উদ্বৃত্ত মূল্য (ইংরেজি: Surplus Value) প্রত্যয়টি মার্কসের শ্রমভিত্তিক মূল্যতত্ত্বের (Labour theory of value) প্রধান অঙ্গ। মার্কসবাদী বিশ্লেষণ মতে, পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতিতে পণ্য বিনিময়ের ফলে পুঁজিপতির যে পরিমাণ পুঁজি বেড়ে যায় তাকেই বলে উদ্বৃত্ত মূল্য।[১]
মার্কস উৎপাদনের মাত্র একটি উপাদান আছে বলে মনে করতেন, সেটা হলো শ্রম। পুঁজিপতি শ্রমিককে তার শ্রম বা শ্রমশক্তির বিনিময়ে যে মূল্য প্রদান করে, সেটা তার শ্রমশক্তির সমতুল বলে ধরে নেওয়া হয়, বস্তুত সেই মূল্য শ্রমিকের কাজের মোট সময়ের মূল্য অপেক্ষা কম।
শ্রমিক যে কাজ করে তার দুটি সময় থাকে। একটি হলো সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমের সময় (socially necessary labour time) এবং অন্যটি হলো অতিরিক্ত শ্রমের সময় (surplus labour time)। শ্রমিক যে বস্তু উৎপাদন করে সেটা অতিরিক্ত দামে পুঁজিপতি বিক্রয় করে, অনুপাতে শ্রমিক মজুরি পায় কম, অর্থাৎ অতিরিক্ত যে সময়ের কাজের মূল্য শ্রমিক কম পায় সেটা তার উদ্বৃত্ত মূল্য হিসেবে প্রাপ্য। শ্রমিক যতটা মজুরি পায় সেটা হলো সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমের সময়ের মূল্য। এবং যতটা থেকে তাকে বঞ্চিত করা হয় সেটা তার অতিরিক্ত শ্রম সময়ের মূল্য।
কার্ল মার্কসের তত্ত্বে উদ্বৃত্ত মূল্যের দৃষ্টিতে মুনাফাকে বিচার করা হয়েছে। শ্রমভিত্তিক মূল্যতত্ত্বে বলা হয় যে কোনও জিনিস উৎপাদন করতে হলে যে সামাজিক সময় লাগে সেটাই হলো তার মূল্য। মুনাফা ও দাম হলো বাহ্য আকার, যার পিছনে অতিরিক্ত শ্রমের মূল্য থাকে অন্তর্নিহিত।[২]
উদ্বৃত্ত মূল্যের হার
মনে করা যাক, শ্রমিকদের উৎপাদিত পণ্য মালিক ৫০০ ডলারে বিক্রি করল, কিন্তু মালিক মজুরদেরকে মজুরির আকারে শোধ করল ২৫০ ডলার। এটা সুস্পষ্ট যে, অবশিষ্ট ২৫০ ডলার উদ্বৃত্ত মূল্যের রূপেই আত্মসাৎ করে।
শ্রমিকদের শ্রমের কত অংশ পুঁজিপতিদের পকেটে যায় তা জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে পুঁজিবাদী শোষণের মাত্রা প্রদর্শন করে এমন একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ আমরা খুঁজে পাব।
এ ধরনের নিরিখ হচ্ছে উদ্বৃত্ত মূল্যের হার (Rate of surplus value). উদ্বৃত্ত মূল্যের হার দ্বারা আমরা পরিবর্তনশীল পুঁজির সাথে উদ্বৃত্ত মূল্যের অনুপাতকে কিংবা, অন্য কথায়, আবশ্যক শ্রমের সাথে মজুরিবিহীন শ্রমের অনুপাতকেই বুঝি। পূর্বোক্ত দৃষ্টান্তে, উদ্বৃত্ত মূল্যের হার নিম্নলিখিত রূপ ধারণ করবে:
২৫০ ডলার উদ্বৃত্ত মূল্য ÷ ২৫০ ডলার পরিবর্তনশীল পুঁজি = শতকরা ১০০
যদি উদ্বৃত্ত মূল্যের হার শতকরা ১০০ ভাগের সমান হয়, তাহলে তার অর্থ এই যে, শ্রমিকের শ্রম আবশ্যক ও উদ্বৃত্ত শ্রমে সমভাবে বিভক্ত, উদ্বৃত্ত মূল্য পরিমাণের দিক দিয়ে পরিবর্তনশীল পুঁজির সমান, শ্রমিকদের কেবলমাত্র তার অর্ধেক শ্রমের মজুরি শোধ করা হয় এবং বাকি অর্ধেক আত্মসাৎ করে পুঁজিপতি। [৩]
তথ্যসূত্র:
১. অনুপ সাদি, মার্কসবাদ, ভাষাপ্রকাশ, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১৬, পৃষ্ঠা ৩৭।
২. সৌরেন্দ্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, রাজনীতির অভিধান, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, জুলাই ২০১৩, পৃষ্ঠা ৫২।
৩. এ লিয়নতিয়েভ, সেরাজুল আনোয়ার অনূদিত, মার্কসীয় রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র, গণপ্রকাশন, ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ, ফেব্রুয়ারি ২০০৫, পৃষ্ঠা ৬৪।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।