মার্কসবাদের তিনটি উৎস (ইংরেজি: Three sources of Marxism) যথাক্রমে হচ্ছে ধ্রুপদী জার্মান দর্শন, ফরাসি কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্র এবং ব্রিটিশ রাজনৈতিক অর্থনীতি। মানবজাতির এই তিনটি শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকারী হচ্ছে মার্কসবাদ।
মার্কসবাদ বলতে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের মতবাদকে বোঝায় না। এর মধ্যে দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি, ইতিহাস, সমাজ ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় এবং এসব বিষয় সম্পর্কিত বিভিন্ন মতবাদের সমাবেশ ঘটেছে। মানুষ, তার সমাজ এবং তার আশপাশের প্রকৃতিকে কেন্দ্র করেই মার্কসবাদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় ও মতবাদের উদ্ভব ঘটেছে।
মার্কসবাদের তিনটি উৎস
মানুষ ও তার সমাজ ও পরিবেশের বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি হচ্ছে তিনটি প্রধান বিষয়। ভ্লাদিমির লেনিন প্রথম মার্কসবাদের তিনটি উৎস সম্পর্কে ধারণা দেন এবং দেখান যে এই তিনটি উৎস থেকে তিনটি দিকের বা অঙ্গের উদ্ভব ঘটেছে।
কার্ল মার্কস তাঁর মতবাদ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পূর্বসূরিদের চিন্তা দ্বারা অনুপ্রাণিত ও প্রভাবিত হন। মানব সমাজের চিন্তার জগতে যেসব প্রশ্ন আগেই উত্থাপিত হয়েছিল মার্কস সেগুলোর জবাব দেন তাঁর মতবাদের এই প্রধান দিকগুলোতে এবং এক্ষেত্রে তিনি পূর্বসূরিদের চিন্তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করে তাঁর মতবাদকে বিকশিত করেন।[১] তবে মার্কস ও এঙ্গেলস কেবল তাঁদের তাত্ত্বিক পূর্বসূরিদের ধারাবাহকই ছিলেন না, তাঁরা বিচার করে সেগুলি ঢেলে সাজান গড়ে তোলেন নতুন মতবাদ। এ প্রসঙ্গে লেনিন বলেছেন,
“মার্কসের সমগ্র প্রতিভাটাই এখানে যে মানব সমাজের অগ্রণী ভাবনায় যেসব জিজ্ঞাসা আগেই দেখা দিয়েছিল মার্কস তারই জবাব দিয়েছেন। তাঁর মতবাদের উদ্ভব হয়েছে দর্শন, অর্থশাস্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের মহাচার্যেরা যে শিক্ষা দান করেছিলেন, তারই প্রত্যক্ষ ও অব্যবহিত অনুবর্তন হিসেবে।”[২]
লেনিন মার্কসবাদকে একটি বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে উপস্থাপন করেন। মার্কসবাদ বিশ্বকে দেখে সামগ্রিকভাবে, অখণ্ডভাবে। এই মতবাদ অনুযায়ী, জগতের সব বস্তু ও ঘটনাপ্রবাহ পরস্পর সম্পর্কিত, সার্বিকভাবে সম্পর্কিত। কোনো বস্তু বা ঘটনাকে বুঝতে হলে তাকে অন্যান্য বস্তু বা ঘটনার সাথে সম্পর্কিত করে দেখতে হবে। বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে বস্তু বা ঘটনার আংশিক রূপটি পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু সামগ্রিক রূপটি পাওয়া যাবে না। মার্কসবাদ বস্তু বা ঘটনার সামগ্রিক রূপটি উদঘাটন করতে চায়। যে কারণেই লেনিন একে সুসম্পূর্ণ ও সুসংহত মতবাদ হিসেবে গণ্য করেন। তাঁর ভাষায়,
“এ মতবাদ সুসম্পূর্ণ ও সুসমঞ্জস, এর কাছ থেকে মানুষ একটি সামগ্রিক বিশ্বদৃষ্টি লাভ করে, যা কোনো রকম কুসংস্কার, প্রতিক্রিয়া অথবা বুর্জোয়া জোয়ালের কোনো রূপ সমর্থনের সঙ্গে আপোস করে না। উনিশ শতকের জার্মান দর্শন, ইংরেজি অর্থশাস্ত্র এবং ফরাসী সমাজতন্ত্র রূপে মানবজাতির যা শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি তার ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকারী হচ্ছে মার্কসবাদ।”[৩]
ফলে উনিশ শতকের ধ্রুপদী জার্মান দর্শন, ফরাসি কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্র এবং ব্রিটিশ রাজনৈতিক অর্থনীতির থেকে উদ্ভব ঘটেছে মার্কসবাদের।
ধ্রুপদী জার্মান দর্শন
ধ্রুপদী জার্মান দর্শনের উদ্ভব ঘটে উনিশ শতকে। এই দর্শনে একদিকে রয়েছে জার্মান ভাববাদ, ইমানুয়েল কান্টের চিন্তায় যার সূত্রপাত ঘটে এবং ফ্রিডরিখ হেগেলের চিন্তায় যা চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। এই দর্শনের অন্যদিকে রয়েছে ফয়েরবাখের বস্তুবাদ। ধ্রুপদী জার্মান দর্শনে হেগেলের দ্বন্দ্বতত্ত্ব এবং ফয়েরবাখের বস্তুবাদ মার্কসীয় দর্শনের উৎস হিসেবে কাজ করে।
হেগেল প্রবর্তন করেন বিকাশের দার্শনিক মতবাদ দ্বন্দ্ববাদ। কিন্তু হেগেলীয় দ্বন্দ্ববাদের সীমাবদ্ধতা ছিলো তার ভাববাদী বুনিয়াদে। তাঁর কাছে কথাটা ছিলো বাস্তব জগতের বিকাশ নিয়ে নয়, তাঁর চিন্তা ছিলো পরম ভাবসত্তার বিকাশ নিয়ে। হেগেলের কাছে এই ভাবসত্তা ছিলো বিশ্বের ভিত্তি এবং তাঁর বিকাশের চূড়ান্ত কারণ। পক্ষান্তরে ফয়েরবাখ দেখান যে প্রকৃতির ব্যাখ্যা করা যায় প্রকৃতিকে দিয়েই, কোনো কল্পনার আশ্রয় নিতে হয় না। কিন্তু ফয়েরবাখের বস্তুবাদ ছিলো অধিবিদ্যক, তাতে বিকাশ বলে কিছু নেই, আছে কেবল পরিমাণগত পরিবর্তন। হেগেলীয় দ্বন্দ্ববাদের বিপুল তাৎপর্য ফয়েরবাখ বোঝেননি, পারেননি তা প্রকৃতির ক্ষেত্রে ও সমাজের ইতিহাসে প্রয়োগ করতে। হেগেলের দ্বন্দ্ববাদ ও ফয়েরবাখের বস্তুবাদ হলো মার্কসীয় দর্শন উদ্ভবের যাত্রাবিন্দু।[৪]
ব্রিটিশ রাজনৈতিক অর্থনীতি
রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রে মার্কসবাদের পূর্বসূরি হলেন ইংরেজ অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ এবং ডেভিড রিকার্ডো। তাঁরা দেখান যে সমাজের সমস্ত সম্পদের মূল উৎস হলো শ্রম এবং তাতে করে বৈজ্ঞানিক অর্থশাস্ত্রের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেন। রিকার্ডোর সূত্রেই মার্কস পণ্য, পণ্যের মূল্য, শ্রমিকের শ্রমের মুলয, মুনাফার ধারণাগুলোকে আরো বিস্তৃত করেন। ক্রমে ক্রমে উৎপাদন, ব্যক্তিগত মালিকানা, পুঁজি, শ্রম, পণ্য উৎপাদন প্রভৃতি ধারনার উপর মার্কস গভীর ও পূর্ণাঙ্গ আলোচনায় মার্কস মনোযোগী হন। অর্থনীতির বিভিন্ন প্রশ্নে তথ্য পেতে, পুঁজিবাদী অর্থনীতির গতি প্রকৃতি, উৎপাদন প্রক্রিয়া, বাণিজ্যিক ক্রিয়াকর্ম, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও পুঁজি বিষয়ে জ্ঞান লাভে মার্কস ও এঙ্গেলসকে সাহায্য করেছে ইংরেজ অর্থনীতিবিদদের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও তাঁদের রচনাবলী। এসব রচনাবলী পাঠ করেই, সেসব থেকে প্রয়োজনীয় ধারণা ও তথ্য নিয়েই মার্কস তৈরি করেছেন তাঁর অর্থনীতির তত্ত্ব।
অর্থনীতির বিভিন্ন সমস্যার সমাধান পেতে মার্কস নিজস্ব পদ্ধতি উদ্ভাবন করলেও তাঁর চিন্তার তাত্ত্বিক কাঠামো গড়ে দিতে পরোক্ষে সাহায্য করেছে ইংরেজ অর্থনীতিবিদগণ। অর্থনীতি যে রাজনীতির ভিত্তি, সমাজ নিয়ন্ত্রণ ও পরিবর্তনের মূলে যে আছে অর্থনীতি, উৎপাদন ও শ্রমের মধ্যেই যে আছে সমাজ বিকাশের শর্ত ইংরেজ অর্থনীতিবিদদের মূল্যবান রচনাগুলো পাঠ করেই এইসব ধ্যানধারণা গড়ে তোলার রসদ পেয়েছেন তিনি। লেনিন লিখেছেন যে মার্কসের অর্থনৈতিক তত্ত্বের মূল কথা হলো উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব।[৫] মার্কসের মতে এটাই পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতির চাবিকাঠি। শ্রমিক যখন তাঁর ন্যায্য বা প্রত্যাশিত শ্রমের অতিরিক্ত শ্রম করে তখন এই অতিরিক্ত শ্রমের দরুন সে বাড়তি মূল্য সৃষ্টি করে। অতিরিক্ত শ্রমের মূল্য সে পায় না, পুঁজিপতি এই মূল্য গ্রাস করে। পুঁজিপতি শ্রমের সময় বাড়িয়ে উদ্বৃত্ত মূল্যের হার বাড়িয়ে নেয় এবং এইভাবেই শ্রমিক শোষণ অব্যাহত রাখে। কার্ল মার্কস ও এঙ্গেলস যে আর্থিক ধারণাগুলো উপস্থিত করেছেন সেগুলো তাঁদের সমকালেরই ধারণা।
ফরাসি কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্র
উনিশ শতকের মহান কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্রী সাঁ সিমোঁ, শার্ল ফুরিয়ে আর রবার্ট ওয়েন পুঁজিবাদী ব্যবস্থার তীব্র সমালোচনা করেন, ভবিষ্যৎ সমাজের প্রধান প্রধান দিকেরও একটা ছবি আঁকেন। তবে তা প্রতিষ্ঠার বাস্তব পথ তাঁরা দেখাতে পারেননি। লেনিন লিখেছেন,
“সামন্তবাদের পতনের পর ঈশ্বরের দুনিয়ায় ‘মুক্ত’ পুঁজিবাদী সমাজের আবির্ভাবের সংগে সংগেই এ কথা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিলো যে, মেহনতি মানুষদের উপর পীড়ন ও শোষণের একটি নতুন ব্যবস্থাই হলো এ মুক্তির অর্থ। সে পীড়নের প্রতিফলন ও প্রতিবাদ স্বরূপ নানাবিধ সমাজতান্ত্রিক মতবাদ অবিলম্বে দেখা দিতে শুরু করে। কিন্তু আদিম সমাজতন্ত্র ছিলো কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্র। পুঁজিবাদী সমাজের তা সমালোচনা করেছে, নিন্দা করেছে, অভিশাপ দিয়েছে, স্বপ্ন দেখেছে তার বিলুপ্তির, উন্নততর এই ব্যবস্থার কল্পনায় মেতেছে, আর ধনিদের বোঝাতে চেয়েছে শোষণ নীতিবিগর্হিত কাজ।
কিন্তু সত্যিকারের উপায় দেখাতে কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্র পারেনি। পুঁজিবাদের আমলে মজুরি দাসত্বের সারমর্ম কী তা সে বোঝাতে পারেনি, পুঁজিবাদের বিকাশের নিয়মগুলি কী তাও সে আবিষ্কার করতে পারেনি, খুঁজে পায়নি কোন সামাজিক শক্তি নতুন সমাজের নির্মাতা হবার ক্ষমতা ধরে।”[৬]
ধ্রুপদী জার্মান দর্শন, ফরাসি কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্র[৭] এবং ইংরেজ রাজনৈতিক অর্থনীতি—উপরে আলোচিত মার্কসবাদের এই তিনটি উৎস থেকেই এসেছে মার্কসবাদ।[৮]
তথ্যসূত্র ও টীকাঃ
১. হারুন রশীদ, মার্কসীয় দর্শন, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০০৭, পৃষ্ঠা ১৩
২. ভ্লাদিমির লেনিন, মার্কস-এঙ্গেলস-মার্কসবাদ, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো; ১৯৭৫, পৃষ্ঠা ৫১
৩. ভ্লাদিমির লেনিন, মার্কস-এঙ্গেলস-মার্কসবাদ, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো; ১৯৭৫, পৃষ্ঠা ৫১-৫২
৪. ভ. বুজুয়েভ ও ভ. গরোদনভ, মার্কসবাদ-লেনিনবাদ, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৮৮, পৃষ্ঠা ৩৬
৫. ভ্লাদিমির লেনিন, মার্কস-এঙ্গেলস-মার্কসবাদ, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো; ১৯৭৫, পৃষ্ঠা ৫৪
৬. লেনিন, মার্কস-এঙ্গেলস-মার্কসবাদ, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো; ১৯৭৫, পৃষ্ঠা ৫৫-৫৬
৭. কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্র বিষয়ে পড়ুন, আমার লেখা ভাষাপ্রকাশ থেকে ২০১৫ সালে প্রকাশিত সমাজতন্ত্র গ্রন্থের ৩৭-৪৪ পৃষ্ঠার প্রবন্ধ।
৮. প্রবন্ধটি আমার [অনুপ সাদি] ২০১৬ সালে ভাষাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত মার্কসবাদ গ্রন্থের ২১-২৫ পৃষ্ঠা থেকে নেয়া এবং এখানে কিছুটা সম্পাদিত আকারে প্রকাশিত।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।