“আমি শিল্পী হিসেবে involvement-এ বিশ্বাস করি। আমি বিশ্বাস করি যে চারপাশের মানুষের জীবনের সাথে নাড়ীর যোগ রেখে ছবি করতে হয়। তা না হলে ছবি করার কোন মানে হয় না। যে কোন সৎ শিল্পীকেই সমাজের অংশীদার হতে হবে। লক্ষ মানুষের জীবনের সাথে যোগাযোগ রাখতে হবে এবং তাদের সংগ্রামের অংশীদার হতে হবে।”
সেই জন্যই হয়তো ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্রগুলো এতটা বাস্তব। মানুষের জীবনের নানা সংকটকে হৃদয় দিয়ে যতটা দেখেছেন তারচেয়ে বেশি বুঝতে চেয়েছে চলমান অর্থব্যবস্থাকে। কোন রাষ্ট্রিয় অর্থনীতির কারণে মানুষের সংগ্রামের পথগুলো পাল্টে যাচ্ছে, বারবার প্রতারিত হচ্ছে দেশের জনগণ, রাজনৈতিক নেতাদের মুখোশ উন্মোচন, বাংলায় বহিরাগতদের আধিপত্যের কুফল ইত্যাদির সমাধান খুঁজে চলেছিলেন আমৃত্যু। তার পরিচালিত কিছু কিছু চলচ্চিত্রে এই সব বিষয় খুবই সূক্ষ্মভাবে এসেছে যেমন ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘সুবর্নরেখা’ চলচ্চিত্রে দেখা যায় যোগ্য, শিক্ষিত হওয়ার পরও বাংলায় চাকরি না পেয়ে বোম্বে চলে যেতে হয় তা না হলে অভাব অনটনে মরতে হয়। এখানে বাংলার বুকে যে অসৎ রাজনীতি চলছে তার নোংরা চিত্র ফুটে ওঠে। সমাজের বাস্তবতাকে বুঝতে গিয়ে এমনভাবে ডুবে যেতেন যে অর্থহীন আবেগের কাহিনীকে শিল্পের খাতায় পাত্তাই দিতেন না। নিজের চলচ্চিত্র কাহিনী সম্পর্কে বলেছেন-
আমি কোন সময়েই একটা সাধারণ পুতপুতু মার্কা গল্প বলি না যে একটি ছেলে একটি মেয়ে প্রেমে পড়েছে, প্রথমে মিলতে পারছে না তাই দুঃখ পাচ্ছে, পরে মিলে গেল বা একজন পটল তুলল এমন বস্তাপচা সাজানো গল্প লিখে বা ছবি করে নির্বোধ দর্শকদের খুব হাসিয়ে বা কাঁদিয়ে ঐ গল্পের মধ্যেও involve করিয়ে দিলাম দু’মিনিটেই তারা ছবির কথা ভুলে গেল। খুব খুশী হয়ে বাড়ি গিয়ে খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। এর মধ্যে আমি নেই ।
তিনি ছিলেন সত্য, সুন্দর, বাস্তববাদী শিল্পী। তাই মনে করতেন জনগণের কাছে থেকে যেমন শিখতে হবে তেমনি জনগণের চিন্তার মানকেও উন্নত করা আমাদেরই দায়িত্ব। এটা না করতে পারলে দেখা যাবে নিজেদের অজ্ঞতায় নিজেরা যেমন মরছে তেমনি অন্যকেও মারছে। ব্যক্তি প্রতি মুহুর্তে রাজনীতি, অর্থনীতি সম্পর্কে সচেতন হলেই সমাজের সংকটগুলো বুঝতে পারবে।
যুক্তি তক্কো আর গপ্পো-এর কাহিনী:
ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্র ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’- এর কাজ শুরু হয় ১৯৭৪ সালে এবং মুক্তি পায় ১৯৭৭ সালে। এটিই ছিলো ঋত্বিকের শেষ ছবি এবং তাঁর মৃত্যুর পড়ে মুক্তি পায়। চলচ্চিত্রটি ভারতে নকশাল আন্দোলনের পটভূমিতে চলচ্চিত্রায়িত হয়। নীলকণ্ঠ বাগচী নামের এক ব্যক্তিকে নিয়ে ছবির শুরু। দেশে নানা রকম বিবর্তন চলছে। নির্যাতিত জনগণের উপর নানা রকম পরীক্ষা নীরিক্ষা চলছে। এই সব পরীক্ষা নীরিক্ষার চাপে পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে জন জীবন। রাজনৈতিক নেতা এবং তাদের উচ্ছিষ্টভোগীরা দেশের মুক্তি আন্দোলন পকেটে করে ঘুরে বেড়ায় আর বড় বড় আদর্শের কথা বলে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। তাতে নীলকণ্ঠ বাগচীর মতো ব্যক্তিদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয় না। পাড়ার এক তরুণ ছেলে নচিকেতা নীলকণ্ঠের সাথে থাকে। নীলকণ্ঠের দায়িত্বহীন আচরণে তার স্ত্রী এবং শিশু পুত্রের কলকাতার গলির বাসার সংসার ত্যাগী করে। কলকাতার গলি থেকে রাজপথে চলতে চলতে নীলকণ্ঠ ঢক ঢক করে গলায় বাংলা মদ ঢালে।
কাহিনীর শুরুতেই দেখা মেলে বঙ্গবালা নামে এক তরুণী গ্রাম্য মেয়ের। যার সম্বল শুধু মাত্র একটা পোটলা। মেয়েটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার মিলিটারী বর্বরতার শিকার। বাংলাদেশ থেকে সে উদ্বাস্ত হয়ে এসেছে। এরপরে এক টোলো পণ্ডিতের সাথে দেখা মেলে। সে ছিলো অত্যন্ত অভাবগ্রস্ত। সে শহরে এসেছেন রুটি রোজগারের আশায়। কলকাতার ফুটপাথে, রাস্তার পাশেই পাশেই তার রাত কাটে। তারপর এদের সবাইকে নিয়ে নীলকণ্ঠ শহর ছেড়ে গ্রাম বাংলার দিকে উদ্দেশ্যহীনভাবে পথ চলে শুরু করে। এই পথ পরিক্রমাই হচ্ছে ছবির উপজীব্য। এক রাতে সবাই শালবনের মধ্যে রাত পায়। সেই বনেই রাতে এসে আশ্রয় নেয় কিছু নকশাল কর্মী। পুলিশের সাথে গুলি বিনিময়ের সময় গুলি লেগে নীলকণ্ঠ বাগচী মারা যায়। অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অসুসংবদ্ধ প্রতিরোধের আন্দোলনে নীলকণ্ঠ বাগচীদের আত্মবিচ্ছিন্নতা ও বিভ্রান্তি হচ্ছে ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’।[১]
সংকট উপস্থাপন:
চলচ্চিত্র পরিচালক হিসাবে ঋত্বিক ঘটক যেসব কাহিনী নিয়ে কাজ করতেন যারমধ্যে বেশিটাই দ্বন্দ্বের প্রকাশ করেছেন। যেমন চলচ্চিত্রে দ্বাদ্বিক সম্পর্কগুলো বাংলাভাগের, রাজনৈতিক মতাদর্শন, সাহিত্য বা শিল্পচর্চা, সাহিত্যে বা শিল্পে ভাষার প্রকাশ, জোতদার ও গ্রামবাসীর মধ্যে সংঘাত, শহর ও গ্রামের বিলুপ্ত প্রায় সংস্কৃতির মধ্যে দ্বন্দ্ব ইত্যাদি। এই চলচ্চিত্রটি মূলত রাজনৈতিক এবং সেটার স্পষ্ট প্রকাশ আছে। চলচ্চিত্রের এক জায়গায় দেখা যায় এক নেতা তেজী বক্তব্য দিচ্ছেন; নেতার কথাগুলো ছিলো মিথ্যা আশ্বাস এবং হুট করে এক কুকুর ঘেউ ঘেউ করে উঠল। এই দৃশ্যটা দিয়ে ভন্ড নেতাদের প্রতি তিরস্কার, অবজ্ঞার তীক্ষ্ণ প্রকাশ। যেটার জন্য বিন্দুমাত্র ভীত ছিলেন না তিনি।
বঙ্গবালা পাকিস্তানি বাহীনির নির্যাতন ও উদ্বাস্তু শিবিরের অভাব থেকে বাঁচার জন্য পালিয়ে কলকাতায় আসে। নীলকণ্ঠের সাথে দেখা হয়; তার সব কথা শুনে তাকে একটি নিরাপদ আশ্রয় খুঁজার জন্য বেড়িয়ে পড়ে পথে। এই যে বঙ্গবালা ও তার আশ্রয় এটা প্রতিকী হলেও মূল বক্তব্য হলো মাতৃভূমির প্রতি প্রেম। বাংলাকে যারা লুটেপুটে খাচ্ছে, দ্বিখন্ডিত করে অত্যাচার চালাছে, বাংলার ঐতিহ্য-সংস্কৃতিকে বিলুপ্ত করছে সেটা রক্ষার জন্য সচেতন যেমন হতে হবে তেমনি ভবিষৎ প্রজন্মকে দায়িত্বশীলও করতে হবে।
রাজনীতি ও অর্থনীতির পরিবর্তন:
বাংলাভাগের ফলে কলকাতার অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। সেই ভঙ্গুর বাংলার সংকট কাটিয়ে উঠতে না উঠেই বাংলাদেশের যুদ্ধ শুরু হয়। আবার উদ্বাস্তু হয়ে কলকাতায় ঘুরতে দেখা যায় অনেক বাঙ্গালীকে। অন্যদিকে নকশালবাড়ি আন্দোলনের উষ্ণ হাওয়ায় বয়ে চলে কলকাতা শহরের অলিতে গলিতে। সেই সময় অনেকেই ছিলেন যারা গা বাঁচানোর জন্য সমস্যাগুলোকে এড়িয়ে যেতো। চলচ্চিত্রে তেমন চরিত্রকে উপস্থাপনের জন্য উৎপল দত্তের আবির্ভাব। যে সুড়সুড়ি মার্কা বিজ্ঞাপন করে। কথা প্রসঙ্গে নীলকণ্ঠ তার মুখের উপর নানা কথা বলে দেয়। রাজনীতির বাইরে কোন কিছুই না সেটা ব্যক্তি হোক আর একটি পশু হোক। এই ক্ষেত্রে যারা জনগণকে অজ্ঞ করে রাখতে চায় তাদের উদ্দেশ্যে নীলকণ্ঠের মুখ দিয়ে ঋত্বিক বলান ‘ভাবো ভাবো, ভাবার প্র্যাকটিস করো। তোমরা ভাবলে কাজ হবে।’
রাজনীতির বাইরে সমাজে অবস্থানরত কোনো কিছুই নেই। এই সত্যটাকে অস্বীকার করে শিল্প তৈরি হয় না। সাংবাদিকের সাথে এই চলচ্চিত্রটি নিয়ে আলোচনাকালে ঋত্বিক বলেন, ‘পলিটিক্স কি জীবনের বাইরে?’ তার এই ছবিটি পলিটিকাল সম্পূর্ণভাবে। পলিটিকাল ছবি করা আসলে মেরুদণ্ডের প্রশ্ন। [২] কোন দল বা নিজের রাজনৈতিক চিন্তাকে চাপিয়ে দেওয়ার জন্য এই ছবি বানানি; জনগণকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে সচেতন করায় ছিলো বিষয়বস্তু। কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক তা বিচার করবে জনগণ।
দুই বাংলার বিভাজন কোনো মতেই মেনে নিয়ে পারেন নি তিনি। বাংলার ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের মেলবন্ধন দেখিয়েছেন এই চলচ্চিত্রে। গ্রামবাংলার প্রকৃতি, ছৌ নাচ, প্রতিম মুর্তি, পূজা পার্বন, নবান্ন ইত্যাদির মাধ্যমে একত্রিত হতে চেয়েছেন বারবার। বঙ্গবালা নামের মেয়েটিকে বাংলার মুখ রূপক করেই ঋত্বিক ভদ্রসমাজের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চেয়েছেন মাতৃভূমির প্রতি কতটাই না নির্যাতন করেছি আমরা। সমাজের দ্বন্দ্বগুলোকে স্পষ্ট করতেই খন্ড খন্ড ঘটনাগুলোকে একত্রিত করে একটি পুর্ণাঙ্গ পটভুমি বানিয়েছেন।[৩]
তথ্যসূত্র:
১. ঋত্বিক কুমার ঘটক, চলচ্চিত্র মানুষ এবং আরো কিছু, “সুখ অসুখ ও ঋত্বিক ঘটক”দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, পুনর্মুদ্রণ নভেম্বর ২০১৫, পৃষ্ঠা, ২৬৪।
২. ইকবাল আহসান চৌধুরী, সাজেদুল আউয়াল সম্পাদিত, ঋত্বিকমঙ্গল, “চলচ্চিত্রে নিবেদিত প্রাণ : ঋত্বিক কুমার ঘটক” বাংলা একাডেমী, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ জুন ২০০১, পৃষ্ঠা, ২৪৩।
৩. দোলন প্রভা, ১ আগস্ট, ২০২০, “যুক্তি তক্কো আর গপ্পো চলচ্চিত্রে সমাজের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক ফুটে উঠেছে”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএলঃ https://www.roddure.com/art/jukti-takko-aar-gappo/
দোলন প্রভা বাংলাদেশের একজন কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক ও উইকিপিডিয়ান। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। তার জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯ তারিখে বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলার রেলওয়ে নিউ কলোনিতে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বাংলাদেশের আনন্দমোহন কলেজ থেকে এমএ সম্পন্ন করেছেন। তিনি ফুলকিবাজ এবং রোদ্দুরে ডটকমের সম্পাদক।