বাড়ি থেকে পালিয়ে: কলকাতার ভঙ্গুর অর্থনীতি ও উদ্বাস্তুর করুণ চিত্রের প্রতিফলন

ঋত্বিক ঘটক চলচ্চিত্র করেছেন জনগণের জন্য; সেটা যে স্তরেরই হোক না কেন। এরমাধ্যমে তিনি নিজের চিন্তাকে প্রবাহিত করেছেন। যেকোনো শিল্পী নিজের শিল্প দিয়ে সমাজের অসঙ্গতিকে তুলে ধরেন ও নিজের দর্শনের বহিঃপ্রকাশ করেন। এই ক্ষেত্রে শিল্পীকে নিজের সৃষ্টির জায়গাতে সৎ, নিষ্ঠাবান, দায়িত্বশীল হতে হয়। ঋত্বিক সম্পর্কে আমরা আমরা যতই খামখেয়ালীর অভিযোগ শুনিনা কেন! কাজের ক্ষেত্র ছিলেন দায়িত্বশীন। উনি দেখতে ও কথা বলার ক্ষেত্রে খুবই অগোসালো। কিন্তু চিত্র বা ঘটনাকে ক্যামেরা বন্ধি করার সময় সবচেয়ে সুন্দর, বাস্তব, সত্যকে তুলে ধরার চেষ্টা করেন। চলচ্চিত্রের ক্যামেরাকে তিনি এমন এক বস্তু মনে করতেন, যার ব্যবহার সম্পর্কে জানলে সমাজে বিশাল আলোড়ন সৃষ্টি করা যায়। ঋত্বিক নিজের এক লেখায় বলেছিলেন-

ছবি করার গোড়ার শর্ত হচ্ছে সততা। নিজের অনুভূতি এবং উপলব্ধির সৎপ্রকাশ। ক্যামেরায় যে মিথ্যা কথা বলার মারাত্মক ক্ষমতা আছে, তা রীতিমতো ভীতিকর। কারণ মিথ্যাকে সত্য বলে চালাতে ক্যামেরা যত পারে তত আর কিছুই পারে না।[১]

তিনি যেই সময় থেকে চলচ্চিত্র পরিচালনা শুরু করেছিলেন সেই সময় বাংলা ছিলো দ্বি-খন্ডিত। তাই খন্ডিত স্বাধীনতা পেয়ে বাংলা কি পেয়েছে সেই সত্যকে তুলে ধরেছেন চলচ্চিত্রে। 

ঋত্বিক ঘটকের ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ ছিলো বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র। যদিও সেটা সফল ছিলো না। শিবরাম চক্রবর্তীর গল্প অবলম্বনে ঋত্বিকের এই চলচ্চিত্র মুক্তি পায় ১৯৫৯ সালে। তিনি চলচ্চিত্রের বেশ কিছু অংশ পরিবর্তন করে নিজের চিন্তা ও সমাজের বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। বাস্তববাদী চিন্তার কারণে কাল্পনিকতার কোনো আশ্রয় দিতেন না।

বাড়ি থেকে পালিয়ে-এর কাহিনী সংক্ষেপ:

ছবিতে প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করেন শ্রীমান পরমভট্টারক লাহিড়ী, কালী বন্দোপাধ্যায়, নৃপতি চট্টোপাধ্যায়, পদ্মা দেবী ও জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়সহ অনেকে। চলচ্চিত্রের গল্পে দেখা যায়, প্রধান চরিত্র কাঞ্চন চঞ্চল, দুরন্ত, অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় কিশোর। সে স্কুলের বইয়ের আড়ালে লুকিয়ে নানা গল্পের বই পড়ে। তার এই সমস্ত ব্যপার মেনে নেয় মা। তার কিন্তু বাবা ভীষণ কড়া মেজাজ ছিলো। বাবাকে সে তুলনা করে এক অত্যাচারী দৈত্যের সঙ্গে। বাবার শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে কাঞ্চন একদিন সিদ্ধান্ত নেয় বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবে। কাঞ্চন বাড়ি থেকে পালিয়ে তার স্বপ্নের শহর কলকাতায় যায়। 

এরপরে জীবন সম্পর্কে বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে থাকে। এখানে কাঞ্চনের সঙ্গে পরিচয় ঘটে চানাচুর ভাজাওয়ালা হরিদাস, জাদুকর, গৃহ পরিচারিকা মা, কনক নামে এক বালিকা ও তার পরিবার, বোবা ভিক্ষুক ছেলে, চোর এবং আরও অনেক নিম্নআয়ের মানুষের সঙ্গে। সবার কাছ থেকে শিক্ষা নিতে থাকে। সেইসব মানুষগুলো নানান উপায়ে কংক্রিটের শহরে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করে। এই চলচ্চিত্রের যাদের সাথেই কাঞ্চনের দেখা হয় তারা সবাই দেশ ভাগের ফলে নিজেদের গৃহ এবং পরিচয় হারিয়ে ফেলা উদ্বাস্তু হয়ে গিয়েছে। তাদের অভিজ্ঞতাগুলো কাঞ্চনের কাছে খুবই বিচিত্রপুর্ণ সব ঘটনা। 

একপাশে কলকাতা শহরের গড়ে ওঠা গগনচুম্বী ইমারত, হাওড়া ব্রিজ অন্যপাশে গৃহহারা উদ্বাস্তুদের বাঁচার লড়ায়। তার কাছে অবাক লেগেছে একদিকে অনেক মানুষের অপ্রযোজনীয় পানভোজন অন্যদিকে দেখে খাবার নিয়ে কুকুর ও মানুষের লড়াই। ছেলের চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েন কাঞ্চনের মা, বাবা তাকে খুঁজে পাওয়ার জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেন। কাঞ্চনও সিদ্ধান্ত নেয় বাড়ি ফিরে যাওয়ার। তার এই সিদ্ধান্তেই অবসান হয় তার সাহসী অভিযানের।[২] 

মনস্তাত্ত্বিক বিষয়:

আমরা জানি শিল্পী সমাজেরই এক অনন্য ব্যক্তিত্ব; এবং তার চিত্ত উদ্যানে সমাজের তাৎপর্য, যুগের যাতনা একজন সাধারণ মানুষের বিচারে অনেক বেশি সক্রিয়। আর এই সক্রিয়রূপের সত্য-সৌন্দর্য প্রকাশই তো শিল্প। এমনকি শিল্পাঙ্গিকের অমোঘ-শৈলী ফ্যান্টাসি বা কৌতুক নকশার যে অবতারণা তাতেও দেখি জীবন গভীরতার অপূর্ব আর্তি। আর ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ ছবিতে কাঞ্চনের দৃষ্টি-গভীরতার তাৎপর্য যে কিছুতেই অস্বীকার করার নয় তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছবির আদি এবং অন্তিম মুহূর্ত।[৩]

বাড়ি থেকে পালিয়ে চলচ্চিতের একটি প্রধান বার্তা হলো, শিশুর মনস্তত্ত্ব বোঝার প্রতি গুরুত্বারোপ করা। শুধু শাসন নয়, স্নেহ এবং ভালোবাসা দিয়ে সুখী এবং সুন্দর পরিবার তথা সমাজ গঠন করা যায়; সেই দিক তুলে ধরা। কাঞ্চন নিজের বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে আত্নীয়হীন শহর কলকাতায় স্বজন খুঁজেছিলো; কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে উপলব্ধি করলো ‘বাড়িই ভালো’। এই অভিজ্ঞতা তাকে পরিপূর্ণ মানুষ করে তোলে। ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারে তার বাবা মোটেও দৈত্য নন; বরং তিনি দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রামরত এক স্নেহময় বাবা।

চলচ্চিত্রে শিশু মানে ভবিষৎ প্রজন্ম। তাদের আগামী কি হবে বা কি করতে হবে? যেটা বুঝানোর জন্য পুস্তকের জ্ঞান থেকে বাস্তবে নামাতে হবে। ঋত্বিক সেটাই করেছেন। রবীন্দ্রনাথ তার ‘ফটিক’ ছোটগল্পে বয়স:সন্ধিকালের মানসিকতা তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু জীবন যুদ্ধে নামাতে পারেন নি। কাঞ্চনকে সেটা করা হয়েছে। সে বাড়িতে নিজের মতো অনেক কাজ করতে পারতো; কিন্তু বাবার কথার মানে বুঝতো না। যখন কলকাতায় এসে মানুষের জীবনের বৈচিত্র দেখলো তখন বাবার কথার অর্থ খুঁজে পেতে থাকলো। বাবার মুখে শুনতো ‘বিলাসিতা’ শব্দটি; কাঞ্চন মনে করতো বাবা মনে হয় তার আনন্দকে মেরে ফেলতে চাচ্ছে। কিন্তু কলকাতায় এসে দেখে এক শ্রেণির বিলাসিতা, অপ্রযোজনীত অপচয়ের ফলে অন্য শ্রেণির মানুষ বাঁচার সাধারণ চাহিদা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বয়স:সন্ধিকালে শিশুদের সমাজ বাস্তবতার অভিজ্ঞতার স্বশরীরে নিতে হয় অনেকাংশেই। কাঞ্চন এক পর্যায়ে বুঝতে পারে তার পায়ের নিচের মাটি আর নিজের মতো করে থাকছে না। বাড়ি, মা, পড়ার বই, ছোটবেলায় বেড়ে ঔঠা পরিবেশের কথা খুব মনে পড়তে থাকে। 

উদ্বাস্তু কলকাতার করুণ চিত্র:

কাঞ্চন বাড়ি থেকে পালিয়ে নিজে নিজেই উদ্বাস্তু হয়েছিলো। সে জানতো না দেশের কি অবস্থা! কলকাতায় এসে যাদের সাথে মিশছিলো তারা সবাই ছিলো উদ্বাস্তু। বাংলা দুই ভাগ হয়েছে, কলকাতার অর্থনীতির এমন করুণ পরিস্থিতি যে কেউ কাউকে চুল পরিমান জায়গা ছেড়ে দেয় না। ব্যক্তির আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা, মমতার কোনো মূল্য নেই। মানুষের সাথে বিক্রি হয়ে যায় বোধ, বিবেক, মর্যাদা। দুই বাংলা থেকে মানুষের স্থানান্তর পাল্টে দেয় সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি। ক্ষুধা থেকে বাঁচার জন্য বোবা সেজে অন্যের সহানুভুতি নিতে হয়। একই খাবার ভাগ করে খেতে হয় কুকুর ও মানুষের। সং সেজে অন্যের মনোরঞ্জন করে জীবিকা উপার্জন করতে হয়। 

উদ্বাস্তু কলোনিগুলোতে অভাব, দৈন্য, মৃত্যু সবসময় ওঁত পেতে থাকে। কাঞ্চনের বাবা সেই সময়ে দেশের অবস্থা জানতো তাই পরিবারের সাথে রুক্ষ আচরন করতো; কিন্তু কাঞ্চনের বাস্তব জ্ঞান না থাকায় তার কল্পনায় সুখের আবেশ ছিলো। বইয়ের যে অভিযানের গল্প পড়েছে সেটার সাথে বাস্তবের কোনো মিল নেই। বর্তমান কলকাতা তার চোখ খুলে দেয়। উদ্বাস্তুরা নিজের ভিটে ছেড়ে ভিনদেশে এসে যাযাবর, ভিখিরী, ভাসমান কচুরিপানার মতো জীবন যাপন করতে থাকে। সেটাই প্রজন্মকে উপলব্ধি করানোর জন্য কাঞ্চনকে বাড়ি থেকে পথে নামান লেখক, পরিচালক উভয়।

উপন্যাস থেকে বাড়ি থেকে পালিয়ে চলচ্চিত্রের কাহিনীর মধ্যে পার্থক্য শেষের অংশে। উপন্যাসের কাঞ্চন যখন সিদ্ধান্ত নেয় সে বাড়ি ফিরে যাব তখন সে মায়ের জন্য নানা জিনিস ও টাকা নিয়ে যায়। কারণ শহরে আসার পড়ে সে লিটারিতে টাকা পেয়েছিলো। কিন্তু চলচ্চিত্রের কাঞ্চন শুধু একটি মুখোশ নিয়ে ফেরে।[২] আমরা যদি কাহিনীর মাঝে এই পার্থক্যকে সাধারণ হিসাবে দেখি তাহলে ভুল বিশ্লেষণ হবে। একটু চিন্তা করলে দেখা যাবে, এই কাহিনী যেই সময়ে লেখা সেই সময়ে উদ্বাস্তু সংকট চলছে কলকাতা জুড়ে। তখন লটারি পাওয়া তাও ছোট একটি ছেলের ক্ষেত্রে সেটা অতিরঞ্জন বা কাল্পনিক। সেই দিকটাকে ঋত্বিক বাস্তবতার ছাঁচে ফেলেছেন। কলকাতা জুড়ে অর্থনৈতিক বিশাল পরিবর্তন চলছে; যেখানে মানুষ অনেক কিছু না দেখার ভান করছে বা নিজেকে দায়িত্ব থেকে অড়াল করতে মুখোশ পড়তে হচ্ছে। এটাই হচ্ছে চলচ্চিত্রের মহত্ব। 

ঋত্বিক চলচ্চিত্র পরিচালক হিসাবে তার প্রায় লেখাতে লিখেছে ‘সততা, দায়িত্ব, সৎ, নিষ্ঠা’ ইত্যাদি শব্দ। এটার অর্থ হচ্ছে শিল্পর চোখ সাধারনের থেকে আলাদা হতে হয়। নিজের সৃষ্টিকে বিপুল মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাইলে সচেতন হতে হয় সঙ্গে নিজের দায়িত্ব বুঝতে হয়। সাধারণ মানুষ স্রোতে গা ভাসাতে চায় কিন্তু শিল্পীর কাজ সেই সব মানুষকে ভাবতে শেখানো। এটাই শিল্পের দায়িত্বের জায়গা। 

তথ্যসূত্র:

১. ঋত্বিক কুমার ঘটক, চলচ্চিত্র মানুষ এবং আরো কিছু, “শিল্প ও সততা”দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, পুনর্মুদ্রণ নভেম্বর ২০১৫, পৃষ্ঠা, ৯১-৯৩।

২. দোলন প্রভা, ২২ জুলাই, ২০২০, “বাড়ি থেকে পালিয়ে: কলকাতার ভঙ্গুর অর্থনীতি ও উদ্বাস্তুর করুণ চিত্র”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএলঃ https://www.roddure.com/art/bari-theke-paliye/

৩. আনোয়ার হোসেন পিন্টু, সাজেদুল আউয়াল সম্পাদিত, ঋত্বিকমঙ্গল, “ঋত্বিক-চলচ্চিত্রে শিশুর ভূমিকা” বাংলা একাডেমী, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ জুন ২০০১, পৃষ্ঠা, ২৬১-২৬৯।

Leave a Comment

error: Content is protected !!