চিন্তার স্বাধীনতা প্রসঙ্গে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের সাক্ষাৎকার

দার্শনিক ও চিন্তাবিদ অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের এই রাজনৈতিক সাক্ষাৎকার আমি ২০০২ সনের ৮ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের বিপরীতের দক্ষিণে অবস্থিত রোকেয়া হলের আবাসিক ভবনের তৎকালীন বাসায় গ্রহণ করি। সাক্ষাৎকারটি অনেক দীর্ঘ হওয়ায় অনলাইন পাঠকদের সুবিধার্থে এখানে কয়েকটি বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন শিরোনামে বিভক্ত করে ফুলকিবাজ ডট কমে ২০ মে ২০২১ তারিখে প্রকাশ করা হচ্ছে। বর্তমান ফুলকিবাজ পাঠ্যে চিন্তার স্বাধীনতা প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। আপনারা নিচের লিংকগুলোতে ক্লিক করে আবুল কাসেম ফজলুল হকের এই রাজনৈতিক সাক্ষাৎকারটি বিষয় অনুসারে পড়তে পারবেন।

সাক্ষাৎকারটি তৎকালীন দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকার ১৯, ২০, ২১ ও ২২ আগস্ট, ২০০২ তারিখে চার কিস্তিতে “নতুন প্রযুক্তির অভিঘাতে সভ্যতা ও সংস্কৃতি” শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল। আবুল কাসেম ফজলুল হকের সাক্ষাৎকারের পুরো পাঠ অনুসরণ করতে ক্লিক করুন যথাক্রমে গণতন্ত্র, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সমস্যা, সর্বহারার গণতন্ত্র, নারীমুক্তি, বাঙালি জাতি ও জাতি সমস্যা, বাংলা ভাগ, ফেডারেশন ও কনফেডারেশন এবং চিন্তার স্বাধীনতা প্রসঙ্গে।

চিন্তার স্বাধীনতা প্রসঙ্গে

অনুপ সাদি: স্বধীনতা বা মুক্তির জন্য চিন্তার স্বাধীনতাও তো দরকার। উন্নত আধুনিক চিন্তাকে ব্যাপক জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া, তাদের মধ্যে বৌদ্ধিক-নৈতিক মিতালি গড়া ছাড়া মুক্তি সম্ভব নয়। চিন্তার বিকাশে দার্শনিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানীগণ ঢাকার বর্তমান চিন্তাবিধ্বংসী পরিবেশে কীভাবে কী করবেন।

আবুল কাসেম ফজলুল হক: এটা ঠিক কথা যে চিন্তার স্বাধীনতা দরকার, চিন্তার স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ সমস্যার আলোচনায় গেলেই আমরা দেখতে পাই যে, চিন্তা ব্যাপারটা পরিবেশের সাথেও সর্ম্পকিত; কোনো ব্যক্তির চিন্তা একান্তভাবে তার মস্তিষ্ক বা স্নায়ুমন্ডলির ব্যাপার নয়, বাইরের পরিবেশ চিন্তকের ইন্দ্রিয়ের উপরে কাজ করে, প্রভাব বিস্তার করে, সেই প্রভাবে মস্তিষ্কে অনুভূতি ও চিন্তা জাগে এবং সেই চিন্তার ধারায় চিন্তক সজ্ঞান চেষ্টার দ্বারা নানা সিদ্ধান্তে পৌঁছেন, কাজেই চিন্তার স্বাধীনতার কথা যে বলছো, যারা চিন্তার স্বাধীনতা চান, উন্নত অবস্থা চান, তাদেরকে বাস্তব অবস্থা বিশ্লেষণ করে কর্মনীতি তৈরি করতে হবে, তত্ত্ব আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং সেই আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য বাস্তব অবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি, প্রতিষ্ঠানব্যবস্থা, পদ্ধতি, পরিবেশ পরিবর্তন করতে হবে। ওই সংগ্রামে গেলেই চিন্তার স্বাধীনতার ভিত্তি তৈরি হবে।

ভিত্তি তৈরি ও মানসিকতা তৈরি দুটোই একসাথে দরকার, দ্বিমুখি সঙগ্রাম দরকার– মনোজীবনের পরিবর্তনের এবং বস্তুগত পরিবেষ্টন-পরিবেশ পরিবর্তনের সংগ্রাম। বস্তুগত মৌলিক ভিত্তিতে পরিবর্তন সাধন করতে হবে, উপরের স্তরে ভাসাভাসা কাজ করে সমস্যার সমাধান করা যাবে না। অন্তত স্থায়ি কিছু করা যাবে না, মুক্তবুদ্ধির সাথে শুভবুদ্ধি যুক্ত হলেই কল্যাণ হবে। শুভবুদ্ধিহীন মুক্তবুদ্ধি বিপদজনক হতে পারে।

অনুপ সাদি: বাঙলাদেশে সব কিছুরই মূল্য আছে, শুধু মানুষেরই মূল্য নেই। যেমন একটা বাস হঠাত করে নেমে গেল নদীতে, একসাথে ৫০ জনের মৃত্যু, এ রাষ্ট্রটাকে আমার কাছে অপরাষ্ট্র ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না– একটা বর্বর অমানবিক রাষ্ট্র। একটা মানুষ সারাদিন পরিশ্রম করেও ঠিকমতো খেতে পাচ্ছে না। এই যে বর্বরতা আর অমানবিকতা– বুর্জোয়া জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র থেকে এটা অনেক দূরে অবস্থান করছে না কি?

আবুল কাসেম ফজলুল হক: তোমার কথায় সত্য আছে। এটা অমানবিক রাষ্ট্র। এতে বিরাজ করছে অমানবিক মানবীয় সম্পর্ক, তবে কোনো কথাকেই Absolute অর্থে ধরলে ঠিক হবে না। বাস্তবের সাথে মিলিয়ে অর্থ করতে হবে। মানবিক মানবীয় সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে হলে যারা সাফার করছে, যারা বঞ্চিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত, তাদের সংগ্রাম করতে হবে। নিজেদের জন্য মানবীয় পরিবেশ তাদের তৈরি করতে হবে। দয়া-দাক্ষিণ্য দিয়ে কতটা হবে? কর্তব্যবোধের তাড়নায় কে কার জন্য কি করে দেয়?

একবারেই যারা গরিব হয়ে গেছে, জীবনের ধারা থেকে খসে পড়েছে, তারা জীবনের স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলেছে, তারা সংগ্রাম করতে পারবে না, তারা করুণার পাত্রে পরিণত হয়েছে, তাদের জন্য করুণা দরকার-অবশ্যই দরকার। কিন্তু এদেশের মধ্যস্তরের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ, তারাও গরিব মানুষ, তাদের সংগ্রাম করার শক্তি আছে এবং সেই সংগ্রামের স্পৃহা জাগিয়ে দিতে হবে। ……. মানবিক রাষ্ট্রব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা, মানবিক পৃথিবীর দিকে যাওয়ার জন্যে সাধারণ মানুষের ভিতরে সংগ্রাম সৃষ্টি করতে হবে, সংগ্রামের পথ ছাড়া মুক্তির আর তো কোনো পথ নেই। মুক্তি ও উন্নতির পথে সাধনা ও সংগ্রামের কোনো বিকল্প নেই, ছিল না, কোনোদিন হবে কী না কে বলতে পারবে? যারা পথ প্রদর্শন করবেন, নেতৃত্ব দেবেন, তাদেরকে জনসাধারণের সাথে চলতে হবে, কাজ করতে হবে।

এরপরেও আমাদের আলোচনা বিভিন্ন বিষয়ে বিচ্ছিন্নভাবে চলতে থাকে। সে প্রসঙ্গ এখানে দেয়ার দরকার নেই।

1 thought on “চিন্তার স্বাধীনতা প্রসঙ্গে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের সাক্ষাৎকার”

Leave a Comment

error: Content is protected !!