রাষ্ট্র সম্পর্কে লেনিনবাদী ধারণা হচ্ছে রাষ্ট্রের উদ্ভব ও বিকাশের দ্বন্দ্ববাদী বিশ্লেষণ

রাষ্ট্র সম্পর্কে লেনিনবাদী ধারণা বা রাষ্ট্র সম্পর্কিত লেনিনের ধারনা (ইংরেজি: Leninist ideas on State) হচ্ছে ভি আই লেনিন কর্তৃক প্রদত্ত রাষ্ট্রের উদ্ভব ও বিকাশের দ্বন্দ্ববাদী ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ। লেনিন বিভিন্ন গ্রন্থ পুস্তিকা, বক্তৃতা ও আলোচনায় রাষ্ট্র সম্পর্কে নিজের বক্তব্য প্রকাশ করে গেছেন। এগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হলো রাষ্ট্র (ইংরেজি: The State) পুস্তিকা এবং রাষ্ট্র ও বিপ্লব (ইংরেজি: The State and Revolution) গ্রন্থ। এই দুই গ্রন্থে লেনিন কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের বক্তব্য বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন কারণ মার্কস ও এঙ্গেলস রাষ্ট্র সম্পর্কে বিভিন্ন জায়গায় আলোচনা করলেও সমগ্র ধারণাটি সুবিন্যস্ত আকারে ব্যাখ্যা করে যাননি।

বলা হয়ে থাকে যে, রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কস ও এঙ্গেলসের বক্তব্যের পূর্ণাঙ্গ ও সঠিক ব্যাখ্যা রাষ্ট্র ও বিপ্লব গ্রন্থে পাওয়া যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে লেনিন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করলেও রাষ্ট্র সম্পর্কে তার বক্তব্য মার্কস ও এঙ্গেলসের ধারণা অনুযায়ী। অনেকে মনে করেন রাষ্ট্র সম্পর্কে লেনিনবাদে যা বলা হয়েছে তা মার্কস ও এঙ্গেলস বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি ছাড়া কিছু নয়।

রাষ্ট্র সম্পর্কে লেনিনবাদী ধারণা বিশ্লেষণ

বুর্জোয়া রাষ্ট্রের চরিত্র সম্পর্কে লেনিন যা বলেছেন তা পুরোমাত্রায় মার্কসীয় দর্শনের অনুগামী। লেনিনের মৌলিকত্ব এখানেই যে তিনি মার্কসীয় দর্শনকে মনে রেখেই রাষ্ট্র ও বিপ্লব গ্রন্থটি রচনা করেছেন তাছাড়া এই সময়, রাশিয়ার অত্যাচারী শাসককে অপসারিত করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করার পর রাষ্ট্রের ভূমিকা কী হওয়া উচিত তা বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সঞ্চয় করেছিলেন।

বুর্জোয়া রাষ্ট্রের স্বরূপ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে লেনিন বলেছেন যে বুর্জোয়া দার্শনিক ও তাত্ত্বিকগণ রাষ্ট্রকে একটি ঐশ্বরিক ও অতিপ্রাকৃত ধারণা বলে চিত্রিত করেছেন। অর্থাৎ রাষ্ট্র নামক রাজনৈকি প্রতিষ্ঠানের উদ্ভব ও বিকাশের পিছনে সমাজস্ত কোনো উপাদান বা শক্তির কোনো ভূমিকা নেই। রাষ্ট্র সর্বসাধারণের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলে বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থ সংকটের মধ্যে পড়বে, সেই কারণে বুজোয়া তাত্ত্বিকগণ রাষ্ট্রের উপর দৈবত্ব আরোপ করেছেন। লেনিন মনে করেন রাষ্ট্র কোনো সমাজ বহির্ভুত শক্তির দ্বারা সৃষ্ট প্রতিষ্ঠান নয়। সমাজ বিকাশের একটি পর্বে রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে।[১]

লেনিন রাষ্ট্র ও বিপ্লব গ্রন্থে বলেছেন, সমাজ বিকাশের একেবারে আদি পর্বে ছিল সাম্যবাদ। তারপর ব্যক্তিগত সম্পত্তির উৎপত্তির সাথে সাথে সমাজে বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে সংঘর্ষের সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়, যার সমাধান সূত্র বের করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালে সমাজের আধিপত্যকারী শ্রেণি নিজেদের স্বার্থ রক্ষার প্রয়োজনে এমন এক প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হলো যার হাতে আছে সামরিক বাহিনী, পুলিশ এবং আমলাতন্ত্র – রাষ্ট্র হচ্ছে সেই প্রতিষ্ঠান। লেনিন বলেছেন,

“রাষ্ট্র হলও শ্রেণি-বিরোধের অমীমাংসেয়তার ফল ও অভিব্যক্তি। রাষ্ট্রের উদ্ভব হয় সেইখানে, সেই সময়, এবং সেই পরিমাণে, যেখানে, যে সময় এবং যে পরিমাণে বাস্তব ক্ষেত্রে শ্রেণি-বিরোধের সমাধান হতে পারছে না। এবং বিপরীতে, রাষ্ট্রের অস্তিত্ব প্রমাণ করে যে, শ্রেণি-বিরোধ অমীমাংসেয়।”

ভি আই লেনিন, রাষ্ট্র ও বিপ্লব

লেনিন মনে করেন রাষ্ট্র হচ্ছে শ্রেণি শোষণের হাতিয়ার, রাষ্ট্র নানাভাবে তার এই শোষণ ও নিপীড়নকে পুঁজিপতিদের স্বার্থের অনুকূলে ব্যবহার করে আসছে। বুর্জোয়া বিচার ব্যবস্থাও বুর্জোয়াদের স্বার্থে পরিচালিত হওয়ায় সাধারণ মানুষ সেখানে সুবিচার পান না। এক কথায় বুর্জোয়া শ্রেণি নিজেদের স্বার্থ রক্ষার প্রয়োজনে রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে, রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রেখেছে। লেনিন বলেছেন,

“রাষ্ট্র এক শ্রেণি কর্তৃক অপর শ্রেণিকে দমনের যন্ত্র ছাড়া কিছু নয়, এবং গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে সেটা রাজতন্ত্রের চেয়ে একছিটে কম নয়।”

ভি আই লেনিন, রাষ্ট্র ও বিপ্লব

একই গ্রন্থে একই বিষয়ে লেনিন আরো বলেছেন,

“প্রভু শ্রেণির কোন লোকটি পার্লামেন্টে জনগণকে দমিত ও দলিত করবে, কয়েক বছরে একবার করে তা স্থির করা– এই হলো বুর্জোয়া পার্লামেন্টপ্রথার আসল মর্মার্থ।”

ভি আই লেনিন, রাষ্ট্র ও বিপ্লব

রাষ্ট্রের উদ্ভব বিকাশ এবং সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হলে রাষ্ট্রের অবস্থা কী হবে ইত্যাদি ধারণাগুলিকে লেনিন সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। রাষ্ট্রের এই আলোচনা থেকেই এসেছে রাষ্ট্রের শুকিয়ে মরার তত্ত্ব।

তথ্যসূত্র

১. গোবিন্দ নস্কর, Political thought, ডাইরেক্টরেট অফ ডিসট্যান্ট এডুকেশন, ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়, ২০১৬, দিল্লি, পৃষ্ঠা ৩৪-৩৫।

Leave a Comment

error: Content is protected !!