রাষ্ট্রচিন্তায় মেকিয়াভেলির অবদান মানব প্রকৃতি, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদে

আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তায় মেকিয়াভেলির অবদান (ইংরেজি: Machiavelli’s contribution to Political Thought) রয়েছে মানব প্রকৃতি, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ নির্মাণে। এই আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার পুরোধা নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি (১৪৬৯-১৫২৭) ইতালীর ফ্লোরেন্স নগরীর সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। জীবনের বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাতের এক পর্যায়ে তিনি তাঁর যুগান্তকারী পুস্তক ‘দি প্রিন্স’ রচনা করেন। ‘দি প্রিন্স’ পুস্তকে ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তার মূল বিষয়গুলো বিবৃত হয়েছে। রাজনৈতিক বিষয়ে তাঁর আরও পুস্তক রয়েছে, এর মধ্যে ‘ডিসকোর্স’, ‘দি আর্ট অব ওয়ার’ অন্যতম।

মেকিয়াভেলির রাজনৈতিক চিন্তাধারা তৎকালীন ইতালীর অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং রেনেসাঁ বা নবজাগরণের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। প্রথমত, তৎকালীন অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত দুর্বল এবং খন্ডবিখন্ড ইতালীকে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে ম্যাকিয়াভেলি একত্রিত করার ব্রত নিয়ে একটি শক্তিশালী শাসন ব্যবস্থার অধীনে আনতে চেয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, রেনেসাঁ বা নবজাগরণের সন্তান হিসাবে খ্যাত ম্যাকিয়াভেলি রাজনৈতিক বিষয়াদিকে ধর্মনিরপেক্ষ বা ইহজাগতিক (Secular) চেতনার দ্বারা পরিচালিত করার মানসে তাকে মধ্যযুগীয় তথা ধর্মীয় ও নৈতিকতার বেড়াজাল থেকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যান।

মানব প্রকৃতির সম্পর্কে ধারণা

উপরোক্ত লক্ষ্যে মেকিয়াভেলি যে রাজনৈতিক দর্শন উপস্থাপন করেছেন, তা তাঁর মানব প্রকৃতির ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। মানুষের চরিত্র ও রাষ্ট্রীয় সংগঠনের মধ্যে যোগসূত্র রচনা করতে গিয়ে ম্যাকিয়াভেলি বলেছেন, মানুষ স্বার্থপর , হীন মনোভাবাপন্ন, ইত্যাদি। মানুষ লোভী এবং ভীত প্রাণী। নিরাপত্তা ও উপকারের জন্য মানুষ সমাজ ও সরকার গঠন করে ও তার প্রতি আনুগত্য দেখায়। এমতাবস্থায় কঠোর শাসনের কোনো বিকল্প নাই। কঠোর শাসনের কাছে ব্যক্তি নিঃশর্ত আনুগত্য প্রদর্শন করে থাকে। জাতি রাষ্ট্রের সম্প্রসারণ এবং কঠোর শাসনের স্বার্থে শাসক যে কোনো কৌশল অবলম্বন করতে পারবেন। মেকিয়াভেলিকে তাই অনেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী না বলে ‘রাজনৈতিক কুটনীতি বিশ্লেষক’ এবং ‘কৌশল বিজ্ঞানী’ বলে অভিহিত করতে চান।

ধর্ম ও নৈতিকতার সাথে রাজনীতির সম্পর্ক 

ধর্ম ও রাজনীতি সম্পর্কে মেকিয়াভেলির ধারণা তাঁর রাজনৈতিক চিন্তার এক উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। বস্তুত, ধর্ম ও রাজনীতি সম্পর্কীয় ধারণা তাঁকে মধ্যযুগ থেকে পৃথক করে আধুনিক যুগের পথ প্রদর্শকের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। রাজনৈতিক লক্ষ্য-তথা রাষ্ট্রের ঐক্য, সংহতি ও রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করার জন্য ম্যাকিয়াভেলি ধর্ম ও নৈতিকতাকে রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণরূপে পৃথক করার পরামর্শ দিয়েছেন। ম্যাকিয়াভেলি মনে করতেন, ধর্ম, নৈতিকতা, আদর্শ বা মূল্যবোধ ইত্যাদি শাসকের কাজকর্মের সামনে বাঁধা স্বরূপ, ফলে এ সকল বাধার কারণে শাসকের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন বিঘ্নিত হতে পারে। তাই তিনি এগুলোকে রাজনীতি থেকে আলাদা করতে চেয়েছিলেন। তাঁর মতে রাজনীতির জন্য প্রয়োজন ধর্ম বা নীতিশাস্ত্র নয়, বরং এর জন্য প্রয়োজন শক্তি (Power)। জনগণের নিরাপত্তা ও সম্পত্তি রক্ষা করা এবং রাষ্ট্রের ঐক্য ও সংহতির জন্য শক্তির কোনো বিকল্প নাই। তবে তিনি জনগণের জন্য ধর্ম ও নৈতিকতাকে অস্বীকার করেন নি। তাছাড়া শাসক প্রয়োজনে ধর্মকে ব্যবহার করতে পারবেন, এমন কথাও তিনি বলেছেন। অনেকে নীতি ও ধর্মের প্রশ্নে তাঁর দ্বৈতমানকে (Double standard) সমালোচনা করে থাকেন। 

রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ও শাসকের প্রতি উপদেশ

প্রাচীন গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তায় সৎ ও উন্নত নৈতিক জীবন নিশ্চিত করাকে রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু ম্যাকিয়াভেলির লেখনীতে তা প্রত্যাখান করে ক্ষমতা অর্জন এবং শক্তিকে রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ও ভিত্তি হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। তাঁর রাষ্ট্রচিন্তার পুরোটাই রাষ্ট্রের ক্ষমতা অর্জন, বৃদ্ধি ও সংরক্ষরণের উপর প্রতিষ্ঠিত। বলাবাহুল্য, তিনি তাই শাসককে ‘সিংহের ন্যায় শক্তিশালী ও শৃগালের ন্যায় ধূর্ত’ হওয়ার উপদেশ দিয়েছেন। রাষ্ট্রের উপরোক্ত উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য তিনি মনে করতেন, শাসক যে কোনো পথ অবলম্বন করতে পারেন। ম্যাকিয়াভেলি অনুসৃত এ নীতিকে অনেকে ‘ম্যাকিয়াভেলিবাদ’ (Machiavellism) বলে আখ্যায়িত করে থাকেন। এর অর্থ হলো, রাষ্ট্রের স্বার্থে প্রতারণা, কপটতা ও নিষ্ঠুরতার দ্বারা শাসিতের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করা এবং শাসন করা। তিনি বলতে চান এর মধ্যে অনৈতিক বা অধর্মের কিছু নাই। রাষ্ট্রের স্বার্থে রাজনীতির তথা শাসকের থাকবে পূর্ণ স্বাধীনতা।

উপরোক্ত বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায় যে, ম্যাকিয়াভেলির দর্শনে রাজতান্ত্রিক ধরনের শাসন ব্যবস্থাই অগ্রাধিকার পেয়েছে এবং সার্বভৌম ক্ষমতা রাজার হাতেই তিনি ন্যাস্ত করতে চেয়েছেন। ইতালীর তৎকালীন দুর্দশার পরিপ্রেক্ষিতে ম্যাকিয়াভেলির এ ধরনের চিন্তা ভাবনা হয়তো বাস্তবমুখী ছিল।

নিকোলো মেকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তার মূল্যায়ন 

রাষ্ট্রতত্ত্ব বা রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে ম্যাকিয়াভেলি হয়তো প্লেটো, এরিস্টটলের মত বড় মাপের কেউ নন। তবে রাজনীতির কৌশল সম্পর্কে তিনি যে অবদান রেখে গিয়েছেন তা তাঁকে স্থায়ী মর্যাদা দিয়েছে। মধ্যযুগীয় ধর্মাচ্ছন্ন এবং প্রায় অস্তিত্ব বিলুপ্ত যুক্তি ভিত্তিক রাজনীতিকে ম্যাকিয়াভেলিই সর্বপ্রথম স্বার্থকভাবে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব এখানেই। এ অবদান ম্যাকিয়াভেলিকে অদ্যাবধি অম্লান করে রেখেছে। মানব প্রকৃতি সম্পর্কে হতাশাব্যাঞ্জক মন্তব্য করলেও মানবতার স্বার্থে তিনি ধর্মনিরপেক্ষ চেতনাকে এগিয়ে নিয়েছেন। রাজনৈতিক বিষয়গুলোকে পরলৌকিক বা ধর্মীয় ধারণা থেকে আলাদা করে তিনি আধুনিক যুগের একজন নির্মাতা হিসাবে ইতিহাসে পাকাপোক্ত স্থান করে নিয়েছেন। 

মেকিয়াভেলি আধুনিক জাতি রাষ্ট্রের পথ প্রদর্শক। জাতীয় রাষ্ট্র বিকাশের ক্ষেত্রে মেকিয়াভেলি একজন মূল স্থপতির ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর পূর্বে রাষ্ট্রকে এমন স্পষ্ট ও জোরালোভাবে কেউ তুলে ধরেন নি। খ্রিস্টীয় সাম্রাজ্যের বিপরীতে জাতি রাষ্ট্রের জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করার যোগ্যতার কথা তার লেখনীতে উচ্চারিত হয়েছে। ভাষা, ধর্ম, প্রথা, ইতিহাস, ঐতিহ্য নির্ভর অভিন্ন মানব গোষ্ঠীর সমম্বয়ে আধুনিক জাতি রাষ্ট্রের ধারণা তাঁরই অবদান। পরবর্তীতে ইউরোপে ও বিশ্বের অন্যান্য স্থানে একজাতি ও এক রাষ্ট্রের দ্রুত উদ্ভব লক্ষ্য করা যায়। রাষ্ট্রচিন্তাবিদ হলওয়েল যথার্থই বলেছেন, ‘ম্যাকিয়াভেলির নিকট থেকে মাৎসিনি, গ্যারিবল্টি, ক্যাভুর প্রমুখ জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ দেশপ্রেমের পথ নিয়েছিলেন।’ 

ম্যাকিয়াভেলি আধুনিক কূটনীতির জনক হিসাবেও পরিচিত। ছোট, বড়, শত্রু, মিত্র নানা ধরনের রাষ্ট্রের মধ্যে টিকে থাকার জন্য একটি রাষ্ট্রের কূটনৈতিক প্রক্রিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ম্যাকিয়াভেলি কূটনীতির মূল সূত্রগুলো তাঁর বিভিন্ন লেখনীর দ্বারা তুলে ধরেছেন। 

রাজনীতি থেকে ধর্ম ও নীতিবিজ্ঞানকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য তিনি দারুনভাবে সমালোচিত হয়ে থাকেন। শাসককে শঠতা, মিথ্যাচার, ক্ষমতা ও শক্তি প্রদর্শন এবং যুদ্ধের মাধ্যমে রাষ্ট্রের বিকাশের পরামর্শ দেওয়ার জন্য তিনি সমালোচিত হন।

উপসংহারে বলা যায়, রাষ্ট্রচিন্তায় বা রাষ্ট্র ও রাষ্ট্র শাসনে মেকিয়াভেলির অবদান হচ্ছে অনুসৃত কলাকৌশলগুলো ভালো হোক বা মন্দ হোক আধুনিক জাতি রাষ্ট্রে তা প্রায় সর্বত্রই অনুসরণ করা হচ্ছে। তাই ম্যাকিয়াভেলির চিন্তা-চেতনা আধুনিককালে জীবিত ও ক্রিয়াশীল। তাঁর এ অবদান রাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে অম্লান হয়ে আছে।

সারকথা 

নিকোলো মেকিয়াভেলি আধুনিক রাজনীতির জনক। আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তায় মেকিয়াভেলির অবদান হচ্ছে ধর্মাচ্ছন্ন মধ্যযুগীয় অসহনীয় পরিস্থিতি থেকে রাজনীতিকে উদ্ধার করে ধর্মনিরপেক্ষ বা সেকুলার ও স্বতন্ত্র মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার কৃতিত্বের দাবীদার। তাঁর মূল বক্তব্য ছিল জনগণের নিরাপত্তার জন্য, জাতি রাষ্ট্রের স্বার্থে শাসক যে কোনো পন্থা অবলম্বন করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে ধর্ম, নীতি বা মূল্যবোধ ইত্যাদি কোনো বাঁধা নয়। শঠতা, মিথ্যাচার ধোকাবাজি, রাজনীতির জন্য কোনো অপরাধ নয়। এ ভাবে তিনি আধুনিক যুগের স্থপতির ভূমিকা পালন করেছেন। অবশ্য তার জন্য তিনি সমালোচিতও হয়ে থাকেন।

তথ্যসূত্র

১. হাসানুজ্জামান চৌধুরী, মো আব্দুর রশীদ, এ এমদাদুল হক ও অন্যান্য; রাষ্ট্রবিজ্ঞান দ্বিতীয় খণ্ড, রাষ্ট্রচিন্তা, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা, ত্রয়োদশ প্রকাশ, ২০২০, পৃষ্ঠা ১২২-১২৪।

2 thoughts on “রাষ্ট্রচিন্তায় মেকিয়াভেলির অবদান মানব প্রকৃতি, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদে”

  1. I need your help for my political project. The Project name– “Machiavelli is contribution to political thought”.

    Reply
  2. লেখাটি সুন্দরভাবে উপস্থাপিত। এরকম লেখা আরো দেবেন।

    Reply

Leave a Comment

error: Content is protected !!