দার্শনিক ও চিন্তাবিদ অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের এই রাজনৈতিক সাক্ষাৎকার আমি ২০০২ সনের ৮ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের বিপরীতের দক্ষিণে অবস্থিত রোকেয়া হলের আবাসিক ভবনের তৎকালীন বাসায় গ্রহণ করি। সাক্ষাৎকারটি অনেক দীর্ঘ হওয়ায় অনলাইন পাঠকদের সুবিধার্থে এখানে কয়েকটি বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন শিরোনামে বিভক্ত করে ফুলকিবাজ ডট কমে ২০ মে ২০২১ তারিখে প্রকাশ করা হচ্ছে। বর্তমান ফুলকিবাজ পাঠ্যে বাংলা ভাগ প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। আপনারা নিচের লিংকগুলোতে ক্লিক করে আবুল কাসেম ফজলুল হকের এই রাজনৈতিক সাক্ষাৎকারটি বিষয় অনুসারে পড়তে পারবেন।
সাক্ষাৎকারটি তৎকালীন দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকার ১৯, ২০, ২১ ও ২২ আগস্ট, ২০০২ তারিখে চার কিস্তিতে “নতুন প্রযুক্তির অভিঘাতে সভ্যতা ও সংস্কৃতি” শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল। আবুল কাসেম ফজলুল হকের সাক্ষাৎকারের পুরো পাঠ অনুসরণ করতে ক্লিক করুন যথাক্রমে গণতন্ত্র, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সমস্যা, সর্বহারার গণতন্ত্র, নারীমুক্তি, বাঙালি জাতি ও জাতি সমস্যা, বাংলা ভাগ, ফেডারেশন ও কনফেডারেশন এবং চিন্তার স্বাধীনতা প্রসঙ্গে।
বাংলা ভাগ প্রসঙ্গে
অনুপ সাদি: বাংলা ভাগ বাঙালিকে কতটুকু দুর্বল করেছে?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: বাংলা ভাগ অনেক কার্যকারণের মধ্যে দিয়ে ঐতিহাসিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে হয়েছে। দুর্বলতার ধারাগুলো আগে থেকে বিকশিত হয়ে আসছিল, ১৯৪৭ সালের বিভক্তির মধ্য দিয়ে একটা পরিণতিতে গিয়েছে। এর দ্বারা বাঙালিরা সাধারণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু এই ক্ষতিটা আকস্মিকভাবে হয়নি, অনেক দুর্বলতা একত্রে ঘনীভূত হয়ে বাঙলাকে ভেঙেছে, বাঙালি আত্মকলহের সমাধান করে এক থাকতে পারেনি। তবে গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে এখন বাংলাদেশই জাতি রাষ্ট্র, আর কোনোটি নয়।
বাংলাদেশ উন্নতি করতে পারলে বাংলাদেশের বাঙালিরা ভারতীয় উপমহাদেশের সকল জাতির পথপ্রদর্শক হতে পারত। দুঃখের বিষয় বাংলাদেশের জনগণ ১৯৭২ সাল থেকেই জাতি না হওয়ার প্রক্রিয়ায় পড়ে গেছে– বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে জাতীয় ঐক্য ভেঙে খান খান হয়ে গেছে।
অনুপ সাদি: দুই বাঙলা কী এক হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: দুই বাঙলা এক হতে পারে এরকম চিন্তা কেউ কেউ করেন, স্পষ্টভাবে ঘোষণা না করলেও, পশ্চিমবাংলায় এমন লোক আছেন, বাংলাদেশেও আছেন। শক্তিশালী বৃহত বাঙালি জাতি আর বাঙালির শক্তিশালী বৃহত রাষ্ট্র হয়তো তারা কামনা করেন। আমার কাছে যেটা মনে হয় সেটা হলো, সেই ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের সময় থেকে অনেকগুলো কারণ মিলে বিভেদ বেড়েছে, বেড়েছে, কেবলই বেড়েছে। এমনকি গত ২০ বছরের মধ্যে নতুন করে ব্যবধান বেড়েছে। তাতে দুই বাংলা এক হবে এই চিন্তাকে এখন কোনো গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা মনে হয় না আমার কাছে।
পশ্চিম বাঙলার বাঙালিরাও বাঙালি হিসেবে বিকশিত হোক, বাংলাদেশের বাঙালিরাও বাঙালি হিসেবে বিকশিত হোক। নিজ নিজ ধারনা ও অভিপ্রায় মতো এইভাবে যদি দুই জনগোষ্ঠীর বিকাশের উপায় হয়– ওখানের বাঙালিরা একটা জাতি হয়, এখানের বাঙালিরা একটা জাতি হয়ে ওঠে, তাহলে ভবিষ্যতে দুই জাতির সম্পর্ক ভালো হতে পারে, তখন দুই জাতির সভ্যতা সংস্কৃতি উন্নত হলে কোনো কল্যাণকর পরিবর্তন হতে পারে।
অনুপ সাদি: বাংলা ভাগ হয়ে যে সমস্যাটা হলো, অনেক লোকের মাইগ্রেশন ঘটলো, লাখ লাখ লোক শরণার্থী হলো, দুর্বিষহ জীবনযাত্রা ………….।
আবুল কাসেম ফজলুল হক: বহু লোকের প্রাণ গেছে, বহু লোক পথের ভিখারি হয়েছে, সে এক মর্মান্তিক ইতিহাস। আবার কিছু লোক নানা সুযোগ সুবিধা নিয়ে ধনী হয়েছে, ক্ষমতাবান হয়েছে। পশ্চিম বাঙলায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা কর্তৃত্ব করছে, সন্ধান করলে দেখবে তাদের অনেকগুলো পরিবারই এখান থেকে রিফিউজি হিসেবে, বাস্তুত্যাগী হয়ে, ওখানে গিয়ে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছে।
আমাদের ঢাকার সংস্কৃতিতে বাঙলাদেশে যারা কর্তৃত্ব করছে রাজনীতিবিদদের, বুদ্ধিজীবিদের ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে, তাদের অনেককেই দেখবে পশ্চিম বাঙলা থেকে আগত। যারা রিফিউজি হয়ে যায় তারা সাধারণত বেশি উদ্যেগি ও পরিশ্রমি হয়ে থাকে। তাদের মধ্যে একটা ভিন্ন রকমের আত্মসচেতনতা থাকে, ভিন্ন রকমের ঐক্যবোধও থাকে। ফলে তারা উন্নতি করে। তবে সকলে পারে না; বিপুল অধিকাংশই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, তারা ভিখারি হয়ে গেছে, পথে দাঁড়িয়েছে। তুমি চিন্তা করো এই মোহাম্মদপুরে মিরপুরে যারা বিহারি হিসেবে পরিচিত হয়ে আছে, তারা অনেকে পশ্চিমবাঙলা থেকে এসেছে, বিহার থেকে এসেছে– তাদের কী দুর্দশা; একবার ভেবে দেখো। অনেকে একেবারে ভিক্ষুক হয়ে গেছে, অনেকে খুব কম পারিশ্রমিকে কঠোর শারীরিক পরিশ্রম করে যে কোনো রকমে জীবিকা নির্বাহ করে। হয়ত তারা বিহারি, পশ্চিমবঙ্গে বিহারে থাকাকালে ভালো অবস্থায় ছিলো। কাজেই মানুষের এই দুর্দশা, দুঃখ, লোমহর্ষক দুরবস্থা দেশভাগের ফলে হয়েছে। জাতি সম্পর্কে বিকৃত ধারণার ও কার্যধারার ফলে হয়েছে। ভারতবর্ষে প্রতিটি জাতির আলাদা আলাদা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হওয়া উচিত ছিল।
অনুপ সাদি: বিহারিদের কথা পৃথিবীর মানুষ একেবারে ভুলে গেছে, ৫০ বছরেরও আগের ঘটনা, পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে ভুলে যাওয়া রিফিউজি হচ্ছে বাঙলাদেশের বিহারিরা। এদের মানবিক দিকটা দেখা খুবই জরুরি।
আবুল কাসেম ফজলুল হক: দেখা খুব জরুরি ছিলো, এখনও জরুরি আছে। এখন জনসংখ্যার দিক দিয়ে এরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে দারিদ্র এবং নির্দয়তায় সাফার করতে করতে। ১৯৭১ সনের যুদ্ধের সময়ে এরা পাকিস্থান রক্ষা করতে চেয়েছিল, বাঙালিদের জন্য এদের ভূমিকা ক্ষতিকর ছিল, এদের তখনকার ভূমিকা নিজেদের জন্যও আত্মঘাতি হয়েছে।
অনুপ সাদি: বাঙালির জাতি না হয়ে ওঠার কথা হচ্ছিলো, স্বকীয় সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া কি জাতিয়তাবোধ গড়ে ওঠে?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: কোনো ভূভাগের জনসমষ্টির দৃষ্টিভংগি এবং সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রবোধ জাতি গঠনের একটি অপরিহার্য শর্ত– মর্মগত বিষয়। জাতীয় সংস্কৃতির চেতনা জাতি গঠনের মর্মে কাজ করে। যখন এই চেতনা রাজনৈতিক চেতনায় রূপ নেয় তখন তা হয় জাতীয়তাবাদ। কোনো জনসমষ্টি তখনই জাতিতে রূপ নেয়। জাতীয়তাবাদ জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় পরিণতি খোঁজে।
জাতীয় সংস্কৃতির ধারণা, জাতীয় সংস্কৃতির বোধ, জাতীয় সংস্কৃতি নিয়ে উচ্চাশা-স্বপ্ন-কল্পনা না থাকলে কোনো ভূভাগের জনসমষ্টি জাতি হয় না, আমাদের কিছুটা জাতীয়তাবোধ আমরা দেখেছি পাকিস্থান আমলে, সে সময় পূর্ব বাঙলার বা পূর্ব পাকিস্তানের লোকদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতির কথা বলা হয়েছে এবং এই সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র ও শ্রেষ্ঠত্বকে ভাষাগত, সাহিত্যগত, চিন্তাগত, ভাবনাগত, আচরণগত দিক দিয়ে হাজারো উপায়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে। কিন্তু বাঙলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে সেই জাতীয়তাবোধের যৌক্তিক বিকাশ আর হলো না, অনৈক্য দেখা দিলো এবং সবকিছু খন্ড-বিখন্ড হয়ে গেল।
এখন রাজনীতিবিদেরা ও তাদের সহযোগি বুদ্ধিজীবিরা নানাভাবে বিভক্ত করেছে জনসাধারণকে– মৌলবাদি ও অমৌলবাদি, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ও বিপক্ষের শক্তি ইত্যাদিতে বিভক্ত করছে; নারীবাদীরা নারী-পুরুষে বিভক্ত করে চেতনাকে খন্ড করছে; তারপরে কোনো গবেষক বিদেশি টাকায় গবেষণা করে উপজাতিসমুহের মধ্যে বাঙালিবিরোধি মনোভাব সৃষ্টির জন্য নানাভাবে উস্কানি দিচ্ছে, বাঙালিদের সাথে তাদের ব্যবধান বাড়াবার চেষ্টা করছে।
এটা ঠিক কথা যে, ছোট ছোট জাতিগুলো এদেশে ক্ষতিগ্রস্ত, এখন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা, এই ক্ষতিগ্রস্ত জাতিগুলোর সাথে বৃহৎ জাতির ঐক্য সৃষ্টি করা, এবং বাঙলাদেশের রাষ্ট্রসত্তার মধ্যে সকলের সমস্যার সমাধান করা দরকার। অতীতের অন্যায়সমূহ দূর করা দরকার। কিন্তু বিভেদ বাড়ানো ও বিভক্ত করার প্রক্রিয়া দ্বারা তা হবে না, উস্কানিমূলক কাজের দ্বারা তা হবে না। অতীতের তিক্ততা ও রক্তপাতের স্মৃতি থেকে সকলের মনকে মুক্ত করা দরকার, ক্ষুদ্র জাতিসমূহের উপর চাপিয়ে দেয়ার ও শোষণের প্রক্রিয়া বন্ধ করা দরকার। সকলের উন্নতির কর্মসূচি, কর্মনীতি ও কর্মপ্রক্রিয়া দরকার।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।
সাক্ষাৎকারটির জন্য ধন্যবাদ।