লেনিনের বই রাশিয়ায় পুঁজিবাদের বিকাশ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা

রাশিয়ায় পুঁজিবাদের বিকাশ (রুশ: Развитие капитализма в России) হচ্ছে ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন লিখিত ১৮৯৯ সালে প্রকাশিত একটি বই। বইটি লেনিনের নির্বাসনকালে লেখা হয় এবং লেনিন এই কাজ তিন বছরের অধিককাল ধরে চালান।[১]

বিপ্লবী ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনকে ১৮৯৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি সাইবেরিয়ায় তিন বছরের জন্য নির্বাসনের দণ্ডাজ্ঞা দেয়া হয়। ১৮৯৭ সালের মে মাসে তিনি মিনুসিনস্ক গ্রামে এসে পৌঁছেন। এখানেই লেনিন লিখে শেষ করেন রাশিয়ায় পুঁজিবাদের বিকাশ গ্রন্থ যা ১৮৯৯ সালে প্রকাশিত হয়। এটি হলও রাশিয়ার অর্থনৈতিক বিকাশ নিয়ে একটি বৃহত বৈজ্ঞানিক গবেষণা, যা সরাসরি কার্ল মার্কসের পুঁজি বইটির পূর্বানুসরণ।

রাশিয়ায় পুঁজিবাদের বিকাশ বইয়ে রাশিয়ার অর্থনীতি বিশ্লেষণ করে লেনিন নতুন প্রতিপাদ্যে মার্কসীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেন। বাস্তব তথ্যের ভিত্তিতে তিনি দেখান যে রাশিয়ায় পুঁজিবাদ শুধু শিল্পে নয়, কৃষিতেও জোরদার হচ্ছে। এই বইয়ের মাধ্যমে মূলত নারোদবাদের পরাজয় ও পরিপূর্ণ সমাধি রচিত হয়। এই বইয়ের ভেতর দিয়ে লেনিন পুঁজিবাদী সমাজের অন্তর্নিহিত গভীরতম বিরোধগুলি উদ্ঘাটন করে দেখান। এতে তিনি দেখান কীভাবে পুঁজিবাদী সমাজের গর্ভে বেড়ে উঠছে ও শক্তি সঞ্চয় করছে শ্রমিক শ্রেণি, যেই শ্রমিক শ্রেণি পুঁজিবাদের গোরখোদক ও নতুন সমাজতান্ত্রিক সমাজের স্রষ্টা। এই গ্রন্থে দেখানো হয় সমাজতন্ত্রীদের নেতৃত্বকারী ঐতিহাসিক ভূমিকার কথা। লেনিন এই গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় জুলাই ১৯০৭-এ লেখেন,

“ প্রতিবিপ্লবী বুর্জোয়া ও বিপ্লবী প্রলেতারিয়েতের মধ্যে হতদরিদ্র ক্ষুদে মালিকের দোদুল্যমানতা প্রতিটি পুঁজিবাদী সমাজে বিদ্যমান ঘটনার মতোই অবশ্যম্ভাবী, যেখানে ক্ষুদে উৎপাদকদের নগণ্য সংখ্যালঘিষ্ঠ একটি অংশ ধনী হয়ে ওঠে, “দুনিয়ায় সদম্ভে বিচরণ করে,” বুর্জোয়ায় পরিণত হয়, পক্ষান্তরে সুবিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠরা হয়তোবা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে পরিণত হয় মজুরি শ্রমিক অথবা নিঃস্ব ভিখারীতে, কিংবা প্রায়-প্রলেতারিয় অস্তিত্ব বয়ে নিয়ে চলে অনন্তকালব্যাপী। কৃষক সমাজের মধ্যে এই উভয়বিধ ঝোঁকের অর্থনৈতিক ভিত্তি প্রকটিত হয়েছে বর্তমান এ গ্রন্থটিতে।

এই অর্থনৈতিক ভিত্তি নিয়ে রাশিয়ায় বিপ্লব, অবশ্য, অনিবার্যভাবেই হবে একটি বুর্জোয়া বিপ্লব। এই মার্কসবাদী প্রতিজ্ঞা নিঃসন্দেহে অখণ্ডনীয়। এটা অবশ্যই কখনো ভুলে গেলে চলবে না। এটা অবশ্যই সর্বদা প্রয়োগ করতে হবে রুশ বিপ্লবের সকল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যার ক্ষেত্রে।

কিন্তু এটাকে কীভাবে প্রয়োগ করা যায় তা অবশ্যই জানতে হবে। বিভিন্ন শ্রেণির অবস্থান ও স্বার্থের একটি বাস্তব বিশ্লেষণ এই সত্যের সুনির্দিষ্ট তাৎপর্য নির্ধারণের উপায়রূপে অবশ্যই কাজ করবে যখন তা প্রযুক্ত হবে কোনো না কোনো সমস্যার ক্ষেত্রে। প্লেখানভের নেতৃত্বাধীন দক্ষিণপন্থী সোশ্যাল ডেমোক্রাটদের মধ্যে প্রায়শই এর বিপরীত যুক্তি প্রণালীর, অর্থাৎ আমাদের বিপ্লবের মূল চরিত্র সম্পর্কিত সাধারণ সত্যটির সরল যৌক্তিক বিকাশের মধ্যে বাস্তব প্রশ্নাদির উত্তর খুঁজে বেড়ানোর প্রচেষ্টার মুখোমুখি হতে হয়, যা আদতে হচ্ছে মার্কসবাদেরই ইতরীকরণ এবং দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের ডাহা উপহাস। যারা এই বিপ্লবের চরিত্রের সাধারণ সত্য থেকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, উপমাস্বরূপ, বিপ্লবে বুর্জোয়ার রয়েছে নেতৃত্ব প্রদানকারীর ভূমিকা অথবা সমাজতন্ত্রীদের উচিত উদারনৈতিকদেরকে সমর্থন করা তাদের সম্পর্কে মার্কস খুব সম্ভবত সেই কথাগুলিরই পুনরাবৃত্তি করতেন যা তিনি একদা উদ্ধৃত করেছিলেন হাইনের রচনা থেকে: আমি বপন করেছিলাম ড্রাগনের দাঁত আর ফসল পেলাম রক্তপায়ী পক্ষহীন কীট”।[২]

রাশিয়ায় সাধারণ জনসংখ্যার মধ্যে শ্রমিক শ্রেণীর সংখ্যাল্পতা সত্ত্বেও লেনিন তাদের মধ্যেই এক মহা শক্তিকে দেখতে পেয়েছিলেন, এবং বিপ্লবী আন্দোলনে এই শ্রেণির নেতৃ-ভূমিকা তিনি প্রতিপন্ন করে যান। সেই সঙ্গে লেনিন প্রলেতারিয়েতের সঙ্গে কৃষক সম্প্রদায়ের ঐক্যের আবশ্যিকতার উপর জোর দেন, এ ছাড়া আসন্ন বিপ্লবে জয়লাভ অসম্ভব। মার্কসীয় সাহিত্যে সর্বপ্রথম এই বইতেই পুঁজিবাদের আমলে কৃষকদের অবস্থা নিয়ে গবেষণা করা হয় এবং শ্রমিক ও কৃষকের মধ্যে জোটের জন্য এক গভীর অর্থনীতিভিত্তিক মতবাদ উত্থাপন করা হয়। বৈজ্ঞানিকভাবে প্রলেতারীয় পার্টির তত্ত্ব, কর্মসচি ও রণকৌশল রচনায় বইটির অবদান বৃহৎ। অগ্রণী বুদ্ধিজীবী, শিক্ষার্থী ছাত্র, শ্রমিক চক্রের সদস্যদের মধ্যে বইটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। মার্কসবাদী কর্মীদের ভাবাদর্শগত ও তত্ত্বগত লালনে বইটির ভূমিকা বিপুল।

 লেনিন বরাবরই মার্কসবাদকে দেখতেন একটা জীবন্ত, বিকাশমান মতবাদ হিসাবে, তাকে শুধু ব্যবহারিক ক্রিয়াকলাপে প্রয়োগ করতে পারাই নয়, আরো বিকশিত করে তোলাও দরকার। নির্বাসনে তাঁর একটি রচনায় তিনি লিখেছিলেন, “আমরা মার্কসের তত্ত্বকে পরিসমাপ্ত ও স্পর্শাতীত কিছু একটা বলে দেখি না, উল্টে বরং আমরা এই বিশ্বাস করি যে তা শুধু এমন একটা বিজ্ঞানের ভিত্তিপ্রস্তর পেতেছে, জীবন থেকে পিছিয়ে পড়তে না হলে যাকে সব দিক দিয়ে আরো বিকশিত করতে হবে সমাজতন্ত্রীদের। মার্কসীয় তত্ত্বের প্রতি এই ধরনের সজনমূলক মনোভাব ভাদিমির ইলিচের সমগ্র ভবিষ্যৎ ক্রিয়াকলাপেরই বৈশিষ্ট্য।[৩]

তথ্যসূত্র

১. অনুপ সাদি, ২৭ ডিসেম্বর ২০২০, “রাশিয়ায় পুঁজিবাদের বিকাশ প্রসঙ্গে”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/book/development-of-capitalism-in-russia/
২. ভি. আই. লেনিন, জুলাই ১৯০৭, দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা, রাশিয়ায় পুঁজিবাদের বিকাশ, দাউদ হোসেন অনূদিত, সংঘ প্রকাশন, ঢাকা, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০০৪, পৃষ্ঠা ৩৫-৩৬।
৩. গ. দ. অবিচকিন ও অন্যান্য; ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন, সংক্ষিপ্ত জীবনী; প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৭১, পৃষ্ঠা ৩৮-৩৯

Leave a Comment

error: Content is protected !!