পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রেণি-পার্থক্য হচ্ছে একটি চরম, পরম ও অনিবার্য সত্য

শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রেণি-পার্থক্য বা শ্রেণি-বৈষম্য(ইংরেজি: Class-disparity) হচ্ছে একটি চরম, পরম ও অনিবার্য সত্য। যে কোনো একটি পুঁজিবাদী দেশের কথা ধরা যাক। উন্নত বা পশ্চাদপদ – যেরূপ দেশই তা হোক না কেন, প্রথম যে জিনিসটি নজরে পড়ে তা হলো শ্রেণি-পার্থক্য। রাজপথের ধারে সারিবদ্ধ সবুজ প্রাঙ্গণ ও বৃক্ষরাজি শোভিত সুরম্য অট্টালিকায় বসবাস করে মুষ্টিমেয় বিত্তবান লোক আর নিরানন্দ রাস্তার পাশে পুঁতিগন্ধময় ও ধূম্রাচ্ছন্ন গৃহে, নিকৃষ্ট বস্তিতে কিংবা নড়বড়ে কুঁড়েঘরে বাস করে মজুরের দল, বিত্তবানদের বিপুল বৈভবের সৃষ্টিকর্তা।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সমাজ দুটি বিরাট শত্রু শিবিরে, দুটি বিরোধী শ্রেণিতে – বুর্জোয়া শ্রেণি ও সর্বহারা শ্রেণিতে বিভক্ত। বুর্জোয়া শ্রেণির হাতে রয়েছে সকল সম্পদ ও সর্বৈব ক্ষমতা, সকল শিল্প-কারখানা, ফ্যাক্টরী, খনি, জমি, ব্যাংক, রেলপথের মালিক তারা; বুর্জোয়া শ্রেণি হলো শাসক শ্রেণি। সর্বহারা শ্রেণির জন্যে রয়েছে সকল ধরনের নিপীড়ন ও দারিদ্র। বুর্জোয়া শ্রেণি ও সর্বহারা শ্রেণির মধ্যেকার বৈসাদৃশ্য – এটাই হলো যে কোনো পুঁজিবাদী দেশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভেদ চিহ্ন। শ্রমিক শ্রেণি ও বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যেকার সংগ্রাম – এটাই অন্য সবকিছুর ওপর প্রাধান্য লাভ করে। এই দুটি শ্রেণির মধ্যেকার ব্যবধান ক্রমাগত আরো গভীর, আরো ব্যাপক হতে থাকে। শ্রেণি-দ্বন্দ্বের বৃদ্ধির হবার সাথে সাথে ব্যাপক শ্রমিক শ্রেণির ঘৃণা-ভরা ক্রোধ বাড়তে থাকে, তাদের সংগ্রাম করার আকাঙ্ক্ষাও বাড়তে থাকে, বাড়তে থাকে তাদের বিপ্লবী সচেতনতা, নিজেদের শক্তির ওপর আস্থা ও পুঁজিবাদের উপর তাদের চূড়ান্ত বিজয়ের প্রতি বিশ্বাস।

সংকট সর্বহারা শ্রেণির জন্যে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট ডেকে এনেছে। ব্যাপক আকারের বেকারত্ব, স্বল্প মজুরী, হতাশায় নিমজ্জিত হাজারো মানুষের আত্মহত্যা, অন্নাভাবে মৃত্যু, ক্রমবর্ধমান শিশু-মৃত্যু – এগুলোই হলো পুঁজিবাদ থেকে শ্রমিকদের পরম প্রাপ্তি। একই সাথে, বুর্জোয়া শ্রেণি আগের মতোই বিপুল সম্পদ অর্জন করতে থাকে যা শ্রেণি-পার্থক্য আরো বাড়িয়ে তোলে।

এতদনুসারে, উদাহরণস্বরূপ লিয়নতিয়েভ রচিত মার্কসীয় রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র, গ্রন্থের এক হিসাব উদ্ধৃত জার্মান সংবাদপত্রের ১৯৩৫ সালের বা তার আগের বিবরণ অনুযায়ী দেখা যায়, রং প্রস্তুতকারী ট্রাস্টের ৪৩ জন ডিরেক্টর বছরে প্রত্যেকে পায় – ১,৪৫,০০০ মার্ক; শকুবার্ট ও সল্টজার প্রতিষ্ঠানের ৪ জন ডিরেক্টর প্রত্যেকে পায় – ১,৪৫,০০০ মার্ক; ইলসে কর্পোরেশনের ২ জন ডিরেক্টর প্রত্যেকে পায় – ১,৩০,০০০ মার্ক; ম্যানসম্যান কর্পোরেশনের ৭ জন ডিরেক্টর প্রত্যেকে পায় – ১,৩৫,০০০ মার্ক; অ্যালায়েন্স ইনস্যুরেন্স কোম্পানীর ২২ জন ডিরেক্টর প্রত্যেকে পায় – ৮০,০০০ মার্ক।

মুষ্টিমেয় পরজীবী প্রাণী যাতে ভোগ-বিলাস ও আরাম-আয়েশে জীবন-যাপন করতে পারে তার জন্য লক্ষ-কোটি জনগণকে থাকতে হয় ক্ষুধার্ত। এই হলো পুঁজিবাদের তুলে ধরা চিত্র, এই হলো শ্রেণি-দ্বন্দ্বের চিত্র, যা নজিরবিহীন সংকট দ্বারা চূড়ান্ত মাত্রায় তীব্র হয়ে উঠেছে। 

বুর্জোয়া শ্রেণি তার শাসন বজায় রাখতে চায় সকল ধরনের হিংসাত্মক কার্যক্রম ও প্রবঞ্চনা দ্বারা। নিজ শ্রেণি-চেতনা বৃদ্ধির মাত্রা অনুযায়ি, সর্বহারা শ্রেণি চায় পুঁজিবাদী দাসত্বের অবসান ঘটাতে এবং সেই স্থানে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে।

পুঁজিবাদী দেশসমূহে বুর্জোয়া শ্রেণি ও সর্বহারা শ্রেণিই হলো মূল শ্রেণি। এই দুই শ্রেণির শ্রেণি-পার্থক্য, তাদের পরস্পর সম্পর্ক, তাদের সংগ্রাম – এগুলোই পুঁজিবাদী সমাজের নিয়তি নির্ধারণ করে। কিন্তু, পুঁজিবাদী দেশসমূহে, বুর্জোয়া শ্রেণি ও সর্বহারা শ্রেণির সাথে সাথে অন্যান্য, মধ্যবর্তী স্তর রয়েছে। বহু দেশেই এসব মধ্যবর্তী স্তর সংখ্যায় বেশ পরিমাণে বড়।

মধ্যবর্তী স্তরের অন্তর্ভূক্ত রয়েছে ছোট ও মাঝারী কৃষক, হস্তশিল্প ও কারিগর। এসব স্তরকে আমরা বলি খুদে-বুর্জোয়া বাপেটি-বুর্জোয়া। বুর্জোয়াদের দিকে যা তাদের নৈকট্য সৃষ্টি করে তা হলো তারা জমি, যন্ত্রপাতি ও হাতিয়ারের মালিক। কিন্তু একই সাথে তারা হলো শ্রমজীবী, আর এটাই সর্বহারা শ্রেণির দিকে তাদের নৈকট্য সৃষ্টি করে। পুঁজিবাদ অবশ্যম্ভাবীরূপে এসব মধ্যবর্তী স্তরকে নিঃস্ব হওয়ার দিকে ঠেলে দেয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থাধীনে এরা নিষ্পেষিত হয়। এদের নগণ্য সংখ্যকই শোষক শ্রেণির সারিতে প্রবেশ করতে পারে, ব্যাপক জনসাধারণই নিঃস্ব হয়ে যায় এবং সর্বহারা শ্রেণির সারিতে তলিয়ে যায়। সে কারণে, পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে, ব্যাপক শ্রমজীবী কৃষক জনগণের মধ্যে সর্বহারা শ্রেণি মিত্র খুঁজে পায়।

আলোকচিত্রের ইতিহাস: লেখায় ব্যবহৃত মূল আলোকচিত্রটি বোম্বাই শহরের বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েতের পার্থক্যকে ফুটিয়ে তুলেছে। আলোকচিত্রটি Surajnagre তুলেছেন ৩১ মার্চ ২০১৬ তারিখে।

তথ্যসূত্র

১. এ লিয়নতিয়েভ, মার্কসীয় রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র, সেরাজুল আনোয়ার অনূদিত, গণপ্রকাশন, ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০০৫, পৃষ্ঠা ২-৩।

Leave a Comment

error: Content is protected !!