রাজনৈতিক অর্থনীতি অধ্যয়নের পরিধি (ইংরেজি: Scope of the study of political economy) হচ্ছে পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ অবধি। শ্রমজীবী জনগণের নির্মম শোষণের উপর প্রতিষ্ঠিত পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ইতিহাসের মঞ্চ থেকে স্বেচ্ছায় বিদায় নেবে না। উপনিবেশসমূহের কৃষক ও শ্রমজীবী মৌলিক জনগণের সাথে মৈত্রীর উপর নির্ভর করে, শ্রমিক শ্রেণির বীরত্বপূর্ণ বিপ্লবী সংগ্রামই কেবল পুঁজিবাদের উচ্ছেদ ও বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্রের বিজয় নিয়ে আসতে পারে।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কিভাবে গঠিত, কিভাবে সংগঠিত হয় পুঁজিবাদী যন্ত্রটি যার মাধ্যমে মুষ্টিমেয় পুঁজিপতি ব্যাপক শ্রমজীবীদের দাসত্বে আবব্ধ করে? গোটা বিশ্ব জুড়ে পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের মধ্যে যে সংগ্রাম চলছে তাতে সক্রিয় ও সচেতন অংশগ্রহণ করতে হলে তা জানা দরকার।
পুঁজিবাদের ক্রমবিকাশ সর্বহারা বিপ্লবের বিজয়ের দিকে, নতুন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিজয়ের দিকে চালিত হয়। বহু বছর পূর্বেই মার্কস এটা প্রতিষ্ঠিত করে যান। মার্কস এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেন পুঁজিবাদী উৎপাদন-পদ্ধতির এক সামগ্রিক অধ্যয়নের মাধ্যমে, পুঁজিবাদের বিকাশ ও অবক্ষয়ের নিয়মাবলী আবিষ্কার করার মাধ্যমে।
এ থেকে সুস্পষ্ট, রাজনৈতিক অর্থনীতি কী বিপুল গুরুত্বই-না বহন করে, যা লেনিনের ভাষায় হলো, “সামাজিক উৎপাদনের বিকাশমান ঐতিহাসিক পদ্ধতিসমূহের বিজ্ঞান”। মার্কস ও লেনিনের সমস্ত শিক্ষাবলীতে এ বিজ্ঞান অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। পুঁজি গ্রন্থের ভূমিকায়, মার্কস বলেছেন,
“এই রচনার চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো আধুনিক সমাজের[১] গতির অর্থনৈতিক নিয়ম উঘাটিত করা।”
সর্বহারা শ্রেণিকে তার মুক্তির সংগ্রামে পরিচালিত করার উদ্দেশ্যে পুঁজিবাদী সমাজের বিকাশের নিয়মাবলী আবিষ্কার করার কাজে মার্কস নিজেকে নিয়োজিত করেন। লেনিন বলেছেন,
“একটি নির্দিষ্ট, ঐতিহাসিকভাবে নির্ধারিত সমাজের উৎপাদন-সম্পর্কসমূহকে তাদের উৎপত্তি, বিকাশ, এবং তাদের অবক্ষয়ের দিক থেকে অধ্যয়ন – এটাই হচ্ছে মার্কস-এর অর্থনৈতিক শিক্ষাবলীর মর্মবস্তু।”
বুর্জোয়া শ্রেণির সেবাদাসরা “প্রমাণ করার” চেষ্টা করে যে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, পুঁজিবাদী সম্পর্কসমূহ হচ্ছে চিরন্তন আর অপরিবর্তনীয়। তাদের উদ্দেশ্য অত্যন্ত স্পষ্ট। তারা শ্রমিকদের প্রমাণ-প্রয়োগে এটাই বুঝাতে চায় যে, পুঁজিবাদের উচ্ছেদের কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। তারা বলতে চায়, পুঁজিবাদের পতন মানে মানব জাতির পতন। তাদের কথা অনুযায়ি, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ভিত্তিতেই কেবল মানব জাতি টিকে থাকতে পারে। এ থেকে তারা পুঁজিবাদের সকল মৌলিক বিধি-বিধানকে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অতি গুরুত্বপূর্ণ সকল সামাজিক সম্পর্ককে শাশ্বত বিধি-বিধান হিসেবে, অপরিবর্তনীয় সম্পর্ক হিসেবে তুলে ধরতে চায়। চিরকাল এরূপই ছিল, চিরকাল এরূপই থাকবে – বুর্জোয়া শ্রেণির মাইনে-খাটা ভৃত্যরা একথাই বলে।
মার্কস ও লেনিনের সৃষ্ট মার্কসবাদী রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র প্রতিক্রিয়াশীলদের এই স্বপ্নসৌধ কোনো উপায়েই দাঁড়িয়ে থাকতে দেয় না। মার্কসবাদী-লেনিনবাদী তত্ত্ব দেখিয়ে দেয় কিভাবে পূর্বতন সমাজ-ব্যবস্থার ধ্বংসাবশেষ থেকে পুঁজিবাদী সম্পর্কসমূহ উদ্ভূত হয়, কিভাবে সেগুলো বিকাশ লাভ করে, আর কিভাবেই-বা পুঁজিবাদের নিয়ত তীব্র হয়ে-ওঠা অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বসমূহ অবশ্যম্ভাবী রূপে ডেকে আনে তার ধ্বংস, চালিত করে বুর্জোয়া শ্রেণির কবর রচনাকারী সর্বহারা শ্রেণির সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের বিজয়ের দিকে ।
মানব জাতির ইতিহাস আমাদের একথা বলে যে, পুঁজিবাদ সম্পর্কে কিছু না জেনেই মানুষ এই পৃথিবীতে হাজার হাজার বছর বসবাস করে এসেছে। এর অর্থ হলো, রাজনৈতিক অর্থনীতি পুঁজিবাদী উৎপাদনের যে নিয়মাবলীকে উদ্ঘাটন করে দিয়েছে তা চিরন্তনও নয়, অপরিবর্তনীয় নয়। বিপরীত পক্ষে, এসব নিয়মাবলী পুঁজিবাদের আবির্ভাবের সাথে সাথে একত্রেই আবির্ভূত হয় এবং যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এগুলোর জন্ম দিয়েছিল সেই ব্যবস্থার ধ্বংসের সাথে সাথে সেগুলোও তিরোহিত হয়ে যায়।
তদসঙ্গে, এর আরও অর্থ হলো, রাজনৈতিক অর্থনীতি কেবলমাত্র পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা অধ্যয়নের মধ্যেই নিজেকে আটকে রাখতে পারে না, বরং সমাজ বিকাশের ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী যুগগুলো তাকে অবশ্যই অধ্যয়ন করতে হবে।
মার্কসবাদী-লেনিনবাদী রাজনৈতিক অর্থনীতি দমনমূলক ও শোষণমূলক পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার নিভৃততম কন্দরে গভীরভাবে প্রবেশ করে। তা শ্রেণি-সম্পর্কের সত্যিকার প্রকৃতিকে উঘাটিত করে দেয়, যা বুর্জোয়া শ্রেণির মাইনে-খাটা বিজ্ঞ ভৃত্যরা কুয়াশাচ্ছন্ন করে রাখতে চায়।
মার্কসবাদ-লেনিনবাদ পুঁজিবাদী সমাজে মানুষের উৎপাদন-সম্পর্কসমূহকে তাদের বিকাশ, তাদের গতির দিক থেকেই অধ্যয়ন করে। আমরা ইতিপূর্বেই দেখেছি, মানব সমাজের উৎপাদিকা-শক্তিসমূহ সুনির্দিষ্ট উৎপাদন-সম্পর্কের রূপরেখার মধ্যেই বিকাশ লাভ করে। কিন্তু পুঁজিবাদী সমাজের বিকাশ এমন একটা বিন্দুতে পৌঁছায় যেখানে একটা নির্দিষ্ট সময় ধরে উৎপাদিকা-শক্তিসমূহ যে উৎপাদন-সম্পর্কের রূপরেখার মধ্যে বৃদ্ধি ও বিকাশ লাভ করছিল, সেই উৎপাদন-সম্পর্কের দ্বারা আরোপিত সীমারেখাকে তা ছাড়িয়ে যায়। পুঁজিবাদী সমাজের উৎপাদিকা-শক্তিসমূহ ও তার উৎপাদন-সম্পর্কের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব তখন হয়ে ওঠে অধিক মাত্রায় তীব্র ও গভীর। এই দ্বন্দ্বসমূহ অভিব্যক্তি লাভ করে শোষণমূলক ব্যবস্থার রক্ষক বুর্জোয়া শ্রেণি আর মানুষ কর্তৃক মানুষের উপর সকল শোষণের অবসানের জন্যে লড়াইরত সর্বহারা শ্রেণির মধ্যেকার শ্রেণিসংগ্রামের মধ্যে।
মার্কসবাদী-লেনিনবাদী রাজনৈতিক অর্থনীতি মনোযোগ নিবদ্ধ করে পুঁজিবাদের বিকাশমান দ্বন্দ্বসমূহের ওপর, যেগুলো তাকে তার ধ্বংসের দিকে আর সর্বহারা শ্রেণির সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের বিজয়ের দিকে চালিত করে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উৎপাদিকা-শক্তিসমূহ ও উৎপাদন-সম্পর্কসমূহের মধ্যেকার দ্বন্দ্বসমূহ সামাজিক বিপ্লব রূপায়িত করে, যে দ্বন্দ্বগুলো শ্রেণিসংগ্রামের মধ্যেই অভিব্যক্তি লাভ করে। পুঁজিবাদী সমাজ যতই বিকাশ লাভ করে ততই এসব দ্বন্দ্ব অনিবার্যরূপে আরো তীব্র হয়ে ওঠে।
তথ্যসূত্র ও টিকা
১. আধুনিক সমাজ বলতে কার্ল মার্কস পুঁজিবাদী সমাজকে বুঝিয়েছেন।
২. এ লিয়নতিয়েভ, মার্কসীয় রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র, সেরাজুল আনোয়ার অনূদিত, গণপ্রকাশন, ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০০৫, পৃষ্ঠা ৭-৯।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।