কমরেড জ্যোতিষ বসু বা সেন্টু বসু (ইংরেজি: Jyotish Bose, ১৯২০ – ১৮ জুন, ১৯৮১) ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন অন্যতম ব্যক্তিত্ব, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য, ভাষা সৈনিক, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, স্বৈরতন্ত্র ও সামরিক শাসনবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বলিষ্ঠ নেতা এবং ১৯৭১ সালের সশস্ত্র সংগ্রামের একজন লড়াকু শ্রেণিযোদ্ধা।
রাজনীতি ছাড়াও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের বিভিন্ন কর্মকান্ডের সাথে ছিল তাঁর বিশেষ যোগাযোগ। বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের উপদেষ্টা ও সংগঠক হিসেবে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, মুক্তবাতায়ন পাঠচক্রের মত সাংস্কৃতিক কিংবা বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার সংগঠনে তাঁর পরোক্ষ অবদান স্মরণযোগ্য।
জন্ম ও শৈশবে জ্যোতিষ বসু
জ্যোতিষ বসুর পিতা ছিলেন উপেন্দ্র চন্দ্র বসু এবং মাতার নাম লাবণ্য প্রভা বসু। তাঁর পিতার আদি নিবাস ছিল বর্তমান টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতি থানার নারিন্দা গ্রামে। চার ভাইবোনের মাঝে তৃতীয় জ্যোতিষ বসু বিষয় সম্পত্তির ঐতিহ্যে লালিত এক উদার রাজনৈতিক পরিমন্ডলে বৃহত্তর পারিবারিক পরিসরে ময়মনসিংহ শহরের নওমহলস্থ পৈত্রিক বাড়িতে ১৯২০ সনে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা উপেন্দ্র বসু ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম রাজনৈতিক সংগঠন “ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের” একজন সংগঠক। মাতা লাবণ্য প্রভা বসু ছিলেন কংগ্রেসের একজন নারী কর্মী–যিনি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নারীদের হাতে কলমে শিক্ষা দিয়ে স্বাবলম্বী করার মানসে রামকৃষ্ণ রোড নিজ বাড়িতে সেলাই শিক্ষার এক ‘বয়ন বিদ্যালয়’ স্থাপন করে নিজেই তা পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন।
শিক্ষা জীবনে জ্যোতিষ বসু
জ্যোতিষ বসু ময়মনসিংহ সিটি কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ছাত্রাবস্থায়ই ময়মনসিংহ শহরের বিপ্লবী গোপন রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃস্থানীয় সংগঠকদের সাথে তাঁর সম্পর্ক গড়ে উঠে। বিখ্যাত বাম বিপ্লবী নেতা সুনির্মল সেনের একান্ত সহচর হিসাবে তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। ম্যাট্রিক পাশ করার পর তাঁকে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি করানো হয়। কিন্তু অল্পকিছুদিনের ভিতরেই “সর্বভারতীয় ছাত্র ফেডারেশনের” একজন সদস্য হিসাবে তাঁর শিক্ষা জীবনের কার্যত পরিসমাপ্তি ঘটে। পরিবারের সদস্যদের বারবার প্রচেষ্টার পরও তাঁকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানো সম্ভব হয়নি।
রাজনৈতিক জীবনে জ্যোতিষ বসু
শিক্ষাজীবন সমাপ্ত না করেই ময়মনসিংহ শহরে ফিরে পুরোদমে বিপ্লবী রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িয়ে পড়েন। বিশেষতঃ চল্লিশের দশকের শুরুতে ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের একজন সক্রিয় যোদ্ধা হিসাবে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেন। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ফরোয়ার্ড ব্লকের সাথে সংঘর্ষে তাঁর সহকর্মী ও বন্ধু ফনি চক্রবর্তী নিহত হন এবং কানু রায় আহত হন।
কমরেড জ্যোতিষ বসু ১৯৪০ সনে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। ১৯৪৩ সনে “ভিয়েতনাম দিবস”কে কেন্দ্র করে ময়মনসিংহ শহরে যে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে উঠে জ্যোতিষবসু ছিলেন এর অন্যতম সংগঠক। ১৯৪৪ সনে তিনি গ্রেফতার বরণ করেন ও পরে মুক্তিলাভ করেন।কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব কমরেড মনি সিং,খোকা রায় আর আলতাব আলীর সহকর্মী হিসাবে শুরু হয় তাঁর পুরোদম্ভর রাজনৈতিক জীবন। ১৯৪৫ সনে নেত্রকোনায় অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় কৃষক সভায় তিনি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অংশ নেন।
কমরেড জ্যোতিষ বসু সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা দেখুন ইউটিউব থেকে
ময়মনসিংহের উত্তরাঞ্চলের কৃষকদের মাঝে গড়ে উঠা বিখ্যাত ‘টংক আন্দোলনে’ তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। চল্লিশের দশকের দিকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার লেলিহান শিখায় যখন গোটা বাংলা বিপর্যস্ত তখন তিনি বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা কমরেড আলতাব আলীর সহযাত্রী হিসেবে ময়মনসিংহ শহরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সৃষ্টি ও দাঙ্গা প্রতিরোধে অনন্য ভূমিকা পালন করেন।
সাম্প্রদায়িক হানাহানির ভিতর দিয়ে ১৯৪৭ সনে ভারত বিভক্তির চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে। প্রকৃত প্রস্তাবে এর পরপরই নেতৃস্থানীয় অনেক অভিজাত কমরেড এবং শুভানুধ্যায়ীদের ঘটে দেশত্যাগ। একদিকে পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সরকারের নির্যাতন, অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক হানাহানি সব মিলিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির জন্য ছিল এক কঠিন সময়। এমনতর প্রচন্ড প্রতিকূল বাস্তবতার ভিতর তরুণ জ্যোতিষবসু আত্নগোপনে-অনাহারে-অর্ধাহারে থেকে পরিচিত-অপরিচিত ব্যক্তিবর্গের আশ্রয়ে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে মেহনতি মানুষের লালঝান্ডাকে সম্বল করে পার্টিকে সংগঠিত করার কাজে আত্ননিয়োগ করেন। ফলতঃ পাকিস্তান সরকারের নির্যাতন নেমে আসে তাঁর গোটা পরিবারের উপর। ১৯৪৮ সাল থেকে ৫৪ দীর্ঘ ৬ বছর একটানা আত্মগোপনে থেকে মুসলিম লীগ বিরোধী যুক্তফ্রন্টের প্রাদেশিক নির্বাচনের প্রাক্কালে আবার প্রকাশ্যে তৎপর হন।
১৯৫৬ সালে প্রাদেশিক যুক্তফ্রন্ট সরকারকে পাকিস্তানের কেন্দ্রিয় সরকার অন্যায়ভাবে ভেঙে দিয়ে পূর্ব বাংলার প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার শুরু করে। তখন ৯২(ক) ধারায় জ্যোতিষ বসুকে গ্রেফতার করা হয়। মুক্তি পেয়ে পুনরায় আত্মগোপন করেন। ১৯৫৭ সনে তিনি পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। ১৯৫৮ সনে আইয়ূব খানের সামরিক সরকার জ্যোতিষ বসু ও তাঁর নব পরিণীতা স্ত্রী শ্রীমতি ছায়া বসুর নামে হুলিয়া জারি করে এবং বেআইনীভাবে ময়মনসিংহ শহরের পৈত্রিকবাড়ীসহ সর্বমোট ২৪ কাঠা জমি ক্রোক করে সমগ্র পরিবারটিকে উচ্ছেদ করে। পরবর্তীতে তাঁর এক সময়ের জেলসঙ্গীঁ ও আওয়ামী লীগের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ স্বাধীন বাংলাদেশে এই ক্রোককৃত সম্পত্তির জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে চাইলে জ্যোতিষ বসু যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে অর্থ নিতে সম্মত হন নি।
১৯৬০ সনে আত্মগোপন অবস্থায় কিশোরগঞ্জে তাঁকে গ্রেফতার করা হয় এবং ১৯৬৯ সন পর্যন্ত জেলে কাটান। অবশ্য এই নয় বছরের ভিতর তিনদিনের জন্য তাঁকে মুক্তি দেয়া হয়েছিল। ১৯৬৯ সনে মুক্তি পেয়ে পুনরায় আত্মগোপন করেন।
জ্যোতিষ বসুর মুক্তিযুদ্ধে অবদান
১৯৭১ সনে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। ১৯৭১ সনে কমরেড আলতাব আলীসহ সীমান্ত অতিক্রম করে যাওয়ার সময় লেংগুড়া বাজারের নিকট ই,পি,আরদের হাতে আটক হন এবং একপর্যায়ে উভয়কে ফায়ারিং স্কোয়াডে পাঠানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ইতোমধ্যেই এই সীমান্তবর্তী এলাকায় খবরটি ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয় জনসাধারণ তৎপর হয়ে উঠেন এবং তাঁদেরকে মুক্ত করেন।বিখ্যাত টংক আন্দোলন অধ্যুষিত এই সীমান্ত এলাকার জনসাধারণের কাছে আলতাব আলী ও জ্যোতিষ বসু নামটি ছিল খুবই পরিচিত –সর্বস্তরের জনতার প্রতিরোধের মুখে সেদিন তাঁরা দুজন প্রাণে বেঁচে যান। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বারেঙ্গাঁ পাড়া, চান্দু ভূঁই ও সিশিংপাড়ায় ছাত্র ইউনিয়ন, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির সমন্বয়ে গঠিত গেরিলা বাহিনীর ৩ টি ক্যাম্পের পরিচালক ছিলেন তিনি। জ্যোতিষ বসুর পুরো পরিবারটি মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের অভ্যন্তরে আটকা পড়ে নানানভাবে নির্যাতন আর হয়রানির শিকার হন।
স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে ফিরে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের দায়িত্বে নিজেকে সর্বতোভাবে নিয়োজিত করেন এবং একই সাথে কমিউনিস্ট পার্টিকে শক্তিশালী গণভিত্তি দিতে তৎপর হন। ১৯৭২ সনে তিনি পার্টির কেন্দ্রিয় কমিটির সংগঠক নিযুক্ত হন এবং ১৯৭৩ সনে ২য় কংগ্রসে কেন্দ্রিয় কমিটির সদস্য নিযুক্ত হন। ১৯৮০ সন পর্যন্ত তিনি কেন্দ্রিয় কমিটির সদস্য হিসেবে ও আমৃত্যু জেলা কমিটির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সনের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর তিনি পুনরায় আত্মগোপন করেন এবং ১৯৭৭ সনে আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে আসেন।
জেল, হুলিয়া, আত্মগোপন আর রাজনৈতিক নির্যাতনের মত চরম প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পৈত্রিক সহায় সম্পত্তি হারিয়েও মেহনতি মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে নিবেদিত প্রাণ দেশ মাতৃকার এই বরেণ্য সন্তান ১৯৮১ সনের ১৮ জুন ৬১ বছর বয়েসে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
সুবক্তা, উদার মন মানসিকতার এক শক্তিশালী সাহসী রাজনৈতিক সংগঠক হিসেবে জ্যোতিষ বসুর নিজ পার্টির প্রতি আনুগত্য ও আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা ছিল প্রশ্নাতীত। কিন্তু তিনি তাঁর কর্মকান্ডে,ব্যক্তি আচরণে রাজনৈতিক কিংবা দলীয় বৃত্তাবদ্ধ অনুশাসন,সংকীর্ণতা আর যান্ত্রিকতায় বাঁধা পড়েন নি। বরঞ্চ তাঁর নিজস্ব ধরণের রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি তাঁকে অন্য সকল দলের কাছে করেছিল গ্রহণযোগ্য ও শ্রদ্ধাভাজন। যান্ত্রিক মানসিকতা কিংবা অন্যের উপর অভিভাবকের জড়বুদ্ধির অহংবোধমুক্ত এই মানুষটি যথার্থভাবেই জনতার কাতারে দাঁড়িয়ে প্রাণে ন্যায়ে আচরণে শাসনে এক নতুন সমাজ নির্মাণের স্বপ্নই দেখেছেন।
পাকিস্তানী স্বৈরশাসকদের নিপীড়নে তাঁর গোটা পরিবারটি স্থায়ীভাবে ভারতে চলে গেলেও এবং পরিবারের সদস্যদের সকল আবেদন নিবেদন অগ্রাহ্য করেও দেশ, মাটি আর মানুষকে ভালবেসেই নিজেকে নিবেদন করেছেন। জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে জেলে কিংবা তাঁর জেল জীবনে বিভিন্ন সময়ে সাথী হয়েছেন মহারাজ ত্রৈলোক্য নাথ চক্রবর্তী, মনোরঞ্জন ধর, নগেন সরকার, মন্মথ দে, সুকুমার ভাওয়াল, কাজী আব্দুল বারী, আলতাব আলী, মহাদেব স্যানাল, রবি নিয়োগী, অজয় রায়, আলোকময় নাহা, মীর কফিল উদ্দিন (লাল মিয়া), জমিয়ত আলী, রফিক উদ্দিন ভুইয়া, কৃষক নেতা সামছুল হক, আজিজুল ইসলাম খান সহ অগণিত গণতান্ত্রিক ও বাম আন্দোলনের নেতা, সংগঠক।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।