দার্শনিক ও চিন্তাবিদ অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের এই রাজনৈতিক সাক্ষাৎকার আমি ২০০২ সনের ৮ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের বিপরীতের দক্ষিণে অবস্থিত রোকেয়া হলের আবাসিক ভবনের তৎকালীন বাসায় গ্রহণ করি। সাক্ষাৎকারটি অনেক দীর্ঘ হওয়ায় অনলাইন পাঠকদের সুবিধার্থে এখানে কয়েকটি বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন শিরোনামে বিভক্ত করে ফুলকিবাজ ডট কমে ২০ মে ২০২১ তারিখে প্রকাশ করা হচ্ছে। বর্তমান ফুলকিবাজ পাঠ্যে সর্বহারার গণতন্ত্র প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। আপনারা নিচের লিংকগুলোতে ক্লিক করে আবুল কাসেম ফজলুল হকের এই রাজনৈতিক সাক্ষাৎকারটি বিষয় অনুসারে পড়তে পারবেন।
সাক্ষাৎকারটি তৎকালীন দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকার ১৯, ২০, ২১ ও ২২ আগস্ট, ২০০২ তারিখে চার কিস্তিতে “নতুন প্রযুক্তির অভিঘাতে সভ্যতা ও সংস্কৃতি” শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল। আবুল কাসেম ফজলুল হকের সাক্ষাৎকারের পুরো পাঠ অনুসরণ করতে ক্লিক করুন যথাক্রমে গণতন্ত্র, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সমস্যা, সর্বহারার গণতন্ত্র, নারীমুক্তি, বাঙালি জাতি ও জাতি সমস্যা, বাংলা ভাগ, ফেডারেশন ও কনফেডারেশন এবং চিন্তার স্বাধীনতা প্রসঙ্গে।
সর্বহারার গণতন্ত্র প্রসঙ্গে
অনুপ সাদি: একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে অধিকার ও সুযোগ পায় না গরীবেরা। তাদের অধিকারের ক্ষেত্রেই সমস্যার সৃষ্টি হয়। একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গরীবেরা যদি শাসন করে, তাহলে তো রাষ্ট্রটা আরো গণতান্ত্রিক হবে। তাই নয় কি?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: গরীবেরা শাসন করলে গণতান্ত্রিক হবে, কিন্তু গরীবরা শাসন করবে কিভাবে– দারিদ্র্যের সঙ্গে তো আরও অনেক কিছু জড়িত। দারিদ্র্যের সঙ্গে অশিক্ষা জড়িত, দারিদ্র্যের সঙ্গে শক্তির অভাব বা দুর্বলতা জড়িত, মানুষ দীর্ঘদিন দারিদ্র্য ভোগ করলে তার বুদ্ধি-বিবেচনা-কর্মক্ষমতা ও নৈপুণ্য কমে যায়। কাজেই দরিদ্রদের মধ্যে সংগ্রামী চেতনা, সংগ্রামী স্পৃহা, সংগ্রামী শিক্ষা, সংগ্রামী পরিকল্পনা দেখা দিলে– ঐক্য দেখা দিলে তারা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। কেবল তখনই তারা রাষ্ট্রমতার দিকে এগুতে পারে। দরিদ্র, দুর্বল, … অশিক্ষিত থেকে তো তা সম্ভব নয়, কাজেই দরিদ্ররা সহজে ক্ষমতায় যাবে এবং ক্ষমতা পেয়ে তারা এ অবস্থা পরিবর্তন করে ফেলবে– এটা স্থুলভাবে বলা যায় না।
যে মানুষটা গরীব সেই মানুষটাই যখন ধনী হয় তার আচরণ শতকরা একশ ভাগ বদলে যেতে পারে, সে তখন দরিদ্রদের স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে। আমরা বাস্তবে এমন বহু দৃষ্টান্ত দেখেছি। যেসব পরিবারের লোকেরা আগে থেকে ধনী তাদের পরিবারের লোকেরা সাধারণত গরীব মানুষের প্রতি যতটা ঔদার্য প্রদর্শন করে, যে লোকটা নতুন ধনী হয়েছে সে প্রায়শ তা পারে না। সে অনেক বেশি নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করে এবং অন্যদেরকে দমন করে রাখতে চায়। মানুষ গরীব হলেই তার নৈতিক মান উন্নত হবে– একথা বলার উপায় আছে কি? মানুষ প্রতিবাদি হলেই যে তার নৈতিক মান উন্নত হবে, তাও বলা যায় না।
অনুপ সাদি: এখানে গরীবরা শাসন ক্ষমতায় গেলেই যে ধনী হয়ে যাচ্ছে তা কিন্তু নয়? —
আবুল কাসেম ফজলুল হক: না, বাস্তবে দেখা যায় গরীবরা শাসন ক্ষমতায় গেলে ধনী হয়ে যায়। ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। ব্যতিক্রম দুর্লভ। রাশিয়া, চীন– এসব দেশ তো একটা পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করেছে। তাদের সামনে আদর্শ ছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল যে, একটা সময়ের ব্যবধানে যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাচ্ছে তারা আনুষঙ্গিক অন্য ক্ষমতা, যেমন– শিক্ষা-দীক্ষার সুযোগ নিচ্ছে, অর্থনৈতিক ক্ষমতা-সম্পদ অর্জন করছে, রাষ্ট্রে চাকরি-বাকরির ব্যবস্থা থাকলে সেইখানে তাদের ছেলেমেয়েরা বেশি সুযোগ নিচ্ছে। কাজেই এখানে মানবস্বভাব বিচার করে সমস্যার সমাধান চিন্তা করতে হবে। রাতারাতি কিংবা অল্প সময়ে কোনো উন্নতি হবে না।
Nature of Man, Concept of Man বলে দর্শনের একটা সমস্যা আছে। সেই সমস্যার ভেতরে প্রবেশ করলে গণতন্ত্রের সমস্যাগুলো গভীরভাবে বোঝা যাবে। মানুষের কামনা-বাসনা ও আশা আকাঙ্ক্ষার জগতটাকে জানতে পারলে গণতন্ত্রের সমস্যার গভীরে যাওয়া যাবে। মানুষের কামনা-বাসনা তো শূন্যে থাকে না। মানুষের দেহের সংগে যেমন তেমনি পরিবেশের সংগেও কামনা-বাসনার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক আছে। ওই জায়গায় গেলে, মানুষের স্বরূপের সমস্যায় গেলে গণতন্ত্রের আসল সমস্যাগুলো বোঝা যাবে এবং তার সমাধান যে জটিল কঠিন তা স্পষ্ট বোঝা যাবে। তুমি যেসব সমস্যার সমাধান আশা করছো সেগুলোর সমাধান যে হাজার হাজার বছরের সংগ্রাম ও সাধনার ব্যাপার সেটা বোঝা যাবে। তবে অনেক সমস্যা আছে যেগুলোর সমাধান অল্প সময়ের মধ্যে করা যাবে।
অনুপ সাদি: পুঁজিবাদী উদার গণতন্ত্রের মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে অন্তত ২০টি দেশের ওপর যুদ্ধ চালিয়েছে, বোমাবর্ষণ করেছে। এ দেশটা তো আসলে কোনো দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে চায় না।

আবুল কাসেম ফজলুল হক: এতে কোনো সন্দেহ নেই, খুবই সত্য কথা এটা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী কালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের … … যে আধিপত্যবাদী নীতি, সাম্রাজ্যবাদী নীতি, কর্তৃত্ববাদী নীতি, শোষণনীতি আমরা লক্ষ্য করি, তাতে লক্ষ্য করি_ গণতন্ত্র স্বাধীনতা ও মানবতাবাদের বিকাশে তাদের ভূমিকা অত্যান্ত ক্ষতিকর। একক সুপার পাওয়ার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পর থেকে এই রাষ্ট্রটি অত্যন্ত জঘন্যভাবে অন্য অনেক রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে চলেছে_ সন্ত্রাসী ও যুদ্ধবাজের ভূমিকা গ্রহণ করেছে। তাদের ভূমিকা জঘন্য থেকে জঘন্যতর হয়ে চলেছে।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।