বাংলা সাহিত্য হচ্ছে বাংলাভাষী জনগণের গত দেড় হাজার বছরের সৃষ্ট সাহিত্য

বাংলা সাহিত্য (ইংরেজি: Bangla Literature) হচ্ছে প্রধানভাবে আধুনিক দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর দ্বারা বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্য। জাতি হিসেবে বাঙালির রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের কোনো ধারাই সেদিক থেকে অবজ্ঞা করবার মতো নয়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসও বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসের একটি অঙ্গ এবং বাঙালীর ইতিহাসেরই একটি শাখা। অবশ্য সাহিত্যের ইতিহাস শুধু ইতিহাসও নয়, সাহিত্যের স্বশাসিত এলাকায় সৃষ্টি-প্রেরণার ও সৃষ্টি-ঐতিহ্যেরও প্রকাশ ও বিকাশ, সাহিত্যেরও আপন ক্ষেত্রে স্বরাজ লাভ। এই কথা সাহিত্য-জিজ্ঞাসু পাঠক মাত্রই জানেন, অনুসন্ধানকালে আমিও তা বিস্মৃত হতে চাই নি। 

এই বাংলাভাষী জনগণের পরিচয় নিহিত আছে সাহিত্য এবং তার স্বাধীনতার সংগ্রামে। মূলত তা একই সত্যের দু পিঠ। বাঙালির পক্ষেও তা ছিল একই প্রেরণার দুই ধারা, একই সাধনার দুই দিক; সে প্রেরণা আত্মপ্রকাশের প্রেরণা, সে সাধনা আত্মবিকাশের সাধনা। গর্ব করবার মতো কারণ তাতে আমাদের আছে, তা আমরা জানি। তথাপি ১৯৪৭ সালের আগস্টে বাঙালি জাতি ব্রিটিশ প্ররোচনায় এবং ব্রাহ্মণ্যবাদী ষড়যন্ত্রে দুই স্বতন্ত্র রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে গেল, বাংলার ইতিহাসে এত বড় ট্রাজেডি আর ঘটে নি। সমসাময়িক কালের রাজনৈতিক ঘটনাবর্ত যেভাবে সৃষ্টি হয়েছে তা আমরা দেখেছি। কিন্তু ঘটনাটা দৈবাৎ ঘটেনি। এই ট্রাজেডি সম্বন্ধে গভীরতর জিজ্ঞাসার অবকাশ আছে। বাঙালির ইতিহাসে তার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। 

বাংলা সাহিত্য উদ্ভবের প্রেক্ষাপট

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে বাংলা ভাষার উৎপত্তিকাল খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দী। কম পক্ষে হাজার বছরের পুরানো বাংলা ভাষা উৎপত্তির পর থেকে নানা পর্যায়ে পরিবর্তনের মাধ্যমে আধুনিক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। বাংলা ভাষার বিবর্তনের ইতিহাসে ধ্রুপদী, অপভ্রংশ ও আধুনিক—এই তিন যুগের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য উপলব্ধি করা যায়। আদি ধ্রুপদী বা প্রাচীন যুগের বাংলা ভাষার কাল দ্বাদশ শতক পর্যন্ত বিস্তৃত। এ সময়ের প্রধান নিদর্শন চর্যাপদ। এর ভাষা থেকে তখন পর্যন্ত তার পূর্ববর্তী অপভ্রংশের প্রভাব দূর হয়ে যায় নি, এমন কি প্রাকৃতের প্রভাবও তাতে বর্তমান ছিল। তবে সেই সময়েই বাংলা ভাষা তার স্বতন্ত্র মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছে।[১]  

বাংলা সাহিত্যের এরূপ ইতিহাস জিজ্ঞাসায় এখনো দুস্তর বাধা রয়েছে। বাধা দু’দিকের। সাহিত্য হিসাবে, বাংলা সাহিত্য কেন, কোনো সাহিত্যই সামন্ত যুগীয় সামাজিক পরিবেশ ও মতাদর্শ কাটিয়ে উঠতে না পারলে আত্মপ্রতিষ্ঠ হয় না। আমাদের দেশের সাহিত্যে এই সামন্ত যুগ দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে;—এই হলো প্রথম বাধা। কাজেই খ্রিস্টীয় প্রায় ১৮০০ অব্দ পর্যন্ত রচিত বাঙলা সাহিত্যে যা সাহিত্য বলে গণ্য হয়, তার সাহিত্য-বিচারই প্রায় গৌণ জিনিস। ধ্রুপদী ও সামন্ত যুগের বাঙলা সাহিত্যের বারো আনা আলোচনাই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আলোচনা, পূজা-অর্চনা, নিয়ম-নীতি, ধ্যান-ধারণা, অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠানের বিচার বৃত্তান্ত। অর্থাৎ এ হচ্ছে সাংস্কৃতিক নৃ-বিজ্ঞানের গবেষণা,-সাহিত্যিক বিচারের পক্ষে তা একটা বাধা হয়ে ওঠে। অথচ সাংস্কৃতিক বিষয়ের কার্যকারণ যথার্থরূপে বুঝতে হলে জীবন-যাত্রার মূল সত্য জানা থাকা চাই; এবং সামাজিক বিন্যাসের মূল তথ্য না জানা থাকলে সাংস্কৃতিক বিশ্লেষণ অসম্ভব। দুর্ভাগ্যক্রমে বাংলার সামাজিক ইতিহাসের সেই সব মূল তথ্য এখনো অনাবিষ্কৃত;- এইটি দ্বিতীয় বাধা। এই জন্যই আমরা বরং অতীতের সাহিত্য থেকে বুঝতে চাই অতীতের সামাজিক অবস্থা। উপরতলা দেখে অনুমান করে নিতে যাই ভিত্তিভূমির বিন্যাস। এরূপ অনুমান কিছু কিছু সত্যও হতে পারে; কিন্তু সমাজ-বিজ্ঞানের ছাত্র মাত্রই জানেন এটি হলো সংস্কৃতি-জিজ্ঞাসার বিপরীত মার্গ। 

জীবন-যাত্রার গোড়ার কথা আগে জানতে হয়, তবেই বোঝা সম্ভব সাহিত্যে তার প্রতিফলন কতটা পড়েছে প্রত্যক্ষ, কতটা পরোক্ষ কতটা পড়েছে সৃষ্টির মৌলিক নিয়মে অনুরঞ্জিত হয়ে, কতটা পড়েছে ব্যক্তি-মানসের মধ্য দিয়ে কুজ হয়ে বা ন্যুজ হয়ে। এ গ্রন্থে আমি সেই সমাজবিজ্ঞানসম্মত পথে বাঙলা সাহিত্যের কথা পরিবেশন করেছি, এমন ধারণা কেউ করে থাকলে তিনি অত্যধিক আশা করছেন;-এখনো তদুপযোগী তথ্য আমাদের নেই, এবং আমিও তদুপযোগী যোগ্য গবেষক নই। তবে যোগ্যতা না থাকলেও আমার জিজ্ঞাসা আছে, আর এ গ্রন্থেও তার পরিচয় হয়তো পাঠকের পাবেন। তার অপেক্ষা বেশি কিছু আশা করবেন না। 

বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাস রচনা একটা দুঃসাধ্য কাজ; কতকাংশে প্রায় তা অসম্ভবও। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্য বলতে তো পুঁথিপত্র। কত পুঁথি কোথায় আছে ঠিক নেই। যে সব পুঁথির কথা জানা গিয়েছে, সে সব পুঁথিও সকলের পরীক্ষা করবার সুযোগ নেই। কোন পুঁথিতে কি ছিল কি আছে তাও জানা যায় না। যা মুদ্রিত হয়েছে তারও কতটা খাঁটি কতটুকু মেকি বোঝা সহজ নয়। যা মুদ্রিত হয়নি তাও নকলের নকলে বা শোনা কথার প্রমাণেই অনেক সময়ে গ্রাহ্য। তাছাড়া, কে কোন্ পুথির লেখক, কে গায়ক, কে লিপিকার, কে আগে কে পরে, এসব কত প্রশ্ন যে ওঠে এবং এখনো মীমাংসার অপেক্ষায় আছে, তার শেষ নেই। এ সব প্রশ্ন মীমাংসিত না হলে বাংলা সাহিত্যের যথার্থ ইতিহাস রচনা দুরূহ কাজ।[২]

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে চালিত স্বাধীনতা আন্দোলন আধুনিক ও প্রথানুসারী সাহিত্যের বিষয়বস্তু ও আবেদনের উপর চূড়ান্ত প্রভাব বিস্তার করেছিল। জনপ্রিয় নাট্যকলা এবং তৎকালীন সঙ্গীত ও নৃত্যের ক্ষেত্রেও এটি বহুলাংশে প্রযোজ্য। এগুলিতে অতি সংক্ষেপে ভারতীয় পৌরাণিক কাহিনীর নায়ক-নায়িকাদের মুখ দিয়ে রূপকথার ভাষায় ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামের কথা জনগণের মধ্যে প্রচার করা হতো। জনপ্রিয় শিল্পকলায় স্বাধীনতার স্বীকৃতিতে ব্রিটিশবিরোধী গুপ্তসমিতিগুলির কর্মীদের রাজনৈতিক ও আদর্শগত নীতিগুলি প্রতিধ্বনিত হত।[৩]

তথ্যসূত্র:

১. মাহবুবুল আলম, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি, ঢাকা, ষোড়শ সংস্করণ জুলাই ২০১৬, পৃষ্ঠা ২৭
২. গোপাল হালদার, বাঙলা সাহিত্যের রূপ-রেখা, প্রথম খণ্ড প্রাচীন ও মধ্যযুগ, এ মুখার্জি এন্ড কোং প্রা লি, কলকাতা, দ্বিতীয় সংস্করণ শ্রাবণ ১৩৬৩, পৃষ্ঠা ০৩-০৪।
৩. কোকা আন্তোনভা, গ্রিগরি বোনগার্দ-লেভিন, গ্রিগোরি কতোভস্কি; অনুবাদক মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়; ভারতবর্ষের ইতিহাস, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, প্রথম সংস্করণ ১৯৮২, পৃষ্ঠা- ৫১৩।

Leave a Comment

error: Content is protected !!