কোমল গান্ধার চলচ্চিত্র দুই বাংলার সাংকৃতিক মেলবন্ধনের আকুতি

মানুষকে পাগলে মতো ভালোবাসা ব্যক্তিটি হলো ঋত্বিক ঘটক। যেকোনো শিল্পকে শেষ পর্যন্ত মানুষের কাছে পৌঁছাতেই হবে। কোনো শিল্পী যদি সেটা না করতে পারে তাহলে তাঁর শিল্পের কোনো মূল্য নেই। দুই বাংলায় বেড়ে ঔঠা এই মানুষটি মানুষের আচার, সংস্কৃতি, শিল্প, লোকজ জীবন, প্রাণ, প্রকৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। তাই চলচ্চিত্রে সেই দিকগুলোকে তুলে আনতে পেরেছেন। বাংলা ভাগের সাথে সাথে ভূখণ্ড, রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিকতার পরিবর্তন হয়ে যায়। যেটা পুষিয়ে ওঠার না। [১]

ঋত্বিক দেশভাগেরচিত্রকে সরাসরি এঁকেছেন তিনটি চলচ্চিত্রে; ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘কোমল গান্ধার’ আর সুবর্ণরেখা। এক সাক্ষাৎকারে চলচ্চিত্রগুলোর বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে উঠে আসে নানা প্রেক্ষাপট। এই বাংলাদেশ ভাগ হয়ে-যাওয়াটা দুই বঙ্গের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক জীবনকে তােলপাড় করে তুলেছিল। সেই সময়ে জ্ঞানগম্যি যাদের হয়েছিল তাদের অনেকেই এই বিষয়টা বুঝতে পারেন। ঋত্বিকের ভাষায়- 

আজকের সমস্ত অর্থনীতিটা যে চুরমার হয়ে গেছে তার বেসিক ফ্যাক্টর ছিল ঐ বাংলাভাগ। বাংলাভাগটাকে আমি কিছুতেই গ্রহণ করতে পারিনি। আজও পারি না। আর ঐ তিনটে ছবিতে আমি ওকথাই বলতে চেয়েছি। ইচ্ছেনা-থাকা সত্ত্বেও হয়ে গেল একটা ট্রিলজি :‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘কোমল গান্ধার’ আর সুবর্ণরেখা। 

তিনি মেঘে ঢাকা তারা দিয়ে যখন শুরু করেছিলেন তখনও রাজনৈতিক মিলনের কথা বলিনি। কারণ ইতিহাসে যা হয়ে গেছে তা পাল্টানাে খুব মুশকিল বিষয়। এক্ষেত্রে মনে করেন সেটা কোনো পরিচালকের কাজও নয়। তবে সাংস্কৃতিক মিলনের পথে যে-বাধা যে-ছেদ, যার মধ্যে রাজনীতি অর্থনীতি সবই এসে পড়ে, সেটাই ঋত্বিকে প্রচণ্ড ব্যথা দিয়েছিল। আর এই সাংস্কৃতিক মিলনের কথাই ‘কোমল গান্ধার’-এ পরিষ্কার করে বলা আছে। যেটা অন্য কোনো চলচ্চিত্রে প্রকাশ করেন নি।[১]

কোমল গান্ধার চলচ্চিত্রের কাহিনী:

‘কোমল গান্ধার’-এর শুরুতেই নাটক পাগল ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে জড়ো হয়। তারা সবাই একসাথে দল করে, দলের মধ্যে গড়ে ওঠে স্নেহ, ভালবাসা, মমতা, হিংসা; এইসব নিয়েই নাট্যদলটি একটি পরিবার। ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্রকে     সাধারণ দর্শকের কাছে বরাবরই কিছুটা দুর্বোধ্য। তবে চলচ্চিত্রের মধ্যে দিয়ে যে বার্তা তিনি দিতে চেয়েছেন, সেই বার্তা এসেছে অত্যন্ত সরাসরি। চলচ্চিত্রে দেখা যায় নাট্যাভিনয়ের একজন বৃদ্ধকে, যিনি চিৎকার করে জানতে চান- এমন কোমল দ্যাশটা ছাইড়া, আমার নদী, পদ্মার ইলিশ ছাইড়া, আমি যামু ক্যান?’ উত্তরে তার পুত্রবেশী সহ-অভিনেতা বলে-যাইবা খাইবার লাইগা। এই শ্যাষ সুযোগ, এখনও শরনার্থী হও।’ এই কথা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, নাটকের বিষয় দেশভাগ।

এই চলচ্চিত্রটি মূলত নাট্যদলের উত্থান-পতন নিয়ে। সেই দলের নেতা ভৃগু, যার স্বভাব স্পষ্টভাষী, প্রথম দর্শনে যেকেউ বুঝবে সে একজন আবেগহীন যুবক। শিবনাথ দলে যার সম্মান বা অবস্থান ভৃগুর পরেই। কথায় কথায় অন্যকে খোঁচা দেওয়া তার অভ্যাস। মঞ্চে আলোকসজ্জার দায়িত্বে থাকে ঋষি। যে বোহেমিয়ান, তার পোশাক মলিন। তাকে একসময় দেখা যায়, কার্শিয়াঙের পাহাড়ি রাস্তায় ভোরবেলা হাঁটতে হাঁটতে ‘আকাশভরা সূর্যতারা’ গেয়ে চলেছে। একেবারেই কাউকে পরোয়া না করা মনোভাবের একজন মানুষটিকে ভালবাসে। যাকে জয়া ভালোবাসে। জয়াকে নাটক করার জন্য প্রতিদিনই রক্ষণশীল পরিবারের কাছে নির্যাতন সইতে হয়। 

আরো আছে শান্তা যে ভৃগু দল ছেড়ে সঙ্গে কয়েকজনকে নিয়ে যায়। তবে একদিন দল ভেঙে চলে যাওয়ার মধ্যেকার যে টানাপোড়েন, সেখানে হঠাৎ এক সেতুবন্ধন করতে আসেন অনুসূয়া ভট্টাচার্য। তাঁর বাচনভঙ্গি অসাধারণ, চমৎকার অভিনয়, অনেকেই মুগ্ধ করতে পারে অল্পসময়েই। সে সম্পর্কে শান্তার ভাসুরঝি, এবং শান্তাদের দল ‘দক্ষিণাপথ’-এর সম্পাদিকা। একসময়র সিদ্ধান্ত হলো দুই দলের যৌথ প্রযোজনার নাটক হবে। তখন প্রত্যেকেই নিজেকে ও তার আশেপাশের সকলকে আবিষ্কার করতে থাকে। এই যে নাট্যদলের পরবর্তী প্রযোজনা নিয়ে নিরন্তর পরিশ্রম, উদ্যোগ, আনন্দে গান গাইতে গাইতে বাইরে যাওয়া, কখনও লালগোলা, কখনও কার্শিয়াং, কখনও বোলপুর। 

দেশভাগ ও খন্ডিত স্মৃতি:

চলচ্চিত্রে দেখা যায় দুই নাট্যদলের কর্মীদের আলাপ, মেলামেশা স্বাভাবিক হতে থাকে। ভৃগুর স্বভাবে কোমলতা ও কঠিনতার মিশ্রণে গড়া তুলে অনুসূয়া। তাদের দুজনের সম্পর্কের বলার সুযোগ আসে লালগোলার পদ্মার পাড়। চলচ্চিত্রের এই স্থানটিই ছিলো গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কাহিনীটা মূল ফোকাস ছিলো দুজনের ভাবের আদান প্রদানের সঙ্গে অতীত স্মৃতি ও দেশভাগের নির্মমতা। যে ভৃগুকে দেখলে খুব রুক্ষ, প্রেম, আবেগহীন মনে হতো সেই ভৃগু এতদিন এই পদ্মার পাড়ে এসে তাঁর সমস্ত দুঃখ, কষ্ট, বেদানাকে উজাড় করে দেয় অনুসূয়ার কাছে। শেষ বিকেলে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে ওপারের ‘দেশে’র কথা বলতে বলতে একে অপরের কাছাকাছি আসে। অতীতের মায়াভরা স্মৃতি বলতে গিয়ে অনুসূয়া ভেঙে পড়ে। তাদের বুকের উপর দিয়ে ছুটে চলে কোনও এক অদৃশ্য গতি, পরিত্যক্ত রেললাইনের উপর দিয়ে স্মৃতিরা ছুটে যেতে চায় ওপার বাংলায়।

এই দৃশ্যটি যেন দেশভাগকে সরাসরি না দেখিয়েও এক নাপাওয়ার আকুলতার হাহাকারকে প্রকট করে তোলে। বাংলাভাগের করুণ অধ্যায়ের শেষের দীর্ঘ দেড় দশক পরেও যেন সে ক্ষত শুকোয় না। পদ্মার শান্ত ঢেউয়ের সাথে তারা নিজেদেরকে অন্যভাবে আবিষ্কার করে। অনুসূয়া বলে তার মায়ের কথা, পদ্মায় স্নানের দৃশ্য, দেশের বাড়ির সেই নিশ্চিন্ত, নির্মল জীবনের অনুভূতি। ভৃগু আস্তে আস্তে বলতে থাকে- ‘তুমি সেদিন বললে আমি অকারণ রুক্ষ আর কোনও বন্ধু পাব না, কিন্তু জানো, আমি সবসময় এমন ছিলাম না। এমন একদিন ছিল, যেদিন পদ্মার ওপারে বসে শাঁখ-ঘণ্টার শব্দ ভেসে আসত, আকাশের মেঘগুলো মুহূর্তে মুহূর্তে রং বদলাত। কিন্তু তারপর? এক মুহূর্তে সর্বস্বান্ত হয়ে গেলাম আমরা।’ একদিন বাবা মারা গেলেন ভিখিরির মতো মা একরকম না খেতে পেয়েই শেষ হয়ে গেলেন চোখের সামনে। মরার ঠিক আগেই বাবা বলেছিলেন, জীবনটাকে আরম্ভ করেছিলাম কী নির্মল ছন্দে, এইভাবে শেষ হয়ে যাওয়াটা কি উচিৎ? সেদিন থেকে আমি কেমন যেন হয়ে গেলাম! কী ভীষণ একা হয়ে গেছি, তুমি জানো না!’ ভৃগুের কথাগুলো শুনে অনুসূয়াও বলে ফেলে-‘ভৃগু, আমিও বড় একা।’

তাদের কথোপকথনে বাংলা ভাগের যে স্মৃতি উঠে আসে তা এই নির্মমতাকে কেউ মেনে নিতে পাড়ে না। বাংলা ভাগ শুধু ভূখণ্ড দ্বি-খন্ডিত নয় নিজেদের বোধ, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে আঘাত করা। এটা উপর মহলের বসে যারা বিভাজনের রাজনীতি থেকে সুবিধা নিয়েছে তারা কিছুতে বুঝে না। একটি পরাধীন বাংলায় পরিণত হয়েছে কলকাতা। যেখানে শাসন চালায় ভিন্ন সংস্কৃতির শাসক। 

নাট্যদল বাংলাভাগের প্রতিচ্ছবি:

কোমল গান্ধার চলচ্চিত্রটি মূলত একটি নাট্য দলকে কেন্দ্র করে তৈরি। যে দলটি ভেঙ্গে দুই ভাগ হয়েছিলো। পুনরায় একসাথে কাজ করতে গিয়েও করতে পারেনি। কারণ মতের পার্থক্য, হিংসা, ষড়যন্ত্র ইত্যাদি গ্রাস করেছিলো কিছু কর্মীর মধ্যে। এটা দিয়ে ঋত্বিক বাংলা ভাগের চিত্র তুলে ধরেছেন। কিছু মানুষের সুবিধা, ইচ্ছা, লোভের কারণে একই ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি চিন্তাধারার জাতিকে ভেঙ্গে দ্বিখন্ডিত করে ফেলা হয়েছে। এরফলে যে শুধু উদ্বাস্ত বেড়েছে কলকাতায় সেটা নয়। অনেক ঘর পুড়েছে, হত্যা, ধর্ষন, রক্তের হলি খেলায় মেতেছিলো নিজেদের লোকগুলোই। একটু সচেতন ব্যক্তি মাত্রই মেনে নিতে পারে না বিষয়টা। 

কোমল গান্ধারে দেখা যায় নাট্যদলের মাঝে যখন দ্বিতীয়বার সমস্যা তৈরি হয় সেই সময় অনুসূয়া চেষ্টা করে একত্রিত করার। নানা জনের নানা আচরনে ব্যথিত হওয়ার পরেও দল ছেড়ে যেতে পারে না অনেকেই। কলকাতা জুড়ে বাংলা ভাগের ফলে সৃষ্ট সংকটের কারণে নানা অভাব অভিযোগ নিয়ে মিছিল হয়; সেই সময় একটি ছোট বালক পিছন থেকে অনুসূয়া শাড়ির আঁচল টেলে ধরে খেতে চায় তখন প্রকাশ পায় মায়ের কাছে সন্তানের চাওয়া। এই চাওয়া নিজের স্বদেশের প্রতি সন্তাদের। নিজের ভুমিকে আবার সুন্দর করে সাজানোর আকুতি। 

রাজনীতির কারণে ইতিহাসে যে নতুন অধ্যায় সৃষ্টি হয়েছে সেটা তো এখন পাল্টানো সম্ভব না; কিন্তু সাংস্কৃতিকভাবে মেলবন্ধন রাখা সম্ভব। কোমল গান্ধারে সেটাই ঋত্বক ঘটক দেখাতে চেয়েছে। চলচ্চিত্র সম্পর্কে বলতে গিয়ে একটি লেখায় বলেছেন- ‘এ ছবির দর্শকদের কাছ থেকে একটি এপিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রার্থনীয় – সে দৃষ্টিভঙ্গি এদেশে এখনও একটি প্রাণবন্ত ঐতিহ্যরূপে বিরাজমান।’[২] আশাবাদী হয়ে তিনি অনেক কিছু সৃষ্টি করতে চেয়েছে। নিজেদের আকুতিকে অন্যের কাছে পৌঁছাতে হবে। অন্যের মাঝেও আকুতি, অতৃপ্তিকে জাগাতে পারলেই সৃষ্টি সার্থক হবে। সভ্যতা নির্মানের দিকে এগিয়ে যাবে তারা। 

তথ্যসূত্র:

১. দোলন প্রভা, ২৭ জুলাই, ২০২০, “অযান্ত্রিক চলচ্চিত্র মানুষ ও যন্ত্রের মধ্যকার দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের প্রকাশ”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএলঃ https://www.roddure.com/art/komal-gandhar/

২. শিবাদিত্য দাশগুপ্ত ও সন্দীপন ভট্টাচার্য সম্পাদিতঃ সাক্ষাৎ ঋত্বি, দীপায়ন, কলকাতা, প্রথম  প্রকাশ ২০০০, পৃষ্ঠা, ৬২।

৩. ঋত্বিক কুমার ঘটক, চলচ্চিত্র মানুষ এবং আরো কিছু, “শিল্প ও সততা” দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, পুনর্মুদ্রণ নভেম্বর ২০১৫, পৃষ্ঠা, ১৪২-১৪৩।

Leave a Comment

error: Content is protected !!