ছোটগল্পের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস (ইংরেজি: History of Short story) শুরু হয়েছে ঊনবিংশ শতাব্দীর তৃতীয়—চতুর্থ দশকে। গল্প বলা এবং শোনার প্রবণতা মানুষের মধ্যে প্রাচীনকাল থেকে বিদ্যমান থাকলেও একটি নির্দিষ্ট শিল্পরূপ হিসেবে ছোটগল্পের সৃষ্টি ঊনবিংশ শতাব্দীতে। অর্থাৎ ছোটগল্প সাহিত্যের কনিষ্ঠতম আঙ্গিক। কবিতা, নাটক, উপন্যাস, এমন কি প্রবন্ধেরও পরে ছোট গল্পের সৃষ্টি।
ইংরেজি Story শব্দটির অর্থ ব্যাপক ও বিচিত্র; যেমন, রূপকথা, প্রাচীনকাহিনী, ঘটনার বিবরণ, কল্পিত কাহিনী, সংবাদ, বিবৃতি, গল্প কিংবা উপন্যাস ও নাটকের কাহিনী ইত্যাদি। এই Story শব্দটি ছোটগল্পের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়েছে। ছোটগল্প শব্দবন্ধটিকে আমরা ইংরেজি Short Story শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে গ্রহণ করেছি।
ছোটগল্পের উদ্ভব
উদ্ভব পর্যায়ের ছোটগল্প রচয়িতাদের মধ্যে এডগার এ্যালান পো-ই (১৮০৯-১৮৪৯) প্রথম লেখক যিনি ছোটগল্প রচনা ও তার সংজ্ঞার্থ নির্ণয়ে মনোযোগী হয়েছিলেন। সাধারণ পাঠকের জন্য সাময়িক পত্রিকা যে গল্পরস সৃষ্টি করে, পো তাকেই বিশিষ্ট শিল্প-আঙ্গিকের মর্যাদায় উন্নীত করেন। কবিতা, নাটক ও উপন্যাসের মতো ছোটগল্পের মধ্যেও তিনি প্রত্যক্ষ করেন পরিপূর্ণ শিল্পরূপের লক্ষণ। আধুনিক বুদ্ধিমান পাঠক তার সক্ষম সংবেদনশীলতা দিয়ে যে ছোটগল্প উপভোগ করতে পারেন, এ- ধারণাকেও তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন।
ছোটগল্প আয়তনে ছোট হলেও যে কাঠামোসর্বস্ব নয়, এধারণাকে তিনি ভুল প্রমাণ করলেন। বিষয় ও আঙ্গিকের সতর্ক বিন্যাসে ছোটগল্প একটি জৈব-সমগ্ররূপ প্রাপ্ত হয়। ঘটনা ছোটগল্পের আবশ্যক উপাদান বটে, কিন্তু ঘটনার পর ঘটনার উপস্থাপনা ছোটগল্প নয়। বরং একটি নির্দিষ্ট ভাবের কার্যকারণ-সম্মত বিন্যাস চরিত্রের কর্ম ও চিন্তার মধ্য দিয়ে ছোটগল্পে রূপ লাভ করে। ঘটনাংশ বা Plot সাহিত্যের প্রতিটি রূপেরই (Form) আবশ্যিক উপাদান। কিন্তু ছোটগল্প উদ্ভবের কালে অন্যান্য সাহিত্যরূপেও ঘটনা অপেক্ষা ঘটনার কার্যকারণ কিংবা ঘটনার প্রতিক্রিয়াকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়। পৃথিবীর সব ছোটগল্পকারের মধ্যেই এ-বিষয়ে মনোযোগ ও সতর্কতা লক্ষ করা যায়। বিষয়বস্তু বা ভাবের সঙ্গে এভাবেই ঘটনার ঐক্য নিরূপিত হয়।[১]
রাশিয়ায় নিকোলাই গোগল এবং আমেরিকায় এডগার অ্যালান পো ও নাথানিয়েল হথর্ন বিশ শতকের তিনের দশকেই শিল্পরূপ হিসেবে ছোটগল্পকে তৈরি করে ফেলেছেন। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর অষ্টম-নবম দশক পর্যন্ত অনেকেই মনে করেছেন ছোটগল্প হলো লম্বা-গল্প বা উপন্যাস লেখার প্রস্তুতি পর্ব মাত্র। যেমন এমিল জোলা, গী দ্য-মোপাসাঁর প্রথম গল্পসংকলনের প্রশংসা করতে গিয়ে ১৮৮১ সালেও লেখেন যে একটি উপন্যাস লিখে মোপাসাঁকে তাঁর সম্ভাবনার সত্যিকারের প্রতিষ্ঠা দিতে হবে। আবার এরকম প্রচলিত বিশ্বাস ছিল যে গল্পের মধ্যে কিছু উপকাহিনি ঢুকিয়ে এবং নতুন চরিত্র যোগ করে উপন্যাসের রূপ দেওয়া যায়। তেমন প্রচেষ্টা বেশ কিছু লেখকদের একটা রীতি মধ্যে লক্ষ করা গেছে, ফলে ছোটগল্পকে খণ্ড বা ভগ্ন হিসেবে দেখার এক তৈরী হয়।
ছোটগল্পের আলোচনায় ‘বিফ লিটল’ ‘ক্ষুদ্র’ ‘টুকরো’ ইত্যাদি শব্দগুলি ফিরে ফিরে আসে, বোধ হয় এক ধরনের অসম্পূর্ণতার বোধ থেকে। এ-সব ও শুনতে, হয়তো কিছুটা হতাশ হয়েই, ১৮৮৯ সালে আন্তন চেকভ অনেক ভঙ্গীতে জানান যে ছোটগল্পেরও নিজস্ব কিছু রীতিনীতি আছে এবং একটি ছোটগল্প পাঠককে শেষ পর্যন্ত একটি সম্পূর্ণতার বোধে পৌছে দেয়। রবীন্দ্রনাথের ছ-টি গল্প প্রকাশের পর হিতবাদী কর্তৃপক্ষ যে গল্প-প্রকাশ বন্ধ করে দেন তার কারণ কি গল্পকার রবীন্দ্রনাথ নাকি এই শিল্পরীতির বিষয়েই এক ধরনের অনাস্থা? ছোটগল্পের জন্ম কেন হলো এ নিয়ে একটি অন্যতম মত হলো কোনো আকস্মিকতা নেই এর পেছনে। আমাদের ভঙ্গুর এবং দ্রুত অপসৃয়মাণ ঘটনাবলি ও সময়ের নিয়মেই এর জন্ম ।
উনবিংশ শতাব্দীর থ্রী-ডেকার, ত্রয়ী, মহাকাব্যিক ইত্যাদি নানাগোত্রের উপন্যাসে যে বাস্তবতার নির্মাণ তা যেন অনেকটাই স্বপ্নবিলাস। এর বিপরীতে আধুনিক অস্তিত্ব চেস্টারটনের ভাষায়, একটা আভাস মাত্র, হয়ত বা শুধুই মায়া। আমাদের কোনো চূড়ান্ত সহজাত প্রবৃত্তি বা প্রকৃতি নেই । অসম্পূর্ণতা আমাদের আসল বাস্তবতা আর সম্পূর্ণতা আমাদের নির্মাণ, উপকথা আমাদের প্রকৃত ভাষ্য, কথা আমাদের সৃষ্টি। উপন্যাস থেকে ছোটগল্পে আসা প্রকৃতপক্ষে আধুনিক জীবন ও সাম্প্রতিক সময়ের কাছে যাওয়া, জীবন ও শিল্পের অস্তিত্বকে আরো কিছুটা নিবিড় করা। অবশ্য এই মত সর্বজনগ্রাহ্য নয়। আবার একই লেখক গল্প এবং উপন্যাস একই সঙ্গে লিখছেন, যেন সময়, সমাজ ও জীবনেরই ভিন্ন কোনো দায় থেকে। যেমন রবীন্দ্রনাথ একদিকে তার গল্পগুচ্ছ-এ পল্লী-প্রাঙ্গণের ‘আপন প্রাত্যহিক সুখদুঃখের’ কথা প্রতিবিম্বিত করলেন, অন্যদিকে নাগরিক জীবন, রাষ্ট্রভাবনা, রাজনীতি, স্বদেশ-বিদেশ ইত্যাদি বিষয়গুলি ব্যবহার করলেন তাঁর উপন্যাসগুলিতে।
তার পরবর্তী সময়ে বেশ কয়েকজন গল্পকার বিশেষ করে হর্হে লুই বোরহেস এবং ফ্রানৎস কাফকা, অন্য এক আধুনিকতার সন্ধান করলেন ছোটগল্পে বোরহেস সচেতন নতুন কিছু সৃষ্টির পরিবর্তে একই কাহিনির মধ্য দিয়ে আধুনিক সময় ও জীবনকে নতুনভাবে আবিষ্কার (ডিসকভারি) করতে চাইলেন আর কাফকা ছোটগল্পে খুঁজে চললেন এমন শব্দমালা যা প্রাচীরের পরিবর্তে সেতু বাঁধতে পারে এবং একই সঙ্গে কেউ গল্পের সন্ধানে মাতলে যা একই সঙ্গে যুদ্ধ ও মুক্ত করতে পারে।[২]
তথ্যসূত্র
১. বেগম আকতার কামাল, ভীষ্মদেব চৌধুরী, রফিকউল্লাহ খান ও অন্যান্য, বাংলা ভাষা: সাহিত্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর, পুনর্মুদ্রণ ২০১১, পৃষ্ঠা ১৯।
২. রামকুমার মুখোপাধ্যায় সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত বুদ্ধিজীবীর নোটবই, নবযুগ প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা, প্রথম সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০১০, পৃষ্ঠা, ২২৬-২২৮।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।