল এবং তার কারনেই এসব কাজ গুরুত্ব পায়নি। পেলে আজকে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি এমন সব প্রিয় হয়ে উঠতে পারতো না। এদের নির্মূল করার জন্য আমাদের জেগে উঠতে হতো না।  

অনুপ সাদি: আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারনে সমস্যা হচ্ছে অহরহ। এ থেকে মুক্তি পেতে হলে রাজনীতিবিদরা কি করতে পারে?  

সেলিনা হোসেন: রাজনীতিবিদরা সন্ত্রাসীদের প্রশ্রয় না দিয়ে সমাজকে সন্ত্রাসমুক্ত করতে পারে। এজন্যে প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের ঐক্যমত প্রয়োজন। একদল সন্ত্রাসী পুষবে আর অন্য দল পুষবে না এমন অহিংস নীতি কোনো দলই মানতে পারবে না। এক্ষেত্রে আমার বিশ্বাস রাজনীতিবিদরা মানুষের জীবনকে জীম্মি না করে যদি নিজেরা সৎ ও মানবিক হন তবে সমাজ ও জীবন থেকে সন্ত্রাস নির্মূল হতে সময় লাগবে না ।

অনুপ সাদি: কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি, শিক্ষক রাজনীতি, গোলযোগ ইত্যাদিতে শিক্ষার পরিবেশ সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে। এথেকে উত্তরনের পথ কি?

সেলিনা হোসেন: এথেকে উত্তরনের পথ একটাই, তাহলো এ-ধরনের কার্যকলাপ থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে ফেলা। কিন্তু প্রশ্ন হলো তারা কি নিজেদের দূরে সরিয়ে ফেলবেন? তাদের কি সেই শুভ বুদ্ধির উদয় হবে? ব্যক্তির স্বার্থের বাইরে তারা কি সমষ্টির জন্য চিন্তা কররেন? এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার কেউ আছে কি না আমি জানি না ।

অনুপ সাদি: বাংলাদেশে প্রায় ৩ দশকেও উন্নতি হয়নি? এজন্য রাজনীতিবিদরা দেশকে উন্নয়নের পথে নিয়ে যেতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে বলে কি আপনার মনে হয় না?

সেলিনা হোসেন: বাংলাদেশে প্রায় ৩ দশকেও উন্নতি হয়নি; এটা পুরো সত্য নয়। অনেক কিছু হয়েছে এটা মানতেই হবে। ব্যর্থতার প্রশ্ন উঠলে আমি শুধু রাজনীতিবিদদের কথা বলবো না। এই ব্যর্থতার জন্য সামরিক শাসকরা দায়ি, সুশীল সমাজ দায়ী এবং আপামর জনগণও দায়ী। কারণ প্রত্যেকে প্রত্যেকের ক্ষেত্রে নিজ নিজ দায়িত্ব নিষ্টার সাথে পালন করেনি। তবে এটাও সত্যি একটি বড় মাপের নেতৃত্ব মানুষকে উদ্ধুদ্ধ করার জন্য প্রয়োজন ছিল। এই নেতৃত্বহীনতা দীর্ঘ সময় ধরে এ সমাজে নানা ফোকর তৈরি করেছে। যে ফোকরে নষ্ট জল ঢুকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে মানুষের শুভবোধ।

অনুপ সাদি: স্বাধীনতার প্রায় তিন দশকে বাংলাদেশ কোন কোন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। অবশ্যই আপনার দৃষ্টিত।

সেলিনা হোসেন: স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েই যে দুটি প্রধান সাফল্য আমার কাছে অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ তার একটি হলো অল্প সময়ে একটি অসাধারণ সংবিধান রচনা, দ্বিতীয়টি বাংলাদেশ থেকে মিত্র বাহিনীর দেশে ফিরে যাওয়া। এছাড়া বাংলাদেশকে ১০৮টি দেশের স্বীকৃতি প্রদান, জাতীসংঘের সদস্য পদ লাভ এবং বিশ্বের বড় বড় সংস্থার সদস্য পদ পেয়ে দেশের উন্নয়নের জন্য বৈদেশিক সাহায্য লাভ আরও অনেক সাফল্যের মধ্যে অন্যতম। ইউনিয়ন পরিষদে নারীদের নির্বাচন এবং নারীদের মূল স্রোতে টেনে আসার প্রক্রিয়াকে আমি বর্তমান সরকারের উল্লেখযোগ্য দিক মনে করি।

অনুপ সাদি: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

সেলিনা হোসেন: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ। বাংলাবাজার পত্রিকা সংশ্লিষ্ট সবাইকে এবং অগনিত পাঠকদের ধন্যবাদ।[১]  

তথ্যসূত্র ও টিকাঃ

১. এই সাক্ষাতকারটি দুই সময়ে গৃহীত দুটি সাক্ষাতকারের সংযুক্ত রূপ। বাঁকা হরফের অংশটুকু ৪ সেপ্টেম্বর, ২০০৩ থেকে শুরু করে সপ্তাহখানেক ধরে লিখে নেয়া হয়েছিল। এবং এটি গ্রহণ করা হয়েছিল কাজল বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ছোটকাগজ ‘রোদ্দুর’-এর জন্য। কিন্তু রোদ্দুর বের না হওয়ায় এটি পরে শফিকুল কাদির সম্পাদিত ময়মনসিংহের ছোটকাগজ ‘অর্ঘ্য’-এর অক্টোবর, ২০০৮ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। বাকি অংশটুকু দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকার জন্য গৃহীত এবং ২৯ অক্টোবর, ২০০০ সালে প্রকাশিত। এই অংশটুকু ২০০০ সনের অক্টোবর মাসের কোনো এক সপ্তাহে লিখে নেয়া। সাক্ষাতকারের দুটি অংশই তার বাংলা একাডেমির অফিসরুমে বসে সপ্তাহখানেক সময় ব্যয় করে হাতে লিখে গ্রহণ করি, কারণ তিনি অডিও রেকর্ডারে সাক্ষাতকার প্রদান করতেন না।

সাক্ষাৎকারটি অনলাইনে রোদ্দুরে ডট কমে ৫ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে প্রকাশিত হয়। সেখান থেকে হুবহু ফুলকিবাজ ডট কমে প্রকাশ করা হয়েছে।

Leave a Comment

error: Content is protected !!