রাষ্ট্র ও বিপ্লব হচ্ছে ১৯১৭ সালে লেনিন লিখিত বই যাতে রাষ্ট্রের ভূমিকা আলোচিত

রাষ্ট্র ও বিপ্লব (ইংরেজিতে: The State and Revolution) হচ্ছে ১৯১৭ সালে ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন লিখিত এমন একটি বই যেখানে সমাজে সার্বভৌম রাষ্ট্রের ভূমিকা এবং বিপ্লব অর্জনে প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার পথে সমাজ গণতন্ত্রের তাত্ত্বিক অপর্যাপ্ততার বর্ণনা করা হয়েছে। রাষ্ট্র ও বিপ্লব গ্রন্থকে বিবেচনা করা হয় রাষ্ট্রের ওপরে লেনিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে এবং লুসিও কোলেত্তি এটিকে বলেছেন “রাজনৈতিক তত্ত্বে লেনিনের মহত্তম অবদান”।[১]

১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব এগিয়ে আসায় বুর্জোয়া রাষ্ট্রের প্রতি পার্টির মনোভাব কী হবে এবং প্রলেতারিয়েতের হাতে ক্ষমতা এলে কী ধরনের রাষ্ট্র হওয়া উচিত এ প্রশ্ন উত্থিত হয়েছিল অতি তীক্ষ্ণতায়। লেনিন তার উত্তর দিলেন প্রতিভাদীপ্ত ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ পুস্তকে, এটি তিনি লিখেছিলেন গোপন অবস্থায়, ১৯১৭ সালের গ্রীষ্মে ও শরতে। রাষ্ট্র ও প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব বিষয়ে কার্ল মার্কসফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের যে মতবাদ সুবিধাবাদীরা বিকৃত করেছিল তা থেকে তাকে পরিশুদ্ধ করে নতুন ঐতিহাসিক পরিস্থিতির উপযোগী করে সংবর্ধিত করেন লেনিন।[২] মার্কসবাদী তাত্ত্বিক David McLellan-এর মতানুসারে,

“the book had its origin in Lenin’s argument with Bukharin in the summer of 1916 over the existence of the state after a proletarian revolution. Bukharin had emphasized the ‘withering’ aspect, whereas Lenin insisted on the necessity of the state machinery to expropriate the expropriators. In fact, it was Lenin who changed his mind, and many of the ideas of State and Revolution, composed in the summer of 1917 – and particularly the anti-Statist theme – were those of Bukharin.”[৩]

রাষ্ট্র ও বিপ্লব রচনার প্রেক্ষাপট

পার্টি ও বিপ্লবের ইতিহাসে সবার আগে ছিল ১৯১৭ সালের জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত পার্টির ষষ্ঠ কংগ্রেসের ভূমিকা। কংগ্রেসের নির্দেশানুসারে এবং তার তরফ থেকে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির এক ইস্তেহারসহ এই আহবান জানানো হয়, ‘রাশিয়ার সমস্ত মেহনতী মানুষ, সমস্ত শ্রমিক, সেনা ও কৃষকের প্রতি’, যাতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের বিজয়ের ব্যাপারে পূর্ণ আস্থা প্রকাশিত হয়।

সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব যে এগিয়ে এসেছে এটা লেনিন পরিষ্কার দেখতে পেয়েছিলেন, পার্টিকে প্রস্তুত করে তুলছিলেন তার জন্য। কংগ্রেসের পর পার্টি কলকারখানায়, ফৌজে, গ্রামাঞ্চলে, শ্রমিক, সৈনিক, নাবিক ও কৃষকদের মধ্যে বিরাট ব্যাখ্যামূলক ও সংগঠনমূলক কাজ চলে লেনিনের পরিচালনায়। গড়ে উঠল লাল রক্ষিবাহিনী যারা ছিলেন অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সময় প্রলেতারিয়েতের সশস্ত্র বাহিনী। শ্রমিকেরা অস্ত্র সংগ্রহ করে তা ব্যবহারের তালিম নিতে থাকল।

লেনিন শেখালেন যে দেখতে যতই গণতান্ত্রিক হোক, সব ধরনের বুর্জোয়া রাষ্ট্রই হলো আসলে বুর্জোয়া একনায়কত্বের বা বুর্জোয়া প্রভুত্বের একটা প্রকারভেদ। বুর্জোয়ার ক্ষমতা উচ্ছেদ করে প্রলেতারিয়েতের উচিত নিজ একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করা। পুরনো, বুর্জোয়া রাষ্ট্র যন্ত্রটাকে ভেঙে চুর্ণ করতে হবে, তার স্থানে বসাতে হবে নতুন রাষ্ট্র যন্ত্র। এই ধরনের রাষ্ট্রই হলো সত্যিকার গণতান্ত্রিক, কেননা তাতে জনগণের স্বার্থ প্রকাশ পায়। অসাধারণ যথাযথ ও প্রাঞ্জলভাবে ভ্লাদিমির ইলিচ ব্যাখ্যা করলেন কেন প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব আবশ্যক, কী তার ঐতিহাসিক ভূমিকা। তিনি লিখলেন, ‘রাষ্ট্র ক্ষমতা, শক্তির কেন্দ্রীভূত সংগঠন, বলপ্রয়োগের সংগঠন প্রলেতারিয়েতের দরকার শোষকদের প্রতিরোধ দমন এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ‘সুব্যবস্থার’ ব্যাপারে কৃষক, পেটি বুর্জোয়া ও আধা-প্রলেতারিয়ানদের বিপুল জনসংখ্যাকে নেতৃত্ব দান, এই উভয়ের জন্যই’। লেনিন নির্দেশ দিলেন, প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্বের শিক্ষাটাই মার্কসবাদের প্রধান কথা, প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্বকেই তিনি সমাজতন্ত্র নির্মাণের প্রধান হাতিয়ার বলে গণ্য করলেন।

‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ গ্রন্থে সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজমকে লেনিন কমিউনিস্ট সমাজ বিকাশের দুই পর্যায় হিসাবে গণ্য করেন ও সে আলোচনায় অনেক মন দেন। মার্কস ও এঙ্গেলসের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্ধিত করে লেনিন দেখালেন যে সমাজতন্ত্র অনিবার্যই পরিবিকশিত হয়ে উঠবে কমিউনিজমে। কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা সম্পর্কেও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিপাদ্য ভ্লাদিমির ইলিচ পেশ করেন। তিনি এইটাতে জোর দিলেন যে পার্টি হলো প্রলেতারিয়েতের এমন অগ্রবাহিনী যা সমস্ত জনগণকে সমাজতন্ত্রে পরিচালিত করতে, নতুন সমাজব্যবস্থা গড়তে, এবং সমস্ত মেহনতীর শিক্ষক, পরিচালক ও নেতা হতে সক্ষম। বুর্জোয়া ছাড়াই এবং বুর্জোয়া বিরুদ্ধে নবজীবনের নির্মাণে নেতৃত্ব করতে পারে কেবল কমিউনিস্ট পার্টি।[৪]

রাষ্ট্র ও বিপ্লব গ্রন্থে লেনিন দেখিয়েছেন যে রাষ্ট্রকে ধ্বংস করা এবং রাষ্ট্রের শুকিয়ে যাওয়া এক জিনিস নয়। প্রলেতারিয়েতরা বিপ্লবের সাহায্যে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করবে এবং বুর্জোয়া শ্রেণি শাসনের অবসান ঘটবে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে বুর্জোয়া রাষ্ট্রকে পরোপুরি ধ্বংস করে ফেলবে। সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হলে স্বাভাবিকভাবেই সেখানে কোন শ্রেণি বিভাজন থাকবে না, এবং রাষ্ট্রের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে, এটাকেই লেনিন রাষ্ট্রের শুকিয়ে যাওয়া বলে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে,

“বুর্জোয়া রাষ্ট্রের বদলে প্রলেতারীয় রাষ্ট্র বলভিত্তিক বিপ্লব ছাড়া অসম্ভব। প্রলেতারীয় রাষ্ট্রের বিলোপ, অর্থাৎ সমস্ত রাষ্ট্রের বিলোপ ‘শুকিয়ে মরার’ পথে ছাড়া অসম্ভব।”

ভি আই লেনিন, রাষ্ট্র ও বিপ্লব

শ্রমিক ও কৃষকদের রাষ্ট্র কেমন হওয়া উচিত তার পরিষ্কার উপলব্ধিতে পার্টি ও শ্রমিকজনকে সশস্ত্র করল লেনিনের রচনা। অন্য সমস্ত দেশের কমিউনিস্ট ও শ্রমিক পার্টির কাছে রাষ্ট্র সম্পর্কে লেনিনীয় এই শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম।

তথ্যসূত্র

১. L. Colletti, From Rosseau to Lenin (London and New York, 1972, p.224)
২. গ. দ. অবিচকিন, ক. আ. অস্ত্রউখভা ও অন্যান্য; ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন, সংক্ষিপ্ত জীবনী; প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৭১; পৃষ্ঠা-১৫৮
৩. David Mclellan Marxism after Marx, 1979, New York: Harper and Row, p.98. For Lenin’s considerable debt to Bukharin, see S. Cohen Bukharin and the Bolshevik Revolution (New York, 1973, pp.25ff; 39ff)
৪. গ. দ. অবিচকিন, ক. আ. অস্ত্রউখভা ও অন্যান্য; পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা-১৫৭-১৫৯

Leave a Comment

error: Content is protected !!