বস্তুবাদ ও ভাববাদ হচ্ছে দুটি পরস্পরবিরোধী বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি

বস্তুবাদ ও ভাববাদ (ইংরেজি: Materialism and Idealism) হচ্ছে দুটি পরস্পরবিরোধী বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি যেগুলো বিশ্ব বিকাশের নিয়মকে দুভাবে ব্যাখ্যা করে।[১] এই দুই পরস্পরবিরোধী বিশ্ব দৃষ্টি মানুষের জ্ঞানের ইতিহাসজুড়েই বিদ্যমান থাকতে দেখা যায়। বিশ্ব বিকাশের নিয়ম ব্যাখ্যার একটি হচ্ছে দ্বন্দ্ববাদী ধারণা এবং অন্যটি আধিবিদ্যক ধারণা। এই ধারণা দুটিকে দার্শনিকগণ তাত্ত্বিক নামানুসারে বস্তুবাদ ও ভাববাদ হিসেবে নামাঙ্কিত করে থাকেন।  

বিজ্ঞানের সাধারণ চরিত্র নিয়ে বিতর্ক নতুন কোনো ব্যাপার নয়। বিজ্ঞানের ইতিহাস ঘাটলেই পরিষ্কার দেখা যাবে যে শুরু থেকেই বিজ্ঞান নিয়ে দুটি পরস্পরবিরোধী প্রবণতার মধ্যে সংগ্রাম চলে আসছে কখনো প্রচ্ছন্নভাবে, কখনোবা সক্রিয়ভাবে। তার একটি আকারবাদী ও ভাববাদী, অন্যটি ব্যবহারিক ও বস্তুবাদী। গ্রিক দর্শনে এই ধারার সংঘাত ছিল মুখ্য, আরও বেশি দৃষ্ট। তবে জে ডি বার্নাল মনে করেন যে এর উৎপত্তি আরো আগের ঘটনা।

শ্রেণিবিভক্ত সমাজকাঠামো উৎপত্তির একেবারে আদিপর্বেই এই সংঘাতের সূচনা হয়ে থাকবে। কারণ এই বিবাদে সংগ্রামরত দুই পক্ষের কার সামাজিক অবস্থান কোন দিকে ছিল, সেটা ছিল খুবই স্পষ্ট। যারা ভাববাদী দর্শনের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন, তারা ছিলেন প্রতিষ্ঠিত সমাজকাঠামোর সমর্থক অভিজাততন্ত্র ও প্রতিষ্ঠিত প্রবল প্রতাপশালী ধর্মের সমর্থক। এ দলের সবচেয়ে বড় সমর্থক ছিলেন প্লেটো। এক কথায় এদের বলা যায় সংরক্ষণবাদী বা রক্ষণশীল- যা যেমন আছে, তেমন থাক। এই মত মনে করে যে বিজ্ঞানের লক্ষ্য হলো যা কিছু যেমন আছে তেমনই থাকবে, বিজ্ঞান শুধু তার কারণ অনুসন্ধান করবে। সেই সঙ্গে এটা প্রমাণ করা যে, আমূল কোনো পরিবর্তন করতে যাওয়া শুধু সে অসম্ভব তাই নয়, অন্যায়ও বটে।

প্লেটো মনে করতেন গণতন্ত্রের কিছু কলঙ্ক দূর করতে পারলেই ‘সোনার মানুষ’দের অভিভাবকত্বে প্রজাতন্ত্রের অস্তিত্ব চিরকালের মতো নিরাপদ হয়ে উঠবে। কিন্তু প্লেটোর সে অনিন্দ্যসুন্দর রাষ্ট্র সম্পর্কে নিচতলার গতরখাটা মানুষ চটজলদি কোনো ধারণা করতে পারবে না। বিধায় তাদের কাছে প্রমাণ করা দরকার যে এই বিশ্বটা আসলেই মায়া। সুতরাং এর অশুভ দিকগুলোও আসলে অবাস্তব এবং অলীক। এই কল্পজগতে পরিবর্তন হলো অশুভ। যা আদর্শ, সত্য ও সুন্দর, তাই বাস্তব, চিরন্তন ও প্রশ্নাতীত। যেহেতু এই পৃথিবীতে সে সত্য সুন্দর ও আদর্শের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় না, তাই এসবের সন্ধান করতে হবে আদর্শায়িত বেহেশতে। বিজ্ঞানের ওপর, বিশেষ করে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও পদার্থবিদ্যার বিকাশের ওপর, এই দৃষ্টিভঙ্গির সুগভীর প্রভাব পড়েছে। আজ আরো সূক্ষ্ম ও পরিশীলিতভাবে বিজ্ঞানে এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রসারের প্রয়াস লক্ষ করা যায়।

এর বিপরীতে বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি শত শত বছর ধরে শিক্ষিত মহলে বিশেষ সমর্থন পায়নি। রাষ্ট্রের অফিসিয়াল-দর্শন হিসেবেও খুব কমই স্বীকৃতি পেয়েছে। কারণ এর বাস্তববাদী চরিত্র; তার চেয়েও বেশি এর বিপ্লবী নিহিতার্থ। এর অন্তত একটি প্রামাণ এখনো টিকে আছে। তা হলো লুক্রেশিয়াস-রচিত De Return Natura (বস্তুচরিত্র সম্পর্কে) নামক এপিকিউরসপন্থী কাব্যে। সেই কাব্য প্রমাণ করে যে এই বস্তুবাদী দর্শনের শক্তি কত এবং প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার জন্য তা কত বিপজ্জনক। সে কাব্যের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল বস্তু ও তার গতি। কবি সে কাব্যে প্রকৃতি ও সমাজের ব্যাখ্যা করেছিলেন, কিন্তু উপর থেকে নয়, নিচ থেকে। সে কাব্যে চিরচঞ্চল বস্তুজগতের অনিঃশেষ স্থিতিশীলতার ওপর গুরুত্তারোপ করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল যদি বিশ্বপ্রকৃতির নিয়মকানুনগুলো জেনে নেওয়া যায়, তা হলে মানুষ একদিন তাকে বদলাবার ক্ষমতা অর্জন করবে।

লুক্রেশিয়াসের (৯৯-৫৫ খ্রি. পূর্ব) ভবিষ্যদ্বাণীর অনেকটাই আজ মানুষ অর্জন করলেও প্রাচীন গ্রিক-রোমান যুগের বস্তুবাদী দার্শনিকবৃন্দ তার বেশি অগ্রসর হতে পারেননি। তার বেশি অগ্রসর হওয়ার মতো বস্তুজ্ঞান তারা অর্জন করতে পারেননি। কারণ কায়িক শ্রমের সঙ্গে তাদের কোনো যোগসূত্র স্থাপিত হয়নি। পরে যিনি বস্তুবাদকে নতুনরূপে ঢেলে সাজান সেই প্রখ্যাত দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকনও (১৫৬১-১৬২৮) বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেননি। তারপর শিল্পবিপ্লবের সময় বিজ্ঞান বস্তুবাদী হয়ে ওঠে, কিন্তু রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণে তা মুখে ভাববাদী দর্শনের কথাই বলে চলে।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বস্তুবাদ দার্শনিকভাবে অপরিণত ছিল। কারণ তখনো সমাজ ও তার রূপান্তর সম্পর্কে তার তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। সেই জন্য ধর্ম ও রাজনীতিকে তা বিবেচনায় আনতে পারেনি। বস্তুবাদকে সম্প্রসারিত ও পরিবর্তিত করে নিয়ে সেই কাজটিই করেন কার্ল মার্কস এবং তার অনুসারিবৃন্দ। নতুন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ প্রথম দিকে কেবল রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে সক্রিয় ছিল; সবেমাত্র তা প্রকৃতিবিষয়ক বিজ্ঞানের অঙ্গনে প্রবেশ করতে শুরু করেছে।

ইতিহাসে সেই আদিকাল থেকেই বিজ্ঞানে নিরবচ্ছিন্নভাবে বস্তুবাদ ও ভাববাদ অর্থাৎ ভাববাদী ও বস্তুবাদী প্রবণতার এই সংঘাত চলে আসছে। প্লেটোর ভাববাদ এক অর্থে পরমাণু-তত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা ডেমোক্রিটাসের পাল্টা উত্তর বলে মনে করেন জে.ডি. বার্নাল। মধ্যযুগের রজার বেকন (১২১৪-৯২) সমকালে প্রচলিত প্লেটো-এরিস্টটলবাদী দর্শনের পাল্টা এক বিজ্ঞানের প্রবক্তা হয়ে ওঠেন। তার সেই বিজ্ঞান ছিল মুখ্যত উপযোগবাদী ও ব্যবহারিক।

প্রসিদ্ধ রেনেসাঁ যুগে আধুনিক পরীক্ষাভিত্তিক বিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপনের লক্ষ্যে যে তুমুল সংগ্রাম চলে, তার প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল চার্চের মদদপুষ্ট আকারবাদী (Formal) এরিস্টটলীয় দর্শন। উনিশ শতকে ডারউইনবাদী বিবর্তনকে ঘিরে বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যে যে লড়াই জমে উঠেছিল, তার মধ্যেও একই বিরোধিতা লক্ষ করা যায়। দীর্ঘ এ লড়াইয়ে বস্তুবাদী বিজ্ঞানই বারবার জয়লাভ করেছে। তা সত্ত্বেও এ সংগ্রাম যে এত দীর্ঘদিন ধরে একটানা চলে আসছে তা থেকে বোঝা যায় যে এ সংগ্রাম আসলে দর্শন বা বিজ্ঞানের সংগ্রাম নয়। বিজ্ঞানবিরোধিতার নামে এ সংগ্রাম রাজনৈতিক সংগ্রাম।

প্রতিটি পর্বে ভাববাদী দর্শনের দোহাই দিয়ে বিদ্যমান অসন্তোষগুলোকে মায়া বলে প্রমাণ করে বিদ্যমান অবস্থাটাকেই আদর্শ বলে প্রচার করার চেষ্টা করা হয়েছে। অন্যদিকে প্রতিটি পর্বে বস্তুবাদী দর্শন বাস্তবতার ব্যবহারিক দিকটাকেই সত্য বলে মেনে নিয়ে পরিবর্তনের অবশ্যম্ভাবিতার ওপর নির্ভর করেছে।

তথ্যসূত্র

১. মাও সেতুং, দ্বন্দ্ব সম্পর্কে, আগষ্ট, ১৯৩৭।
২. শহিদুল ইসলাম, বিজ্ঞানের দর্শন, প্রথম অখণ্ড সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০১৩, কথাপ্রকাশ, ঢাকা, পৃষ্ঠা ৮১-৮৩।

Leave a Comment

error: Content is protected !!