ঋত্বিক ঘটক তাঁর পরিচালিত সমস্ত চলচ্চিত্রে, বিভিন্ন লেখায়, সাক্ষাৎকারে বোঝাতে চেয়েছেন যে, সমকালীন বাঙালি-জীবনের সার্বিক দৈন্য ও দুর্গতির মূলে বাংলাভাগ একান্ত ভাবেই দায়ী; সংকটের অবকাঠামোর মধ্যে বাঙালির গৌরবান্বিত ইতিহাস ও ঐতিহ্য সাধনার চরম পথভ্রষ্টতা; মনন-মানসের আত্মিক নৈরাশ্য ও অবক্ষয়ের মূল লক্ষণগুলি নিহিত। ঋত্বিকের ‘নাগরিক’ (১৯৫২- ৫৩) পর্ব থেকে শুরু করে ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ (১৯৭৪) পর্যন্ত বিস্তৃত সমস্ত ছবিতেই জন্মভূমি পূর্ব বাংলা সম্পর্কে নস্টালজিয়া বা স্বদেশের প্রতি আকুতি, দেশবিভাগজনিত উদ্বাস্তু মানুষের তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ, দুই বাংলার সাংস্কৃতিক মিলনের আকুল আর্তি বারবার বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে ঘুরে-ফিরে এসেছে। এ সবের মধ্যে সবচেয়ে বেশি করে প্রকট হয়ে ফুটে উঠেছে উদ্বাস্তু মানুষের ছিন্নমূল হয়ে-যাওয়ার জীবনযন্ত্রণা প্রসূত বিষাদঘন পটভূমি বিস্তৃত কাহিনী। এখানে উদ্বাস্তু অর্থে শুধুমাত্র নিজের ভূমি থেক উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া নয়, সেই সঙ্গে ইতিহাস ও ঐতিহ্যচ্যুত ব্যাপক মানুষের হাহাকার আর্তি।[১]
মানুষের সীমাহীন কষ্ট, অভাব, অভিযোগ, দারিদ্র, হাহাকারকে কাছ থেকে দেখেছেন ঋত্বিক। তাই মনোরঞ্জনের নাটক ছেড়ে আশ্রয় নিলেন সেলুলয়েডের ফিতায়। নিজের বয়স যখন সাতাশ বছর সেই সময় তিনি প্রথম বানালেন নাগরিক ছবিটি। সেই সময় তাঁর চিন্তায় ছিলো নিজের চিন্তাকে একসাথে অনেক জনগণের কাছে পৌঁছাতে হবে। তাই প্রথম ছবি হিসাবে সমাজকে দেখার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, মগজের সঠিক ব্যবহার করে বিচ্ছিন্ন চিত্র, ঘটনাকে একত্রিত করেছেন।
নাগরিক চলচ্চিত্রের কাহিনী:
‘নাগরিক’-এর নায়ক রামু ছিলো কলকাতার অসংখ্য নাগরিকের মধ্যে একজন। তবে অফিসপাড়ার পরিবেশের মধ্যে সে একজন বিশেষ নাগরিক। চলচ্চিত্রের শুরুতে তাকে দেখা যায়, অন্য আট দশজন মধ্যবিত্ত পরিবারের যুবকের মতো ভালোভাবে বাঁচার আকাঙ্খায় লড়ায় চালাচ্ছে সমাজের সাথে। বাবার অবসরের পর ধীরে ধীরে শুরু হয় অর্থের অভাব। রামুসহ তার পরিবার শ্যামপুকুরের বড় বাড়ি ছেড়ে কলকাতার ঘিঞ্জি এলাকায় বাসা ভাড়া করে থাকে। নতুন ভাড়া বাড়িতে মায়ের মতো রামুও হাঁপিয়ে ওঠে। রামু স্বপ্ন দেখে খোলা পরিবেশে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার। কিন্তু বার বার ব্যর্থ হয়। একটা চাকুরীর জন্য সে হন্য হয়ে ছুটতে থাকে শহরের অফিস থেকে অফিসে। চাকরির বাজারে কোনো প্রাপ্তির আলো দেখতে পায় না। তারপরে একদিন ঘিঞ্জি এলাকার বাসা ছেড়ে আরো কম ভাড়ার আরো ঘিঞ্জি পরিবেশের দিকে যাত্রা শুরু করে রামু, তার মা-বাবা ও বোন।
রামু একের পর এক ইন্টারভিউ দিয়ে চলেছে। দারিদ্র তাদের বাড়িতে, দারিদ্র তার প্রেমিকার বাড়িতে, অন্যান্য বাসিন্দাদের। বাড়িওয়ালা , বকেয়া ভাড়ার জন্য তাগাদা দিয়ে যায়। পেয়িং গেস্ট হয়ে আসা উচ্চশিক্ষিত সাগরও একটা চাকরির চেষ্টা করে। ঘরে চাল নেই শুনে সাগর তার বই বিক্রি করে চাল কেনার টাকা নিয়ে আসে, রামুর প্রেমিকা উমা সেলাই করে সংসার চালাবার চেষ্টা করে। উমার বোন শেফালী দারিদ্রের জন্য বেশ্যা হয়ে যায়। উমাদের প্রতিবেশী যতীন বাবুর আকাখা ভালো খাবার। খাবারের অভাবে ছেলে মারা যায়। যতীন বাবুরা বাড়ি ছেড়ে বস্তিতে চলে যায়। ছবির শেষে রামুও তাদের বাড়ি ছেড়ে বস্তিতে উঠে যায়। [২]
নগর অর্থনীতি ও নাগরিক জীবন:
সময়ের নানা প্রেক্ষাপট, ইতিহাস চেহারা ভিন্ন তৈরি করে একটি সমাজের। যেটা সাধারণ চোখে দেখে বুঝা দুরূহ। ঋত্বিক ঘটকের ‘নাগরিক’ চলচ্চিত্রে নগরের আর্থ-সামাজিক বিষয়কে উপজীব্য করে তৈরি করেছেন। ঋত্বিকের চলচ্চিত্রের বেশিরভাগ চরিত্রগুলো মধ্যবিত্ত। বিশ্বযুদ্ধ আর দেশভাগ দু’টি ঐতিহাসিক বিষয়। এই দুটোর ঘটনা মধ্যবিত্তের সামাজিক জীবনে যে প্রভাব ফেলেছিলো সেটাই ছিলো এই চলচ্চিত্রের দৈনন্দিন ও সামগ্রিক বিষয়।
ঋত্বিকের ছবিতে নগর কলকাতার সমস্ত চিহ্ন নিয়ে উপস্থিত। ছবির ভৌগোলিক পটভূমিকে বাস্তব, নিখাত, সুক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর করে তুলে আনার চেষ্টা করেছেন; ঋত্বিকের ক্যামেরা কলকাতার বাহির ও ভিতর উভয়কে তুলে ধরেছে নিপুণভাবে। ‘নাগরিক’ ছবির শুরুতেই পর পর দৃশ্য রয়েছে গঙ্গা, হাওড়া ব্রীজ, ট্রামের তার, ট্রাম লাইন, মানুষ, রাস্তা, বাস, পথের মোড়, বেহালা বাজিয়ে ভিক্ষে চাওয়া। ছবির মাঝখানে দৃশ্যে সমস্ত ময়দান, অক্টোরলনী মনুমেন্ট, মূর্তি, গলি, রিকসাওয়ালা, কোলে সন্তান নিয়ে গান গেয়ে ভিক্ষে করছে ভিখারী দম্পতি, রাস্তার ধারে ভাঙ্গা দেওয়ালে ঘঁটে লাগানো, পথে হকার। আবার একটা বিশেষ সময়ের পরিচয় দিতে পূজোর প্যান্ডেল, মাইকের গান ।[৩]
ক্ষয়ে যাওয়া মধ্যবিত্তের মনস্তাত্বিকতা:
নাগরিক চলচ্চিত্রে দেখা যায় রামু একজন তরুণ, রোম্যান্টিক, প্রাণচঞ্চল, শিক্ষিত মেধাবী বেকার যুবক হিসাবে আমাদের সামনে দৃশ্যমান। যে চাকরি খুঁজছে, অন্য সব সাধারণের মতো সুস্থ, স্বাভাবিক, সুখী একক জীবনের স্বপ্ন দেখে। কিন্তু ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাওয়া মধ্যবিত্ত সমাজের অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হতে থাকে। এই চলচ্চিত্রে নাটকীয় বা অতিরঞ্জিত কোনো মুহূর্ত ব্যবহার না করে অল্প কয়েকটি সাধারণ চরিত্রের মাধ্যমে এ কাহিনি গড়ে তুলেছেন ঋত্বিক। প্রধান চরিত্র রামুর জীবন প্রধানত দুই ধরণের মানসিক চাপে উদ্ভব ঘটে। একদিকে বাবা মাসহ অবিবাহিত বোন। অন্যদিকে প্রেমিকা উমা, তার ছোট বোন শেফালি ও তাদের বিধবা মা। দুটি আলাদা পরিবার হলেও জীবনযুদ্ধ একই। বাঁচার তাড়নায় একদিকে রামু স্বাভাবিক থেকে ঘিঞ্জি পরিবেশে যাত্রা করতে থাকে। অন্যদিকে উমার বোন বেশ্যা হয়ে যায়।
রামুদের পেয়িং গেস্ট সাগর সেন উচ্চশিক্ষিত ছেলে; যে চাকরির খোঁজে শহরে এসে একদিন নিরুপায় হয়ে পড়ার বই বেচে চাল কিনে আনে। রামুর বন্ধু সুশান্ত সে বামপন্থী রাজনীতির সাথে যুক্ত; মাঝে মাঝে রামুকে আহ্বান জানাতো বাঁচার সংগ্রামে শামিল হতে। নাগরিক চলচ্চিত্রে রামু চরিত্রকে কেন্দ্র করে বাঁচার লড়াইটিকে সাজানো হয়েছে; সঙ্গে সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। পুরো চলচ্চিত্র জুড়ে মধ্যবিত্তের টানাপড়েন আছে। প্রতিটি পরিবারের লক্ষ্য একটি চাকরি এবং সংসারে সবাই মিলে স্বস্তির নিঃশ্বাস। তারা সমাজের জটিল চিন্তায় যায় না, রাজনীতির, অর্থনীতি, উদ্বাস্তু সমস্যা ইত্যাদি নিয়ে মাথা ঘামায় না।
বাংলা ভাগের পরে কলকাতার পুরো আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাকে পাল্টে দিয়েছে। এর কারণে বেকার সমস্যা, যোগ্যতা থাকার পরেও চাকরি নেই, অনাহারে থাকা পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি, চুরি-ছিনতাই, ভিক্ষুক, ঝগড়া-বিবাদ, পতিতাবৃত্তি, একটু একটু করে গজে ওঠা বস্তি থেকে বিশাল হা-ঘরে শহর। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য কোনো আন্দোলন করে না; তাদের রাগ হয় না উঁচুতে বসে যারা বিভাজনের রাজনীতি করে তাদের উপর; দেখা যায় নিজেদের মধ্যবৃত্ত মানসিকতাকে মহৎ করে হীন জীবনের পথে যাত্রা করে। এরপরেও ঋত্বিক বাঁচতে শেখায় শেষব্দধি অনেক চেষ্টায় রামুর কোনো চাকুরী হয় না, কিন্তু রামু হতাশায় ডুবে না গিয়ে বরং আরো বেশি সাহসী, তেজী, প্রত্যয়ী হয়ে ওঠে আগামী দিনগুলোতে মাথা উঁচু করে এগিয়ে যাবেন বলে।
তথ্যসূত্র:
১. শিবাদিত্য দাশগুপ্ত ও সন্দীপন ভট্টাচার্য সম্পাদিতঃ সাক্ষাৎ ঋত্বিক, দীপায়ন, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ২০০০, পৃষ্ঠা, ২২৮।
২. শুভেন্দু দাশগুপ্ত, সাজেদুল আউয়াল সম্পাদিত, ঋত্বিকমঙ্গল, “নগর: নির্মিত ও অস্বীকৃত [ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্র]”বাংলা একাডেমী, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ জুন ২০০১, পৃষ্ঠা, ৩২৫-৩৩৫।
২. দোলন প্রভা, ২৭ জুলাই, ২০২০, “নাগরিক: যুদ্ধোত্তর ও বাংলাভাগ পরবর্তি মধ্যবিত্তের জীবন চিত্র”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএলঃ https://www.roddure.com/art/nagarik/
দোলন প্রভা বাংলাদেশের একজন কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক ও উইকিপিডিয়ান। তাঁর প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্থ “স্বপ্নের পাখিরা ওড়ে যৌথ খামারে” এবং যুগ্মভাবে সম্পাদিত বই “শাহেরা খাতুন স্মারক গ্রন্থ”। তার জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৮৯ তারিখে বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলার রেলওয়ে নিউ কলোনিতে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বাংলাদেশের আনন্দমোহন কলেজ থেকে এমএ সম্পন্ন করেছেন। তিনি ফুলকিবাজ এবং রোদ্দুরে ডটকমের সম্পাদক।