তিতাস একটি নদীর নাম: সামন্তীয় চিন্তার ভাঙ্গন, নগরায়ন ও অন্যান্য

১৯৭৩ সালে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ মুক্তি পাওয়ার পড়ে দর্শকের সামনে যে চলচ্চিত্র এসেছে তা দেখে অনেকে বিমোহিত হয়েছিলো; আবার নানা সমালোচনার ঝড়ও উঠেছিলো। নানা সমালোচনা মূলক লেখার জবাবে  ঋত্বিক ঘটক (৪ নভেম্বর, ১৯২৫ – ৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৬) এই চলচ্চিত্রটি সম্পর্কে বলেছেন ‘আমি ছাড়া তিতাস সৃষ্টি হতো না। তিতাস ছিল আমার স্বপ্ন। আমার মতো মমতা দিয়ে এ কাহিনীকে কেউ তুলে ধরতে আগ্রহী হতেন না।’[১] এই কথা বলার যথেষ্ট কারণও ছিলো। তবে আমরা যখন কোনো কিছু নিয়ে সমালোচনা করবো তখন বিষয়টির খন্ড খন্ড ভাবে যেমন দেখব তেমনি সামগ্রিকভাবেও ভাবতে ও দেখতে হবে। ১৯৭৩ সাল থেকে আজ অব্দি ‘তিতাস’ চলচ্চিত্রটি দর্শকে  বিমুগ্ধ, মোহিত, পুলকিত করতে পেরেছে তার পুর্বে কিছু ইতিহাস আছে। সেই বিষয় জানা থাকলে আমাদের বুঝতে সুবিধা হবে; কীভাবে ঋত্বিক এই চলচ্চিত্রটিকে বাস্তব ও প্রাণবন্ত করতে পেড়েছে।[১] 

তিতাস একটি নদীর নাম চলচ্চিত্রটির প্রযোজক হাবিবুর রহমান খান। তার প্রযোজনা জীবন শুরু হয় তিতাস চলচ্চিত্রের মধ্যে দিয়ে। পরিচালক হিসাবে ঋত্বিক ঘটককে বেছে নিয়েছে, কারণ হাবিবুর রহমান ছাত্রজীবন থেকেই  ঋত্বিকের বিভিন্ন লেখা পড়ে বুঝতে পেরেছিলেন তিনিই উপমহাদেশের শ্রেষ্ট পরিচালক। ১৯৭২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি গায়ক শ্যামল মিত্র ও বরুণ বকশীর সাথে আলাপ হয়। ঋত্বিকের চলচ্চিত্র পরিচালনা সম্পর্কে নেতিবাচক কথা শ্যামল মিত্রের কাছে শুনেও চ্যালেঞ্জ হিসাবে নেন তিনি। বরুণ বকশীর মাধ্যমে ঋত্বিকের সাথে আলাপ হয়।  হাবিবুর রহমান ঋত্বিক ঘটকে বলেন ‘বাংলাদেশের রূপ যথার্থ ফুটে উঠবে’[২] এমন ছবি বানাতে চান তিনি। দুজনের আলোচনা সাপেক্ষে নির্বাচিত হয় অদ্বৈত মল্লবর্মের  উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম

নদী কেন্দ্রিক জীবনী নিয়ে বেশ কিছু গল্প, উপন্যাস লেখা হয়েছে বাংলা সাহিত্যে; বিশেষ করে মানিকের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’। কিন্তু কেন এই উপন্যাস বেছে নিলেন? চিত্রালী সাপ্তাহিক পত্রিকার এমন প্রশ্নের উত্তরে ঋত্বিক বলেছিলেন- ‘কাহিনীর এই সততা এবং আন্তরিকতাই আমাকে আকৃষ্ট করেছে’।[৩]  জেলেদের জীবন চিত্র, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আশা-আকাক্ষা অদ্বৈত মল্লবর্মণ (১জানুয়ারি, ১৯১৪- ১৬ এপ্রিল, ১৯৫১) যেভাবে তুলে ধরেছেন এমনটা অন্য কেউ পারে নি। কারণ অন্য যারা লিখেছেন তারা কেউই জেলে পরিবারের ছিলো না। অদ্বৈত জেলে পরিবারের ছেলে ছিলেন। সাংবাদিকতা করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন।

১৯৪৭-৪৮ সালের দিকে কলকাতার এক খালাসী পাড়ায় বাস শুরু করেছিলেন। সে সময় কলকাতার আশেপাশে জেলে পাড়াতে অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে এসেছিলো। জেলেরা কাজ না পেয়ে অন্নের অভাবে অনাহারে থাকত। সেই সময় অদ্বৈত মল্লবর্মণ  তাদেরকে সাহায্য করার জন্য বেশ কয়েকটি চাকরিতে কাজ করতে শুরু করলেন। তা থেকে যে অর্থ পেতেন সেই সব বিলিয়ে দিতেন জেলেদের মাঝে। তবে সেটা ছিলো সামান্য তাই  এক বন্ধুর পরামর্শ বই লেখা শুরু করলেন; কারণ বই লেখে বেশি অর্থ পাওয়া যেতো সেই সময়। লেখার জন্য উপজীব্য হিসাবে নিলেন জেলে জীবনের কাহিনী। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ (১৯৫৬) সেই প্রচেষ্টার ফসল। তবে এই বইয়ের পাণ্ডুলিপি নিয়ে যেদিন তিনি প্রকাশকের কাছে যাচ্ছিলেন সেদিন মনের ভুলে সেটা দোতলা বাসে রেখে দিয়ে বাস থেকে নেমে পড়লেন। সেজন্য পুনরাই দীর্ঘ দিনের পরিশ্রমে দ্বিতীয় বারের লেখাও সমাপ্ত করলেন।  অবশ্য বইটি প্রকাশিত হয় অদ্বৈত মল্লবর্মের মৃত্যুর পড়ে। কারণ বইটি প্রকাশকের কাছে দেবার পরই আক্রান্ত হলেন যক্ষ্মায়।  বই প্রকাশ পরে প্রচণ্ড সাড়া পড়ে।

উপন্যাসটি পড়ার পড়ে ঋত্বিক ঘটকে বেশ নাড়া দেয়। তবে ‘তিতাস তৈরির আগে প্রায় ১০ বছর সময় ধরে ঋত্বিক কোনো ছবি করতে পারেননি’।[২] ভীষণ খামখেয়ালী, অগোছানো এই মানুষটি তিতাস ছবিটির কাজ শেষ করতে পারবে বলে অনেকেই ধারণা ছিলও না। তবে শেষ পর্যন্ত এক বছর কাজ করার পড়ে চলচ্চিত্রের শুটিং শেষ হয় এবং মুক্তি পাওয়ার আগেই ঋত্বিক অসুস্থ হয়ে যান। 

এই চলচ্চিত্রের পটভূমি গড়ে উঠেছে তিতাসের তীরবর্তী একটি জেলে গ্রামের কাহিনী নিয়ে। তিতাস একটি বহমান নদী। তার তীরবর্তী গ্রামের জেলেদের ভাগ্য তিতাসের সঙ্গে জড়িত। অতীতে  নদীকে কেন্দ্র করে যেমন সভ্যতা গড়ে ওঠেছিল তেমনি এই তিতাসকে কেন্দ্র করেও উঠেছে একটা মালো বসতি, একটা সংস্কৃতি। প্রকৃতির নিয়মে ধীরে ধীরে তিতাস একদিন শীর্ণ হয়ে গেলো। জেলেদের জীবনে নেমে এলো অর্থনৈতিক বিপর্যয়। এই অর্থনৈতিক সংকটকের কারণে মানুষের  যে দুর্দশা তৈরি হয় সেটা বুঝা খুব দরকার। তা না হলে দুঃখকে শুধুই আবেগের সাথে মিলিয়ে দর্শকও কাঁদবে; কিন্তু চলচ্চিত্রের আবেদন বুঝতে পারবে না।  

একপর্যায়ে দেখা যায় তিতাসের তীরে গড়ে উঠেছিলো যে মালো বসতি, নদী শুকিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে সেটাও ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যেতে লাগলো। নদী শুকানোর পড়ে চর জেগে উঠবে এটা স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু সে চরের জন্য যখন রাজনীতি শুরু হয় তখন নদীকেন্দ্রিক মানুষগুলোর জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। কারণ সাধারন চোখে চর নিয়ে রাজনীতির জটিলতা বুঝা কঠিন। তিতাসের বুকে জেগে ওঠা সেই চরের দিকে লোলুপ দৃষ্টি পড়ে পুঁজিপতি ভূস্বামীদের। জেলে পরিবারগুলোর ঐক্যতাকে ভাঙ্গার জন্য নানা ফন্দি ফিকির করতে থাকে। তারা চক্রান্ত করে জেলেদের সেখান থেকে উৎখাত করে চর দখল করাতে চায়। এজন্য মহাজনরা ভন্ড নীতিবান সেজে জেলেদের অভাবের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে টাকার লোভ দেখায়। এই ফাঁদে যে জেলেরা পড়ে, তারা ডিঙ্গি ভাসিয়ে বহুদূরে মাছ ধরতে যায় এবং বাবুদের গুণ গানও গায়। এভাবে ধীরে ধীরে জেলেদের ঐক্যে ফাটল ধরে। 

একপর্যায়ে মহাজনদের চক্রান্তে সাথে পরাজিত হয়ে অনেকে গ্রাম ছেড়ে বহু দূরে চলে যায়। তিতাস মরে যাওয়ার সাথে সাথে তার তীরবর্তী গ্রামের জীবন ব্যবস্থাও নিশ্চল হতে থাকে।

পরিবর্তনের ধারায় তিতাস কেন্দ্রিক মালো পাড়া নিশ্চিহ্ন হতে থাকে। এটাকে দ্বান্দ্বিকভাবে দেখলে বলা যায়, এক সমাজ থেকে অন্য সমাজে পরিবর্তন ঘটা। ছবিতে সেই বক্তব্যকে ঋত্বিক ঘটক তুলে ধরতে চেয়েছেন। তাই ছবির শেষ দৃশ্যে বাসন্তী তিতাসের বুকে পানির আশায় বালি খুঁড়তে থাকে। একসময় বালুতে লুটিয়ে পড়ে ক্লান্ত চোখের সামনে দেখতে পায়, চরে গজিয়ে উঠেছে সবুজ ক্ষেত। একটা উলঙ্গ শিশু হেঁটে যাচ্ছে সবুজের বুক চিরে । এ দৃশ্যের মাধ্যমেই ইঙ্গিত ফুটে উঠেছে সমাজের পরিবর্তনের।

তিতাস একটি নদীর নাম’ এর  মাধ্যমে অদ্বৈত মল্লবর্মণ যেমন মালো পাড়ার মানুষদের জীবন সংগ্রাম, সেখানকার রাজনীতি, অর্থনীতিকে চিত্রিত করেছেন; তেমনি ঋত্বিক সেই বিষটাকে জীবন্ত করে তুলেছেন।  চলচ্চিত্রতে আমরা কাহিনী সরাসরি দেখে অনুভূতি প্রকাশ করতে পারি। কিন্তু গল্প, উপন্যাসে চিন্তা, কল্পনা শক্তিকে বাড়িয়ে বিষয়বস্তুর গভীরে গিয়ে অনুধাবন করতে হয়। এই ছবি দেখার পড়ে অনেকের ধারণা পরিষ্কার হবে এবং পরিচালক ঋত্বিকের শ্রেষ্ট্যত্ব চোখে পরবে। তিতাস চলচ্চিত্রে বেশ কিছু বিষয় উঠে এসেছে; যা আমাদের সমাজে ঘটে; প্রতিনিয়ত আমাদের মোকাবেলা করতে হয়। তবে মগজ ও স্বার্থের সদ্ব্যবহার না থাকায় আমরা অনেকেই বুঝতে পারি না। পুর্বে উপন্যাস ও চলচ্চিত্রর বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এখন শুধু এই চলচ্চিত্রের মৌলিক কয়েকটি দিক তুলে ধরা যাক।

সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন

সমাজের পরিবর্তনের পুঁজির নিয়ম মেনেই তা হয়। সেই সঙ্গে বদলে যায় জীবন যাত্রা। কিন্তু শ্রমজীবী, খেটে খাওয়া মানুষের উপর শোষকের শোষণ থামে না শুধু শোষণের কৌশল বদলায়। এরপরও পরিচালক ঋত্বিক প্রগতি ও আশাবাদী হওয়ায়, তিনি তিতাস-এর মাধ্যমে শোষণহীন এক সমাজের চিত্রকে চিত্রিত করতে চেয়েছে। তাই সমাজের পরিবর্তনকে ভয় না করে আশাবাদী হতে হবে। চলচ্চিত্রের শেষ দৃশ্যে দেখানো হয় তিতাসের চরে সবুজ কচি ধান জন্মেছে; সেটাই বেঁচে থাকার নতুন পৃথিবী। শেষ দৃশ্যটা রূপক হিসাবে উঠে এসেছে। মানুষ মরণশীল হলেও তার কর্ম অমর থাকে। তাই নিজের কর্মফল আপাতদৃষ্টিতে পাওয়া না গেলেও, সামাজ পাল্টানোর লড়ায়টা তুলে দিতে হয় আগামী প্রজন্মের কাছে। ঋত্বিকের ভাষায়- ‘সে একটা ধাপ থেকে আরেকটা ধাপে গিয়ে পৌঁছয়। সেই কথাটাই ছবিতে বলার চেষ্টা করেছি।’[৪] তাই পরিবর্তনকে মেনে নিতে হবে। 

তিতাসের পানি শুকিয়ে যেতে থাকে। মালো পাড়ার ঘরে ঘরে হাহাকার, অন্নের অভাব। এক পর্যায়ে যখন নদীতে চর পড়ে যায়, সেই সময় জেলেদের জীবনে নেমে আসে দারিদ্র্য আর শোষকের অত্যাচার। শেষ পর্যন্ত কর্মঠ, পরিশ্রমী, নীতিবান জেলেরা ভিক্ষার ঝুলি নিতে বাধ্য হয়। এক সময়ের প্রতিবাদী মানুষ বাসন্তী, আজ বড়োই ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত। অসুস্থ হয়ে ছেঁড়া কাঁথা জড়িয়ে পানির সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। অতীতের স্রোতশী তিতাস শুকনো মরুভূমিতে পরিণত হয়। শেষাংশে এসে ঋত্বিক বাসন্তীর করুণ মৃত্যু দিয়ে মালোদের জীবন-সংগ্রামের ইতি টানেন। কিন্তু বাসন্তীর সংগ্রামটা তুলে দেন নতুন প্রজন্মের হাতে। 

তিতাস একটি নদীর নাম সামন্তীয় সমাজে পদাঘাত:

ঋত্বিক যে-মালো সমাজের যে চিত্র এঁকেছেন সেই সমাজের কঠোরতা আমাদের দৃষ্টি এড়িতে পারেনি। সেই সমাজে পুরুষের কাছে নারীরা নির্দ্বিধায় নিজের সর্বস্ব সমর্পণ করে; আর পুরুষ সেই সুযোগে নারীর উপর আধিপত্য বিস্তার করে। তবে এই চিত্র শুধু মালো পাড়ার বা সেই সময়ের না; এ প্রথা বা নিয়ম হাজার বছরের পুরনো। মালো পাড়ারার পুরুষ নদীতে মাছ ধরবে, বেচবে, বাজার ঘাট-করবে; অন্যদিকে নারীরা জালের সুতা কাটবে, সংসার সামলাবে আর সন্তান জন্ম দিবে। এভাবেই  তিতাস পাড়ের নারী জীবন সীমাবদ্ধ থাকে।

কিন্তু ঋত্বিক এই নিয়ম ভাঙতে চেয়েছেন বাসন্তী ও তার সই মুংলি এই দুই চরিত্র দিয়ে। মালো বাড়ির অন্যান্য নারীর মতো শিশুকালে বাসন্তীরও বিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। স্বামী-সংসার বুঝে উঠার আগেই স্বামীহারা হয়ে যায় বাসন্তী। যৌবনা বাসন্তী, হয়ে যায় রাঢ়ী বাসন্তী। তার এই নিয়তি, সমাজিক ‘অনুশাসন’ মেনে নিয়েছিলো। যৌবনা শরীরকে সাদা শাড়ি দিয়ে জড়িয়ে রেখেছিলো। স্বামী-সন্তানহীন বাসন্তী অনন্তকে কাছে নিয়ে মাতৃত্বের স্বাদ পেতে চায়। 

কিশোরী বয়সের বিধবা বাসন্তীর দিকে লোলুপ দৃষ্টি ছিলো মাতব্বরদের। নানা লোভ দেখাতো কিন্তু নত হতো না সে। সেই সমাজে নারীসহ দুর্বলদের উপর ফতোয়ার নামে দোররা মারা হতো গাছে বেঁধে। এই বর্বতার প্রতিবাদ করেছিলো বাসন্তী, মুংলি। রাজার ঝি মারা যাবার পরে অনন্তের থাকা-খাওয়া নিয়ে বাসন্তীর মা অনীহা জানালে বাসন্তী প্রতিবাদ করতে পিছপা হয় নি। তার তেজী কন্ঠ বলে ওঠে “মনে কইরা দ্যাহ কোনকালে বিয়া দিছিলা। মইরা গেছে। জানলাম না কিছু বুঝলাম না কিছু, সেই অবুঝকালে ধম্মে কাঁচা রাঢ়ী বানাইয়া থুইছো,’’।

যে সমাজে নারীর মর্যদা নেই। নারী প্রযোজন মানেই বংশ জন্ম দেওয়া, আর পুরুষের ভোগের সামগ্রি হওয়া। তা যদি কেউ না হতে চাইলে তাহলে পুরুষতন্ত্রের জালে আটকে করুণ মৃত্যু। সেই সমাজ ভাঙ্গার লড়ায় দেখিয়েছেন বাসন্তী ও মুংলি চরিত্রের মধ্যে।

পুরনো অর্থ ব্যবস্থার ভাঙ্গন ও আধুনিকায়ন

মালো সমাজে ঐতিহাসিকভাবেই বয়ে এসেছে সুখে-দুঃখে আর প্রকৃতির সঙ্গে লড়ায় করার একাত্ত শক্তি। কিন্তু সমাজে সৎ লোক যেমন ছিলো, তেমনি অসৎ লোকেরও অভাব ছিলো না। মালো পাড়ার একই চিত্র দেখা যায় মানিকের পদ্মা নদীর মাঝি-তে। শেতল বাবুর মতো ঠকবাজ, অনৈতিক ব্যক্তি তিতাসে বিধুভূষণ পাল, কালোবরণ কিংবা কেষ্ট চন্দ্ররা। আর ঋত্বিকও মালো সমাজের পর্দার অন্তরালে থাকা এসব বিষয়ের নির্মম সত্য উন্মোচন করেছেন। এজন্য মূল উপন্যাসে নেই এমন কিছু বিষয় বা সংলাপ ঋত্বিক তিতাস-এ নানা চরিত্রের মধ্যে দিয়ে তুলে ধরেছেন। যেমন মুঙলীকে দিয়ে বলিয়েছেন যে, ‘মালো সমাজে কেষ্ট চন্দ্রের মতো মোড়লরা কীভাবে ঘুষ খেয়ে পেট মোটা করে আর স্বার্থবাদী চক্রের হয়ে কাজ করে’।

অদ্বৈত মল্লবর্মন মালোদের দুঃখ, দুর্দশা, অনটনের সাথে অর্থনৈতিক দুরাবস্তা তুলে ধরেছেন। মানুষগুলো যে উদ্বাস্তু হয়ে পড়ছে এজন্য কিছু অনৈতিক মানুষের ভূমিকাকেও তুলে ধরেছেন। কিন্তু  ঋত্বিক যে তিতাস এঁকেছেন তাতে ফুটে উঠেছে সামন্তীয় অর্থনীতির পরিবর্তন। একটা ক্ষয়ে যাওয়া সামন্ত সমাজ ভেঙ্গে যাচ্ছে। তিতাস শুকিয়ে যাচ্ছে মানুষ হারাচ্ছে তার কর্ম। উদ্বাস্তু বা শহরমুখী হচ্ছে খেটে খাওয়া মানুষগুলো। ঋত্বিক কৈবর্তসমাজের এই শ্রেণিবৈষম্য স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন। আর এই শ্রেণিবৈষম্যের কারণেই মালোদের একতা শেষ পর্যন্ত আর টিকে থাকেনি। জেলেদের ভুমি-ভিটেহীন জীবনে টিকে থাকার জন্য মাতব্বরদের সাথে লড়ায় করতে হতো। সেই লড়ায় ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে নতুন সমাজ গড়ার দিকে। 

মালো পাড়ায় যখন জেলেদের ঐক্যে ফাটল ধরছে তখন অনেকেই শহরমুখী হয়। বাসন্তী রাজার ঝির ছেলে অনন্তের জন্য নিজের মায়ের সাথে ঝগড়া-মারামারি করে। কিন্তু সেই অনন্ত অন্য একটি নিঃসন্তান জেলে পরিবারের সাথে শহরে যায়। লেখা পড়া করতে চায়। চলচ্চিত্রের এই দৃশ্যের দেখা যায়, মালো সমাজের পুরনো প্রথাকে ভেঙ্গে শিক্ষা ও শহুরে জীবনে ঝুঁকে পরে পরবর্তি প্রজন্ম। এই নতুন প্রজন্মের কাছে মালো সমাজের আবেগ, ভালবাসার মূল্য অতি সামান্য।

তথ্যসূত্র:

১. দোলন প্রভা, ২০ জুন, ২০২০, “অযান্ত্রিক চলচ্চিত্র মানুষ ও যন্ত্রের মধ্যকার দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের প্রকাশ”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএলঃ https://www.roddure.com/art/a-river-called-titash/

২. সাপ্তাহিক চিত্রালী রিপোর্ট, সাজেদুল আউয়াল সম্পাদিত, ঋত্বিকমঙ্গল, “আমি ছাড়া তিতাস হতো না” বাংলা একাডেমী, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ জুন ২০০১, পৃষ্ঠা, ১০৫।

৩. খালেদ হায়দার ও বাকির আবদুল্লাহ, সাজেদুল আউয়াল সম্পাদিত, ঋত্বিকমঙ্গল, “তিতাসের প্রযোজকের সঙ্গে কিছুক্ষণ”- থেকে উদ্ধৃত, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ জুন ২০০১, পৃষ্ঠা, ৩৮।

৪. সাপ্তাহিক চিত্রালী প্রতিনিধি, সাজেদুল আউয়াল সম্পাদিত, ঋত্বিকমঙ্গল, “আমি নতি স্বীকার করিনা”- থেকে উদ্ধৃত, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ জুন ২০০১, পৃষ্ঠা, ৩৩।

৫. শান্তনু কায়সার, সাজেদুল আউয়াল সম্পাদিত, ঋত্বিকমঙ্গল, “তিতাসের-এর চলচ্চিত্রায়ণ”- থেকে উদ্ধৃত, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ জুন ২০০১, পৃষ্ঠা, ২০৬-২১২।

Leave a Comment

error: Content is protected !!