নব মানবতাবাদ বা নয়া মানবতাবাদ বা র্যাডিকাল মানবতাবাদ বা র্যাডিকাল হিউম্যানিজম (ইংরেজি: Radical or Neo-humanism) দর্শন হচ্ছে মানবেন্দ্রনাথ রায় বা এম এন রায়ের আজীবনকাল অর্জিত অনন্য অভিজ্ঞতা ও পাণ্ডিত্যের চূড়ান্ত পরিণতি। স্বাধীন চিন্তার নিরঙ্কুশ প্রকাশে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন। মূলত এই কারণেই তার কমিউনিস্ট জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। কমিন্টার্ন বা সাম্যবাদী আন্তর্জাতিকে অবস্থানকালের শেষ পর্যায়ে এই নব্য জীবনদর্শনের বীজ তার মনে অংকুরিত হয়েছিল।
মানবতা কথাটি নতুন নয়। প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক এবং এদেশের বৈষ্ণব ও সন্ত দার্শনিকদের চিন্তায় এ-আদর্শের প্রভূত পরিচয় পাওয়া যায়। তার আলোচনা অন্য পরিচ্ছেদে ইতিপূর্বে করা হয়েছে। একমাত্র মানবেন্দ্রনাথই এদেশে আধুনিককালে মানবতাবাদকে বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিতে দেখেছেন। বিজ্ঞানের অগ্রগতি মানুষের ব্যক্তিত্বের ও সৃজনশীলতার প্রতিকূল সমুদয় বাধা আপসারিত করেছে। বিজ্ঞানের কল্যাণেই মাষের সৃষ্টি সত্তা মুক্তি পেয়েছে, বিদূরিত হয়েছে যাবতীয় কুসংস্কারমূলক ভ্রান্তি ও ভীতি। অতীন্দ্রিয় চিন্তার আধিপত্য ও আধ্যাত্মিকতার শৃঙ্খল থেকেও মানুষ মুক্তি পেয়েছে।
নব মানবতাবাদ দর্শনের বৈশিষ্ট্য
নব মানবতাবাদ দর্শনের উৎপত্তি নিহিত রয়েছে ইউরোপের মানবতাবাদী দর্শনে। সারাজীবন ধরে অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার পরিণতি স্বরূপ মানবেন্দ্রনাথ জীবনের শেষ পর্বে মার্কসবাদ থেকে পিছু হটে গেলেন এবং সন্ধান পেলেন এক নতুন জীবন দর্শনের, যার নাম Radical Humanism বা নবমানবতাবাদ। এই নব মানবতাবাদ হচ্ছে ইউরোপের উদারতাবাদী চিন্তার একটি ভারতীয় রূপ। ইউরোপীয় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও উদারতাবাদী আদর্শে তিনি অনুপ্রাণিত হন।
বিশ্বব্যাপী মানবতা, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সংকট, সাম্যবাদী ভাবনার বহুবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা, যা রায়ের ভাষায় ‘সাম্যবাদী ভাবনার অপপ্রয়োগ’, মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অবক্ষয় রায়কে উদ্বুদ্ধ করে মানবতাবাদী জীবনাদর্শে। এই দর্শনের মূল সূত্রগুলি হচ্ছে যুক্তি, নীতি ও মুক্তি। ইউরোপের রেনেসাঁ, মানবতাবাদের উজ্জ্বল ভাবনাগুলো ছিল তার চিন্তাভাবনার প্রধান খোরাক। এরই প্রভাবে তিনি লাভ করলেন যুক্তিবাদ, বিচারবোধ, বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ ও নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা; বুঝলেন মানুষই সব কিছুর একমাত্র পরিমাপক। স্বাধীনতার আকুতিই মানুষের অস্তিত্বের মূল কথা; আর সেই ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ মানুষের সৃজনশীলতাকে সম্মান করে। তিনি এই সিদ্ধান্তে আরও উপনীত হন যে, সারা বিশ্বের মানুষ একই মানবিক গুণসম্পন্ন হওয়ায় বিশ্ব সৌভ্রাতৃত্ব একটি স্বাভাবিক পরিণতি।[১]
উদারতাবাদী ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদকে কার্ল মার্কস বুর্জোয়া মনোভাব বলে বর্জন করেন। মানবেন্দ্রনাথের বিশ্লেষণ অনুসারে নীতি তত্ত্বের ঐতিহাসিক বিকাশ সম্পর্কে মার্কসের যথোচিত অভিজ্ঞতার অভাব ছিল। তার মতে মানব সভ্যতার সামনে নৈতিক ও সাংস্কৃতিক যে সংকট দেখা দিয়েছে তার সুরাহা হতে পারে একমাত্র মানববাদী মূল্যবোধের পুনরুজ্জীবনে। আশু কার্যকারিতা (pragmatism) ও সুবিধাসন্ধানী চিন্তার প্রাবল্যে মানুষের সহজাত যুক্তি ও নীতিবোধ উন্মেষিত হচ্ছে না, ফলে সারা বিশ্বেরই নৈতিক ধার নিম্নখাতে প্রবহমান; বাস্তবে নৈতিক মূল্যবোধ আজ বিলীয়মান।
মানবেন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষ করেন দ্বিতীয় সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সারা পৃথিবীর চিন্তাশীল ব্যক্তিরা অনভিপ্রেত, নৈরাশ্যজনক ও অনৈতিকতার এই গতিকে রোধ করতে চাইছেন; অন্বেষণ করছেন স্থায়ী ও কল্যাণকর পরিবেশ। ভারতে মোহনদাস গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শ্রী অরবিন্দ আধ্যাত্মিক পথে অতীন্দ্রিয় শুভশক্তির বোধন চেয়েছেন। মানবেন্দ্রনাথ বস্তুবাদ ও বিজ্ঞানের উদগাতা— তার কাছে অতিলৌকিক আধ্যাত্মিক পথের অনুসরণ অচিন্তনীয়; তিনি চেয়েছেন বিজ্ঞানের আশ্রয়ে যুক্তিমুখী নীতি তত্ত্বের প্রতিষ্ঠা। তার মতে মানুষের যুক্তিপ্রবণতা ঐশী ইচ্ছায় উদ্ভুত হয়নি হয়েছে জৈব বিবর্তন ধারায়। সহজাত যুক্তিবোধই মানববাদী যুক্তি তত্ত্বের ভূমিষ্ঠ ভূমি— বিবেক যুক্তিরই প্রতিবিম্ব। আধ্যাতিকতার পরিমিশ্রণহীন এবং স্বভাবগত যুক্তিবোধ সাপেক্ষ নীতি তত্ত্বের উপর মানবেন্দ্রনাথের ‘নবমানবতাবাদ’ দর্শন প্রতিষ্ঠিত। সৃষ্টি-স্থিতির বস্তুবাদী ব্যাখ্যা অনুযায়ী একমাত্র যুক্তিনির্ভর মানবতন্ত্রী নীতি তত্ত্বে আলোকিত পথই মানুষের নিকট অনুসরণীয়।
বিবর্তন তত্ত্বের সাহায্যে মানবেন্দ্রনাথ বলেন যে, বিশ্ব-বিবর্তনের শেষ ধাপে হয়েছে মানুষ; নিজস্ব নিয়মে নিয়ন্ত্রিত বিশ্বজগতের সে এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। নিয়ম শৃঙ্খলে আবদ্ধ বিশ্বজগতের কোলেই যুক্তিপ্রবণ মানুষের জন্ম। মনুষ্যত্ব ও ব্যক্তিত্বের প্রকাশ যেন যুক্তিবহ সুশৃঙ্খল জগতেরই এক প্রতিধ্বনি। যুক্তি প্রবণতা আধ্যাত্মিক বা দিব্য কোনও সত্তা নয়– বিবর্তন ধারার শেষ পর্যায় মাত্র; এই যুক্তির ভূমিতেই হয় নীতির জন্ম। সামাজিক সামঞ্জস্য এবং সহিষ্ণুতার তাগিদেই মানব মনে নীতিবোধ উন্মেষিত হয়।
মানুষ বিশ্বচরাচরের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তাই মানবিক সত্তায় ধরা-ছোঁয়ার ঊর্ধ্বে বিমূর্ত ব্যঞ্জনা আরোপ করা অসঙ্গত। ‘নব মানবতাবাদ’ দর্শনে মানুষই সব কিছুর একমাত্র মাপকাঠি হিসাবে বিবেচিত; মানুষের মধ্যে কোনও ঐশী সত্তার স্বীকৃতি নেই তাতে। আধ্যাত্মিক মানবতাবাদে মানুষকে বিমূর্ত কল্পনায় বিশ্বাতীত মহত্ব দান করা হয়। পক্ষান্তরে বৈজ্ঞানিক মানবতাবাদে প্রাকৃতিক বিবর্তনের অংশ হিসাবে জৈব দৃষ্টিতে মানুষ বিবেচিত হয়েছে। কি ইউরোপ কি ভারতের পূর্বতন মানবতাবাদের সঙ্গে মানবেন্দ্রনাথের ‘নবমানবতাবাদ’ দর্শনের এইটাই মৌল পার্থক্য। তার দর্শন সম্পূর্ণরূপে মানুষের জ্ঞান ও গবেষণার উপর প্রতিষ্ঠিত – তার পৃষ্ঠপট একাধারে বস্তুবাদী ও গতিসম্পন্ন। সর্বার্থে বিজ্ঞানভিত্তিক এই দর্শন মাসুষের সৎ, শুভ ও সৃজনশীল জৈব ধর্মে আস্থাবান— তার ভিতর শাস্ত্রীয় নির্দেশ অথবা পরম বৈভব বলে কিছু নেই।
মানবেন্দ্রনাথ তার দর্শনে পার্থক্যের চিহ্ন স্বরূপ ‘New’ কথাটি যুক্ত করেছেন এই বলে যে তাতে মানুষকে নতুনভাবে দেখা হয়েছে – যে-দেখার পিছনে আছে ইতিহাস ও বিজ্ঞানের মনোভাব। জীববিদ্যার আধুনিকতম আবিস্কারে মনুষ্য-প্রকৃতির নতুন রূপ নির্ণীত হয়েছে। ততে একথা স্পষ্টভাবে দেখা গেছে যে বিশ্ব-বিবর্তনধারায় উদ্ভূত জীবের শেষ ও শ্রেষ্ঠ পরিণতি হলো মানুষ। মানুষ তার শ্রেষ্ঠত কোনও বিশ্বাতীত অতীন্দ্রিয় শক্তি থেকে অর্জন করে নি – করেছে তার সহজাত সৃজনী শক্তির সাহায্যে প্রকৃতিকে জেনে ও জয় করে। প্রকৃতির নিয়ম নিগড়ে নিয়ন্ত্রিত হলেও সে প্রকৃতিতে নিমজ্জিত নয়। প্রকৃতির মধ্যেও যেমন নিয়ম শৃঙ্খলা আছে তেমনি মানুষের সহজাত স্বভাবেও অনুরূপ নিয়মানুবর্তিতা থাকায় মানুষ মূলতঃ যুক্তিবাদী ও ন্যায়পরায়ণ। জৈব বিবর্তন ধারাতেই মানুষ প্রকৃতির কাছ থেকে তার সহজাত গুণগুলি অর্জন করছে। মানবেন্দ্রনাথ তাঁর এই দর্শনকে নবতম জ্ঞানের সমন্বয় স্বরূপ অতিরিক্ত Integral’ শব্দটি দিয়ে ও তার পার্থক্য চিহ্নিত করেছেন।
নব মানবতাবাদ দর্শন দূরকল্পী (speculative) অথবা কারণ বিচারপুর্বক কার্য নির্ণায়ক পদ্ধতির (Deductive) পরিবর্তে ঐতিহাসিক বিবর্তনে লব্ধ অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে রচিত। এই দর্শনের মর্ম হলো যুক্তি, নীতি ও মুক্তি। স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বিশিষ্ট বিশ্ব নিয়ন্ত্রক শক্তি রূপ যুক্তির প্রত্যয় এই দর্শনের পরিপন্থী। মানব মনের দৃষ্টিতে নিয়ম নিয়ন্ত্রিত বিশ্বে মানুষের অবস্থানকে আশ্রয় করেই যুক্তির উদ্ভব ঘটে। মানুষ মূলত যুক্তিবাদী জীব হলেও অনেক সময়ে তার অপরিশীলিত আদিম মনোবৃত্তি ফুটে ওঠে। সে জন্য চাই মানব মনের যথোচিত কর্ষণ! তার নাতি তত্ত্ব স্বজ্ঞা সঞ্জাত যেমন নয়, তেমনি তা বিশ্বাতীত পরম সত্তার অভিব্যক্তিও নয়। মানুষে-মানুযে সম্বন্ধ ও সামাজিক বিধি ব্যবস্থায় যুক্তির সুষ্ঠু প্রয়োগ থেকেই নীতিনিষ্ঠা গড়ে ওঠে। তার লক্ষ্য সমাজবদ্ধ মানুষের সামগ্রিক কল্যাণ সাধন। মানবেন্দ্রনাথ যুক্তিকে অগ্রাধিকার দিয়ে নীতি তত্ত্বে প্রবেশ করেছেন। কোনো অতীন্দ্রিয় ভাবাবেগ বা শাস্ত্রীয় নির্দেশ তার দর্শনে অবর্তমান।
‘নব মানবতাবাদ’ দর্শনে যুক্তি নির্ভর নীতি ও সর্বাঙ্গীণ মুক্তিকে স্বতঃসিদ্ধ রূপে গ্রহণ করা হয়। আত্মার প্রত্যয় অথবা জগতের ইষ্টহেতুক পরিণামবাদ তাতে নেই। ‘আত্মা শব্দটি মানব মনের সর্বাঙ্গীণ মুক্তির অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ইউরোপীয় রেনেসাঁসেও রাজনৈতিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক বন্ধন থেকে অত্মার মুক্তির দাবি ঘোষিত হয়েছিল। ‘নব মানবতাবাদ’ যুক্তি, নীতি ও মুক্তি এই তিন মূল্যের ভিত্তিতে সমন্বিত! প্রকৃতির প্রতিকুল পরিবেশে আত্মরক্ষা ও আত্মবিকাশের জৈব সংগ্রামেই মুক্তির প্রত্যয় নিহিত। মুক্তিই মানুষের অবাধ বিকাশ ও সামাজিক প্রগতির মানদণ্ড। মুক্তি আর মোক্ষ এক কথা নয়। ধর-ছোঁয়ার এই পৃথিবীতেই মুক্তি চাই। অতীন্দ্রিয় দৃষ্টিতে বহির্বন্ধন সত্বেও আত্মা সদাই মুক্ত এ প্রত্যয়ের সঙ্গে তার চিন্তার কোনও সাদৃশ্য নেই। তেমনি পূর্ব নির্দিষ্ট ও নির্ধারিত সমন্বয়-প্রত্যয় ও যথার্থ মুক্তির পরিপন্থী; পরম কারণজনিত উদেশ্যাবাদ (Teleology) ও এমনকি মার্কসের অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যবাদেও মুক্তি অনুপস্থিত। শ্রী অরবিন্দের দৃষ্টিতে মুক্তি মানুষের একটি দিব্য সত্তা। মানবেন্দ্রনাথের মতে ডারউইনের ক্রমবিবর্তন তত্বানুসারে অস্তিত্বের সংগ্রাম ও আত্ম সংরক্ষণেই মুক্তির আকাঙ্খা দেখা দেয় । মুক্তির আবেগ সমাজ ও সভ্যতার গতি সঞ্চারক।
বিজ্ঞানসম্মত বস্তুবাদ ও বিবর্তন
মানবেন্দ্রনাথের বস্তুবাদী বিশ্বতত্বে মুক্তিকে জৈব বিবর্তনের প্রেক্ষাপটে দেখা হয়েছে, বিমূর্ত মানসের বিশ্বাতীত বিষয়রূপে নয়। মুক্তির আবেগ প্রতি মানুষের অন্তরে নিহিত থাকে। মান্ধাতা আমলের আধ্যাত্মিক ও অতিপ্রাকৃত সংস্কার বন্ধন ছিন্ন করলে মানুষর আত্মিক মুক্তি ঘটবে; মুক্তি অর্জনের শ্রেষ্ঠ উপাদান অন্তর্নিহিত সৃষ্টি শক্তিময় সম্ভাবনার উপলব্ধি। আত্মিক বন্ধনমুক্ত মানুষই কেবল নতুন ও স্বাধীন সমাজ গড়ে তুলতে সক্ষম। সামাজিক ও রাজনৈতিক বন্ধন মুক্তি এক মাত্র সংস্কারমুক্ত মানুষের উপর নির্ভর করে। মানবেন্দ্রনাথের যুক্তিবাদী নীতিতত্ত্ব ওঁর বস্তুবাদী বিশ্ব তত্ত্বেরই অঙ্গ। তাঁর সকল কথার মূলে একটি সুর সদাই যেন অনুরণিত— সেটি হলো আধ্যাত্মিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কয়েদখানা থেকে মানবতার মুক্তি সাধন। মানবতা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও যুক্তিনির্ভর নীতি তত্ত্ব মুক্তির তিন প্রধান স্তম্ভ।
মানবেন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে প্রকৃতি, মানুষ এবং নৈতিকতা এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ যার ভিত্তি হচ্ছে বিজ্ঞানসম্মত বস্তুবাদ। মানুষ প্রকৃতির অঙ্গ। যেহেতু প্রকৃতির গতিপথ নিয়ম নির্দিষ্ট সেই কারণে মানুষের চিন্তা, অনুভূতি ইত্যাদিও নিয়ম নির্দিষ্ট – উভয় ক্ষেত্রেই এক মৌলিক শৃঙ্খলা পরিলক্ষিত হয়। মানুষের নৈতিক আচরণের পিছনে তিনি কোনও অধ্যাত্মিক বা ঐশ্বরিক ব্যাখ্যা মেনে নিতে নারাজ। তিনি মনে করেন বস্তুবাদী নীতিতত্ত্বই এর উৎস আর কেবল নীতি-নির্ভর সমাজদর্শনই পারে বর্তমান সভ্যতার সংকট থেকে মানুষকে মুক্ত করতে। বস্তুত মানবেন্দ্রনাথ ভাব ও বস্তুর পারস্পরিক সম্পর্কে বিশ্বাসী।
‘নবমানবতাবাদ’ সার্বভৌম মানুষের জয়গান করেছে। মানুষের সেই মৌল সত্তা হরণ করার কোনও অধিকারই সমাজের নেই। এই দাবি কোনও কাব্যিক ভাবাবেগ কিংবা অতীন্দ্রিয় আবেগ সম্ভূত নয়। তা হলো সামাজিক ও জৈব বিবর্তন সম্পৃক্ত মানব মনের চরমোৎকর্ষের উপাদান। মানবতা এখন এক সংকটের সম্মুখীন। ব্যষ্টিকে সমষ্টিতন্ত্রের দানব গ্রাস করতে চলেছে; ব্যক্তি স্বাধীনতা অস্তমিত। আর্থিক সংকট মুক্তি মানবতার প্রয়োজনে অবশ্যই প্রয়োজন, কিন্তু সামাজিক ও রাজনৈতিক নিষ্পেষণে এখন ব্যক্তিমানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত।
নব মানবতাবাদ দর্শনের সমালোচনা
‘নবমানবতাবাদ’-এর আদর্শ যে উদারতাবাদী ও বুর্জোয়া মতবাদ সেকথা উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। জাতীয়তাবাদ সমাজ-বিবর্তনের একটি নিচের পর্যায় মাত্র — শেষ ও সর্বোন্নত পর্যায় নয়। মূলত জাতিবিদ্বেয়ে সৃষ্ট জাতীয়তাবাদ যে প্রতিক্রিয়াশীল সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই; তার দীর্ঘস্থায়ীত্ব ও ব্যক্তি ও সমাজ কল্যাণের অন্তরায়। জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে চাই বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব। মানুষে-মানুষে বৈষম্যকে আড়াল করে সাহচর্যপূর্ণ সৌহার্দ্যের কথা মোহনদাস গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও অরবিন্দের মতো মানবেন্দ্রনাথের কণ্ঠেও ধবনিত হয়। তার দৃষ্টিতে সংস্কারমুক্ত ব্যক্তি মানুষের মনই হলো উন্নত সমাজ, বৈশ্বিক মৈত্রী ও মুক্ত বিশ্বের বুনিয়াদ। এই আদর্শে পৌঁছনোর জন্য সর্বাগ্রে চাই মুক্তির আদর্শ ও প্রগতির মন্ত্রে দীক্ষা। ‘নবমানবতাবাদ’ এই মুক্ত ও মিত্রতাবদ্ধ বৈশ্বিক সংঘের আদর্শে প্রতিষ্ঠিত।
মানবেন্দ্রনাথ ঐকান্তিকভাবে যে-বিশ্বসংঘ গঠনের প্রস্তাব করেন সেখানে দেশগত সীমানার প্রশ্ন গৌণ – পুঁজিবাদী, ফ্যাসিবাদী, সাম্রাজ্যবাদী, সাম্যবাদী প্রভৃতি সকল রাষ্ট্রই ক্রমে একদিন বিশ শতকের নবজাগ্রত মানুষের তাড়নায় লুপ্ত হয়ে যাবে। বিশ্বজনীনতা ও আন্তর্জতিকতাকে তিনি ভিন্নার্থে বিচার করেছেন। আন্তর্জাতিকতার প্রত্যয়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব স্বতন্ত্রই থাকে। কিন্তু প্রকৃত বিশ্ব রাষ্ট্র গঠন জাতীয় রাষ্ট্র গুলিকে একত্রীকরণের মাধ্যমেই একমাত্র সম্ভব। তিনি চেয়েছেন বিশ্ব মানবতার ভিত্তিতে তাত্মিক বন্ধনে সংযুক্ত মানবসমাজ।[২]
মানবেন্দ্রনাথের মতে অর্থনৈতিক সামাজিক ও রাজনৈতিক পুনর্গঠনের একমাত্র উপায় হলো মানুষের মননশীলতার নব জাগরণ, আর সেই সঙ্গে মানবতাবাদের মৌল আদর্শে রূপায়ণ।
তথ্যসূত্র
১. ড. চিত্রিতা চৌধুরী, “মানবেন্দ্রনাথ রায়”, ঐচ্ছিক রাষ্ট্রবিজ্ঞান, নেতাজী সুভাষ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, সপ্তম পুনর্মুদ্রণ, আগস্ট ২০১৯, পৃষ্ঠা ২৫৩।
২. সৌরেন্দ্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, বাঙালির রাষ্ট্রচিন্তা রামমোহন থেকে মানবেন্দ্রনাথ, সুবর্ণরেখা, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ এপ্রিল ১৯৬৮, পৃষ্ঠা ৪৩০-৪৩৫
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।