দার্শনিক ও চিন্তাবিদ অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের এই রাজনৈতিক সাক্ষাৎকার আমি ২০০২ সনের ৮ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের বিপরীতের দক্ষিণে অবস্থিত রোকেয়া হলের আবাসিক ভবনের তৎকালীন বাসায় গ্রহণ করি। সাক্ষাৎকারটি অনেক দীর্ঘ হওয়ায় অনলাইন পাঠকদের সুবিধার্থে এখানে কয়েকটি বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন শিরোনামে বিভক্ত করে ফুলকিবাজ ডট কমে ২০ মে ২০২১ তারিখে প্রকাশ করা হচ্ছে। বর্তমান ফুলকিবাজ পাঠ্যে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সমস্যা প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। আপনারা নিচের লিংকগুলোতে ক্লিক করে আবুল কাসেম ফজলুল হকের এই রাজনৈতিক সাক্ষাৎকারটি বিষয় অনুসারে পড়তে পারবেন।
সাক্ষাৎকারটি তৎকালীন দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকার ১৯, ২০, ২১ ও ২২ আগস্ট, ২০০২ তারিখে চার কিস্তিতে “নতুন প্রযুক্তির অভিঘাতে সভ্যতা ও সংস্কৃতি” শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল। আবুল কাসেম ফজলুল হকের সাক্ষাৎকারের পুরো পাঠ অনুসরণ করতে ক্লিক করুন যথাক্রমে গণতন্ত্র, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সমস্যা, সর্বহারার গণতন্ত্র, নারীমুক্তি, বাঙালি জাতি ও জাতি সমস্যা, বাংলা ভাগ, ফেডারেশন ও কনফেডারেশন এবং চিন্তার স্বাধীনতা প্রসঙ্গে।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সমস্যা প্রসঙ্গে
অনুপ সাদি: বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশগুলোর ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের শত্রু কী কী ?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: গণতন্ত্রের শত্রু বাঙলাদেশের মানুষের ভিতরেই সবার আগে দেখা যায়। মানুষের স্বরূপ যদি আমরা বুঝতে চাই তাহলে দেখি যে, মানুষ নিজের জন্যে স্বাধীনতা চায় কিন্তু তার চর্তুপার্শ্বের অন্যদেরকে নিজের অধীন রাখতে চায়। মানুষ নিজে সম্পদ অধিকারে রাখতে চায় এবং সেই সম্পদলিপ্সা চরিতার্থ করতে গিয়ে চারপাশের বহু মানুষকে দরিদ্র রাখে। এই যে মানব স্বভাব, গণতন্ত্রের পথে এগুতে হলে ক্রমাগত এর পরিমার্জন ও পরিশীলন ঘটাতে হয়। এ এক অনন্ত সাধনা ও সংগ্রামের ব্যাপার। এর জন্য কালে কালে উদ্দেশ্য নির্ণয় করতে হয় আর উদ্দেশ্যনিষ্ঠা দরকার হয়। বাঙলাদেশের রাজনৈতিক মহলে, রাজনীতিতে সক্রিয় বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এ উপলব্ধি সামান্যই আছে।
আমরা যদি আওয়ামি লিগ ও বিএনপির দিকে দেখি, তাহলে দেখা যায়, সেখানে গণতন্ত্রের চেতনা বিকশিত হয়নি, বাইরে কিছু শ্লোগানধর্মী কথা তারা বলছে বহুলাংশে মানুষের সমর্থন আদায় করে নেয়ার জন্য_ বলতে পারো ভাওতা দেওয়ার জন্য। তাছাড়া, প্রগতিশীল দল বলে যেগুলো পরিচিত, যারা মার্কসবাদ ও সমাজতন্ত্রের কথা বলেন, কিংবা বলতেন, যারা এখন বামপন্থি বলে আত্মপরিচয় দেন, তাদের ভেতরেও তো মহত্ত্বের সন্ধান পাওয়া যায় না, উন্নততর ব্যবস্থার দিকে যাওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। এমন অনেক কিছু দেখা যায় বলে মানুষ তাদের প্রতি সংশয়াপন্ন_ মানুষ তাদের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে। কাজেই শত্রুর কথা বললে প্রথম শত্রু এই দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষের অমার্জিত, অপরিশীলিত চেতনার মধ্যে পাওয়া যাবে।
বর্তমান ব্যবস্থায় যারা যত ধনী, যারা যত ক্ষমতাবান, যারা যত শিক্ষিত, তাদের অপরাধ তত বেশি। গণতন্ত্রের দিকে অগ্রগতি না হওয়ার সবচেয়ে মূল কারণ এখানেই। এরই ফলে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অনূকুল অর্থনীতি, রাষ্ট্রব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা হয় না। তারপরে বলতে হয়, এই জাতির ভেতরকার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বাইরের বিভিন্ন অপশক্তি আসে, বাইরের আধিপত্যবাদীরা আসে_ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আসে, জি সেভেনের আধিপত্যবাদীরা আসে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন আসে। বাইরের বিভিন্ন বৃহৎ শক্তি নানানভাবে আসে আমাদের উপরে কর্তৃত্ব করার জন্য, আমাদেরকে শুষে নেওয়ার জন্য। একদিকে তাদের আধিপত্যলিপ্সা চরিতার্থ করার জন্য, অন্যদিকে আমাদেরকে শোষণ করে আমাদের সম্পদ তাদের দখলে নিয়ে নেয়ার জন্য। এভাবে শত্রুকে দেখতে হবে যদি আমরা সমাধানসুখী চিন্তা করতে চাই। আত্মশক্তির কথা না ভেবে কেবল বাইরে দৃষ্টি দিলে ভুল হবে। প্রথমে ভেতরে তার পরে বাইরে দৃষ্টি দিতে হবে।
অনুপ সাদি: বাঙলাদেশ তাহলে কতটুকু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র না হলে অগণতন্ত্রের চিত্রগুলো কোথায় কোথায় দেখা যাচ্ছে?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: বাঙলাদেশের মানুষের মধ্যে কখনো কখনো গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা দেখা দিয়েছে, বেশ প্রবলভাবেই দেখা দিয়েছে। আমি আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, পাকিস্থান প্রতিষ্ঠার পরে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের আগে গণতন্ত্রের কথা রাজনৈতিক নেতারা প্রচার করেছেন, তাতে জনগণের মধ্যে গণতন্ত্রের নামে প্রবল আবেগ সৃষ্টি হয়েছে। পরে গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা দেখেছি ১৯৯০ সালে_ এরশাদ সরকারের পতনের পরে। পত্র-পত্রিকায় গণতন্ত্র সম্পর্কে অনেক লেখা হয়েছে। কিন্তু ধারণাগুলো বাস্তবসম্মত রূপ নিয়ে বিকশিত হয়নি। তাত্ত্বিকভাবে গণতন্ত্রের আদর্শ-রূপ-রীতি-পদ্ধতি বাংলাদেশে কি হবে, তা যথেষ্ট স্পষ্ট করা হয়নি।
এদেশে গণতন্ত্রের ধারণা খুব সামান্যই বিকশিত হয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকার ধারণার ওপর অন্ধভাবে নির্ভর করা হয়েছে। তাও পড়ে বোঝা ধারণা নয়, বহুলাংশে শুনে পাওয়া ধারণা। তাতে আমাদের আত্মদর্শনের নিদারুণ অভাব থেকে গেছে। গণতন্ত্র একটা সার্বিক জীবনপদ্ধতি, সমাজ-ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা। একটা রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিতরে সকল স্তরের সকল শ্রেণীর মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং সেই সম্পর্ক পরিচালনার জন্য একটি সরকার ব্যবস্থা; তার মধ্যে ভোটের মাধ্যমে সরকার গঠন একটা অপরিহার্য বিষয়। কিন্তু আরো অনেকগুলো অপরিহার্য বিষয় আছে, সব বিষয় একত্রে চিন্তা আকারে কোনো রাজনৈতিক দলের অথবা বাঙলাদেশের কোনো লেখকের রচনার মধ্য দিয়ে আজও রূপ পায়নি। কোনো রাজনৈতিক দল, কোনো রাজনৈতিক নেতা, কোনো চিন্তাবিদ এসব নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেননি। কোনো দলের ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চা দেখা দেয়নি। কাজেই গণতন্ত্রের আদর্শ ও অনুশীলন এখানে নিতান্তই অপূর্ণ। রাজনৈতিক দলগুলোর অধিকাংশর ভেতরেই গণতন্ত্রের চিন্তা নেই, অনুশীলন নেই।
রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের কথা বলা হয়, কিন্তু দলের ভেতরে গণতন্ত্রের কোনো তাগিদই দেখা যায় না। একদল অন্যদলকে যেভাবে আক্রমণ করে, গালিগালাজ করে, অশোভন কথাবার্তা বলে, সংঘর্ষ সৃষ্টি করে, রক্তপাত ঘটায়, তার সবটাই গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ পরিপন্থি। আর রাজনীতিতে সক্রিয় সকল পক্ষই জাতীয় ইতিহাসকে বিকৃত করে। সর্বোপরি আমরা যদি নির্বাচনগুলো দেখি, বিশেষ করে গত তিনটা নির্বাচন, আমরা দেখি যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রভৃতি কতগুলো বাইরের শক্তি এসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপর প্রত্যক্ষ গার্জিয়ানশিপ নিয়ে নির্বাচনগুলো করে দিয়েছে। তাদের ভূমিকা ছাড়া নির্বাচন বানচাল হয়ে যেত। কাজেই এর মধ্যে বাইরের আরোপিত ব্যাপার আছে। আরোপের প্রক্রিয়ায় মুৎসুদ্দি শক্তিও আছে। গণতন্ত্র অনেকের আবেগ-অনুভূতিতে আছে, কিন্তু তাকে বাস্তবসম্মত চিন্তাগত রূপ দেওয়া হয়নি। আর কার্যক্ষেত্রে গণতন্ত্রের অনুশীলন তো নেই। এ অবস্থায় বাংলাদেশে গণতন্ত্র নেই, তবে মানুষের মধ্যে গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা আছে। বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেশকে পরাধীনতার দিকেই চালিত করছে।
অনুপ সাদি: দলগুলোর ভেতরে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও অন্যান্য পদগুলোর জন্য কি ব্যালটের মাধ্যমে নির্বাচন করা যায় না?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: দলের কমিটি গঠনের বেলায় ব্যালটের মাধ্যমে নির্বাচন করলে গণতন্ত্রের একটা অপরিহার্য শর্ত পূর্ণ হবে এবং ব্যালটের মাধ্যমে একবার-দুবার-তিনবার নির্বাচন হলে ক্রমে ত্রুটি-বিচ্যুতি অতিক্রম করা সম্ভব হবে। যদি কোনো বৈদেশিক শক্তি বা বৈদেশিক চক্রান্তের মাধ্যমে নির্বাচন হয়, তাহলে গণতন্ত্রের আয়োজন ও আশা ব্যার্থ হবে। যদি দলের সদস্যদের আন্তরিকতা থাকে তাহলে প্রথম পর্যায়ে কিছু খারাপ দেখা দিলেও নির্বাচনের ধারা তৈরি হলে অবস্থা উন্নত হবে। আর ভোটের মাধ্যমে গেলে চিন্তা ভাবনাও পরিষ্কার হয়ে আসবে। তখন গণতন্ত্র শুধু ভোটে সীমাবদ্ধ থাকবে না, রাজনৈতিক দলকে, পার্টিকে কিভাবে গড়ে তুলতে হবে, পার্টির নেতৃত্ব কীভাবে তৈরি করতে হবে ইত্যাদি সম্পর্কে উন্নত ধারণা বিকশিত হবে।
নেতা ছাড়া, দল ছাড়া নেতৃত্ব হয় না। নির্বাচনের প্রক্রিয়া বিকশিত করা গেলে ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠত কাদেরকে নেতা বানানো উচিত হবে, দলের কর্মসূচি ও কর্মনীতি কি হবে ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা। পার্টির কাজ তো পার্টির ভেতরে সীমাবদ্ধ থাকবে না, গোটা দেশে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে, জনগণও অনেক কিছুতে উৎসাহী হবে। ফলে দেশকে কীভাবে গড়ে তোলা যাবে সে সম্পর্কে ধারণা বিকশিত হবে বাধ্য। রাজনীতির সংগে অর্থনীতি ও সংস্কৃতিকে যুক্ত করে চিন্তা ও কাজ করতে হবে। ধনতন্ত্র, পুঁজিবাদী গণতন্ত্র জনগণের স্বার্থের পরিপন্থি। আমি যে গণতন্ত্রের কথা বলছি তা জনগণের গণতন্ত্র_ সংক্ষেপে বলতে পারো জনগণতন্ত্র। অবশ্যই তা অতীতের বিভিন্ন জাতির অভিজ্ঞতার আলোকে বিকশিত নতুন ধরনের গণতন্ত্র হবে। দেশ-কালের অনুযায়ী তারও রূপভেদ প্রকৃতিভেদ থাকবে।
অনুপ সাদি: জনগণতন্ত্র বা নতুন ধরনের গণতন্ত্রের রূপ ও প্রকৃতি কি হবে?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: সেটা আগ্রহী মহলের সকলকে চিন্তা করতে হবে। সে সম্পর্কে আমার কিছু ধারণা আছে, সেগুলো বলতে গেলে অনেক কথাই বলতে হবে। তাই এখন কিছু বলতে চাচ্ছি না।
অনুপ সাদি: তাত্ত্বিক দিক নিয়ে দলগুলোও আলোচনা করেনি, লেখকগণও তেমন আলোচনা করেননি। আমাদের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্র কি রকম হতে পারে?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: বাঙলাদেশে যে রকমই হোক প্রায় শুরু থেকেই সংসদীয় গণতন্ত্রের শাসনতন্ত্র আছে, মাঝে মাঝে নানাভাবে বিশেষ করে মার্শাল ’ল জারি হওয়ার ফলে শাসনতন্ত্রের ধারা ব্যর্থ হয়েছে। ইংরেজ চলে যাওয়ার পর পাকিস্থান ও বাংলাদেশ আমলে রাজনৈতিক মহল থেকে সব সময়েই সংসদীয় গণতন্ত্রের কথাই বলা হয়েছে, সংবিধানও তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অপরিহার্য শর্তগুলো পূরণ করা হয়নি। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল গঠন ছাড়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। এদেশে দল গঠন সংক্রান্ত চিন্তা-ভাবনা দেখা যায়নি। রাজনৈতিক দল গঠনের প্রশ্নেই এখন কেন্দীয় গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
অনুপ সাদি: আমার তো মনে হয় যে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা করলে খুব ভালো হয়।
আবুল কাসেম ফজলুল হক: দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা করলে ভাল হবে-এটা আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে; কিন্তু আমার কাছে এটা মনে হয় যে, বাঙলাদেশে রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়ায় আগে মনোযোগ দেয়া উচিত। পার্টি, পার্টির ভেতরে জনগণের গণতন্ত্রের আদর্শের অনুশীলন, পার্টির ভেতরে গণতন্ত্র থাকবে এবং পার্টি রাষ্ট্রের জনগণের জন্য কাজ করবে এই মনোভাব_ এই অপরিহার্য পূর্বশর্ত আগে তৈরি করা দরকার; একক কিংবা দ্বিকক্ষের প্রশ্ন পরে। এক কক্ষবিশিষ্ট সংসদে সমস্যা হয় ঠিক; সেখানে অনেক কথাবার্তা, হৈ-হল্লা, আবেগ-উত্তেজনা ইত্যাদিতে কল্যাণচিন্তা ভন্ডুল হয়ে যায়। সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে অনেক অন্যায় প্রস্তাবও পাস করা হয়।
দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ হলে একটা ভুল মত প্রথম জায়গায় পাস হয়ে গেলেও দ্বিতীয় জায়গায় পরিশোধনের সুযোগ থাকে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের ধারণাকে আমিও ভালো মনে করি, কিন্তু তার চাইতেও অনেক জরুরি বিষয় এখন বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল গঠনের দিকে কেন্দ্রীয় মনোযোগ দেওয়া। আমার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দ্বারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে কোনো অগ্রগতিই হয়নি, হচ্ছে না। অরাজনৈতিক, নির্দলীয় নিরপেক্ষ ব্যক্তি, যাদের চিন্তায়-চেতনায় রাজনীতি নেই, অন্য কিছু আছে, ব্যবসা-বাণিজ্য আছে, আমলাতন্ত্র আছে, বিদেশি শক্তির তাবেদারী করে সম্পত্তি ও ক্ষমতা লাভের অভিলাষ আছে, তারা কর্তৃত্বে এসে গেছে। কাজেই আমাদের অভিজ্ঞতা, দেশ-বিদেশের অভিজ্ঞতা, আর আমাদের কান্ডজ্ঞান বলে দিচ্ছে যে আমাদের নেতা দরকার, কর্মি দরকার, দল দরকার, রাজনীতি দরকার_ এক কথায় দরকার নেতৃত্ব। সেই নেতৃত্বের প্রশ্নেই সকলের মনোযোগ দেওয়া দরকার। রাজনৈতিক দল গঠনে সকলেরই তৎপর হওয়া কর্তব্য। জনসাধারণেরও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে হবে। জনগনের আন্দোলন ছাড়া অগ্রগতি হবে না।
অনুপ সাদি: পার্টি গঠনের কথা বলা আসলে অর্থহীন, তত্ত্ব দাঁড় না করানো গেলে, কিংবা ভালো দিকটা উপস্থাপন না করলে পার্টি গঠন করবে কারা?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: হ্যাঁ, সেসব প্রশ্নে যেতে হবে। পার্টি গঠনের জন্যও তত্ত্ব লাগবে, স্বতঃস্ফুর্তভাবে হবে না। পার্টি গঠন কারা করবে? আর তত্ত্ব হলেই যে পার্টি হবে তা তো নয়। ভালো অর্থে পার্টি গঠনে আকাঙ্ক্ষী মানুষ লাগবে। তত্ত্ব নেই আবার তত্ত্ব আছেও, এই অর্থে যে, তুমি যদি আমাদের দেশের বাঙলা ভাষায় গত ১০০ বছরের লেখকদের রচনাবলি খোঁজ করো তাহলে দেখবে যে, অনেক শুভবুদ্ধির কথা এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা কীভাবে ভালো চলতে পারে তা আছে। এইসব চিন্তা যদি কোনো রাজনৈতিক দলের ভেতরে যেত তাহলে সেই পার্টি এগুলোকে কর্মনীতিতে রূপ দিতে পারত। কিন্তু এখানে তো চিন্তাশীল লেখকদের চিন্তার সঙ্গে রাজনৈতিক দলের এবং রাজনৈতিক নেতাদের কোনো সংযোগ নেই। বুদ্ধিজীবীরা তো চিন্তাশীল লেখক নন। বাঙলা ভাষায় চিন্তাশীল লেখক ছিলেন, আছেন।
অনুপ সাদি: বাঙলাদেশের সংবিধান কি ভালো করে পড়েছেন?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: সংবিধান পড়েছি। যখন প্রথম প্রকাশিত হয় তখন খুব আগ্রহ নিয়ে পড়েছি। তারপরেও পড়েছি। কেন এ প্রশ্ন?
অনুপ সাদি: এই সংবিধানটা এখন কতটুকু গণতন্ত্রের পক্ষে সহায়ক?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: শোনো, বাংলাদেশের সংবিধান সম্পর্কে কোনো কোনো মহল অনেক প্রশংসার কথা বলেছেন। যারা তৈরি করেছেন তারা বলেছেন। কিন্তু কেন এই প্রশংসা? এই সংবিধানে ১১টা অধ্যায় আছে। প্রত্যেকটা অধ্যায়েরই অনেক অপূর্ণতা ও অস্পষ্টতা আছে। এই সংবিধানে এখন পর্যন্ত অনেক সংশোধনী এসেছে এবং কোনো কোনো সংশোধনীর মাধ্যমে গোটা শাসনতন্ত্রকেই বদলে দেয়া হয়েছে। মার্শাল ল-এর মাধ্যমে শাসনতন্ত্রকে স্থগিত করা হয়েছে। দীর্ঘ সময় মার্শাল ল-তে কেটেছে।
আওয়ামি লিগ থেকে বলা হয়েছে যে, এটা পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো অল্প কয়েকটা শাসনতন্ত্রের একটা। কিন্তু এসব কথাকে আমার কাছে অর্থহীন কথা বলে মনে হয়। ভালো শাসনতন্ত্র হলে এত অল্প সময়ের মধ্যে এত সংশোধনী কেন লাগলো? আমেরিকার শাসনতন্ত্র কবে হয়েছে এবং আজ পর্যন্ত কয়টা সংশোধনী তাতে দরকার হয়েছে? ভারতের শাসনতন্ত্র কেমন? চুয়ান্ন বছরে তাতে কয়টা সংশোধনী লেগেছে? এরকম তুলনামূলক আলোচনায় গেলে দেখা যাবে যে, আমাদের দেশের সমাজ-রাজনীতি-সংস্কৃতির সঙ্গে এই শাসনতন্ত্র সঙ্গতিপূর্ণ হয়নি। আওয়ামি লিগের রাজনৈতিক চরিত্রের সংগেও এটা সঙ্গতিপূর্ণ হয়নি। তাই এটা কার্যকারিতা পায়নি।
শাসনতন্ত্রের ১১টা অধ্যায় যদি তুমি পড়ো, তাহলেই দেখবে যে, অনেক কিছু অপূর্ণ আছে, অনেক কিছু অস্পষ্ট আছে, উচিত ছিল সংশোধনী দিয়ে সেগুলোকে পূর্ণ করা, স্পষ্ট করা, কার্যকর করা, স্বচ্ছ করা, কিন্তু সংশোধনী দিয়ে সেগুলো বিকৃত করা হয়েছে। সংশোধনী দ্বারা সংবিধানকে মানুষের অধিকার এবং জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অনূকুলে না নিয়ে উল্টো ধারায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তা ছাড়া, ১৯৭২ থেকে আজ পর্যন্ত কোনো সরকারই জনসাধারণের মধ্যে সংবিধানকে ব্যাপকভাবে প্রচার করার দায়িত্ব পালন করেনি। যদি বিনামূল্যে কিংবা সামান্য মূল্যে জনসাধারণের কাছে সংবিধান সুলভ করা হত, তাহলে জনমত বিচার করে বোঝা যেত, এই সংবিধান ভাল কি মন্দ। আমার মনে হয় না যে, ব্যাপক জনমতে এই সংবিধান ভালো বলে স্বীকৃত হবে। জনগণের গণতন্ত্রের জন্য ভিন্ন সংবিধান লাগবে।
অনুপ সাদি: এখন শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর প্রতিটি রাষ্ট্রেই আমলাতন্ত্র চরম শক্তিশালী। গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ মুখ থুবড়ে পড়েছে। আমলাতন্ত্রের গণতন্ত্র বিরোধীতা মোটামুটি সর্বস্বীকৃত। এ অবস্থায় আমলাতন্ত্রের হাত থেকে গণতন্ত্রকে কিভবে মুক্ত করা যায়?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র আগের তুলনায় দুর্বল, আমলাদের শক্তি আগের তুলনায় কমেছে। এনজিওপতি যারা তাদেরও ক্ষমতা আছে। আমলাদের ক্ষমতা তারা কিছুটা হলেও নিয়ে নিয়েছে। ড. ইউনুস, ফজলে হাসান আবেদ, জাফরুলাহ চৌধুরী, কাজী ফারুক আহমদদের ক্ষমতা আমাদের সেক্রেটারীদের, এমনকি কোনো কোনো দিক দিয়ে প্রধানমন্ত্রির ক্ষমতার চাইতেও বোধ হয় বেশি। আমলাতন্ত্রের যে শক্তিটা ঘনীভূত ছিলো, এখন এনজিও ব্যবস্থা বিকশিত করে তার কিছুটা এনজিওপতিদের হাতে দিয়ে দেয়া হয়েছে। তারপরেও আমলাদের অনেক শক্তি আছে। এই যে তারা ঘুষ, দুর্নীতি, নানা কিছুর মাধ্যমে মানুষকে অসহায় করে রেখেছে এর মধ্যে আমলাদের শক্তির প্রমাণ পাওয়া যায়। আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতির সঙ্গে রাজনীতিবিদরাও জড়িত, মন্ত্রিপরিষদের অনেক সদস্য, পার্লামেন্টের অনেক সদস্য জড়িত_ সবটা মিলে আমলাতন্ত্রের এই রূপ।
আমলাতন্ত্রের সমস্যার কথা গত অন্তত দেড়শো বছর ধরে ইউরোপ-আমেরিকার সমাজ-দার্শনিকেরা, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা, সচেতন নাগরিকেরা আলোচনা করে আসছেন। নানাভাবে তারা তাদের দেশের বাস্তবতায় সমস্যার সমাধান খুঁজছেন। আমলাতন্ত্রের মধ্যে এমন কিছু জটিল সমস্যা আছে যেগুলোর কোনো শাশ্বত চূড়ান্ত সমাধানের কথা এখনো কেউ ভাবতে পারেন না। মানুষের স্বভাবের মধ্যে, যে কথাটা একটু আগে বললাম, দ্বৈধ আছে। মানুষ নিজের জন্যে এক রকম চায় কিন্তু অন্যের জন্য অন্য রকম চায়। এরকম অনেক মানবীয় বৈশিষ্ট্য আছে যেগুলো আমলাদের আচরণের মধ্যে দিয়ে বিশেষ রূপ নিয়ে প্রকাশ পায়। সেগুলো খারাপ রূপ।
আমলাতন্ত্র বলতে সেই শাসনব্যবস্থাকে বোঝায় যে ব্যবস্থায় আমলাদের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা অনেক বেশি থাকে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে, রাজনীতি, অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠানসহ সবকিছুর ওপরেই আমলারা কর্তৃত্ব খাটায়। আমলাতন্ত্রের অভিশাপ সকল রাষ্ট্রব্যবস্থাতেই মাঝে মাঝে ভয়ানকভাবে দেখা যায়। নানাভাবে সমস্যার সমাধান করে এগুতে হয়। কোনো শাশ্বত সমাধানের কথা এখনো কেউ বলতে পারেননি। সোভিয়েত ইউনিয়ন যে ভেঙ্গে পড়েছে, তার পেছনেও অনেকে বলেছেন যে আমলাতন্ত্রের অন্যায়সমূহ ভয়ানকভাবে দেখা দিয়েছিল। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের গোড়া থেকেই বিরুদ্ধবাদীদের থেকে বলা হয়েছে যে, সমাজতন্ত্রে আমলাতন্ত্র অভিশাপ হিসেবে দেখা দেবে। কার্ল মার্কসের কালেই বলা হয়েছে একথা। এটা বাস্তবেও দেখা দিল। কাজেই বিশেষ সময়ে আমলাতন্ত্রের সৃষ্ট যে সমস্যা দেখা দেয় সেগুলো চিহ্নিত করে সমস্যার সমাধান করে এগুতে হবে। সমাধান গণতান্ত্রিক উপায়েই করতে হবে। জনস্বার্থে করতে হবে। আমি ধনতান্ত্রিক গণতন্ত্রের কথা বলছি না, জনগণের গণতন্ত্রের কথা বলছি, ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে ভিন্নতর অর্থনীতি-রাজনীতি-সংস্কৃতির কথা বলছি।
অনুপ সাদি: একটি রাষ্ট্রে আমলাতন্ত্র কি অবশ্যই প্রয়োজনীয়?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: আমলাতন্ত্র অবশ্যই প্রয়োজনীয় নয়; আমলাতন্ত্র অবশ্যই বাতিলযোগ্য, অবাঞ্ছনীয়। কিন্তু প্রশাসন ব্যবস্থা অপরিহার্য। রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে কোনো না কোনো রকম প্রশাসন ব্যবস্থা লাগবেই। প্রশাসন ব্যবস্থার একটি বিকৃত কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থাই আমলাতন্ত্র। আমলাতন্ত্র গণতন্ত্র-বিরোধি।
অনুপ সাদি: নির্বচিত প্রতিনিধি দিয়ে কি প্রশাসন চালানো যায় না?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: অবশ্যই করা যাবে যদি মানুষের সভ্যতা এবং সংস্কৃতি অনেক উন্নত হয়। সেটা ভবিষ্যতে সম্ভব হবে বলে আশা করি। তার জন্য শিক্ষা, সংস্কৃতি, সভ্যতা মানবাচরণ অনেক উন্নত হওয়া দরকার এবং এজন্যে ধাপে ধাপে এগুতে হবে। বাঙলাদেশে নির্বাচন নিয়ে যেমন কাণ্ড চলছে তাতে তো প্রশাসনে নির্বাচন প্রথাকে সফল করা যাবে না।
অনুপ সাদি: ভোটের মধ্য দিয়েই কি গণতন্ত্র পরিমাপ্য? অর্থনৈতিক গণতন্ত্র ছাড়া গণতন্ত্রের সাফল্য কিভাবে সম্ভব?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: না। ভোটের ব্যবস্থা গণতন্ত্রের মাত্র একটা অপরিহার্য শর্ত। ভোটের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ হয়। কিন্তু ভোটের ব্যবস্থাই গণতন্ত্রের একমাত্র পরিমাপক নয়। আর ভোটের প্রক্রিয়া ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় হলে গণতন্ত্র সফল হয় না। সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা হলে গণতন্ত্র সফল হয় না। উপনিবেশবাদী ব্যবস্থা হলে গণতন্ত্র সফল হয় না। এগুলো আমরা দেখেছি আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে। কান্ডজ্ঞান দিয়েও এটা বোঝা যায়।
আর অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের কথাটাও তো বিমূর্ত। অর্থনৈতিক গণতন্ত্র কি? যে মানুষ অশিক্ষিত, যে মানুষ নির্বোধ, যে মানুষ দুর্বল, যে মানুষ Inter Personal Relationship-এ অন্যের সঙ্গে পেরে ওঠে না, ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অন্যের উপর নির্ভরশীল থাকে, সেখানে তার গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব হবে_ এটাতো স্বাভাবিক। দুর্বল থাকলে ক্ষতি স্বীকার করতে হবে। দুর্বলকে দশ জনের সংগে মিলে শক্তিশালী হতে হবে। মিলবার মনোভাব ও প্রস্তুতি যে সমাজে সাধারণ মানুষের মধ্যে যত বেশি আছে সেই সমাজের সাধারণ মানুষ ততটা গণতন্ত্রের দিকে এগুতে পারছে। সমস্যা অনেক আছে। সমস্যার সমাধান করতে হবে। দুর্বল হলে ক্ষতি স্বীকারে বাধ্য হতে হয়। সম্মিলিত চেষ্টায় শক্তি হয়।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।