মার্কসবাদী দর্শন বা মার্কসীয় দর্শন বা মারক্সীয় দর্শন (ইংরেজি Marxist Philosophy বা Marxist theory বা Marxian Philosophy) মানুষের বিচ্ছিন্নতা, তার নিজেকে হারিয়ে ফেলা আর নিছক জিনিসে রূপান্তরিত করবার বিরুদ্ধে এক প্রতিরোধ। এই দর্শন পশ্চিমা শিল্পায়নের বিকাশের অস্থিমজ্জায় মিশে থাকা মানুষের বিমানবিকীকরণ আর তাকে যন্ত্রে পরিণত করবার বিরুদ্ধে এক আন্দোলন। মার্কসবাদী দর্শন প্রতিরোধের দর্শন, এই প্রতিরোধের সাথে জড়িয়ে আছে মানুষ, তার নিজেকে মুক্ত করবার সামর্থ্য, আর তার সম্ভাবনা বাস্তবায়নের উপর বিশ্বাস।
মার্কসবাদী দর্শন কোনো কঠোরভাবে সংজ্ঞায়িত দর্শনের কোনো উপশাখা নয়, কারণ এই দর্শন নানা বৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকা যেমন নন্দনতত্ত্ব, নীতিবিদ্যা, সত্তাতত্ত্ব, জ্ঞানতত্ত্ব, তত্ত্বীয় মনোবিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানের দর্শনে তার প্রভাব বিস্তৃত করেছে। এছাড়াও মার্কসবাদী দর্শন রাষ্ট্রদর্শন এবং ইতিহাসের দর্শনকে সুস্পষ্টভাবে প্রভাবিত করেছে। দর্শনে মার্কসবাদের বৈশিষ্ট্যসমূহের চাবিকাঠি হচ্ছে তার দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ এবং এটির সকল চিন্তার চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে রাজনৈতিক অনুশীলনের প্রতি দায়বদ্ধতা।
মার্কসবাদী দর্শন প্রকৃতি, সমাজ ও চিন্তনের বিকাশের সাধারণ নিয়মাবলী বিষয়ক বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞানলাভের সাধারণ পদ্ধতিমালা। মার্কসীয় দর্শন তার নিজস্ব প্রলেতারিয় শ্রেণিস্বার্থ এবং তাদের রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত শ্রেণিসংগ্রামের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।[১]
মার্কসবাদী দর্শনের দুটি স্পষ্টতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর শ্রেণি প্রকৃতি এবং বাস্তব প্রকৃতি। শ্রেণি প্রকৃতি অনুসারে এটি প্রকাশ্যে ঘোষণা করে যে, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ প্রলেতারিয়েত শ্রেণির সেবা করে। বাস্তব প্রকৃতি অনুসারে মার্কসীয় দর্শনে, তত্ত্ব অনুশীলনের উপর নির্ভরশীল, তত্ত্বের ভিত্তি হচ্ছে অনুশীলন, আবার তত্ত্ব অনুশীলনের সেবা করে।[২] মার্কসবাদী দর্শন তার শ্রেণি চরিত্র লুকিয়ে রাখতে চেষ্টা করে না। এই দর্শন হলো এমন এক তত্ত্ব, যা নির্ধারণ করে শ্রমিক শ্রেণির ও তার নেতৃত্বাধীন শ্রমজীবী জনসাধারণের বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও মতাদর্শ। এই দর্শন খোলাখুলিভাবে ঘোষণা করে যে দর্শন শ্রেণিসংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত। কার্ল মার্কস লিখেছেন,
“দর্শন যেমন তার বস্তুগত অস্ত্র খুঁজে পায় প্রলেতারিয়েতের মধ্যে, তেমনি প্রলেতারিয়েত তার আত্মিক অস্ত্র খুঁজে পায় দর্শনের মধ্যে।[৩]
শ্রেণি প্রকৃতি অনুযায়ী মার্কসবাদ সমাজ বিপ্লবের দর্শন এবং সমাজ বিপ্লবের দর্শন হতে গিয়ে এটি একদিকে এটি জগতকে ব্যাখ্যা করবার দায় গ্রহণ করে, অন্যদিকে এটি জগতকে ব্যাখ্যা করেই ক্ষান্ত হয় না জগতকে পরিবর্তনে নেমে পড়ে। ফয়েরবাখ সম্বন্ধে থিসিসসমূহে মার্কস লিখেছেন,
“দার্শনিকেরা কেবল নানাভাবে জগতকে ব্যাখ্যা করেছেন, কিন্তু আসল কথা হলো তাকে পরিবর্তন করা।”[৪]
মার্কসবাদী দর্শন একটি শ্রেণি দর্শন। শ্রেণি দর্শন হিসেবে এর অবস্থান শ্রমিক শ্রেণির সেবা করার পক্ষে, প্রলেতারিয়েতের মুক্তির হাতিয়ার হিসেবে কাজ করায়। মার্কসবাদী দর্শন অনুযায়ী, শ্রেণিবিভক্ত সমাজে দর্শন শ্রেণিনিরপেক্ষ হতে পারে না। শ্রেণি বিভক্ত সমাজে মানুষ আর নিছক মানুষ থাকে না, সে পরিণত হয় শ্রেণির মানুষে, মানবীয় সম্পর্ক পরিণত হয় শ্রেণি সম্পর্কে। সমাজ যখন থেকে শ্রেণিবিভক্ত হয় তখন থেকে দর্শনও বিভক্ত হয়ে যায়। শোষক শ্রেণি বিদ্যমান ব্যবস্থাসহ এর ধ্যানধারণাগুলো টিকিয়ে রাখার জন্য সৃষ্টি করে এক ধরনের দর্শন, আর শোষিত শ্রেণি বিদ্যমান ব্যবস্থাসহ এর ধ্যানধারণাগুলো উচ্ছেদের লক্ষ্যে সৃষ্টি করে আর এক ধরনের দর্শন।[৫] মাও সেতুং লিখেছেন,
“যেখানে শ্রেণিসংগ্রাম আছে, শুধুমাত্র সেখানেই দর্শন থাকতে পারে। … … নিপীড়করা নিপীড়িতদের নিপীড়ন করে, আর নিপীড়িতদের দরকার হয়ে পড়ে একে সংগ্রাম করা এবং এজন্য একটি পথ খুঁজে পাওয়া, তখনই তারা দর্শনের খোঁজ শুরু করে। যখন মানুষ এটাকে সূচনা-বিন্দু হিসেবে গ্রহণ করলো, মাত্র তখনই মার্কসবাদ-লেনিনবাদের উদ্ভব ঘটলো এবং জনগণ দর্শন আবিষ্কার করলেন।”[৬]
মার্কসবাদী দর্শন এই দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা সে সময়ের প্রচলিত দর্শনের ঐতিহ্যকে ভেঙে দর্শন চিন্তার ইতিহাসে একটি জ্ঞানতাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয় এবং প্রচলিত দর্শনের তত্ত্বগত গণ্ডি অতিক্রম করে দর্শনকে আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার সাথে সম্পৃক্ত করে একটি প্রায়োগিক দর্শনের ভিত্তিভূমিতে দাঁড় করানো হয়।[৭] মার্কস দর্শনকে দেখেছেন সমাজ বাস্তবতার সাথে সম্পর্কিত করে। প্রচলিত দার্শনিকরা দর্শনকে দেখেছেন সমাজ বাস্তবতা থেকে আলাদা করে, বিশুদ্ধ তাত্ত্বিক সমস্যা হিসেবে। ফলে দার্শনিক সমস্যা সমাজ জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। প্রচলিত দার্শনিকদের এই ধারনাকে চ্যালেঞ্জ করে মার্কস ঘোষণা দেন যে দর্শনকে দেখতে হবে সামাজিক প্রেক্ষিতে, ব্যবহারিক জীবনের ব্যবহারিক সমস্যা হিসেবে।[৮] দর্শন যুগের ও কালের সৃষ্টি। যুগের ও কালের বাস্তবতা প্রতিফলিত হয় দর্শন চিন্তার মধ্য দিয়ে।
মার্কসবাদী দর্শন অনবরত এবং ক্রমাগত জোর দেয় বস্তুবাদের ওপর। মাও সেতুং ১৯৩৭ সালে বলেন, ‘মানুষের জ্ঞানের ইতিহাসে বিশ্ব বিকাশের নিয়ম সম্পর্কে চিরকালই দুটি ধারনা চলে এসেছে, আধিবিদ্যক ধারনা এবং দ্বন্দ্ববাদী ধারনা, যেটি দুটি পরস্পর বিরোধী বিশ্বদৃষ্টি সৃষ্টি করে’[৯] সেই দুই বিশ্বদৃষ্টি সংক্রান্ত ধারনায় মার্কসীয় দর্শন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদকে আঁকড়ে ধরে। ভ. ই. লেনিন মার্কস ও এঙ্গেলস কর্তৃক ১৮৪০’র দশকে সৃষ্ট আধুনিক বস্তুবাদকে ‘পূর্বতন সমস্ত ধরনের বস্তুবাদের চেয়ে সারবস্তুতে অতুলনীয় সমৃদ্ধ ও অতুলনীয় রকমের সুসংগত’[১০] বলে বর্ণনা করেন। লেনিন আরো লেখেন,
“পুঁজি এবং অন্যান্য গ্রন্থে মার্কসের আলাদা আলাদা দার্শনিক মন্তব্যগুলো ধরা যাক, চোখে পড়বে একটি অপরিবর্তিত মূল সূত্র: বস্তুবাদের ওপর জোর এবং সবকিছু ধামাচাপা, সবকিছু বিভ্রান্তি ও ভাববাদের দিকে, সবকিছু পিছু হটার দিকে সঘৃণ উপহাস। মার্কসের সমস্ত দার্শনিক মন্তব্য আবর্তিত এই দুই মূল বৈপরীত্য ঘিরে। … … এঙ্গেলস তাঁর সমস্ত দার্শনিক কাজে সমস্ত প্রশ্নেই সংক্ষেপে ও সুস্পষ্ট করে বস্তুবাদী ও ভাববাদী ধারার বৈপরীত্য রেখেছেন।”[১০]
মার্কসীয় দর্শনের এই অখণ্ড বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গিটি গড়ে উঠেছে বস্তুবাদ, একত্রে দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদকে ঘিরে।[১১]
তথ্যসূত্র:
১. সোফিয়া খোলদ, সমাজবিদ্যার সংক্ষিপ্ত শব্দকোষ, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৯০, পৃষ্ঠা ৬২
২. মাও সেতুং, অনুশীলন সম্পর্কে, জুলাই ১৯৩৭
৩. Karl Marx, Contribution to the critique of Hegel’s Philosophy of Law, Introduction, in: Karl Marx, Frederick Engels, Collected Works, Vol. 3, Progress Publishers, Moscow, 1975, p. 187
৪. কার্ল মার্কস, ১৮৪৫, ফয়েরবাখ সম্বন্ধে থিসিসসমূহ, মার্কস এঙ্গেলস রচনা সংকলন, ২য় খণ্ড ২য় অংশ, প্রগতি প্রকাশন মস্কো, ১৯৭২, পৃষ্ঠা ৮৯।
৫. হারুন রশীদ, মার্কসীয় দর্শন, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি, ২০০৭, পৃষ্ঠা ৪৩
৬. মাও সেতুং, দর্শন সম্পর্কে আলোচনা, ১৯৬৪
৭. হারুন রশীদ, মার্কসীয় দর্শন, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ ঢাকা ২০০৭, পৃষ্ঠা ৩২
৮. Marx, Economic and Philosophic Manuscripts of 1844, in Karl Marx, Selected Writings in Sociology and Social Philosophy, T.B. Bottomore and Maximiliien Rubel (ed). Penguin Books, England, 1961, p. 87
৯. মাও সেতুং, দ্বন্দ্ব সম্পর্কে, আগস্ট ১৯৩৭, মাও সেতুঙ নির্বাচিত রচনাবলী, প্রথম খণ্ড, চলন্তিকা বইঘর, ঢাকা, অক্টোবর ১৯৯২, পৃষ্ঠা ৩০৫।
১০. ভ্লাদিমির লেনিন, বস্তুবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদী সমালোচনা, ১৯০৮, মার্কস এঙ্গেলস মার্কসবাদ, প্রগতি প্রকাশন মস্কো, ১৯৭৫, পৃষ্ঠা ৯৬-৯৮।
১১. প্রবন্ধটি আমার [অনুপ সাদি] রচিত ভাষাপ্রকাশ ঢাকা থেকে ২০১৬ সালে প্রকাশিত মার্কসবাদ গ্রন্থের ১৬-২০ পৃষ্ঠা থেকে নেয়া হয়েছে এবং রোদ্দুরেতে প্রকাশিত হলো।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।