রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু বা পরিধি বা সীমানা মানুষের সকল রাজনৈতিক কার্যকলাপ

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি বা সীমানা বা বিষয়বস্তু (ইংরেজি: Scope or Boundary or Subject Matter of Political Science) হচ্ছে মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সকল রাজনৈতিক কার্যকলাপ। তাই এই সামাজিক বিজ্ঞানের শাখাটির আলোচনার ক্ষেত্রের সীমানা বা বিষয়বস্তুর ব্যাপ্তি নির্ধারণ মোটেই সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়বস্তু স্থির নয়, পরিবর্তনশীল। প্রকৃতপক্ষে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার ক্ষেত্রের সীমানা অতিমাত্রায় ব্যাপক। এ জন্যই রোডি (Roddee) বলেন, “রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কোন সঠিক এবং সুনির্দিষ্ট সীমানা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়।”  

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু অনেক ব্যাপক। নিম্নে বিস্তারিতভাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি বা বিষয়বস্তু সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:

১. রাষ্ট্র : রাষ্ট্রবিজ্ঞান হলো রাষ্ট্র সম্পর্কিত বিজ্ঞান। সে সূত্রে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি রাষ্ট্রের লক্ষ্য ও কার্যাবলি, রাষ্ট্রে ব্যক্তির ভূমিকা, রাষ্ট্রের নাগরিক অধিকার ইত্যাদি আলোচনা করে। রাষ্ট্র যেহেতু রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত, সেহেতু এর আলোচনা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। তাই অধ্যাপক গার্নার বলেন, “Political science begins and ends with state.”

২. সমাজ: রাষ্ট্রবিজ্ঞান সামাজিক বিজ্ঞানের একটি অংশ। সুতরাং সামাজিক বিজ্ঞান হিসেবে সমাজবিজ্ঞান, সমাজের উৎপত্তি, সমাজে ব্যক্তির ভূমিকা, সমাজের ভূমিকা, সামাজিক জীব হিসেবে রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যক্তির ভূমিকা ইত্যাদি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আওতাভুক্ত। সামাজিক আচার-আচরণ এবং ন্যায়-নীতিও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয় হিসেবে স্বীকৃত।

৩. সরকার: রাষ্ট্র যেমন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়, সরকার তেমনি রাষ্ট্রের আলোচ্য বিষয়। কারণ সরকারের মাধ্যমে রাষ্ট্র তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে বাস্তবতা দান করে এবং জনগণের আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটায়। তাই আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ অধিকাংশই সরকারের আলোচনাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষপাতী। এ বিষয়ে গিলক্রিস্ট, গেটেল, পল জানে, লাস্কি প্রমুখ চিন্তাবিদরা সুস্পষ্ট অভিমত দিয়েছেন। পলজানে (Paul Janet) বলেছেন, “রাষ্ট্রবিজ্ঞান হলো সামাজিক বিজ্ঞানের সে অংশ, যা রাষ্ট্রের ভিত্তি ও সরকারের নীতিসমূহের আলোচনা করে।”

৪. নৈতিকতা: রাষ্ট্রবিজ্ঞান কী হওয়া উচিত, কী অনুচিত তাও স্থির করে দেয়। রবসন (Robson) বলেন, “মানুষের নৈতিক সমস্যা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয় হিসেবে গণ্য হয়।” সুতরাং মানুষের ভাল মন্দ দিক নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনা করে।

৫. ক্ষমতা: আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ ক্ষমতার আলোচনাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আওতাভুক্ত করেছেন। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতানুসারে রাষ্ট্র ক্ষমতার ভিত্তি। ক্ষমতার দ্বারা প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি ও ক্ষমতা প্রয়োগের ফলাফল অনুসন্ধান করাই হলো রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মুখ্য উদ্দেশ্য। অধ্যাপক বল (Alan R. Ball) বলেছেন, রাজনীতি অধ্যয়নের মূল বিষয়ই হলো রাজনৈতিক ক্ষমতা।

৬. রাজনৈতিক দল: রাজনৈতিক দল হলো এমন এক জনসমষ্টি যারা নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে বৈধ উপায়ে শাসন ক্ষমতা দখল করার চেষ্টা করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান এ সূত্রে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি, দলব্যবস্থার শ্রেণীবিভাগ, বিরোধী দলের ভূমিকা, রাজনৈতিক দলব্যবস্থা, উন্নয়নশীল দেশে এবং উন্নত দেশে কিভাবে ভূমিকা পালন করছে তা নিয়ে আলোচনা করে।

৭. চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী: স্বার্থ গোষ্ঠী হলো এমন এক জনসমষ্টি, যা তার সদস্যদের সরকারি পদে বসানোর চেষ্টা না করে সরকারি সিদ্ধান্তসমূহকে প্রভাবিত করে। চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীসমূহ রাষ্ট্রীয় ক্রিয়াকলাপ তথা সমাজকে প্রভাবিত করে, তাই চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী রাষ্ট্রের একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে।

৮. আইন: সার্বভৌমের নির্দেশকেই আইন বলে। রাষ্ট্র ও সরকার ছাড়াও সরকার প্রণীত আইনও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার অন্তর্ভুক্ত। রাষ্ট্রের পক্ষেই সরকার আইন প্রণয়ন করে শাসনকার্য পরিচালনা এবং শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করে। তাই আইনের আলোচনা করা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মুখ্য বিষয়।

৯. জনমত: জনমত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার মূল বিষয়। রাষ্ট্রের জনগণের কল্যাণকামী মতই হলো জনমত। জনমত আধুনিক শাসনব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক। জনমতের গুরুত্ব রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনমতের বাহন ও ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল কাজ। সুতরাং জনমত হলো রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল আলোচ্য বিষয়।

১০. শাসনতন্ত্র বা সংবিধান: শাসনতন্ত্র হলো সরকার এবং রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক নীতি। শাসনতন্ত্র অনুযায়ী রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালিত হয়। শাসনতন্ত্রের প্রকৃতি অনুযায়ী সরকারের প্রকৃতি নির্ধারিত হয়। শাসনতন্ত্র ব্যক্তি, রাষ্ট্র, সরকারকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। তাই এটা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আওতাভুক্ত।

১১. সার্বভৌমিকতা: সার্বভৌমিকতা হলো রাষ্ট্রের চরম, চূড়ান্ত এবং অবাধ ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতা। সার্বভৌম ক্ষমতা হিসেবে সার্বভৌমের কার্যাবলি, সার্বভৌমিকতার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ ইত্যাদি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আওতাভুক্ত।

১২. অধিকার: প্রত্যেক ব্যক্তি বা ব্যক্তি সমষ্টির ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপযোগী এবং রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও সংরক্ষিত সুযোগ সুবিধাই অধিকার। অধিকার সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় হতে পারে। অধিকার ভোগের মাধ্যমে একজন নাগরিক রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহণ করতে পারে। আবার অধিকারের সাথে কর্তব্যের সম্পর্ক আছে। সুতরাং কর্তব্য পালনের অর্থ হলো রাষ্ট্র ও সরকার সম্পর্কে জানা, যা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আওতাভুক্ত।

১৩. সাম্য ও স্বাধীনতা: স্বাধীনতা বলতে নিজের ইচ্ছামতো কাজ করাকে বুঝায়, যাতে অন্যের অনুরূপ কাজে বাধা সৃষ্টি করতে না পারে। সাম্য হলো সমাজে বা রাষ্ট্রে সকলের সমান সুযোগ সুবিধা ভোগের ক্ষমতা। স্বাধীনতাবিহীন সমাজ জীবন অচল, স্বাধীনতার জন্য বিভিন্ন আইন তৈরি হয়েছে। তাই স্বাধীনতার সাথে আইন ও সাম্যের সম্পর্ক আছে, যা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আলোচিত হয়।

১৪. কূটনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি: রাষ্ট্রবিজ্ঞান আন্তর্জাতিক রাজনীতি আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে কূটনীতির উৎপত্তি, কার্যাবলি, শ্রেণীবিন্যাস ইত্যাদি আলোচনা করে। কেননা কূটনীতি রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক সৃষ্টি করে। অন্যদিকে, নিজ রাষ্ট্রের স্বার্থরক্ষা করার জন্য একটি রাষ্ট্রের সাথে অন্য রাষ্ট্রের যে সম্পর্ক তা হলো পররাষ্ট্রনীতি। পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যাবলি রাষ্ট্রবিজ্ঞান আলোচনা করে।

১৫. আন্তর্জাতিক আইন: যেসব নিয়মকানুন সভ্য রাষ্ট্রসমূহের পারস্পরিক ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রণ করে, সাধারণভাবে সেগুলোই আন্তর্জাতিক আইন। আন্তর্জাতিক আইন মান্য করা প্রতিটি রাষ্ট্রের কর্তব্য। আন্তর্জাতিক আইন মান্য না করলে রাষ্ট্রসমূহকে শাস্তি পেতে হয়। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞান আন্তর্জাতিক আইন প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান জাতিসংঘের কার্যাবলি আলোচনা করে।

১৬. আন্তর্জাতিক রাজনীতি: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিভিন্ন দিক পর্যন্ত বিস্তৃত। কেননা জাতীয় রাজনীতির সাথে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সম্পর্ক রয়েছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাষ্ট্রের ভূমিকা, সরকারের তুলনা, অন্যান্য রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র এবং নাগরিকদের অধিকার ও কর্তব্য স্থান পায়, যা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আওতাভুক্ত হয়েছে। Michael Curtis বলেন, “— the mood of politics today is basically internationalist or transnationalist rather than isolationalist.”

১৭. রাজনৈতিক ইতিহাস: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিভিন্ন আলোচনার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো রাজনৈতিক ইতিহাস। রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাজনৈতিক ইতিহাস আলোচনা করতে গিয়ে অতীতের রাষ্ট্র, রাষ্ট্র ব্যবস্থা, রাষ্ট্রের গঠন, প্রকৃতি, রাষ্ট্র সম্পর্কে প্রদত্ত বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতবাদ আলোচনা করে থাকে। যেমন- মধ্যযুগে ইউরোপীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা।

উপরোক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার ক্ষেত্র শুধু যে ব্যাপক তাই নয়, বরং তা আরও দিন দিন ব্যাপকতর হচ্ছে। অনেকে বলেছেন, মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সকল কার্যকলাপই হলো রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধির অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং Prof. Bryce এর সাথে একমত হয়ে বলা যায়, “Political science is a progressive science. So its scope is increasing day by day by nature.”

তথ্যসূত্র

১. ড. রবিউল ইসলাম, মীর মোশাররফ হোসেন ও অন্যান্য, রাজনৈতিক তত্ত্ব পরিচিতি, গ্রন্থ কুটির ঢাকা, পুনর্মুদ্রণ সেপ্টেম্বর ২০১৯, পৃষ্ঠা ১০-১১।

Leave a Comment

error: Content is protected !!