অর্থনীতিবাদ শ্রমিক আন্দোলনে রাজনীতি বাদ দিয়ে আর্থিক দাবি আদায়ের প্রবণতা

অর্থনীতিবাদ (ইংরেজি: Economism) বলে আখ্যায়িত করা হয় শ্রমিক শ্রেণি পরিচালিত সাম্যবাদী আন্দোলনে রাজনৈতিক সংগ্রাম পরিত্যাগ করে আংশিক আর্থিক দাবি আদায়ের প্রবণতাকে। যখন কোনো কমিউনিস্ট পার্টি রাজনৈতিক সংগ্রামে ঢিলেঢালা ভাব প্রদর্শন করে আর্থিক উন্নতির দাবি তোলে তখন অর্থনীতিবাদ প্রকাশ পায়।[১]

বুর্জোয়া সংস্কারবাদের সাথে অর্থনীতিবাদ প্রায়ই একাকার হয়ে যায়। তবে এ দু’য়ের মাঝে পার্থক্য রয়েছে। মার্কসের যুগে অর্থনীতিবাদ এসেছিল বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রামে শ্রমিক শ্রেণিকে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়ার আন্দোলনের মধ্যে আটকে রাখার জন্য। মার্কস এই ধারার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন। তিনি পুঁজিবাদী সমাজের ধ্বংস সাধনের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা বা শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির প্রকৃত উপায়- এই বিপ্লবী রাজনীতিকে সামনে নিয়ে আসেন। এটি হচ্ছে অর্থনীতিবাদের পুরনো ধারা।[২]

পরবর্তীকালে অর্থনীতিবাদ আরো বিকশিত হয়। শ্রমিক শ্রেণি অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়ার মধ্য দিয়ে ক্রমে ক্রমে বিপ্লবী রাজনীতিতে সজ্জিত হবে, এই সংগ্রাম ক্রমান্বয়ে রাজনৈতিক সংগ্রামে রূপ নেবে এবং এই ধারাবাহিকতায় বিপ্লব ঘটবে– এভাবে এই ধারার অর্থনীতিবাদ নিজেকে প্রকাশ করে। ১৯০৩ সালে রচিত বিখ্যাত “কী করতে হবে” পুস্তকটিতে মহামতি ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন এই ধারাটিকে অর্থনীতিবাদের নতুন রূপ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন।

লেনিনের বিশ্লেষণে অর্থনীতিবাদ

কী করতে হবে গ্রন্থে লেনিন দেখান যে, এই ধরনের অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়ার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিপ্লবী রাজনৈতিক চেতনা অর্জিত হতে পারে না। বরং, বিপ্লবী রাজনৈতিক চেতনা বাহির থেকে শ্রমিক শ্রেণির কাছে নিয়ে যেতে হবে, তাদের উপর তা আরোপ করতে হবে। লেনিন দেখান যে, বিপ্লবী সচেতনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে দাবি-দাওয়ার আন্দোলনের মাধ্যমে গড়ে উঠতে পারে না। সুতরাং স্বতঃস্ফুর্ত সংগ্রামের উপর ভিত্তি করে শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবও ঘটতে পারে না। শ্রমিক শ্রেণির পার্টি কমিউনিস্ট পার্টির দায়িত্ব হলো বাহির থেকে বিপ্লবী রাজনৈতিক চেতনা নিয়ে গিয়ে শ্রমিক শ্রেণিকে সচেতন ও সজ্জিত করা।[২]

১৯১৭ সালে সংঘটিত রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পূর্বে আন্দোলনের মধ্যে অর্থনীতিবাদ একটি বিতর্কিত ধারা ছিল। লেনিনের অনুসারী বলশেভিকগণ নরমপন্থীদের বিরুদ্ধে অর্থনীতিবাদের অভিযোগ আনেন।[৩] লেনিনবাদীদের মতে অর্থনীতিবাদের অনুসারীগণকে সমাজতন্ত্রী বলা চলে না। কেননা, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন কেবলমাত্র শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন নয়। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন শ্রমিকদের নেতৃত্বে রাষ্ট্রকে করায়ত্ত করার এবং শ্রমিকশ্রেণিকে ক্ষমতায় উন্নীত করারও আন্দোলন। শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন দ্বারা শ্রমিকদের মুক্তি সম্ভব নয়।

পশ্চিমে বার্নস্তাইনপন্থীরা এবং রাশিয়ার অর্থনীতিবাদীরা বিশেষ জোর দিয়েছিল ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার স্বতঃস্ফূর্ততার উপর, শ্রমিক শ্রেণির রাজনৈতিক সংগ্রামের কার্যকারিতার ব্যাপারে সঠিক মূল্যায়নে তারা অক্ষম হয় এবং এ সংগ্রামে তারা শুধু অর্থনৈতিক দাবিই উত্থাপন করে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্র ও পেশাগত সংগ্রামের মধ্যেই তার গণ্ডি সীমাবদ্ধ রাখে।[৪]

অর্থনীতিবাদ বিরোধী সংগ্রামে লেনিনবাদী পার্টির করণীয় 

রুশ বলশেভিক পার্টির মধ্যে কারা অর্থনীতিবাদী এবং তাদের মত কিভাবে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য ক্ষতিকর, তার বিশ্লেষণ করে লেনিন ‘কি করতে হবে’ নামক পুস্তক রচনা করেন। শ্রমিক আন্দোলন এবং সমাজতান্ত্রিক সংগ্রাম আজ কোনো বিশেষ দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। একে একটি আন্তর্জাতিক ধারা বলে অভিহিত করা চলে।

মার্কসবাদীরা শ্রমিক শ্রেণির নিজস্ব অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়ার আন্দোলনকে বাতিল করে না। বরং এই আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে। কিন্তু মার্কসবাদীরা একে প্রধান কাজ মনে করে না। মার্কসবাদী পার্টির বা কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান কাজ হওয়া উচিত বিপ্লবী রাজনীতির প্রচার-প্রসার এবং তার ভিত্তিতে বিপ্লবের সচেতনতা গড়ে তোলা ও বিপ্লবী সংগঠন ও সংগ্রাম পরিচালনা করা। অর্থাৎ, বিপ্লবী রাজনীতির স্বার্থে অর্থনৈতিক আন্দোলনকে কাজে লাগানো।

তথ্যসূত্র:

  1. অনুপ সাদি, ১৫ মে ২০১৯, “অর্থনীতিবাদ প্রসঙ্গে” রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/economics/economism/
  2. রায়হান আকবর, রাজনীতির ভাষা পরিচয়, আন্দোলন প্রকাশনা, ঢাকা, জুন ২০২০, পৃষ্ঠা ২৫-২৬।
  3. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ১৪৩।
  4. ভূমিকা অংশ, ভি আই লেনিন, কি করতে হবে, মার্কসবাদ লেনিনবাদ ইন্সটিটিউট, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো ১৯৮৪ পৃষ্ঠা ৫-৯

Leave a Comment

error: Content is protected !!