মার্কসীয় রাজনৈতিক অর্থনীতির ভূমিকা এক যুদ্ধরত পার্টি বৈশিষ্ট্যধারী শ্রেণি-বিজ্ঞান

মার্কসীয় রাজনৈতিক অর্থনীতির প্রধান ভূমিকা (Role of Marxian Political economy) হচ্ছে এক যুদ্ধরত পার্টি বৈশিষ্ট্যধারী শ্রেণি বিজ্ঞান। এই শাস্ত্র শ্রেণির সেবা করে, প্রলেতারিয়েত শ্রেণি এই শাস্ত্রকে লাগাতে চায় তার কাজে। পুঁজিবাদের অনিবার্য পতন আর সাম্যবাদের বিজয়ের নিয়মাবলী লুকিয়ে রাখতেই বুর্জোয়া শ্রেণি যেখানে আগ্রহী সেখানে সর্বহারা শ্রেণি চায় সাম্যবাদের বিজয়কে এগিয়ে নিতে। অর্থনীতির বুর্জোয়া অধ্যাপকবৃন্দ – লেনিন যেভাবে এর বর্ণনা করেছেন; তেমনি, “পুঁজিপতি শ্রেণির এসব সুশিক্ষিত বিশ্বস্ত অনুচরবৃন্দ” – নিপীড়ন ও দাসত্বের দোষ-ত্রুটি ঢেকে রেখে ও তাকে সাজ-সজ্জা পরিয়ে, আন্তরিকতা ও বিশ্বস্থতার সাথে পুঁজিবাদের সেবা করে।

বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদরা পুঁজিবাদী উৎপাদন নিয়ন্ত্রণকারী প্রকৃত নিয়ম-বিধিগুলোকে আড়াল ও কুয়াশাচ্ছন্ন করে রাখে। তারা পুঁজিবাদকে চিরস্থায়ী করার চেষ্টা চালায়, তারা পুঁজিবাদকে সামাজিক জীবনের একমাত্র সম্ভাব্য ব্যবস্থা হিসেবে চিত্রিত করে। তাদের মত অনুসারে পুঁজিবাদের নিয়ম-বিধি হলো চিরন্তন ও অপরিবর্তনীয়। এরূপ মিথ্যাচার দ্বারা তারা অনিবার্য ধ্বংস থেকে পুঁজিবাদকে রক্ষা করার চেষ্টা চালায়।

শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী সংগ্রামের অগ্রভাগে অবস্থান করে কমিউনিস্ট পার্টি। কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে একমাত্র দৃঢ় নেতৃত্বই সর্বহারা শ্রেণির বিজয় সুনিশ্চিত করে। কমিউনিজমের সকল শক্রই কমিউনিস্ট পার্টিকে বিষাক্ত হৃদয়ে ঘৃণা করে। সম্ভাব্য সকল উপায় একে বিভক্ত করার, তার ঐক্য ধ্বংস করার প্রচেষ্টা তারা চালায়, এবং পার্টির সারির অভ্যন্তরে তার সাধারণ লাইন থেকে যে কোনো বিচ্যুতিতে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। 

পুঁজির বিরুদ্ধে সংগ্রামে, সাম্যবাদের জন্যে সংগ্রামে রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র হলো সুতীক্ষ্ণ হাতিয়ার। সমস্ত বিজ্ঞানের মতোই, আর প্রাথমিকভাবে মানব সমাজ ও তার বিকাশের নিয়মাবলী যেসব বিজ্ঞানের বিষয়ীভূত সেগুলোর মতোই, রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র হলো এক শ্রেণি বিজ্ঞান।

সর্বহারা শ্রেণি বহুসংখ্যক শত্রু দ্বারা পরিবেষ্টিত। এক তিক্ত সংগাম এগিয়ে চলেছে। এই সংগ্রামে কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ লাইনের উপর সকল আক্রমণ, তত্ত্বের ক্ষেত্রেই হোক আর অনুশীলনের ক্ষেত্রেই হোক তাকে ধ্বংস সাধনের সকল প্রচেষ্টা, শক্রর লাভের কারণ হয়ে ওঠে। সে কারণে, পার্টির সাধারণ লাইন থেকে বিচ্যুতির বিরুদ্ধে সতর্ক ও বিরামহীন সংগ্রাম, প্রকাশ্য দক্ষিণ সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে আর তার সাথে সাথে সকল ধরনের “বাম” বিচ্যুতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম অবশ্যই চালিয়ে যেতে হবে। বিপ্লবের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ক্ষেত্রে, সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে এক নয়া হস্তক্ষেপের জন্য প্রস্তুতির ক্ষেত্রে প্রতিবিপ্লবী ট্রটস্কিবাদ হলো বুর্জোয়া শ্রেণির সপক্ষে এক বিশেষ সেবাকর্ম। সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাসির অন্যতম এক সংস্করণ হিসেবে, ট্রটস্কিবাদ সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়াদের বিশেষ করে যোগান দেয় বিভিন্ন দেশের বিপ্লবী আন্দোলন সম্পর্কে, সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে সকল ধরনের কুৎসামণ্ডিত কল্পকাহিনী। ট্রটস্কিবাদ হলো প্রতিবিপ্লবী বুর্জোয়াদের এক অগ্রবর্তী খুঁটি।

রুশ সাময়িকপত্র “সর্বহারা বিপ্লব” [ প্রোলেতারস্কায়া রিভোলিউৎসিয়া]-এর সম্পাদকমণ্ডলীর নিকট ১৯৩১ সালের শরৎকালে লিখিত “বলশেভিক মতবাদের ইতিহাস সম্পর্কিত প্রশ্নাবলী” শীর্ষক চিঠিতে স্তালিন কমিউনিস্ট পার্টির ভেতরে লেনিনবাদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন মতাদর্শের অনুপ্রবেশের সকল প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে বিরামহীন সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তার প্রতি, আর বিশেষ করে “আমাদের সাহিত্যে ছদ্মবেশী ট্রটস্কিবাদী জঞ্জাল চুপিসারে চালান দিয়ে দেয়ার” সকল ধরনের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে দৃঢ়বদ্ধ প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কমিউনিস্ট পার্টির মনোযোগ আকর্ষণ করেন। সর্বহারা শ্রেণির প্রতি বিরোধী ভাবানুগ প্রবণতাগুলোর প্রতিনিধিরা এখন তাদের মতামতগুলো ধূর্ততার সাথে, অলক্ষিতে চালান দিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। এ সমস্ত সকল প্রচেষ্টাই শক্তভাবে প্রতিরোধ করতে হবে। এসব বিরোধী-ভাবানুগ মতামতের প্রতি কোনো সহিষ্ণুতা প্রদর্শন, সেগুলো সম্পর্কে কোনো হীন উদারতাবাদ, শ্রমিক শ্রেণি ও সমাজতন্ত্রের জন্যে তার সংগ্রামের বিরুদ্ধে এক প্রত্যক্ষ অপরাধ।

সর্বহারা শ্রেণির শ্রেণি-শত্রুরা মার্কসীয় রাজনৈতিক অর্থনীতির ভূমিকা ও প্রভাবকে বিকৃত করা ও তাদের নিজস্ব স্বার্থের সেবার উপযোগী করে তোলার জন্যে সর্বোতভাবে চেষ্টা চালায়। বুর্জোয়া ও সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাট অর্থনীতিবিদরা পুঁজিবাদকে রক্ষা করার প্রচেষ্টায় সকল ধরনের সাজানো প্রতারণামূলক কেচ্ছা-কাহিনী উদ্ভাবন করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামে তাদের নিজেদের উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য তারা রাজনৈতিক অর্থনীতিকে ব্যবহার করার অপচেষ্টা চালায়।

সুতরাং, রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র অধ্যয়নকালে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর অন্যতম হলো সকল অ-মার্কসীয় ও বিচ্যুতিময় প্রবণতার বিরুদ্ধে বিরামহীন সংগ্রাম পরিচালনা করা।

তথ্যসূত্র

১. এ লিয়নতিয়েভ, মার্কসীয় রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র, সেরাজুল আনোয়ার অনূদিত, গণপ্রকাশন, ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০০৫, পৃষ্ঠা ১৫-১৭।

Leave a Comment

error: Content is protected !!