উৎপাদিকা-শক্তি ও উৎপাদন-সম্পর্ক প্রসঙ্গে মার্কসীয় অর্থশাস্ত্রের বিশ্লেষণ

উৎপাদিকা-শক্তি ও উৎপাদন-সম্পর্ক (ইংরেজি: Productive forces & Production relations) প্রসঙ্গে মার্কসীয় রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রের বিশ্লেষণ হাজির করে। মানব সমাজের বিকাশের নিয়মাবলী মার্কসবাদই সর্বপ্রথম উদঘাটিত করে। মার্কস দেখিয়ে দেন যে, সমাজ বিকাশের ভিত্তিমূলে রয়েছে অর্থনীতি আর সমাজ বিকাশের উৎসমূল হলো শ্রেণিসংগ্রাম। নিপীড়ক শ্রেণিসমূহের বিরুদ্ধে নিপীড়িত শ্রেণিসমূহের সংগ্রাম – এটাই হলো ইতিহাসের মৌলিক চালিকাশক্তি।

আমরা পূর্বে দেখেছি, কোনো নির্দিষ্ট সামাজিক উৎপাদন ব্যবস্থায় তারা যে অবস্থান গ্রহণ করে সে অনুসারেই শ্রেণিসমূহ ভিন্ন ভিন্ন হয়। আমরা এটাও দেখেছি, কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণি কর্তৃক অধিকৃত অবস্থান নির্ধারিত হয় উৎপাদন-যন্ত্রের সাথে উক্ত শ্রেণির সম্পর্কের দ্বারা। উৎপাদনের প্রক্রিয়ায়ই মানুষের সাথে মানুষের নির্দিষ্ট সম্পর্কসমূহ স্থাপিত হয়।

আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি যে, সামাজিক উৎপাদন বিভিন্নভাবে সংগঠিত হয়। পুঁজিবাদী দেশসমূহে রয়েছে এক ধরনের সমাজ ব্যবস্থা, সোভিয়েত ইউনিয়নে ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের সমাজ ব্যবস্থা। পুঁজিবাদী দেশসমূহে পুঁজিপতিদের জন্য কাজ করতে সর্বহারা শ্রেণি বাধ্য; বশ্যতা ও স্বেচ্ছাচারী শাসনের তারা অধীন। সেখানে কলকারখানা, ফ্যাক্টরি, রেলপথ, জমি, ব্যাংক – সমস্ত কিছুরই মালিক হলো বুর্জোয়া শ্রেণি। বুর্জোয়া শ্রেণির হাতে রয়েছে সকল উৎপাদন-যন্ত্র। এই ঘটনা বুর্জোয়াদের পক্ষে সম্ভব করে তোলে শ্রমিকদের জীবনী রস শুষে নিতে, শ্রমিক শ্রেণিকে নিপীড়ন ও দাসত্বে আবদ্ধ করতে। বুর্জোয়া শ্রেণি ও সর্বহারা শ্রেণির মধ্যেকার, পুঁজিবাদী নিপীড়ক ও শোষিত শ্রমিকের মধ্যেকার সম্পর্ক যে কোনো পুঁজিবাদী দেশের গোটা ব্যবস্থার উপর এক চূড়ান্ত ছাপ একে দেয়। বিপরীত পক্ষে, সোভিয়েত ইউনিয়নে কল-কারখানা, ফ্যাক্টরি ও গোটা রাষ্ট্রে সর্বহারা শ্রেণি শাসকের অবস্থান দখল করে রয়েছে।

উৎপাদনের গতিধারায়, মানুষের সাথে মানুষের, সমগ্রভাবে শ্রেণির সাথে শ্রেণির নির্দিষ্ট সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এই সম্পর্ককে আমরা উৎপাদন-সম্পর্ক বলে অভিহিত করি। শ্রমিক ও পুঁজিপতির মধ্যেকার সম্পর্ককে উৎপাদন-সম্পর্কের একটি উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা যায় । প্রতিটি সমাজ ব্যবস্থা, প্রতিটি সামাজিক উৎপাদন পদ্ধতি বিশিষ্টতা লাভ করে তার মধ্যে আধিপত্যশীল উৎপাদন-সম্পর্ক দ্বারা। স্তালিনকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে বিদ্যমান উৎপাদন-সম্পর্ক পুঁজিবাদী দেশসমূহের উৎপাদন-সম্পর্ক থেকে সম্পূর্ণভাবেই ভিন্ন ছিল।

সমাজের উৎপাদন-সম্পর্ক কি দ্বারা নির্ধারিত হয়, কিসের উপর তা নির্ভর করে? মার্কস দেখিয়ে দিয়েছেন যে, সমাজের বস্তুগত উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের স্তরের উপর উৎপাদন সম্পর্ক নির্ভর করে। বিকাশের বিভিন্ন স্তরে কোনো নির্দিষ্ট সমাজে বিভিন্ন মাত্রার উৎপাদিকা শক্তি পরিলক্ষিত হয়। বর্তমানে, জটিল যন্ত্রপাতির সাহায্যে বিরাট বিরাট কলকারখানা ও ফ্যাক্টরিতেই প্রধানত উৎপাদন-কর্ম সংঘটিত হয়। এমনকি যে কৃষি ক্ষেত্রে যুগ যুগ ধরে সুপ্রাচীন কাঠের লাঙ্গলের ছিল রাজত্ব, সেখানেও আরো বৃহত্তর পরিধিতে জটিল যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু অতীত কালে মানব-শ্রম ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। সে সময়ে আধুনিক জটিল যন্ত্রপাতির কথা এমনকি কল্পনাও করা যেত না। অতি প্রাচীন যুগে এক খণ্ড পাথর আর একটি লাঠিই ছিল মানুষের একমাত্র পরিচিত হাতিয়ার।

তারপর বহু হাজার-লাখ বছর পার হয়ে গিয়েছে। ধীরে ধীরে মানুষ আবিষ্কার করেছে নতুন থেকে নতুনতর শ্রমের পদ্ধতি, শিখেছে নতুন নতুন হাতিয়ার তৈরি করতে। হাতিয়ার আর যন্ত্রপাতি মানুষের সেবা ও সহায়তা করে। এগুলোর সাহায্যে মানুষের শ্রমশক্তি বিপুল পরিমেয় জিনিসপত্র উৎপাদন করে, যা পূর্বে কল্পনাও করা যেতো না। অবশ্য, উৎপাদন-যন্ত্রের পরিবর্তনের সাথে সাথে, নতুন যন্ত্রপাতি প্রবর্তনের সাথে সাথে মানুষের খোদ শ্রমেরই পরিবর্তন ঘটে। বিগত দেড় শতাব্দী ধরে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ছিল বিশেষভাবে দ্রুত।

প্রায় দেড়শত বছর আগেও বাষ্পীয় ইঞ্জিন সম্পর্কে মানুষ কিছুই জানতো না; প্রায় পঞ্চাশ বছর পূর্বেই কেবল বিদ্যুতের ব্যবহার শুরু হয়। কেবল গত এক শত বছরেই রেলপথের বিকাশ সাধিত হয়েছে। মোটর গাড়ী মাত্র গত কয়েক দশকেই প্রচলিত হয়ে উঠেছে, ট্রাক্টর হয়েছে আরো সম্প্রতি। উড়োজাহাজের প্রথম আবির্ভাবের কথা মানুষ এখনও খুব ভাল করে স্মরণ করতে পারে – এটা হলো প্রথম মহাযুদ্ধের মাত্র কিছুদিন আগের কথা। রেডিওর অগ্রগতি ঘটেছে কেবল মহাযুদ্ধের সময় থেকে।

কিন্তু মানুষের হাতিয়ারপাতি – তার নিষ্প্রাণ সাহায্যকারীই কেবল উন্নত ও বিকশিত হয়নি, একই সাথে সমাজের সজীব [living ] উৎপাদিকা-শক্তিও বিকশিত হয়েছে। সবচেয়ে বড় উৎপাদিকা-শক্তি হলো খোদ শ্রমজীবী জনসাধারণ নিজেরাই, খোদ মানুষ নিজেই। যন্ত্রপাতির অগ্রগতি আর কলা-কৌশলের উন্নতির সাথে সাথে মানুষের ক্ষমতা, দক্ষতা ও জ্ঞানও বৃদ্ধি পায়। উড়োজাহাজ না থাকলে বিমান চালকও থাকতে পারে না, মোটরযানের আবির্ভাবের পূর্বে কোনো মোটর-চালকের থাকার কথা নয়। জটিল যন্ত্রপাতির সহায়তা নিয়ে মানুষ কেবল কাজ করতেই শিখে না, প্রথমত সেগুলো সৃষ্টি করতে, সেগুলো নির্মাণ করতেও সে শিখে।

উৎপাদিকা-শক্তির বিকাশের সাথে সাথে উৎপাদন-সম্পর্কও বদলে যায়। মার্কস বলেছেন, বস্তুগত উৎপাদন-যন্ত্রের পরিবর্তন ও বিকাশের সাথে সাথে, উৎপাদিকা-শক্তির ক্ষেত্রে পরিবর্তনের সাথে সাথে সামাজিক উৎপাদন-সম্পর্কেরও যুগপৎ পরিবর্তন ঘটে।

অধিকন্তু, এক বিশেষ রূপের শ্রেণি-আধিপত্য থেকে অন্য রূপের শ্রেণি-আধিপত্যে উত্তরণ অবিচ্ছেদ্যভাবে সমাজের উৎপাদিকা-শক্তিসমূহের বিকাশের সাথে গ্রথিত। উদাহরণস্বরূপ, পুঁজিবাদের বিকাশ বৃহদায়তন-উৎপাদনের বিস্তৃতি ও যন্ত্রের আবির্ভাবের সাথে যুক্ত।

দৃষ্টান্তস্বরূপ, আমরা পূর্বেই দেখেছি যে, আদিম যুগে উৎপাদিকা-শক্তির বিকাশের অবস্থা ছিল খুবই নিম্ন পর্যায়ে। শ্রমের হাতিয়ার-পত্র তখনও বিকশিত হয়ে ওঠেনি। প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানুষ কেবল অপ্রতুলভাবেই লড়াই করতে পারতো। শিকারজাত বস্তুগুলোর উপর নির্ভর করেই আদিম গোত্রগুলি কেবলমাত্র কোনো প্রকারে নিজেদের ক্ষুন্নিবৃত্তি সাধন করতে পারতো। কোনো ধরনের মজুদই থাকতো না। সে কারণে কোনোরূপ শ্রেণিভেদ ব্যবস্থা সেখানে থাকতে পারতো না, যেখানে একজন অন্যের শ্রমের বদৌলতে জীবন ধারণ করে। শ্রেণিতে শ্রেণিতে সমাজের বিভক্তি দেখা দেয় উৎপাদিকা-শক্তির বিকাশের এক উচ্চতর স্তরে।

কোনো এক নির্দিষ্ট মুহূর্ত পর্যন্ত উৎপাদন-সম্পর্ক বস্তুগত উৎপাদিকা-শক্তির প্রাণ সঞ্চার করে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, পুঁজিবাদ মৌলিকভাবেই পুরাতন শ্রম-পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটায়, বৃহদায়তন-উৎপাদনের আবির্ভাব ও বিকাশ সাধন করে। কিন্তু তাদের বিকাশের এক নির্দিষ্ট মুহূর্তে যে উৎপাদন-সম্পর্কের অভ্যন্তরে উৎপাদিকা-শক্তিসমূহ বিকাশ লাভ করছিল সেই উৎপাদন-সম্পর্ককে সেগুলো অস্বীকার করতে শুরু করে।

“উৎপাদিকা-শক্তিগুলোর বিকাশের উপযুক্ত রূপ থেকে এই সম্পর্কগুলো তাদের শৃংখলে পরিণত হয়। তখনই আসে সমাজ-বিপ্লবের আমল।”[২]

বর্তমানকালে আমরা এরূপ এক সমাজ-বিপ্লবের আমলেই বাস করছি। পুঁজিবাদী সমাজের উৎপাদন-সম্পর্কসমূহ উৎপাদিকা-শক্তিসমূহের আরো অধিক বিকাশে বাধাস্বরূপ হয়ে শৃংখলে পরিণত হয়েছে। পুঁজির ক্ষমতা উচ্ছেদ করে, সর্বহারা শ্রেণি এসব শৃংখল ভেঙে ফেলে। সর্বহারা বিপ্লব পুঁজিবাদের শৃংখল থেকে উৎপাদিকা-শক্তিসমূহকে মুক্ত করে এবং তাদের বিকাশের জন্যে সীমাহীন সুযোগ সৃষ্টি করে। 

তথ্যসূত্র

১. এ লিয়নতিয়েভ, মার্কসীয় রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র, সেরাজুল আনোয়ার অনূদিত, গণপ্রকাশন, ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০০৫, পৃষ্ঠা ৩-৫।
২. মার্কস, “ক্রিটিক অব পলিটিক্যাল ইকনমি”-র ভূমিকা, পৃঃ ১১, চার্লস এই কার এণ্ড কোং, শিকাগো, ১৯০৮

Leave a Comment

error: Content is protected !!