নারীমুক্তি প্রসঙ্গে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের সাক্ষাৎকার

দার্শনিক ও চিন্তাবিদ অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের এই রাজনৈতিক সাক্ষাৎকার আমি ২০০২ সনের ৮ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের বিপরীতের দক্ষিণে অবস্থিত রোকেয়া হলের আবাসিক ভবনের তৎকালীন বাসায় গ্রহণ করি। সাক্ষাৎকারটি অনেক দীর্ঘ হওয়ায় অনলাইন পাঠকদের সুবিধার্থে এখানে কয়েকটি বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন শিরোনামে বিভক্ত করে ফুলকিবাজ ডট কমে ২০ মে ২০২১ তারিখে প্রকাশ করা হচ্ছে। বর্তমান ফুলকিবাজ পাঠ্যে নারীমুক্তি প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। আপনারা নিচের লিংকগুলোতে ক্লিক করে আবুল কাসেম ফজলুল হকের এই রাজনৈতিক সাক্ষাৎকারটি বিষয় অনুসারে পড়তে পারবেন।

সাক্ষাৎকারটি তৎকালীন দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকার ১৯, ২০, ২১ ও ২২ আগস্ট, ২০০২ তারিখে চার কিস্তিতে “নতুন প্রযুক্তির অভিঘাতে সভ্যতা ও সংস্কৃতি” শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল। আবুল কাসেম ফজলুল হকের সাক্ষাৎকারের পুরো পাঠ অনুসরণ করতে ক্লিক করুন যথাক্রমে গণতন্ত্র, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সমস্যা, সর্বহারার গণতন্ত্র, নারীমুক্তি, বাঙালি জাতি ও জাতি সমস্যা, বাংলা ভাগ, ফেডারেশন ও কনফেডারেশন এবং চিন্তার স্বাধীনতা প্রসঙ্গে।

নারীমুক্তি প্রসঙ্গে

অনুপ সাদি: পুঁজিবাদী উদার গণতন্ত্র নারীকে পণ্য করে রেখেছে। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র নারীকে মুক্ত করতে চেয়েছিল, কিন্তু তার আগেই তো সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের পতন আমাদের চোখের সামনেই ঘটে গেল। নারী পুরুষের সমান অংশ। নারীর মুক্তির একটা ব্যাপার আছে, পুরুষের মুক্তিরও একটা ব্যাপার আছে। নারী-পুরুষ উভয়ের মুক্তির ক্ষেত্রে উদার গণতন্ত্র ব্যর্থ। কিভাবে মুক্তি ঘটবে?

আবুল কাসেম ফজলুল হক: সেটা বলা যাবে না। পুঁজিবাদী উদার গণতন্ত্রের ধারণায় একজনের সংগে অন্যজনের পার্থক্য আছে, এক রাষ্ট্রের সংগে অন্য রাষ্টের পার্থক্য আছে। ব্রিটেনের লিবারাল পার্টি থেকে উদার গণতন্ত্রের কথাটা বাইরের জগতে ছড়িয়েছে। সেই লিবারাল পার্টির তো এখন অস্তিত্ব প্রায় নেই, লিবারাল পার্টির ওপরে দাঁড়িয়ে গেছে লেবার পার্টি।

নারীমুক্তির বেলায়ও বুঝতে হবে যে, মুক্তি মানে সমস্যা থেকে মুক্তি– অর্থাৎ সমস্যার সমাধান। বিশেষ সমাজব্যবস্থায়, রাষ্ট্রব্যবস্থায়, পরিবারব্যবস্থায় নারীর যে সমস্যা দেখা দেয়, সেই সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে তা থেকে মুক্তির জন্যে চেষ্টা করতে হবে। চুড়ান্ত মুক্তির কথা বলা যায়, কিন্তু চুড়ান্ত মুক্তির রাতারাতি বাস্তবায়ন সম্ভব কোনো ছবি তো অঙ্কন করা যায় না। …….. নারীতে এবং পুরুষে পার্থক্য আছে, বায়োলজিকাল পার্থক্য আছে, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষায় চিন্তা-ভাবনায় পার্থক্য আছে এবং এই পার্থক্য আমাদের জানা ইতিহাসের সবটাতেই দেখতে পাই। কাজেই ১০, ৫০, ১০০ বা ২০০ বছরের মধ্যে সমস্যার পরম সমাধান হবে– এটা আশা করা তো বাতুলতা মাত্র।

তবে এটা আমরা দেখি, যে-কথাটা গণতন্ত্র বা অন্যান্য প্রশ্ন সম্পর্কেও বলেছি যে, আমরা যদি ফরাসি বিপ্লবের পূর্ববর্তী ২০০ বছরের ইউরোপের সমাজের অবস্থা দেখি, তাহলে সেখানে নারীর অবস্থা যতটা বঞ্চনার, নির্যাতনের মধ্যে দেখতে পাই, তা থেকে পরবর্তী ২০০ বছরের অবস্থার অনেকখানি উন্নতি দেখি। আজকে আমরা যে অবস্থা দেখছি সে অবস্থা দীর্ঘকাল থাকবে না, স্বাভাবিক বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি হবে। তাতে মুক্তি বা অগ্রগতি বা সমস্যার সমাধান হবে। এক সমস্যার সমাধান হলে নতুন আরেক সমস্যা দেখা দেবে। তারপর সেই সমস্যারও সমাধান করতে হবে। এই ভাবেই এগুতে হবে। নারী এবং পুরুষ যতদিন থাকবে ততদিনই তাদের সম্পর্কের মধ্যে সমস্যা থাকবে।

অনুপ সাদি: তাহলে নারীমুক্তির ব্যাপারটা নিয়ে কি আলাদাভাবে চিন্তা করার দরকার নেই?

আবুল কাসেম ফজলুল হক: আছে দরকার, কারণ নারীরা যেহেতু পুরুষ থেকে কোনো কোনো দিক দেয়ে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী, সুতরাং তাদের স্বতন্ত্র সমস্যা আছে। এমনকি পুরুষের কিছু আলাদা অসুখ আছে, নারীরও কিছু আলাদা অসুখ আছে, সেগুলোতে আলাদা চিকিৎসার কথা ভাবতে হয়। সমাজব্যবস্থায় মেয়েদের সমস্যার কথা আলাদাভাবে চিন্তা করতে হবে। আবার অনেক সমস্যা আছে যেগুলোতে নারী-পুরুষ উভয়কে মিলিয়েই সমাধান খুঁজতে হবে। মেয়েদের সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রেও পুরুষের সহযোগিতার প্রয়োজন আছে। পুরুষের সুখ-শান্তি-সমৃদ্ধির জন্যও মেয়েদের সহযোগিতার প্রয়োজন আছে।

নারী-পুরুষ মিলেই তো মানুষ। মানুষ বললে শুধু পুরুষকে বোঝায় না, মানুষ বললে শুধু নারীকেও বোঝায় না, নারী-পুরুষ উভয়কেই বোঝায়। কাজেই সমস্যাগুলোকে নির্দিষ্ট পরিবেশের মধ্যে নারী-পুরুষ উভয়কে মিলিয়েই দেখতে হবে। তারপরে মেয়েদের সমস্যা আলাদা করে আইডেন্টিফাই করে সেগুলোর সমাধান করতে হবে। পুরুষকে নারীর কিংবা নারীকে পুরুষের শত্রুরূপে দেখলে ভুল করা হয়। নারীর সমস্যার মূল জায়গা পরিবার। নারীর মুক্তির ও উন্নতির জন্য পরিবার ব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে।

অনুপ সাদি: নারী-পুরুষের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করা ছাড়া কি ধনী-দরিদ্র্যের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর সম্ভব? নারী-পুরুষের বৈষম্যের  ক্ষেত্রে কিন্তু অর্থনৈতিক বৈষম্যটাই মূল ফ্যাক্টর।

আবুল কাসেম ফজলুল হক: নারী-পুরুষ যদি একসংগে সংসার করে, যদি তাদের পরিবার সন্তানাদি ও সম্পত্তি থাকে, তাহলে নারী-পুরুষের অর্থনৈতিক সাম্যের প্রশ্নটা এভাবে আসবে যে, সম্পত্তির মালিকানা– পরিবারের সম্পত্তির মালিকানা ও উত্তরাধিকার কী হওয়া উচিত। সেই ক্ষেত্রে বাঙলাদেশের বাস্তবতায় আইন-কানুনের পরিবর্তনের দরকার আছে। কিন্তু সেই পরিবর্তনগুলো যারা ‘নারীবাদী আন্দোলন’ করছেন, সেই নারী-পুরুষেরাও ভালো করে, স্পষ্ট করে, বলছেন না। কারণ পরিবর্তন সাধনে সমস্যা আছে।

মেয়েদের কাগুজে সুযোগ-সুবিধা দিয়ে পরিবর্তন ঘটানো হলেই যে মেয়েরা অধিকার ভোগ করতে পারবে, এ নিয়েও সংশয় আছে। সে কারণেই হয়তো তারা বিবাহ ও উত্তরাধিকার সংক্রান্ত আইন-কানুন পরিবর্তনের কথা জোরেশোরে বলেন না। কিন্তু আমি মনে করি সম্পত্তির মালিকানা, উত্তরাধিকার ও হস্তান্তর সম্পর্কিত আইনগুলোতে বড়ো রকমের পরিবর্তন সাধনের দরকার আছে– গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যও দরকার আছে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্যও দরকার আছে, নারী-পুরুষের মানবসৃষ্ট অসাম্য দূর করার জন্যও দরকার আছে।

নারীর উন্নতি, পুরুষের উন্নতি, সন্তানাদির উন্নতি, সকলের উন্নতির জন্যেই এবং সমাজে অথবা ধনী-দরিদ্রের মধ্যে মানবসৃষ্ট বৈষম্য দূর করে উন্নত সুন্দর সমাজব্যবস্থা ও জীবন প্রতিষ্ঠার জন্য সম্পত্তির মালিকানা, উত্তরাধিকার, সম্পত্তি অর্জনের উপায় ইত্যাদি বিষয়ক আইন-কানুনের বড়ো রকমের পরিবর্তন দরকার। শুধু বাঙলাদেশের নয়, পৃথিবীর সকল দেশেই দরকার।

বিয়েতে দেনমোহর ও খোরপোষ সংক্রান্ত যেসব কথা মুসলমানদের ক্ষেত্রে দলিলে লেখা হয়, তাতে তো আসলে মেয়েদের বেলায় বিয়ে মেয়ের পিতার দিক থেকে কন্যা বিক্রয়ের তুল্য। অন্য ধর্মসমূহের বেলায় যে বিশেষ উন্নত আইন ও নীতি কার্যকর আছে তা তো নয়। আমি যে গণতন্ত্রের কথা বলি তাতে বিবাহ ও উত্তরাধিকার সংক্রান্ত আইন-কানুনের মৌলিক পরিবর্তন অপরিহার্য। তবে সেই পরিবর্তন সাধন করতে হবে জনমতের ভিত্তিতে; শক্তি প্রয়োগ করে কিংবা জবরদস্তি দ্বারা নয়। সমাজে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যের সমস্যা আর নারী পুরুষের বৈষম্যের সমস্যাকে এক করে ফেললে ভুল করা হয়। দুই সমস্যার প্রকৃতি ভিন্ন।

Leave a Comment

error: Content is protected !!