ফকরুল আলমের সাক্ষাৎকার — আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গতিশীল না

ফকরুল আলম গবেষক, প্রাবন্ধিক, সমালোচক, অনুবাদক। তাঁর জন্ম ১৯৫১ সনের ২০ জুলাই। ছাত্রাবস্থাবেই তিনি লেখালেখির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর এ যাবত প্রকাশিত ইংরেজি গ্রন্থ ‘ড্যানিয়েল ডিফো-কলোনিয়াল প্রপাগান্ডিস্ট’, নিউইয়র্কের টোয়েন পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত ‘ভারতী মুখার্জি’ এবং ১৯৯৯ সালে ইউপিএল প্রকাশ করেছে ‘জীবনানন্দ দাশ সিলেক্টড পোয়েমস’। দেশ-বিদেশের অনেক পত্রিকা’, জার্নাল ও পুস্তকে তাঁর গবেষণামূলক অনেক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ‘জার্নাল অব দি এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ’-এর সম্পাদক এবং এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় যে এনসাইক্লোপেডিয়া প্রকাশিত হয়েছে সেটির সহকারি ভাষা সম্পাদক।

পেশাগত দিক দিয়ে তিনি বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক। তিনি অনুবাদে বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৩ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেছেন। তিনি সমাজ ও সাহিত্য, দেশ, কাল, রাজনীতি, অর্থনীতি, উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ভাষা ইত্যাদির বিভিন্ন দিক নিয়ে একটি সাক্ষাতকার প্রদান করেন। তাঁর সেই সাক্ষাতকারটি আমি ও আমার বন্ধু মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান গ্রহণ করি তাঁর ফুলার রোডের বাসায় ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহের কোনো একদিন সন্ধ্যায়।

অনুপ সাদি: জোনাথন সুইফটের Guliver’s Travels-এ গালিভারের মানুষের প্রতি যে ঘৃণাসূচক দৃষ্টিভঙ্গি; তার দৃষ্টিতে মানুষ মূলত সর্বনিকৃষ্ট প্রাণী; আপনার দৃষ্টিভঙ্গির সাথে তার দৃষ্টিভঙ্গির কতটুকু মিল রয়েছে তা জানতে চাচ্ছি?

ফকরুল আলম: প্রথমেই আমাদের বুঝতে হবে যে গালিভার একটি Satire এর Character বা ব্যঙ্গ রচনার চরিত্র। গালিভার সুইফট না। গালিভারের দৃষ্টিভঙ্গি একজন মানসিক বিপর্যস্ত চরিত্রের। গালিভারকে অনেক রকম ধাক্কা সহ্য করতে হয়েছে, অনেক কিছু সে দেখেছে; দেখে সে, আমরা বলতে পারি যে, তাল সামলাতে পারে না। সেজন্য যে গালিভারকে দেখি তার সাথে সুইফটের মিল হওয়ার কোনো কথাই উঠে না। আমাদের গালিভারকে সেরকম চোখেই দেখা উচিত, এই গালিভারকে আমরা শেষে দেখি ঘোড়ার সাথে আস্তাবলে থাকছে, এ গালিভার তো নরমাল না। সেজন্য আমাদের মনে হয় সুইফট দেখাতে চেয়েছে, সত্যের যে তীব্রতা এটা যদি আমরা সহ্য করতে না পারি তাহলে আমাদের বিপদ হতে পারে; সেটাও একটা বিপদ, যেরকম Pride.  

অনুপ সাদি: মানুষের মধ্যে তো অনেক খারাপ দোষ রয়েছে: এগুলি প্রায়ই মাথাচাড়া দিয়ে উঠে; এ দৃষ্টিকোণ থেকে  মানুষ আসলে পতিত প্রাণী। নিকৃষ্ট প্রাণী…… তারা কতোটুকু নিকৃষ্ট?

ফকরুল আলম: সেটা একটা দিক। এখন এটা নির্ভর করে কোনো Theological বা ধর্মতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে  দেখি। আমরা Christian Theology থেকে দেখলে দেখি যে,  আমরা Fallen বা পতিত। আমাদের প্রাইডকে সুইফট আক্রমণ করেছেন। কিন্তু এটাও ঠিক যে God has given us the capacity for reason (ঈশ্বর আমাদেরকে প্রজ্ঞা দান করেছেন) এবং আমরা ক্রীশ্চিয়ান মতবাদে reason কে যদি God-এর আলোকে দেখি, ব্যবহার করতে পারি, তাহলে সেটা Right reason (সার্বিক ভালো); Right reason-এর ব্যাপার আছে এখানে। সেজন্য আমরা Right reason যদি ব্যবহার করি তাহলে আমাদের ভবিষ্যত নিশ্চিত, নইলে না; কিন্তু গালিভার মানুষকে এ্যাটাক করতে গিয়ে নিজে Unreasonable হয়ে যায়, Irrational হয়ে যায়। সেটাই আমার মনে হয় সুইফট দেখাচ্ছেন।

অনুপ সাদি: ড্যানিয়েল ডিফো রবিনসন ক্রুসোতে Colonial Propagandist. প্রধান চরিত্র ক্রুশো এখানে ফ্রাইডের উপর ভাষা, ধর্ম, আচার ইত্যাদি চাপিয়ে দেয়। এটা কি উপনিবেশবাদ বা সাম্রাজ্যবাদের চরিত্র? সাম্রাজ্যবাদের অতীত রূপ ও বর্তমান রূপ কেমন?

ফকরুল আলম: নিশ্চয়ই, এটা সাম্রাজ্যবাদেরই অতীত চরিত্রের একটা বড় দিক। এটা তো বলা যায় আমরা ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে ইংলিশ ভাষা শিখছি, আমরা ইংরেজিতে আমাদের অনেক কিছু চালিয়ে যাচ্ছি, এটা তো Obviously linguistic colonialism-এর একটা দিক। ঠিক একই রকমভাবে মিশনারির যেসব কাজ হয়েছে আমাদের দেশে, উপমহাদেশে, এশিয়াতে, আফ্রিকাতে …এটা সাম্রাজ্যবাদের আর একটা দিক । Religious colonialism বলা যায় এক দিক, আর একটা Linguistic colonialism. Religious ও Linguistic colonialism Economic colonialism থেকেই বের হয়ে এসেছে। একটার  সাথে আর একটা জড়িত, আমরা আলদা করতে পারি না। সেজন্য আমার মনে হয় যে, পুরোটাকেই এক রকমভাবে দেখতে হবে। আর বর্তমানের সাথে তুলনা করলে বলা যাবে যে, এখন তো আর সেই আগের Imperialism নেই, Imperialism সে অর্থে নাই; কিন্তু নিশ্চয়ই ক্যাপিটাল বা পুঁজির জোরটা আছে। এবং পুঁজিবাদকে Imperialism না বললেও একরকম  চেষ্টা আছে যেটার কোনো Original source কিংবা Force নেই। কিন্তু সেটা একবার শুরু হলে নিজের বেগেই Colonize করে, আমাদের মনকে Colonize করে। সেটা হয়েই আসছে; আমাদের মনকে Colonize করছে। পশ্চিমের Capital থেকে যায়। উৎস তার অনেক Forces; এটার কোনো one originating source নাই; এভাবে আমাদের দেখা উচিত। আমরা সুস্পষ্টভাবে বলতে পারব না যে এরা colonizer সেজন্য মনে হয় বিপদজনক অনেক দিক থেকেই, কেননা চিহ্নিত করা যায় না শত্রুটাকে।

অনুপ সাদি: তাহলে আগের চাইতে কী বর্তমান সাম্রাজ্যবাদ আরো বেশি জটিল? যেমন সাম্রাজ্যবাদের সাথে শোষণের একটা নিবিড় ও ভয়ংকর সম্পর্ক আছে। এই শোষণটার বর্তমানের রূপ কেমন?

ফকরুল আলম: নিশ্চয়ই জটিল একদিক থেকে কিন্তু অন্যদিক থেকে এটার জোর অতো নেই। আমার মনে হয় যে এটা বুঝতে হলে সবচেয়ে ভালো হবে বুঝতে ফুকোর Concept of discourseকে। এখন আমরা বলতে পারি যে ডিসকোর্সের জোরেই আমরা শোষিত হচ্ছি। এটা যে কোনো অবভিয়াস ডিরেকশনে যাচ্ছে বা এটাকে কেউ ইচ্ছা করে আমাদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে তা কিন্তু না; এটার একটা নিজস্ব বেগ আছে, নিজস্ব একটা গতি আছে এবং সেজন্যে অনেক জটিল বেশি। অন্যদিক থেকে আমার মনে হয় অতোটা জোর নেই। কেননা কনসেনট্রেট হলেই তখন জোরটা হবে; টার্গেট যদি থাকে তাহলে হবে কিন্তু এখানে টার্গেটের প্রশ্নই আসছে না। তারপর আবার এখনকার যুগ যেহেতু গ্লোবালাইজেশনের; এর আরেকটা দিক আছে; গ্লোবালাইজেশনের খারাপ দিক যেমন আছে, ভালো দিকও আছে; ডেমোক্রেসিসহ অনেক বিষয়ে আমরা অনেক বেশি সচেতন এখন একারণে। সেজন্য আগের মতো চাপিয়ে দেয়াটা সম্ভব না। আমার মনে হয় প্রতিবাদের ভাষাটাও এসে গেছে, প্রতিবাদের অনেক পথ খুলে গেছে, যেটা আগে ছিলো না; সেজন্য আমার মনে হয় সাম্রাজ্যবাদের আগের তীব্রতাটা আর নেই।

অনুপ সাদি: আপনি সাম্রাজ্যবাদ বা উপনিবেশবাদের কথা বলছেন, ডেমোক্রেসি এবং পুঁজিবাদের কথাও বলছেন; বিশেষ করে আমেরিকা ও বৃটেন গণতন্ত্রের চর্চা করেছে কিন্তু দেখা গেছে বিভিন্ন কলোনিতে শোষণ করেছে, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে তাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সামরিক শাসন এনেছে শোষণের জন্য, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে এ-ক্ষেত্রে। তাহলে একটি দেশ গণতন্ত্রের চর্চা করছে কিন্তু দেখা যাচ্ছে তারা অন্য দেশকে শোষণ করছে; এটা আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখছেন?

ফকরুল আলম: এটার উত্তর আসলে অতোটা কঠিন না। প্রত্যেক দেশই নিজের স্বার্থ দেখে। আমরা দেখি আমেরিকানদের বেলায়, যখন ওদের স্বার্থের সাথে কোনা রকম দ্বন্দ্ব না থাকে, স্বার্থের সাথে কোনো রকমের সমস্যা না থাকে তখন ওরা গণতন্ত্রকে চ্যাম্পিয়ন করবে; কিন্তু যখন ওদের নিজস্ব স্বার্থ থাকে কোনো দেশে, তখন ওদের স্বার্থটাই বড় হয়; সেজন্য অনেক সময় ওরা Dictatorship বা একনায়কতন্ত্রকেও প্রশ্রয় দিয়েছে। শুধু প্রশ্রয়ই দেয়নি অনেক সময় প্রতিষ্ঠিতও করেছে; আমরা এটা ইতিহাস জানলে দেখি। কিন্তু যেখানে ওদের নিজেদের স্বার্থের ব্যাপার থাকে না, আমার মনে হয় আমেরিকানরা বেশ Constantly গণতন্ত্রকে চ্যাম্পিয়ন করে এসেছে, সেটা একটা উত্তর। আর একটা উত্তর হলো যে রাজনৈতিক আবহাওয়াও পরিবর্তন হয়, একটা সময় ছিলো যখন Unipolar World ছিলো না, যখন Cold War-এর সময় ছিলো, তখন কিন্তু আমেরিকানদের একটা পলিসিই ছিলো যতদূর সম্ভব ডানপন্থি শক্তিদেরকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অনেকখানি প্রাধান্য দিয়েছে; সেজন্য ডেমোক্রেসির ব্যাপারটা তোয়াক্কা করেনি। এখন কিন্তু সেই ক্লাইমেটটা চেঞ্জ হয়ে গেছে। ইউনিপোলার ওয়ার্ল্ডে আমেরিকানরা এখন আরো অনেক বেশি জোর দিয়ে ডেমোক্রেসি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে। কিন্তু কোল্ড ওয়ারের সময়, মুখ্য ছিল রাশিয়ানদেরকে বা কমুনিজমকে ঠেকানো, এখন আর সেটা নেই, এখন ওরা অনেক বেশি এগ্রেসিভলি ডেমোক্রেসিকে প্রমোট করে।

অনুপ সাদি: কিন্তু কমুনিজমকে, একটা মতবাদকে কিংবা একটা আদর্শকে ঠেকানোর জন্য তারা যে নানা দিক দিয়ে চাপ প্রয়োগ করেছে, বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে মানুষকে প্রভাবিত করেছে, এটা কতটুকু ঠিক হয়েছে?

ফকরুল আলম: এটা তো আসলে ঠিক-অঠিকের কথা না; এটা রিয়েল পলিটিকের ব্যাপার। এটাকে আমরা নৈতিকভাবে বলতে পারি যে এটা ঠিক না; কিন্তু একটা রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হলে প্রাগম্যাটিজম বা প্রয়োগবাদের ব্যাপার থাকে, সেটাও সত্যি। এর একটা ব্যাপার আমি যেটা একটু আগেই বলছিলাম যে, রিলেটিভিটি বা আপেক্ষিকতার ব্যাপার আছে, এক সময় যেটা ঠিক মনে হয় অন্য সময় সেটা ঠিক মনে হয় না; আমেরিকানদের এখন ভিয়েতনামের ব্যাপারে যে ধরনের guilty মনোভাব আছে মেজরিটির সেটা এক সময় ছিলো না। তাহলে ওদের মধ্যেও পরিবর্তন এসেছে অনেক দিক থেকে। এখন ওরা অনেক কিছুই ঠিক মনে করে না যেটা ওরা Cold War-এর সময় ঠিক মনে করতো; এটাকে একটা ঐতিহসিক দৃষ্টিভংগি থেকে দেখতে হবে। ইন্টারন্যাশনাল পলিটিক্সের ব্যাপারে বেশ কটি দিক আছে; কোনটা ঠিক কোনটা ঠিক না সেটা জোর দিয়ে বলা উচিত না। অনেকগুলো Consideration আছে, অনেক দিক থেকে যাচাই করতে হবে।

অনুপ সাদি: ক্রুশোর ভাষা ফ্রাইডে গ্রহণ করেছিলো। বাঙালি উর্দু গ্রহণ করেনি। এখন আবার বলা হচ্ছে ইংরেজি শিখলেই সব সমস্যার সমাধান হবে। আপনি ইংরেজির শিক্ষক; ইংরেজি শিখে আসলে আমাদের কী উন্নতি হবে? ইংরেজির A, B, C না জেনেও অনেক দেশের মাথাপিছু আয় হাজার ডলারেরও উপর রয়েছে।

ফকরুল আলম: পুরো ব্যাপারটা আসলে এতো জটিল যে ইংরেজি না শিখলে হাজার ডলার ইনকাম হবে আর ইংরেজি শিখলে হাজার ডলার হবে_ কোনোটাই আমরা সুনিশ্চিত করে বলতে পারি না। তবে ইংরেজি শিখলে যে আমাদের ক্ষতি হয় না এটা যদি আমরা ইতিহাসের দিকে তাকাই, আমরা যদি নাইনটিনথ সেঞ্চুরি বেঙ্গলি রেনেসান্সের দিকে যাই, আমরা যদি আমাদের সবচেয়ে বড় মনিষী, সবচেয়ে বড় লেখকদের দিকে তাকাই, রাজা রামমোহন রায়, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দের দিকে যদি তাকাই; আমরা দেখি যে ইংরেজি শিক্ষা এদেরকে কোনো ক্ষেত্রেই বাঙলা থেকে দূরে নেয়নি বরঞ্চ অনেক কিছু বাঙলায় প্রকাশে সহায়ক হয়েছে। সেজন্য আমি মনে করি যে আমরা যদি নতুন করে ইংরেজি ভালোভাবে শিখি, সেটা যদি আমরা করি তাহলে আমাদের জন্য ভালোই হবে, খারাপ হবে বলে মনে করি না, বাঙলার জন্য খারাপ হবে এমন মনে করার কোনো কারণ নেই।

আর অনেক দেশ, যেমন চায়নার মতো দেশ যার বিরাট শক্তি, বিরাট অর্থনৈতিক শক্তি; তাদের জন্য ইংরেজি না শিখে চায়নিজে সবকিছু চালিয়ে যাওয়াটা অনেক সহজ। আমাদের মতো দেশ যারা মাল্টিন্যাশনালের উপর নির্ভর করে অনেক বেশি, বিশ্ব ব্যাংকের উপর নির্ভর করে, এডিবি-এর উপর নির্ভর করে, বিদেশে চাকরির উপর অনেক কিছু নির্ভর করে, তাই আমাদের ইংরেজি শিখার অনেক প্র্যাকটিক্যাল কারণ আছে। আর একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, চায়নাতেও আজকাল ইংরেজি শিক্ষার হিড়িক পড়ে গেছে। আমি নিজে জানি চায়না থেকে লোককে সমানে ইংরেজি শিক্ষার জন্য বিদেশ পাঠানো হয়, ইংরেজির শিক্ষকরা বিদেশ থেকে চায়নায় যায়। জাপানেও এখন, এক সময় যা ছিলো না, ইংরেজি শিক্ষার দাম অনেক বেশি। আমার মনে হয় এটা গ্লোবালাইজেশনেরও একটা ব্যাপার যে ইংরেজি শিক্ষা আবার নতুনভাবে দেখা দিচ্ছে- এটা সাম্রাজ্যবাদ কিংবা চাপিয়ে দেয়ার ব্যাপার না। যদি আমরা গ্লোবাল ইকোনোমিতে টিকতে চাই, এই কারনেও আমাদের ইংরেজি শেখা দরকার।

অনুপ সাদি: বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রি, আমলাদের ইংরেজির দরকার নেই; যেটুকু দরকার তা দোভাষী বা অনুবাদক দিয়েই চলে। ম্যজিস্ট্রেট, উকিল কৃষক বা শ্রমিকদের ইংরেজির দরকার নেই। প্রকৌশলি, ডাক্তার কিংবা সব স্নাতোকোত্তর উপাধিধারীর কি ইংরেজি দরকার? যেটুকু দরকার তা তো বাঙলা দিয়েই চলে। আর্ন্তজাতিক ব্যবসা বাণিজ্যে দরকার; কিন্তু বাংলাদেশের কজন ব্যবসা করে; বড়জোর ৫০০ জন; তারা তো দোভাষী দিয়েই চালাতে পারে। অর্থাৎ এদের কারোরই ইংরেজির দরকার নেই। ইংরেজি দরকার শুধু তাদের যারা মৌলিক জ্ঞান সৃষ্টি করতে চান। এদর মধ্যে পড়ে মৌলিক বৈজ্ঞানিক, গবেষক ও সৃষ্টিশীল লেখকেরা। যেমন, মধূসুদন, রবীন্দ্রনাথ, জগদীশচন্দ্র বা আরো অনেকে। এছাড়া কারো দরকার নেই। কিন্তু সাধারণ মানুষকে বোকা বানানোর জন্যেই ছদ্মবেশ পরতে হয়, বলতে হয় আর্ন্তজাতিক যোগাযোগ বা জ্ঞানের কথা। ইংরেজি শিক্ষা আসলে শোষণের মোক্ষম উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপনি কি বলেন? ইংরেজি না শিখিয়ে বাঙলাদেশের গরীব জনগণকে এমন কিছু শেখানো দরকার যা তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করবে। 

ফকরুল আলম: একটার সাথে আর একটা জড়িত। কোনোটো থেকে কোনোটা আলাদা না। আমরা ইংরেজি না শিখলে যে সাধারণ মানুষ তাদের অধিকার পাবে, সবদিক থেকে ভালো থাকবে এটা তো আমরা বলতে পারি না। আবার ইংরেজি শিখলে যে শোষিত হবে এটাও আমরা বলতে পারি না। সবকিছুই বেশ জটিল এদিক থেকে। আমরা ডাক্তারদের ব্যাপারটাই ধরি না কেন, আমরা দেখি ডাক্তারি করতে গিয়ে যে জ্ঞান দরকার সে জ্ঞানটা সে পাবো কোথায়, বাঙলায় কয়টা বই লেখা আছে, বা কয়টা জার্নাল লেখা আছে? …… যদি থিওরিক্যালি বাঙলায় আমরা সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক মেডিকেল জার্নাল পেতাম, দেশে মৌলিক গবেষণা হতো, বিদেশের গবেষণাগুলো এদেশে অনুবাদ করে পড়ানো হতো তাহলে ইংরেজি শিক্ষার কোনো দরকারই পড়তো না। অনুবাদের মাধ্যমে আমরা সব পেয়ে যেতাম। কিন্তু আমাদের দেশের যে অবস্থা, আমাদের বাঙলা একাডেমি কিংবা অনুবাদ করার যেসব প্রতিষ্ঠান আছে সেগুলোতে যে কয়টা অনুবাদ হচ্ছে সেটা জ্ঞানের যে এখন গতি, কোনো রকমভাবেই তার সাথে তাল মেলাতে পারছে না। সেজন্য ইংরেজি যদি না শিখে আমাদের ডাক্তাররা, যদি ইংরেজিতে জার্নাল না পড়তে পারে, এই মুহুর্তে আমরা বলতে পারি যে তারা বিজ্ঞানের সাথে তাল রাখতে পারবে না। সেজন্য তাদের জন্য নিশ্চয়ই ইংরেজি শিক্ষা দরকার। এরকম অনেকের জন্য ইংরেজি দরকার। সাধারণ মানুষের ইংরেজি দরকার হতো না যদি সাধারণ মানুষদের চাকরির ব্যাপার না থাকতো, দেশে মাল্টিন্যাশনাল না থাকতো, সাধারণ মানুষের বিদেশে যাওয়ার ব্যাপার না থাকতো আমরা জানি সাধারণ মানুষরাও আজকাল বিদেশে যায়, চাকরি করে, সাধারণ মানুষের মধ্য থেকেও অনেকে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে, এসব কারণে ইংরেজি শিক্ষার দরকার সবার কাছে আছে। এগুলো যদি না থাকতো, আমরা যদি নিজেদের ক্ষমতায় একেবারে নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারতাম তাহলে ইংরেজি শিক্ষার ব্যাপারটাই হয়ত থাকত না।

অনুপ সাদি: ‘Guliver’s Travels’-এ আমরা দেখি সুইফটের রাজনীতির প্রতিও আগ্রহ রয়েছে। তিনি রাজনীতিকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করেছেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর তৎকালীন ইংল্যান্ডের বা ইউরোপের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সংগে বাঙলাদেশের বর্তমান রাজনীতির মিল কতটুকু?

ফকরুল আলম: অনেক, অনেক। আমি নিজে অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডের ছাত্র, আমি যখন পি.এইচ.ডি. করে দেশে ফিরে আসি, দেশে এসে মিলটা এত বেশি মনে হয়েছে; এখন মনে হয় যে আমি আরো অনেক বেশি মিল দেখছি বছরে বছরে। একটা উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে সুইফট একটা জায়গায় ‘Guliver’s Travels’-এ তৎকালীন অষ্টাদশ শতাব্দীর পার্লামেন্টকে ক্লাসিকাল গ্রিসের পার্লামেন্টের সাথে তুলনা করেছেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর পার্লামেন্টের যে গঠন সেটা দেখলে বোঝা যাবে যে কী ধরনের মানুষ পার্লামেন্টে নির্বাচিত হচ্ছে;_ যাদের পয়সা আছে, এটা বললে তো আবার বিপদে পড়ে যাবো, হা হা, আসলে সুইফট বলে; যাদের বাহুবল আছে, যাদের বিত্ত আছে তারাই নির্বাচিত হচ্ছে পার্লামেন্টে; যারা যোগ্য ব্যক্তি, যারা সত্যিকারের নেতৃত্ব দিতে পারে, যারা বুদ্ধিজীবি, যাদের নেতৃত্বের গুণ আছে তারা কেউই পার্লামেন্টে নির্বাচিত হয় না। সুইফট ক্ষোভ করে বলে যে আগেকার দিনে ক্লাসিকাল পিরিয়ডে সিসেরোর মতো মানুষেরা পার্লামেন্টে যেত, যারা কালচারে আর্টে বিজ্ঞ মানুষ ছিল তারা পার্লামেন্টে যেত, সেই তুলনায় অষ্টাদশ শতাব্দীর পার্লামেন্টে সুইফট যা দেখে সেটাতে সে হতাশ হয়ে যায়। আমার মনে হয় আমরাও ওইরকম মিল দেখতে পারি। আর একটা মিল দেখা যায়, ‘Guliver’s Travels’-এ বুক তিনে সুইফট সাউথ সি বাবল-এর কথা বলেন, সাউথ সি share Market-এ শেয়ার মার্কেটে হঠাৎ করে রাতারাতি শেয়ারের দাম বেড়ে যায়, নিরীহ মানুষ শেয়ার কেনে এবং শেষে সবকিছু হারায়, শেষে ইংল্যান্ডে দারুণ হতাশা এবং অর্থনৈতিক কষ্ট বেড়ে যায় সাধারণের এবং সেটাওতো আমরা দেখেছি খুব বেশি বছর আগে নয়[১]। আমার মনে হয় ‘Guliver’s Travels’-এর একটা অনুবাদ করা দরকার ………। আরো দেখা যায আমাদের দেশে মন্ত্রি Competition দিয়ে অভিনয় করে কে কত বেশি টেকনিক দেখাতে পারে, দেখা যায় কমপিটিশনের মাধ্যমে একজনকে মন্ত্রি করা হয় এবং কিছুদিন পরে আর একজনকে; যেটা ‘Guliver’s Travels’-এ দেখা যায় Rope dancing-এ লিলিপুটের সম্রাটের সামনে। এরকম অনেক মিল, দেখানো যায়, খুব বেশি কষ্ট হবে না পড়লে। সেজন্য আমার মনে হয় ‘Guliver’s Travels’-এর অনুবাদ করা দরকার।

অনুপ সাদি: রাজনীতিতে দেখা যায় পার্লামেন্টের শুরু থেকেই, কোনো ভালো লোক পার্লামেন্টে আসেননি। ভালো সাহিত্যিকতো আসেনইনি, ভালো দার্শনিক এমনকি সমাজতাত্ত্বিকও।

ফকরুল আলম: এটা কি করে হয়; এডমন্ড বার্কের কথাই ধরা যাক, রাজনীতিতে কী দারুণ তার প্রজ্ঞা, কী দারুণ তার পড়াশোনা, সে তো এক বছর না অনেক বছর খুব ডিসটিংশন দিয়ে তিনি রিপ্রেজেন্ট করেছেন। তিনি তার বিদ্যার জন্যই কিন্তু পার্লামেন্টে আসেন। তাকে নেয়া হয়েছিলো তার বিদ্যার জন্যই। অতীতেও অনেক ভালো পার্লামেন্টারিয়ান এসেছে, একজন নয়, অনেক; যেমন, গ্লাডস্টোন, ডিজরেইলি, চার্চিল, ইন্ডিয়াতেও অনেক এসেছে, আমাদের দেশেও ছিল না তা তো নয়, আমাদের দেশেও ঐ রকম অনেক লোক ছিল এক সময়।

অনুপ সাদি: রাজনীতিতে কী ভালো লোকদের সম্পৃক্ত করা যায় না?

ফকরুল আলম: আমার মনে হয় আমাদের খুব বেশি নেগেটিভ হওয়া উচিত নয়। আমার মনে হয়, একদিক থেকে চিন্তা করলে আমাদের চলছে টিদিং প্রবলেমস, দাঁত ওঠার সমস্যা। আমাদের Democracy nascent, জন্ম নিচ্ছে এমন, মাত্র কয়েক বছরের ইতিহাস ডেমোক্রেসির। আমার মনে হয়, আমরাও আগামিতে আশা করি, ভালো লোকরা রাজনীতিতে আসবে, যদিও এখন দেখলে মনে হয় ভবিষ্যতে তেমন কোনো ভালো লোক দেখছি না আমরা, Short-sighted হলে আমরা তাই মনে করবো, তবে আমি আশা করবো যে নিশ্চয়ই আগামিতে ভালো লোক রাজনীতিতে আসবে; এটার জন্য ডেমোক্রেসির পরিপক্কতা দরকার।

মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান: শিশু গণতন্ত্রের যদি উন্নতি হয়, তার পরম্পরা যদি আমরা দেখি; তাহলে ’৯১ সালে যে নির্বাচন হয়েছে তার পরে থেকে এই কয় বছরে আপনার কী মনে হয় গণতন্ত্রের উন্নতি হয়েছে?

ফকরুল আলম: না। কিন্তু আমরা যদি আবার অষ্টাদশ শতকে ফিরে যাই তাহলে আমরা দেখব যে অষ্টাদশ শতকে সুইফট যে নৈরাজ্যের কথা বলে, যে হতাশা দেখে; তারপরে আমরা দেখি যে বার্কের জেনারেশনে খুব ভালো লোকরা পার্লামেন্টে এসেছে যদিও সে সময় অনেক সমস্যা ছিল। তারপরে আমরা দেখব যে উনিশ শতকে গ্লাডস্টোন, ডিজরেইলি, উইনস্টন চার্চিল, অনেকেই আসছেন। সুতরাং আমরা এক পা পেছাতে পারি, তার মানে এই না যে আমরা এক পা সামনে এগুবো না বা দুপা সামনে যাব না। এটা আমার মনে হয়, পার্লামেন্টের উন্নতি হচ্ছে smooth forward linear progress[২] এটা কেউ বলতে পারে না কোনো দেশের ইতিহাসে। আমেরিকাতেও আমরা দেখি যে উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ওদের সমস্যা হয়, ইমপিচমেন্ট হয় এ্যন্ড্রু জ্যাকসন নামে এক প্রেসিডেন্টের; আমেরিকান ডেমোক্রেসিতে একটা খুব ক্রাইসিসের সময় যায়; তারপর ওটাও উতরে ওঠে ওরা। সেজন্য আমি মনে করি খুব নেগেটিভ হওয়ার কারণ নেই।

অনুপ সাদি: বাংলাদেশের পরোক্ষভাবে নির্বাচিত সংরক্ষিত মহিলা আসন কয়টি তো প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র বলতে যা বোঝায় সেটাতেও খুব প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।

ফকরুল আলম: সংরক্ষিত মহিলা আসন কয়টি তো এখন এই মুহূর্তে গণতান্ত্রিক নিয়মেই হচ্ছে না। আমাদের নারীদের যে আন্দোলন সরাসরি নির্বাচনের দাবিতে সেটা যদি হয় তাহলে সত্যিকারের গণতন্ত্র মহিলাদের আসনের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হবে। সেটা নিশ্চয় আমরা সবাই সমর্থন করবো। আমি মনে করি নারীরা সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবে এবং সেটাই গণতান্ত্রিক হবে, ঠিক হবে।

অনুপ সাদি: বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রসঙ্গে আসা যাক, বিশ্ববিদ্যালয়ই সাধারণত সমাজ, সাহিত্য, বিজ্ঞান, সংস্কৃতির উন্নতির ক্ষেত্রে অগ্রনী ভুমিকা পালন করে। মৌলিক জ্ঞানের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় এ ধরনের ভূমিকা রাখতে পারছে না বর্তমানে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শুধু গতানুগতিক পাঠদান ও পরীক্ষা নিচ্ছে। কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নানা ক্ষেত্রের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে?

ফকরুল আলম: আমি এ প্রশ্নের সাথে পুরোপুরি একমত হতে পারছি না। খুব বেশি দূর না, আমাদের ইংরেজি বিভাগের দিকে যদি তাকাই আমরা প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মত ব্যক্তিকে দেখতে পাই। আমরা কি বলব যে উনি জ্ঞানকে অগ্রসর করে নিচ্ছেন না? আমার মনে হয়, নিশ্চয় আমাদের ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে প্রফেসর আনিসুজ্জামান এবং এ রকম আরো অনেক জনের নাম করতে পারব যারা নিশ্চয় আমাদের দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। প্রশ্নটার মূল বক্তব্যটা ঠিকই আছে, সেটা যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গতিশীল না, আমাদের ইউনিভার্সিটির মধ্যে কোনো ডাইনামিজম নেই।

অনুপ সাদি: মৌলিক জ্ঞানের কথা?

ফকরুল আলম: নিশ্চয় মৌলিক জ্ঞানের ক্ষেত্রে তেমন আমরা অবদান রাখতে পারিনি। সেটার অনেক কারণ আছে, একটা কারণ দিয়ে তো আর বলা যাবে না; যেমন লাইব্রেরী সম্পদ আমাদের যা আছে এ্যাডভান্স রিসার্চ করার জন্যে মৌলিক জ্ঞানের ক্ষেত্রে অবদান রাখতে হলে যেটা দরকার কিংবা গবেষণাগারের যন্ত্রপাতি যেটা দরকার কিংবা কম্পিউটারাইজেশন সেগুলোর ক্ষেত্রে আমরা বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে অনেক পিছিয়ে আছি। সেই জন্যে আমরা পিছিয়ে থাকব। শিক্ষকদের পাবলিক ইউনিভার্সিটিগুলোতে যে যান না, যে টাকা-পয়সা দেয়া হয় সেটা দিয়ে আজকালকার বাজারে আমার তো মনে হয়, কারোরই হয় না, তিনি লেকচারারই হোন আর প্রফেসরই হোন। সেজন্যে অনেক অনেক রকমভাবে চেষ্টা করেন টাকা-পয়সা রোজগার করতে, ফলে অনেকে মন দিতে পারেন না পড়াশোনা বা গবেষণায়। আমার মনে হয় আমাদের জ্ঞানচর্চার জন্যে এ্যাডভান্সড ইনস্টিটিউট হয়নি এখনো। ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে একটা হচ্ছিল কিন্তু সেটা আপাতত দুঃখজনকভাবে বন্ধ করা হয়েছে; সে ধরনের এ্যাডভান্স ইনস্টিটিউট, এ্যাডভান্সড লাইব্রেরি-ল্যাবরেটরিজ প্রতিষ্ঠা করা দরকার; তারপর শিক্ষকদের গবেষকদের সেরকম সুযোগ দেয়াও দরকার, তাহলে হয়তো আমরা মৌলিক জ্ঞানের সাক্ষাত পাবো। আমেরিকাতে আমরা দেখি সব সময় প্রাইভেট বিজনেস, প্রাইভেট ফাউন্ডেশন, এ্যালুমনাই ইউনিভার্সিটিকে টাকা দিয়ে যাচ্ছে; খুব নামকরা শিক্ষক-গবেষকদেরকে, অন্য স্কেলে পয়সা দিচ্ছে, সবাইকে এক স্কেলে পয়সা দিচ্ছে না; মেধা ভিত্তিক একটা ব্যবস্থা আছে; আমি যেটা বলি ‘ইউনিভার্সিটি মেরিটোক্রেসি’ যাদের মেরিট বেশি তাদেরকে রিওয়ার্ড করা উচিত। সবাইকে একরকম টাকা-পয়সা দেয়া, সব শিক্ষককে একরকমভাবে রিওয়ার্ড করা ঠিক নয়; ইউনিভার্সিটিতে সক্রিয়তা রাখতে রাখতে হলে সবাইকে একই বেতন দিয়ে চলবে না। সেই জন্যে আমার মনে হয় মৌলিক জ্ঞানে অবদান না রাখার এসব অনেক রকম কারণ আছে। তার উপরে আমাদের ঢাকা ইউনিভার্সিটির অপরিকল্পিত বিস্তার ঢাকা শহরের মতই হয়েছে। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে আমি যখন ছাত্র ছিলাম তখন ৭/৮ হাজার ছাত্র ছিল, এখন এ বছরের ফার্স্ট ইয়ার নিয়ে একই সঙ্গে ৩০/৩২ হাজার ছাত্র-ছাত্রী আছে। সেই তুলনায় Infra-structural Investment, Library Investment, Classroom Expansion কিছুই হয়নি। সেজন্যে এই ইউনিভার্সিটি থেকে আমরা যা পাচ্ছি, প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আনিসুজ্জামান-এর মত মানুষ পাচ্ছি। একদম যে পাচ্ছি না তা না, কিছু কিছু মানুষ তো পাচ্ছি। আরো অনেক পাওয়া উচিত ছিল কিন্তু যা পাচ্ছি তা মোটেই কম নয়।

মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান: শিক্ষকদের জাতির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততাকে কীভাবে দেখছেন?

ফকরুল আলম: আমি মনে করি, দেশের নাগরিক হিসেবে আমার কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলকে ভোট দেয়ার নিশ্চয় অধিকার আছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন যে পর্যায়ে চলেছে সেটা আমি একেবারেই পছন্দ করি না। আমি মনে করি যে ইউনিভার্সিটির সত্যিকারের স্বায়ত্বশাসন হবে যখন আমরা ইউনিভার্সিটিকে নিয়েই চিন্তা-ভাবনা করব; ইউনিভার্সিটিতে বাইরের কোনো দল কিংবা বাইরে কোনো শক্তির প্রভাব Directly পড়বে না। কিন্তু এখন আমরা দেখছি যে, সবদিক থেকে এটা বেড়েই চলছে, সব Successive সরকারের মধ্যে এটা বেড়েই চলেছে; এটা আমার কাছে মোটেও ঠিক মনে হয় না; আমাদের উচ্চশিক্ষা বিকাশের জন্যে এটা Negative. আমার মনে হয় শিক্ষকদের দলীয়করনের মাধ্যমে শিক্ষার ক্ষতিই হচ্ছে, কোনো উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা দেখি না, এখন রাজনীতির যে ঝোঁক সেই ঝোঁকটিতে।

অনুপ সাদি: বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারে যে মূল্যায়ন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় তা কতটুকু ঠিক। শিক্ষকের মূল্যায়নের মানদন্ড কি হওয়া উচিত? প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হলেই কি একজন শিক্ষক হিসেবে ভালো হবেন?

ফকরুল আলম: আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারে কিন্তু বেশ স্পষ্ট নীতিমালা আছে এবং আমি মনে করি তার বেশিরভাগই বলবো খুবই সুচিন্তিত এবং ঠিকমতো প্রয়োগ করলে শিক্ষার পরিবেশ, শিক্ষার মান উন্নতির দিকেই যাবে। সমস্যাটা হয় প্রয়োগ সব সময় ঠিকমতো হয় না। আমার তো কোনো সন্দেহ নেই যে কেউ যদি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয় তবে তার শিক্ষক হওয়ার পটেনশিয়াল অনেক বেশি যে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম না তার তুলনায়। কিন্তু আমরা সেটাকেই যে একমাত্র Criteria করবো তা তো না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পদোন্নতির জন্য আরো অনেক নীতিমালা আছে, প্রকাশনার ব্যাপার আছে, গবেষণার ব্যাপার আছে, উচ্চতর ডিগ্রীজ-এর ব্যাপার আছে, এ-সবই খুব সুস্পষ্ট করে বলা আছে এবং ভালোর জন্যই করা হয়েছে। কয়েকটা জিনিষের ব্যাপারে আমার আপত্তি আছে, আমি যেমন মনে করি, এখন আমাদের পয়েন্ট সিসটেম আছে, সে পয়েন্ট সিসটেমে আমি যদি হলের হাউস টিউটর হই, তার জন্য আমি পয়েন্ট পাই, সে ক্ষেত্রে আমার প্রমোশনের সহায়ক হয়; কিন্তু আমি একটু আগে বলেছিলাম ইউনিভার্সিটি আমার মতে মেরিটোক্রেসি হওয়া উচিত, যদি মেরিটোক্রেসি হয়, আমি হাউস টিউটর হলাম কি হলাম না, আমি Student Adviser হলাম কি হলাম না, সেটা আমার পদোন্নতিতে কোন রকম ইমপ্যাক্ট করা উচিত না। এছাড়া আমি বলব আমাদের নিয়ম-নীতিমালা সবই ভালো এবং সুস্পষ্ট, সমস্যাটা হচ্ছে প্রয়োগ নিয়ে, সেটার সাথে দলীয়করণের ব্যাপারটাও আছে। সেখানে আমার মনে হয় আমাদের অনেক সতর্ক হওয়া উচিত, অনেক পরিবর্তন নিশ্চয়ই করা উচিত। এখন যে নীতিমালা ছিলো সেগুলো এবং শিক্ষকদের প্রমোশনের জন্য যে বোর্ড বসানো হয়, যে পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত সেগুলোর অনেক পরিবর্তন এখন হয়তো করা উচিত। যা নীতিমালা ছিলো খারাপ ছিলো না মোটেও; সবকিছুই সময়ের সাথে পরিবর্তন করতে হয়। যেমন, অটোনমি একটা খুবই ভালো ডকুমেন্ট, খুবই আইডিয়ালিস্টিক, অনেক কিছুই ছিল গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য সহায়ক; কিন্তু সবকিছুর মতোই অভিজ্ঞতার আলোকে এটারও পরিবর্তন দরকার। আমাদের শিক্ষক নির্বাচন পদ্ধতিতেও আমার মনে হয় কিছু কিছু পরিবর্তন আনা দরকার। আর আনা দরকার মেরিটোক্রেসির দিক চিন্তা করে, দলীয়করণের কথা না চিন্তা করে, সেটাই আমি বলতে চাচ্ছি।

অনুপ সাদি: শিক্ষকের পারফরমেন্সের মূল্যায়নের জন্য ছাত্রদের মতামতের কি কোনো গুরুত্ব দেয়া উচিত?

ফকরুল আলম: যেহেতু আমি নর্থ আমেরিকায় পড়িয়েছি টিচিং এ্যাসিসট্যান্ট হিসেবে চার বছর এবং এসোসিয়েট প্রফেসর হিসেবে দু’বছর আমার নিজেরও ছাত্র মূল্যায়ন Face করতে হয়েছে। আমি আমার ইংরেজি বিভাগে এটা আমার অভিজ্ঞতার আলোকে নিজে Introduce করতে চেষ্টা করেছি; কিন্তু আমাদের বিভাগের এটা সবাই মেনে নেননি, মেজরিটি মেনে নেননি, সেজন্য এটা বাস্তবায়ন করতে পারিনি। আমি নিজে থেকেই উদ্যোগ নিয়ে স্টুডেন্ট ইভ্যালুয়েশন করেছি, সেটাতে আমার লাভ হয়েছে, ক্ষতি হয়নি, কারণ ছাত্ররা অনেক কিছুই খেয়াল করে যেটা আমরা খেয়াল করি না, যেমন আমি দ্রুতগতিতে পড়াই, সেটা আমাকে অনেক ছাত্ররা অনেক ইভ্যালুয়েশনেই পয়েন্ট আউট করেছে। ছাত্র মূল্যায়ন দেখার পরে আমি চেষ্টা করেছি কিছুটা শোধরাতে, আবার চেষ্টা করেছি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কথা বলতে; একই কথা দু’তিনবার নানা রকমভাবে বলতে। আমার নিশ্চয় লাভ হয়েছে সেটা থেকে। কিন্তু এটার একটা সীমাবদ্ধতা আছে, আমাদের যে পদ্ধতি সে পদ্ধতিতে একই ছাত্রকে পড়াচ্ছি প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় চতুর্থ বর্ষে; সুতরাং এ ক্ষেত্রে মূল্যায়ন প্রথম বর্ষে করলে পরে আর প্রতি বছর দরকার হয় না, হয়তো আর এক বছর বড়ো জোর করতে পারি, কিন্তু বার বার হয় না। আমেরিকাতে আমি প্রত্যেক সেমিস্টারে নতুন ছাত্রকে পড়াই সেজন্য ওখানে প্রত্যেক সেমিস্টারের মূল্যায়নের দাম আছে, কেননা একটা সতেজ সাড়া পাওয়া যায়। সেটা একটা দিক; আর একটা দিক হলো যে ছাত্র মূল্যায়ন করা উচিত, তাহলে শিক্ষকরা কিছুটা জবাবদিহিতার মুখোমুখি হবে কিন্তু ছাত্র মূল্যায়নের জোরটা সীমাবদ্ধ হওয়া উচিত। তার মানে এটা একটা Criteria হবে এবং ছাত্র মূল্যায়নের ভিত্তিতেই যে সবকিছু হবে তা তো না, আমার পদোন্নতি হবে বা আমার ক্যারিয়ার ইনফ্লুয়েন্স করবে তা তো না। ওদের দেশে ছাত্র মূল্যায়ন হয় পিআর মূল্যায়নও হয়। পিআর মূল্যায়ন মানে আমার সহকর্মীরা আমাকে মূল্যায়ন করবে। সেটা একটা হয়, আবার ডিন মূল্যায়ন করে, চেয়ারম্যান মূল্যায়ন করে; সুতরাং সেখানে চেক এন্ড ব্যালেন্সের একটা ব্যাপার আছে; প্রত্যেক বছরই এই মূল্যায়নগুলি হয়। সেজন্যে আমি মনে করি নিশ্চয়ই ছাত্রদের একটা মূল্যায়ন পদ্ধতি থাকা উচিত, সেটার গুরুত্বটা আমরা খুব বাড়িয়ে দেখবো না, কিন্তু থাকলে ভালো, খারাপ না; এবং একটা মূল্যায়ন পদ্ধতির সাথে অন্যগুলোর চেক এ্যান্ড ব্যালেন্সও থাকতে হবে।

অনুপ সাদি: আপনি সালমান রুশদি পড়েছেন। তার সাহিত্যিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক মূল্যায়ন করুন।

ফকরুল আলম: সালমান রুশদি নিঃসন্দেহে বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের ইংরেজিতে যারা লিখে এসেছেন উপন্যাস, Prose, ফিকশন বা গদ্য তাদের মধ্যে অন্যতম একজন। এটা মনে হয় সহজেই বলা যায়। এটার একটা প্রমাণ যে, সালমান রুশদির ‘Midnight’s Children’ একমাত্র উপন্যাস যেটা শুধুমাত্র বুকার পুরস্কার পেয়েছে তা না, বুকার প্রাইজ হলো উপন্যাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার। ইংরেজী ভাষায় বুকার পুরস্কারের ২৫ বছর সমাপ্তির পরে ওরা যখন ২৫ বছরের বুকার পুরস্কারের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস যাচাই করে তখন ‘Midnight’s Children’কেই নির্ধারণ করে। আমার কাছে এটা অসাধারণ উপন্যাস। এ ছাড়া আমি মনে করি সালমান রুশদি আরো কয়েকটা ভালো উপন্যাস লিখেছে Shame, Haroun and the sea of Stories;_ এ গুলি আমি বলবে যে, যে কোনো মানদন্ডে খুব উঁচুদরের লেখা। কিন্তু নিশ্চয়ই আমি বলবো সালমান রুশদির ‘Midnight’s Children’ ‘Shame’ আর ‘Haroun and the sea of Stories’ যে মানে লিখেছে সেটা ‘স্যাটনিক ভার্সেস’-এ প্রথমত ও রকম লিটারারি মানটাও দেখি না; তাছাড়া মানুষের ধর্ম বিশ্বাসে যেভাবে আঘাত করেছে সেটা নিশ্চই করা উচিত ছিল না এবং আমার কাছে খুব দুঃখ লাগে এ জন্য যে সালমান রুশদি ‘Satanic Verses’ লিখেছে বলেই; নিশ্চিতভাবেই ‘Satanic Verses’ অতো উঁচু মানের নয় এবং  Offensive, এর জন্যই ওর ভালো লেখাগুলি আমরা পড়তে পারছি না; আমার কাছে এটিই দুঃখ হচ্ছে সালমান রুশদির নেগেটিভ দিকটার জন্য ওর পজিটিভ দিকটা ধরা পড়ছে না।

অনুপ সাদি: সালমান রুশদির সামাজিক ও রাজনৈতিক মূল্যায়ন?

ফকরুল আলম: আমরা সুইফটের কথা বলছিলম, সালমান রুশদি হলো অনেকটা সুইফটের ট্রাডিশনের; Satirist বা ব্যঙ্গ রচয়িতা। সালমান রুশদি ‘Midnight’s Children’-এ ইন্দিরা গান্ধী এবং ইমারজেন্সির সময়ের যে Dictatorial Power ছিল সেটার সমালোচনা করে এবং ভারতের যে স্বপ্ন সেটা থেকে যে ভারত দূবে সরে চলে যাচ্ছে, স্বপ্নটা অনেকটা মলিন হয়ে যাচ্ছে সেটা সালমান রুশদি দেখায়। ‘Shame’-এ সালমান রুশদি পাকিস্থানের ইতিহাসকে লজ্জাজনক ইতিহাস হিসেবেই তুলে ধরে। সালমান রুশদি ‘Haroun and the sea of Stories’-এ আমাদের বলবার অধিকার, চিন্তার স্বাধীনতা, এটাকে দেখায়; যারা চিন্তাকে খর্ব করতে চায়, যারা স্বাধীন চিন্তাকে হরণ করতে চায় তাদেরকে ব্যাঙ্গ করে। কিন্তু সালমান রুশদির সমস্যাটা এইখানে যে সালমান রুশদি এক পর্যায়ে গিয়ে ভুলে যায় যে সব সময় সবকিছু নিয়ে ঠাট্টা-রশিকতা করা যায় না কিংবা করা উচিত না। সেজন্যে সালমান রুশদির যে অর্জন, সে অর্জন নিশ্চয়ই একদিকে অর্জন এবং অন্যদিকে সীমাবদ্ধতা হিসেবেই ধরে নেয়া যায় এবং শেষের দিকের সালমান রুশদির উপন্যাস আমি উপভোগ করতে পারিনি; আমার মনে হয়েছে যে অনেকটা নিজের রিপিট করেছে। তার পরের দিকের উপন্যাসগুলিকে আমার অতো উৎকর্ষের বা উঁচুমানের মনে হয়নি।

মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান: জীবনানন্দকে আমরা জানি যে বাঙলা সাহিত্যের যে কয়জন সাহিত্যিক বিশেষ করে কবিতায় আধুনিকতা নিয়ে এসেছেন তাদের মধ্যে একজন এবং এটা বলা যায় ইংরেজি সাহিত্যের প্রভাব। ইংরেজি সাহিত্যের কোন বিশেষ দিকটি প্রতিফলিত হয়েছে জীবনানন্দর কবিতায়, বিশেষ করে আধুনিক ইংরেজী সাহিত্যের?

ফকরুল আলম: অনেক দিকই। আমরা একজন কবির উপর প্রভাবের কথা আলোচনা করতে গিয়ে শুধু Thematic প্রভাব আলোচনা করতে হবে না, কবি সাহিত্যিকের প্রভাবটা Form বা আঙ্গিকের দিকেও হবে। জীবনানন্দের উপরে আধুনিক ইংরেজি ও ইউরোপীয় সাহিত্যের প্রভাব Thematically এসেছে যেমন Alienation, Loneliness, Solitary Figure in a World without God;_ এ রকম অনেক কিছুই আমরা জীবনানন্দে দেখি। আবার Social Consciousnessটা পরের দিকের জীবনানন্দে; যুদ্ধের পটভূমি, Diaspora[৩] ইত্যাদি Thematic প্রভাব আমরা দেখি; সেগুলিও আমরা বলতে পারি যে, W. H. Auden থেকে শেষের দিকে W. B. Yeats থেকে, T. S. Eliot-এর কবিতা থেকে এসেছে। আঙ্গিকের দিক থেকে আমার কাছে মনে হয়, বাঙলা সাহিত্যে আমার জ্ঞান, প্রথমেই বলে নেব, খুবই সীমিত, এসবের উপরে মন্তব্য করাও উচিত না, তবুও সাহস করে বলছি, বাঙলা সাহিত্যে জীবননান্দের বিরাট অবদান। তিনি কথ্য কণ্ঠকে কবিতায় নিয়ে এসেছেন এবং Modernist Movement-এ আমরা যেটা দেখি, শেষের দিকের Yeats কিংবা Eliot থেকে আসছে। তো এভাবে বললে আমার মনে হবে জীবনানন্দকে ছোট করা হচ্ছে, মনে হবে যে জীবননান্দ প্রভাবের জন্যেই এ রকম লিখেছেন, কিন্তু সেটা একদম ঠিক নয়; একজন বড়ো কবি প্রভাবিত হয় না, তিনি নিজের প্রভাবটা খুঁজে বেড়ান; যেটা ওকে Influence করবে; সেটা থেকে সে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত হয় না, সেটা থেকে সে যতোদূর দরকার ততোদূর নেয় তারপর অন্য কিছুর সাথে মিশিয়ে দেয়, এটা সবচেয়ে উঁচুদরের কবিদের কথা বলছি; সবচেয়ে বড়ো কবিদের কথা বলছি_ জীবনানন্দ সেটাই করেছেন। সেজন্য আমি বলব যে আধুনিক ইংরেজি কবিতার এক ধারা থেকে জীবনানন্দ সচেতনভাবে কিছু কিছু জিনিস নিয়েছেন এবং কিছু কিছু নিজেরা মিশিয়ে ফেলেছেন এবং সেজন্য রসায়নে যে ফলাফলটা হয়েছে সেটা জীবনানন্দদেরই। এটা আধুনিক ইউরোপীয় সাহিত্য থেকে আসলেও সারটা জীবননান্দেরই পুরোপুরি।

মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান: আপনি তো জীবননান্দ অনুবাদ করেছেন। আপনার কি এ রকম মনে হয়েছে, জীবনানন্দের এমন কিছু নিজস্ব আছে যেটা অনুবাদে কোনোভাবেই নিয়ে আসা সম্ভব না?

ফকরুল আলম: আমি মনে করি রবার্ট ফ্রস্ট (১৮৭৪-১৯৬৩) খুব একটা সত্যি কথা বলেছিল; রবার্ট ফ্রস্ট বলেছিলো Poetry is what is lost in Translation. কবিতাকে অনুবাদ করতে গেলে কবিতার কবিতাটা হারিয়ে যায়, থাকে না। এটা মনে রেখে যদি অনুবাদক অনুবাদ করে, সে চেষ্টা করে মূলের যতোদূর পারে ধরে রাখতে। কিছুতো হারাবেই। সেজন্য আমি আমার নিজের অনুবাদে চেষ্টা করেছি সবটুকু ধরতে কিন্তু নিশ্চয় জীবনানন্দে যে স্বাদ সেটা ইংরেজিতে আসবে না। আমি এটা জেনেই করেছি। বাংলায় যে জীবননান্দ পড়েছে, ‘বনলতা সেন’ পড়েছে সে অনুবাদে কখনো বাংলার মজাটুকু পাবে না। আমি নিজেই ‘বনলতা সেন’-এর দশ বারোটা ইংরেজি Version করে দেখেছি আমার নিজের করা অনুবাদটা ভালো লাগে না, আমার কাছে মনে হয় না যে এটা জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’। তারপরেও কিছু কিছু আসে নাই। কিন্তু চেষ্ট করাটা আমার কাছে আনন্দের; আর সেটাতেই আমি তৃপ্তি পাই।

অনুপ সাদি: বইমেলা চলছে, অনেক উপাখ্যান বা কাহিনী বর্ণনাকারী সাহিত্যিক বলে গন্য হবেন। জনপ্রিয় বই বা উপন্যাস অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভালো বই বা উপন্যাস নয়। আধুনিক লেখকেরা সাধারণত জনপ্রিয় নন। এলিয়ট, পাউন্ড, ইয়েটস কেউই সমসাময়িককালে জনপ্রিয় ছিলেন না একমাত্র লয়েন্স ছাড়া। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কিছু কিছু কাহিনী রচয়িতা খুব গুরুত্ব পান সাহিত্যিক হিসেবে। এটা কি বাঙালির মগজহীনতার কারণে?

ফকরুল আলম: না, মোটেই না। আমার তো মনে হয় যে, আসলে কে মহত, আসলে কে উচুঁমানের লেখক সময়ই বলবে; আমরা এতো কাছাকাছি থেকে বলতে পারব না এবং একদিক থেকে সত্যি ডিএইচ লরেন্স হয়তো যতোটা জনপ্রিয় ছিলো কনরাড অতোটা ছিল না, জয়েস অতোটা ছিল না; কিন্তু যারা বোদ্ধা সমঝদার চিন্তাশীল ব্যক্তি তাদের মধ্যে, কবিদের মধ্যে, সাহিত্যিকদের মধ্যে, সাড়া পড়ে গেছে জয়েসের উপন্যাসের, তখনই এলিয়টের একটা অনুসারী ছিল; যারা ভালো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের কথা লুকানো থাকে না; মানুষ অল্প কয়েকজন হলেও জেনে যায়। Popular Literature তো আরেক ব্যাপার। এক সময় যারা খুব জনপ্রিয় ছিল তারা তলিয়ে যাবে আবার Popular Literature থেকেও অনেকে দাঁড়িয়ে যাবে যেমন ডিকেন্সের কথা আমরা বলতে পারি; তার নিজের সময় যে রকম জনপ্রিয় ছিলেন আর কেউ ছিল না। আমি অতোটা নিশ্চিত না, তবে নিশ্চয়ই শরৎচন্দ্র জনপ্রিয় ছিলেন এবং মহান লেখকও ছিলেন; জনপ্রিয়তা এবং মহত্ত্ব কোনো কোনো ক্ষেত্রে মিল হতে পারে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে মিল নাও হতে পারে। তবে আমি মনে করি যে, সত্যিকারের মহান লেখক জনপ্রিয় না হলেও কিছু কিছু লোক তাদের কথা জেনে যাবে। যেমন জীবনানন্দের কথাই ধরা যাক, জীবনানন্দ দাশ জীবতকালে তেমন মূল্যায়ন পাননি কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে, বুদ্ধদেব বসু ছাড়াও আরও কয়েকজন ছিলেন, জীবনানন্দের কথা জানতেন, জীবনানন্দকে শ্রদ্ধা করতেন, জীবনানন্দের কবিতাকে ছাপিয়েছেন। আমাদের মধ্যেও আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কথা, উনি বেঁচে থাকতেও তো সবাই জানতো যে উনি উচুঁ মাপের লেখক। আমার মনে হয় যে আমাদের মধ্যেও কারা ভালো লেখক যারা খবর রাখেন তারা নিশ্চয়ই জানেন।

অনুপ সাদি: আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা জানতে চাচ্ছি?

ফকরুল আলম: আমার ভবিষ্যত পরিকল্পনা এই বছরে জীবনানন্দের ‘রুপসী  বাংলা’র পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ; ১৮টার মতো কবিতা করেছি, ৬৪টার মতো কবিতা আছে; পুরোটা অনুবাদ করে সুন্দর একটা ভুমিকা দিয়ে টীকা দিয়ে বের করা। তারপর আগামী ২-৩ বছরে রবীন্দ্রনাথের কবিতার, অনুবাদ আমি অলরেডি শুরু করেছি, একটা অনুবাদ বের করার ইচ্ছা আছে। আরো দীর্ঘ সময়ে ‘বার্ক এ্যান্ড ইন্ডিয়া’-এর উপর কাজ করার ইচ্ছা আছে এবং এ মূহুর্তে আমি কয়েক সপ্তাহ আগে একটা Grant পেয়েছি ভারতে যাওয়ার জন্য। আর কে নারায়ণ-এর উপরে একটা বই লেখার ইচ্ছা আছে আগামী ১/২ বছরের মধ্যে ইংরেজিতে।

অনুপ সাদি: আপনার নিজের গল্প, উপন্যাস বা কবিতা লেখার ইচ্ছা নেই?  

ফকরুল আলম: আসে না, ইচ্ছা অনেক আছে (হাসতে হাসতে) তবে আমি আশা হারাইনি, নিশ্চয় কোনো এক সময় আসবে। কলেজে থাকতে লিখতাম তারপর আর হয়নি গবেষণার মধ্যে ঢুকে পড়েছি, গবেষণামূলক লেখাই লিখি।

অনুপ সাদি: আপনাকে ধন্যবাদ, সময় দেবার জন্য।

ফকরুল আলম:  তোমাদেরকেও ধন্যবাদ। ধন্যবাদ সংশিষ্ট সবাইকে র অগনিত পাঠককে  ধন্যবাদ জানাই।[৪]

তথ্যসূত্র ও টিকা

১. এখানে প্রতিক্রিয়াশীল শেখ হাসিনা সরকারের ১৯৯৬ সালের শেষে ঢাকার শেয়ার বাজারের উত্থান ও পতনের কথা বলা হচ্ছে। পরবর্তীতে ২০১০ সালেও হাসিনা সরকার ক্ষমতায় থাকাকালিন আবার শেয়ার বাজারে ধ্বস নামে।
২. এখানে smooth forward linear progress-এর বাংলা হবে ‘মসৃণ সম্মুখগামি রৈখিক উন্নতি’।
৩. লোকের এক জায়গা থেকে অন্যত্র গমন, Immigration.
৪. সাক্ষাতকারটি সেই সময়ের ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকায় ২০০১ সালের ৬ ও ৭ ফেব্রুয়ারি তারিখে “আমরা যদি নিজেদের ক্ষমতায় একেবারে নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারতাম তাহলে ইংরেজী শিক্ষার ব্যাপারটাই হয়ত থাকতো না।” শিরোনামে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে সাক্ষাৎকারটি প্রাণকাকলি ব্লগে প্রকাশিত হয়। পরে রোদ্দুরে ডট কমে ৩০ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে প্রকাশ করা হয়। সেখান থেকে ১৮ মে ২০২১ তারিখে ফুলকিবাজ ডট কমে প্রকাশ করা হলো। ফুলকিবাজে প্রকাশ করার সময় কেবল শিরোনামটি বদলে দেয়া হয়েছে।

Leave a Comment

error: Content is protected !!