ভি আই লেনিন বা ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিন (ইংরেজি: Vladimir Ilyich Ulyanov Lenin; ২২ এপ্রিল, ১৮৭০ – ২১ জানুয়ারি, ১৯২৪) ছিলেন বিশ শতকের ইউরোপের মহত্তম মানব এবং রাশিয়ার বিপ্লবী মতাদর্শের প্রতিভাবান অনুশীলনকারী, সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা, ১৯১৭ সালের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের নেতা এবং বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন লেনিনবাদের প্রতিষ্ঠাতা এবং মার্কস ও এঙ্গেলসের যোগ্য উত্তরসূরি। ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গন ও পূর্ব ইউরোপের দেশসমূহে সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের ত্যাগের মধ্যে দিয়ে লেনিনের রাষ্ট্র দর্শনের ব্যাপক বিপর্যয় ঘটে।
ভি আই লেনিন ছিলেন মার্কসবাদ তথা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের ব্যাখ্যাতা এবং বিপ্লবী দার্শনিক, যিনি জীবনের প্রথম পর্বে (১৮৮৭ – ৮৮) ইউরোপীয় বিপ্লবী চিন্তাধারার সংস্পর্শে আসেন। বিশেষত কার্ল মার্কস রচিত পুঁজি গ্রন্থটি পাঠের পর নিজেকে তিনি একজন মার্কসবাদী হিসেবে আবিষ্কার করেন।
লেনিনহীন পৃথিবী বৈষম্যে ভরা, আর লেনিন পরবর্তী পৃথিবী সাম্যের সূতিকাগার। সাম্যের স্বপ্নহীন মানুষ পশুরও অধম। আর এই পশুর রাজত্ব শুরু হয়েছিলো ব্যক্তিগত সম্পদের মালিকানা উদ্ভবের পর থেকেই। মানুষের সৃষ্ট এই বৈষম্যকে দূর করার জন্য লেনিন মার্কস-এংগেলসের দেখানো পথে রাশিয়ায় বিপ্লব করেছিলেন যা ছিলো দুনিয়ার প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। তিনি মার্কসবাদের বিপ্লবী সারবস্তু যথা- শ্রেণিসংগ্রাম, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও প্রলেতারীয় একনায়কত্বের মতাবাদকে আঁকড়ে ধরে বিপ্লব সফল করেছিলেন। তিনি রাষ্ট্র ও বিপ্লব গ্রন্থে লিখেছেন, শুধু সেই মার্কসবাদী যে শ্রেণিসংগ্রামের স্বীকৃতিকে প্রসারিত করে প্রলেতারীয় একনায়কত্বের স্বীকৃতিতে।[১]
শৈশবে লেনিন
মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবি পরিবারের সন্তান লেনিন ছোটবেলা থেকেই সক্রিয়ভাবে দেশের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। জারকে হত্যা করার চেষ্টার অভিযোগে তাঁর অগ্রজের ফাঁসি লেনিনকে গভীরভাবে আলোড়িত করে। লেনিন দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনে অধিকতর অংশগ্রহণ করতে শুরু করেন। কিন্তু তিনি তাঁর ভাইয়ের বিপ্লববাদী পন্থা পরিহার করে বিপ্লবী গণসংগঠনের মাধ্যমে সামাজিক বিপ্লব সাধনের নীতি গ্রহণ করেন।
১৭ বছর বয়সে লেনিন ছাত্র আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগে প্রথম গ্রেফতার হন। তাঁকে একটা গ্রামে অন্তরীণাবদ্ধ রাখা হয়। ১৮৯১ সালে সেন্ট পিটার্সবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি আইনে স্নাতক ডিগ্রী অর্জনের পর ভলগা অঞ্চলের সামারা শহরে দুবছর আইন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৮৮৯-৯৩ সালে লেনিন সেন্ট পিটার্সবুর্গে উদীয়মান মার্কসবাদী রাজনৈতিক চক্রে যোগদান করেন।[২]
লেনিনের বিপ্লবী কার্যকলাপের জন্য লেনিনকে স্বৈরাচারী জার নির্যাতনে পিছপা হয়নি। ১৮৯৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি সাইবেরিয়ায় তিন বছরের নির্বাসন দণ্ডাজ্ঞা জানানো হলও লেনিনকে। নির্বাসনে পাঠালো জার সরকার। ১৮৯৭ সালের মে মাসে লেনিন তাঁর নির্ধারিত নির্বাসনস্থল ইয়েনিসেই গুবের্নিয়ার মিনুসিনস্ক এলাকার শুশেনস্কয় গ্রামে পৌঁছলেন। গ্রামটা ছিল রেল লাইন থেকে শত শত কিলোমিটার দূরে এক অজ সাইবেরীয় গ্রাম । এখানে থাকা লেনিনের পক্ষে সহজ ছিল না। বোনের কাছে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন – “নির্বাসনের প্রথম দিকটায় ইউরোপের মানচিত্রটা পর্যন্ত ছোঁব না ঠিক করি। মানচিত্রটা খুলে তার কালো কালো বিন্দুগুলো দেখতে ভারি কষ্ট হতো।” কিন্তু প্রত্যক্ষ বিপ্লবী কর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন থাকলেও তিনি তাঁর উদ্যম- প্রাণোচ্ছলতা হারাননি। ওই সময় প্রচুর পড়াশুনা করেন – কৃষকদের অবস্থা মন দিয়ে দেখতেন – গ্রামের জীবনযাত্রা খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন তখন। আশেপাশের লোকেরা বিভিন্ন অসুবিধায় প্রায়ই সময় লেনিনের কাছে আসত সাহায্যের আশায়। যেমন লেনিন একবার স্বর্ণখনিওয়ালার বিরুদ্ধে এক মজুরকে মামলায় জিততে সাহায্য করেন । প্রায় ২৫ বছর পর ভ্লাদিমির সেই কথা স্মরণ করে বলেছিলেন
“যখন আমি সাইবেরিয়াতে নির্বাসিত ছিলাম, তখন আমাকে উকিল হতে হয়েছিল। অবশ্য আন্ডারগ্রাউন্ড উকিল, কেননা আমি ছিলাম প্রশাসনিক ভাবে নির্বাসিত, তাতে ওকালতি নিষিদ্ধ, কিন্তু আর কেউ না থাকায় আমার কাছেই লোকে এসে কিছু কিছু মামলা – মোকদ্দমার কথা বলত।”[৩]
বিপ্লবী কর্মকাণ্ড
১৮৯৫ সালে সেখানকার শ্রমিক শ্রেণীর মুক্তি আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন। ১৮৯৪ সালে লেনিন ‘জনতার মিত্র কারা এবং সংস্কারবাদের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রামের পদ্ধতি কি’-এই শিরোনামে তাঁর প্রথম গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিক তত্ত্বমূলক গ্রন্থ রচনা করেন।
বিভিন্ন আলোচনা চক্রে এবং রাজনীতিতে অংশ গ্রহণের সময় লেনিন সহজবোধ্য দৃষ্টান্ত দিয়ে বুঝাতেন কিভাবে মার্কবাদকে প্রয়োগ করা উচিত বিপ্লবীদের জীবনে, পুঁজিবাদ ও জার সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করা দরকার কি পদ্ধতিতে। এই বিপ্লবী তৎপরতার অভিযোগে লেলিন তাঁর অপর এক বিপ্লবী সহকর্মী ও পরবর্তীতেম স্ত্রী নাদেজা স্ক্রুপস্কায়ার সাথে ১৫ মাস কারাবরণ এবং ১৯০০ সাল অব্দি সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত জীবন কাটান।[৪]
পরবর্তীকালে লেনিন ইউরোপ প্রবাসে চলে যান এবং সেখানকার বিপ্লবী চক্রে যোগদান করেন এবং ‘ইস্ক্রা’ নামে পত্রিকা প্রকাশে মনোনিবেশ করেন। লেনিনের উদ্যোগ ও পরিচালনায় রাশিয়ায় গড়ে উঠে ইস্ক্রার সহযোগী গ্রুপ ও পাঠক চক্র। পত্রিকাটি সোশ্যাল ডেমোক্রাটদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে সহায়তা করে। নির্বাসনের দ্বিতীয় পর্বে ১৯০২ সালে লেলিন রচনা করেন তাঁর সাংগঠনিক মতবাদ সম্বলিত গ্রন্থ ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান’? এই গ্রন্থে লেনিন শ্রমিক শ্রেণির রাজনৈতিক সংগঠন, পেশাদার বিপ্লবী ধারণা, বিপ্লবীদের কৌশল প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। এ সব ধারণার অনেকগুলোই লেনিন উদ্ভাবন করেন মার্কস-এঙ্গেলস্-এর চিন্তাধারাকে রাশিয়ার সমাজ জীবনে খাপ খাইয়ে নেয়ার প্রয়োজনে।
লেনিনের পরিকল্পিত বিপ্লবী তৎপরতার লক্ষ্যে লেনিন সর্বহারা শ্রেণীর অগ্রণী অংশ হিসেবে পেশাদারী বিপ্লবীদের সংগঠিত করেন যারা সুশৃঙ্খলভাবে জার সরকারের পতনের মাধ্যমে শ্রমিক রাজ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হবেন। লেনিনের মতে, শ্রেণি সচেতন পেশাদার বিপ্লবীরা গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার নীতিতে সংগঠিত হয়ে শ্রমিকদের মধ্যে শ্রেণি সচেতনতা, শৃঙ্খলা ও বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তুলবে এবং মার্কসবাদী দর্শন অনুযায়ী এক একটি নির্দিষ্ট মূহুর্তে করণীয় বিষয়াদি ব্যাখ্যা করবে। পেশাদার বিপ্লবীদের প্রতি লেনিনের অতিরিক্ত গুরুত্বারোপের বিষয়টি মনঃপুত ছিল না রুশ পেটি-বুর্জোয়া সংগঠন সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টির অনুসারীদের কাছে। লেনিন সমর্থকদের কাছে তাদের মতবিরোধ তীব্রতর হয়ে উঠলে ১৯০৩ সালে দলের দ্বিতীয় কংগ্রেসে দল দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। এ ভাবে দলীয় কংগ্রেসে লেলিনের নেতৃত্বাধীন বলশেভিক (যার বাংলা অর্থ সংখ্যগরিষ্ঠ) অল্প সংখ্যাগরিষ্ঠতার ব্যবধান বিরোধী অংশ মেনশেভিকরা কৃষকদের (সংখ্যালঘু) পরাজিত করে। তা সত্ত্বেও পেশাদারী বিপ্লবীদের ভূমিকা অস্বীকার করে মেনশেভিকরা কৃষকদের মনে করত বিপ্লবের চালিকা শক্তি এবং চেষ্টা করত জার সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে এদেরকে অগ্রভাগে নিয়ে আসতে। দলের এই অভ্যন্তরীণ সংকটের রাজনীতি লেনিনের পরবর্তী রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অনেক প্রাধান্য বিস্তার করে।
১৯০৫ সালের বিপ্লব ও পরবর্তী কর্মকাণ্ড
১৯০৫ সালে বিপ্লবের পর রাশিয়ার টালমাটাল দিনগুলোতে লেনিন রাশিয়ায় ফিরে আসেন এবং মাত্র দু’বছরের মাথায় প্রবাসে পাড়ি দিতে বাধ্য হন। নির্বাসিত জীবনে ইউরোপে কঠিন সময় অতিবাহিত করতে হয় লেনিনকে। সে সময় রাশিয়ায় বিপ্লবের ভবিষ্যৎ নিয়ে মেনশেভিকদের সাথে মতবিনিময় সত্ত্বেও লেনিনের অনেক অনুগত মেধাবী অনুসারী তাঁকে পরিত্যাগ করেন। দলের বিপ্লবী চিন্তাধারার কর্ণধার লেনিন ১৯০৯ সালে রচনা করেন। ‘মেটারিয়ালিজম এন্ড ইস্পিরিও ক্রিটিসিজম’ গ্রন্থ। এতে তিনি প্রকৃতি বিজ্ঞানের সর্বশেষ বিকাশের পরিপ্রেক্ষিতে মার্কসবাদী দর্শন ও জ্ঞানতত্ত্বের স্বরূপ তুলে ধরেন। তারও তিন বছর পর প্রাগে দলীয় এক কনভেনশনে মেনশেভিক-বলশেভিক ভাঙ্গন চুড়ান্ত হয়ে পড়ে।
১৯১৪ সালে লেনিন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনালগ্নে যুদ্ধকে বুর্জোয়াদের অভ্যন্তরীণ লড়াই হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং তাঁর কর্মীদেরকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াই-এ অবতীর্ণ হওয়ার আহবান জানান। ১৯১৭ সালের মার্চ মাসে সংগঠিত বিপ্লবে জার সরকারের পতন ঘটলে লেনিন গোপনে জার্মানী হয়ে পেট্রোগার্ড (সেন্ট পিটার্সবুর্গের নতুন নামকরণ) পৌঁছান। জোসেফ স্ট্যালিনসহ স্থানীয় বলশেভিক নেতৃবৃন্দ তখন লেনিনকে জানান যে অভ্যুত্থানের সোভিয়েত শ্রমিক ও সেনা সদস্যরা বুর্জোয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সমর্থন যুগিয়েছে। এটি অবহিত হয়ে লেলিন তার তাৎক্ষণিক বক্তৃতায় (ইতিহাসে যা ‘এপ্রিল থিসিস’ নামে খ্যাত) দলের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের আহবান জানান।
লেনিন এপ্রিল থিসিসে যুক্তি প্রদর্শন করেন যে, বলশেভিক বিপ্লবের পর একমাত্র শ্রমিকদের সমন্বয়ে গঠিত সোভিয়েতগুলো (পরিষদসমূহ) রুশ শ্রমিক ও কৃষকদের আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম। পরবর্তীতে জুলাই মাসে শ্রমিকদের একটি ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর লেলিন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার থেকে লুকিয়ে আগস্ট – সেপ্টেম্বর মাসে ফিনল্যান্ড অবস্থান করেন। সেখানে অবস্থানকালে ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ নামে বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেন। এই বইতে তিনি শ্রেণি সংগ্রাম, রাষ্ট্র ও বিপ্লবের সমস্যাবলী, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে জনগণের ভূমিকা, সাম্যবাদী সমাজ নির্মাণ, জনগণের সাথে পার্টি ও নেতৃত্বের পারস্পরিক সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে আলোকপাত করেন। উপরন্তু, মার্কসের শ্রেণিসংগ্রাম তত্ত্বকে কিছুটা পরিশীলিত করে সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদকে সমাজবিকাশের দুটো পৃথক পর্যায় হিসেবে চিহ্নিত করেন লেনিন। মার্কসীয় রাষ্ট্রতত্ত্বে লেনিনের ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ বইটি এক মৌলিক অবদান হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।[৫]
অক্টোবর বিপ্লব ও লেনিন
১৯১৭ সালের ২৫ অক্টোবর (রাশিয়ার সংশোধিত নতুন পঞ্জিকা অনুসারে ৭ নভেম্বর) সকাল নাগাদ সাময়িক সরকারের আশ্রয়গ্রহণকারী স্থল শীত প্রাসাদ ও পেত্রগ্রাদ সামরিক বাহিনীর সদর দপ্তর ছাড়া গোটা পেত্রগ্রাদ তখন বিপ্লবী শ্রমিক, সৈনিক ও নাবিকদের দখলে। সেদিন বেলা ২-৩৫ মিনিটে স্মলনির হলঘরে পেত্রগ্রাদ সোভিয়েতের সভা বসল। রাতে দলে দলে বিদ্রোহী শ্রমিক, লালরক্ষী, সৈনিক আর নাবিকের হাতে শীত প্রাসাদের দখল সম্পূর্ণ চলে এলো, বুর্জোয়া ও জমিদারদের সরকারের শেষ ঘাঁটিটার পতন হলো।[৬]
বলশেভিক বিপ্লবের পর ৭ নভেম্বর লেনিন সোভিয়েত সরকার প্রধান হিসেবে কাউন্সিল অব পিপলস কমিশনের সভাপতি নির্বাচিত হন। দায়িত্বভার গ্রহণের পর সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ধীরে চলো নীতি গ্রহণ করেন তিনি। বিপ্লবের ফসল সোভিয়েতসমূহের ক্ষমতাকে দেশের অভ্যন্তরীণ ও বাইরের শত্রুর হাত থকে রক্ষার কাজে তিনি আত্মনিয়োগ করেন। একই লক্ষ্যে তিনি জার্মানীর সাথে ব্রেস্ত-লিটভোস্ক শান্তি চুক্তিতে উপনীত হন। তাঁর এই ধীরে চলার নীতি অবশ্য ১৯১৮-২১ সালে দেশে গৃহযুদ্ধ ডেকে আনে। লিও ত্রতস্কির সমর্থন ও রেড আর্মির ক্ষিপ্রতায় লেলিন সোভিয়েত ইউনিয়নের গৃহযুদ্ধে বিজয়ী হন। যুদ্ধের পর লেনিন নয়া অর্থনৈতিক নীতিমালার মাধ্যমে দেশকে বাজার অর্থনীতি ও বহুত্ববাদী সমাজে ফিরিয়ে আনেন এবং একইসাথে দলসমূহের মাঝে ভাঙ্গনের ধারাকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে প্রলেতারীয় একনায়কত্বের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। লেনিন ১৯২৪ সালের ২১ জানুয়ারী তাঁর কর্মবহুল জীবনের অবসান ঘটিয়ে মস্কোর উপকণ্ঠে গর্কি গ্রামে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
ভ্লাদিমির লেনিন গ্রন্থপঞ্জি
মার্কস-এঙ্গেলসের সাম্যবাদী মতবাদের অনুসারী লেনিন রচনা করেছিলেন অনেক চিন্তা ও কাজের লেখা মার্কসবাদী দর্শনের বিশ্লেষণে লেনিন কর্তৃক সম্পাদিত সংযোজনসমূহের সমন্বয়ে ৪৫ খন্ডে প্রকাশিত হয় ‘লেনিন রচনা সমগ্র’। এসব রচনায় লেনিন অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজ, দর্শন, সংস্কৃতি, বিপ্লবের রণকৌশল ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন। অধিকাংশ মার্কসবাদীদের কাছে মার্কসবাদ বলতে মার্কসবাদ-লেলিনবাদের সমন্বিত মতবাদকেই বুঝানো হয়।
শ্রেণী এবং শ্রেণীসংগ্রাম, রাষ্ট্র এবং বিপ্লব প্রভৃতি সমস্যা বিশ্লেষণ করে লেনিন একাধিক গ্রন্থ রচনা করেন। তা ছাড়া তিনি সংস্কৃতি, সমাজতান্ত্রিক শিল্প, সাহিত্য এবং চারিত্রনীতি প্রভৃতি সমস্যার উপরও আলোকপাত করেন। লেনিন ভাবধারাকে লেনিনবাদ নামে অভিহিত করা হয়। লেনিনবাদ মার্কসবাদের নতুনতর বিকাশের স্মারক।
মূল্যায়ন
বিশ শতকের ইতিহাসের নতুন পর্যায়ের সমস্যার বিচার, বিশ্লেষণ ও সমাধানে মার্কসবাদের সৃজনশীল ব্যাখ্যা এবং প্রয়োগের মধ্যেই লেনিনের কৃতিত্ব নিহিত। লেনিন ১৯১৬ সালে তার ‘সাম্রাজ্যবাদ—পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর’ শীর্ষক সুবিখ্যাত গ্রন্থে বিশ শতকের প্রথম দিকে পুঁজিবাদের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যের সুনিপুণ বিশ্লেষণ উপস্থিত করেন এবং সেই বিশ্লেষণের ভিত্তিতে সাম্রাজ্যবাদী স্তরে পুঁজিবাদের বিকাশের বিধান উদঘাটিত করেন। এই বিশ্লেষণ অত্যাসন্ন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের এক শক্তিশালী আদর্শগত হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। লেনিনের এই গ্রন্থ তাঁর অন্যান্য সামাজিক দার্শনিক সমস্যার ওপর লিখিত বহুসংখ্যক গ্রন্থের ন্যায় সমাজ বিকাশের মৌলিক সূত্রের প্রাঞ্জল উপস্থাপনার জন্য বিপ্লবী কর্মী এবং সমাজবিজ্ঞানীর নিকট চিরায়ত সাহিত্যের রূপ লাভ করেছে। বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদের অসম বিকাশের বাস্তব অবস্থাকে বিশ্লেষণ করে লেনিন প্রমাণ করেন, এমন অবস্থায় একটি বিশেষ দেশেও সমাজতন্ত্র কায়েম হতে পারে। ইতিপূর্বে ধারণা করা হতো বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদের যে শক্তি ও বিকাশ তাতে বিচ্ছিন্নভাবে কোনো এক দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে বিশ্বব্যাপী একই সময়ে তা প্রতিষ্ঠিত হবে।
বাস্তব অবস্থার ভিত্তিতে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের নিয়ত বিকাশের ওপর লেনিন সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। ১৯০৮ সালে রচিত তাঁর ‘ম্যাটেরিয়ালিজম অ্যান্ড এমপিরিও ক্রিটিসিজম’ গ্রন্থ তাঁর মৌলিক দার্শনিক চিন্তার প্রকাশ হিসেবে সুপরিচিত। মার্কসবাদ বা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের বিকৃতির অপচেষ্টাকে লেনিন তার এই গ্রন্থে আপোষহীনভাবে বিশ্লেষণ ও সমালোচনা করেন। এই বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে তিনি বিজ্ঞানের সর্বশেষ আবিষ্কার ও তত্ত্বসমূহ সম্পর্কে এবং জ্ঞানের সমস্যায় তার মতামত উপস্থিত করেন। শ্রেণি এবং শ্রেণিসংগ্রাম, রাষ্ট্র এবং বিপ্লব প্রভৃতি সমস্যা বিশ্লেষণ করে লেনিন একাধিক গ্রন্থ রচনা করেন। তাছাড়া তিনি সংস্কৃতি, সমাজতান্ত্রিক শিল্প, সাহিত্য এবং চারিত্রনীতি প্রভৃতি সমস্যার ওপরও আলোকপাত করেন। লেনিনের ভাবধারাকে লেনিনবাদ বলে অভিহিত করা হয়। লেনিনবাদ মার্কসবাদের নতুনতর বিকাশের স্মারক।
Meterialism and Empirio-Criticism বা বস্তুবাদ এবং নব-অভিজ্ঞতাবাদ হচ্ছে লেনিনের একটি দার্শনিক গ্রন্থ। ১৯০৫ সালের রুশ বিপ্লবের ব্যর্থতার পরবর্তী পর্যায়ে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের বুদ্ধিজীবীদের একাংশের মধ্যে নানা দার্শনিক বিভ্রান্তির প্রকাশ দেখা যায়। ম্যাক, আভানারিয়াস প্রমুখ চিন্তাবিদ উনবিংশ শতকের শেষদিকে ‘এ্যামিপিরিও-ক্রিটিসিজম’ নামক এক তত্ত্ব দাঁড় করান। রুশ সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্যে এ তত্ত্বের অনুসারীদের লেনিন ‘ম্যাকিসটস’ বলে আখ্যায়িত করেন। এ তত্ত্বের মূল বিভ্রান্তির দিক উন্মোচন করে তার যে বিশ্লেষণ লেনিন রচনা করেন তাঁর সেই রচনা ‘ম্যাটেরিয়ালিজম অ্যান্ড এমপিরিও-ক্রিটিসিজম’ নামে ১৯০৯ সালে প্রকাশিত হয়। লেনিন এই তাত্ত্বিকদের আলোচনা করে বলেন, আন্দোলনের বিপর্যয়কালে যেখানে প্রয়োজন দ্বান্দ্বিক এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মূল সত্যকে সংশোধনবাদের আঘাত থেকে রক্ষা করা, রুশ ‘ম্যাকিসটস’গণ সেখানে সংশোধনবাদী নব-অভিজ্ঞতাবাদের ‘অন্তর্বাদী’ বা ‘সাবজেকটিভ’ ভাববাদ এবং জ্ঞানের প্রশ্নে অজ্ঞানবাদকে প্রচার করার চেষ্টা করেছেন। বাজারভ, বোগদানভ, লুনাচারস্কি প্রমুখ সমাজতন্ত্রী বুদ্ধিজীবী সংগ্রামের পথ পরিত্যাগ করে গ্রহণ করেছেন রহস্যবাদ এবং হতাশাবাদকে। অভিজ্ঞতাবাদ, উপলব্ধিবাদ, প্রতীকবাদ প্রভৃতি নতুন নতুন শব্দের আড়াল দিয়ে তারা বিকৃত করার চেষ্টা করেছেন দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ তথা মার্কসবাদকে। লেনিনের এ গ্রন্থ ভাবধারার ক্ষেত্রে সংগ্রামের প্রশ্নে তাঁর আপোষহীনতারও এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
বাজারভ, বোগদানভ, লুনাচারস্কি এরাও সমাজতন্ত্রের কথা বলেন, কাজেই তাদের আক্রমণ করে রুষ্ট না করে তাঁদের সঙ্গে আপোষের প্রস্তাব করলে লেনিন লেখক গোর্কিকে বলেছিলেন: আপনি নিশ্চয়ই একদিন স্বীকার করবেন যে, আদর্শের ক্ষেত্রে কোনো মতকে যদি দলের কর্মী স্বপ্রত্যয়ে ভ্রান্ত এবং ক্ষতিকর বলে জানে, তবে সে ভ্রান্ত এবং ক্ষতিকর মতের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রাম করাই তার অনিবার্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। তার সঙ্গে আপোষ করা নয়’। লেনিন তাঁর এই গ্রন্থে বার্কলে, কান্ট, হিউম প্রভৃতি আধুনিক মুখ্য ভাববাদীদের দর্শনসহ সমগ্র ভাববাদের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের ভিত্তিতে, তার বিশিষ্ট রচনাশৈলীতে তীক্ষ সমালোচনা উপস্থিত করেন। লেনিনের ‘ম্যাটেরিয়ালিজম অ্যান্ড এমপিরিও-ক্রিটিসিজম’ সংগ্রামী দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের ক্ষেত্রে এক ঐতিহাসিক সংযোজন।[৭]
উপসংহার
কাল মার্কসের সাম্যবাদী চিন্তাধারা বলশেভিকদের ক্ষমতায় আরোহন ও তা অক্ষুন্ন রাখতে সহায়তা করে। মার্কসবাদী দর্শনকে রাশিয়ার আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্য বিধানে লেনিনের ভূমিকা ছিলো অপরিসীম। মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সমন্বিত চিন্তাধারা পরবর্তীতে গ্রামসি, জোসেফ স্ট্যালিন, লিও ত্রতস্কি ও মাও সেতুঙ এর মতো বিপ্লবী নেতৃত্বের সৃষ্টি করে। অধিকাংশ বিশ্লেষকের মতে লেনিন ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিপ্লবী নেতা।
লেনিনের সব স্বপ্নই পূরণ হচ্ছে, লেনিনের সব আশা আবার পৃথিবীতে ঝলকে উঠছে, লেনিনের সব আকাঙ্ক্ষা ছড়িয়ে যাচ্ছে মহাবিশ্বের দশ দিকে; এ পৃথিবী ক্রমাগত লেনিন হচ্ছে। লেনিনবাদ বেঁচে থাকুক; লেনিন বেঁচে থাকুন মহাবিশ্বের সর্বত্র।
তথ্যসূত্র
১. অনুপ সাদি, ২৩ এপ্রিল ২০১৯, “ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনের মহান বিপ্লবী”, রোদ্দুরে ডট কম, ঢাকা, ইউআরএল: https://www.roddure.com/biography/vladimir-lenin/
২. সরদার ফজলুল করিম, সেইসব দার্শনিক, কথাপ্রকাশ ঢাকা, তৃতীয় মুদ্রণ ফেব্রুয়ারি ২০১৩, পৃষ্ঠা ১০২-১০৪।
৩. গ. দ. অবিচকিন ও অন্যান্য, ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন, সংক্ষিপ্ত জীবনী, প্রগতি প্রকাশন মস্কো, ১৯৭১; পৃষ্ঠা-৩৭-৩৮।
৪. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬; পৃষ্ঠা ২৬৩-২৬৪।
৫. অনুপ সাদি, পূর্বোক্ত,
৬. এম আর চৌধুরী, মার্কসবাদ বা সমাজতন্ত্রের নয় – সংশোধনবাদ ও সমাজতান্ত্রিক বুর্জোয়াদের পতন, হেলাল উদ্দীন, ঢাকা দ্বিতীয় সংস্করণ মার্চ ২০১৬, পৃষ্ঠা ১৭৩
৭. সরদার ফজলুল করিম, সেইসব দার্শনিক, কথাপ্রকাশ ঢাকা, তৃতীয় মুদ্রণ ফেব্রুয়ারি ২০১৩, পৃষ্ঠা ১০২-১০৪।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।