শ্রেণীসংগ্রাম বা শ্রেণিসংগ্রাম (ইংরেজি: Class struggle) হচ্ছে মার্কসবাদের একটি রাজনৈতিক উপাদান। উৎপাদন (Manufacturing) ব্যবস্থার সমরূপের দ্বারা সৃষ্ট, শ্রম-অবস্থানের বিভিন্ন স্তরে অবস্থানরত জনগোষ্ঠী হলো শ্রেণি। সমঅবস্থান ও সমস্বার্থের চেতনা হলো শ্রেণিচেতনা। বর্তমান সমাজ শ্রেণিতে বিভক্ত। সাধারণ শ্রেণি স্বার্থের জন্য সংগ্রামেই দীর্ঘকাল ধরে নির্ধারিত হচ্ছে মানব সমাজের ঐতিহাসিক বিকাশ। সেই কারণে মার্কসবাদী তত্ত্ব শ্রেণিসংগ্রামকেই মনে করে ইতিহাসের চালিকা শক্তি এবং খুবই মনোযোগ প্রদান করে তার নিয়মগুলির অধ্যয়নে।[১]
মার্কসীয় রাজনৈতিক দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে শ্রেণিসংগ্রামের ধারনা। কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহারে কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস এই ধারনাকে সূত্রবদ্ধ করেছেন এই কথা বলে যে মানুষের সমগ্র লিখিত ইতিহাসে ‘যত সমাজ দেখা গেছে তাদের সকলের ইতিহাস হচ্ছে শ্রেণিসংগ্রাম-এর ইতিহাস’।[২] অবশ্য এঙ্গেলস পরে যোগ করেছেন, আদিম গোষ্ঠীগুলির ইতিহাস এর মধ্যে পড়ে না।
মার্কস ও এঙ্গেলস রচিত কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার জুড়ে আছে শ্রেণিসংগ্রামের ধারনা যা মার্কসীয় শ্রেণিদৃষ্টিভঙ্গি তথা শ্রেণি দর্শনকে স্পষ্ট করে তুলেছে। পুঁজিবাদী সমাজের সাধারণ প্রকৃতি বিশ্লেষণ থেকে শুরু করে প্রলেতারিয় বিপ্লবের দিক নির্দেশনা পর্যন্ত কোনো পর্যায়েই মার্কস শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কখনো বিচ্যুত হননি। শ্রেণিসংগ্রামের এই সূত্রটিকে তিনি সমাজবিকাশের একটি সাধারণ সূত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন।[৩]
সমাজবিকাশের ক্ষেত্রে শ্রেণিসংগ্রামের এই সূত্রটির একটি বস্তুগত ভিত্তি আছে। তাছাড়া সমাজ এক জায়গায় স্থির থাকে না, দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ায় তথা গতি ও পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় তা সামনের দিকে এগিয়ে যায়। অর্থাৎ শ্রেণিসংগ্রামের সূত্রটি সমাজের দ্বান্দ্বিকতা তথা গতি ও পরিবর্তনের সূত্র। প্রকৃতিবিজ্ঞানীরা এবং জীববিজ্ঞানীরা যেমন প্রকৃতি ও জীবের বিবর্তনের সূত্র আবিষ্কার করেছেন, একজন সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে মার্কসও ঠিক তেমন সমাজ বিবর্তনের সূত্র বর্ণনা করেছেন। এই সূত্র অনুযায়ী শ্রেণীসংগ্রাম বা শ্রেণিদ্বন্দ্বই হলো সমাজের বস্তুগত দ্বন্দ্ব এবং সমাজবিকাশের চালিকাশক্তি। এই দ্বন্দ্বই সমাজের গতি ও পরিবর্তন প্রকাশ করে। এঙ্গেলসের মতে,
মার্কসই প্রথম ইতিহাসের গতির এই প্রধান নিয়মটি আবিষ্কার করেন যে রাজনীতি, ধর্ম, দর্শন, অথবা ভাবাদর্শের অন্য যে কোনো ক্ষেত্রেই চলুক না কেন, সমস্ত ঐতিহাসিক সংগ্রামই হলো প্রকৃতপক্ষে সামাজিক শ্রেণিসংগ্রামের অল্পবিস্তর স্পষ্ট অভিব্যক্তি; এবং এই সব শ্রেণির অস্তিত্ব তথা সংঘর্ষকেও আবার নিয়ন্ত্রিত করছে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার বিকাশের মাত্রা, তাদের উৎপাদন পদ্ধতি ও তার দ্বারা নির্ধারিত বিনিময় প্রথা। প্রকৃতি বিজ্ঞানের রাজ্যে শক্তির রূপান্তরের নিয়ম যেমন, ইতিহাসের ক্ষেত্রে এই নিয়মটিও তেমনই গুরুত্বপূর্ণ …।[৪]
তবে মার্কসই প্রথম শ্রেণি ও শ্রেণীসংগ্রাম-এর অস্তিত্ব আবিষ্কার করেননি। তাঁর অনেক আগে মেকিয়াভেলি, অ্যাডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো, সিসমন্দি, কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্রীগণ, কার্লাইল এবং আরো অনেকে বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজে শ্রেণির অস্তিত্বশীল ভূমিকা ও তাদের সংগ্রাম প্রসঙ্গে আলোকপাত করেছেন। ১৮৫২ সালে মার্কস তাঁর বন্ধু ভেইদেমেয়ার-এর কাছে লিখিত এক পত্রাংশে এ সম্বন্ধে লিখেছেন,
“… বর্তমান সমাজে বিভিন্ন শ্রেণির অস্তিত্ব আবিষ্কারের, বা তাদের মধ্যে সংগ্রাম আবিষ্কারের কৃতিত্ব আমার নয়। আমার বহুপূর্বে বুর্জোয়া ঐতিহাসিকেরা এই শ্রেণিসংগ্রামের ঐতিহাসিক বিকাশের ধারা এবং বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদেরা বিভিন্ন শ্রেণির অর্থনৈতিক শারীরসংস্থান বর্ণনা করেছেন। আমি নূতন যা করেছি তা হচ্ছে এইটে প্রমাণ করা যে, ১. উৎপাদনের বিকাশের বিশেষ ঐতিহাসিক স্তরের সংগেই শুধু শ্রেণিসমূহের অস্তিত্ব জড়িত; ২. শ্রেণিসংগ্রাম অবশ্যম্ভাবীরূপেই প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্বে পৌঁছয়; ৩. এই একনায়কত্বটা হলো সমস্ত শ্রেণির বিলুপ্তি ও একটি শ্রেণিহীন সমাজে উত্তরণ মাত্র …।”[৫]
অর্থাৎ মার্কস ও এঙ্গেলস শ্রেণির উদ্ভবের কারণ এবং শ্রেণিসমূহের প্রকৃতির বাস্তবভিত্তিক ব্যাখ্যা দিয়ে তার ভিত্তিতেই পুঁজিবাদী সমাজের শ্রেণিগত কাঠামোর বিশ্লেষণ করেছিলেন ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে শ্রমিকশ্রেণির ভূমিকা বিকশিত সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন। লেনিন উল্লেখ করেছেন যে ‘শুধু সেই মার্কসবাদী যে শ্রেণিসংগ্রামের স্বীকৃতিকে প্রসারিত করে প্রলেতারিয় একনায়কত্বের স্বীকৃতিতে’।[৬] লেনিনের কাছে মার্কসবাদের অর্থ শুধু শ্রেণিসংগ্রাম নয়, প্রলেতারিয় একনায়কত্বেরও স্বীকৃতি।
মানবসমাজের ইতিহাসে প্রধানত তিনটি শ্রেণিবিভক্ত সমাজ দেখা যায়। সেগুলো হচ্ছে দাস সমাজ, সামন্ত সমাজ ও পুঁজিবাদী সমাজ। শ্রেণিবিভক্ত সমাজের পরিণত ও চূড়ান্ত রূপ হচ্ছে পুঁজিবাদী সমাজ। এই সমাজেই শ্রেণীসংগ্রাম সবচেয়ে স্পষ্ট রূপ লাভ করে। মার্কসের সময় ছিলো পুঁজিবাদের উত্থান ও বিকাশের সময়। স্বাভাবিকভাবেই তিনি দেখেছেন পুঁজিবাদী সমাজ এবং স্বাভাবিক কারণেই তিনি পুঁজিবাদের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে এর বস্তুগত দ্বন্দ্ব উদঘাটন করেছেন। পুঁজিপতি ও শ্রমিকের দ্বন্দ্ব তথা পুঁজি ও শ্রমের দ্বন্দ্বই হলো এই সমাজের বস্তুগত দ্বন্দ্ব। উৎপাদনের সামাজিক চরিত্রের সাথে সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানার এই দ্বন্দ্বই হলো পুঁজিবাদী সমাজের প্রধান অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। কারণ এই অন্তর্দ্বন্দ্ব শ্রেণীসংগ্রাম বা শ্রেণি বিরোধকে স্পষ্ট ও তীব্র করে তোলে। মার্কস ও এঙ্গেলস বিষয়টিকে উপস্থাপন করেছেন,
“আমাদের যুগ অর্থাৎ বুর্জোয়া যুগের এই একটা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছেঃ শ্রেণি বিরোধ এতে সরল হয়ে এসেছে। গোটা সমাজ ক্রমেই দুটি বিশাল শত্রু শিবিরে ভাগ হয়ে পড়েছে, ভাগ হচ্ছে পরস্পরের সম্মুখীন দুই বিরাট শ্রেণিতে_বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েতে।”[৭]
আদিম গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজ ব্যতীত অতীতের সব সমাজেই শ্রেণি বিরোধ বিরাজমান ছিলো। তবে পুঁজিবাদী সমাজে তা অতীতের যে কোনো সমাজের তুলনায় তা অনেক বেশি প্রকট ও স্পষ্ট হয়েছে। এই পুঁজিবাদী সমাজের প্রেক্ষিতেই মার্কস শ্রেণি দর্শনের ধারনাকে সূত্রবদ্ধ করেছেন। শ্রেণিবিভক্ত সমাজে দর্শন শ্রেণি নিরপেক্ষ হতে পারে না, শ্রেণি স্বার্থ ও শ্রেণিদ্বন্দ্বের বাইরে থাকতে পারে না। ফলে দর্শন হচ্ছে কোনো না কোনো শ্রেণির দর্শন। সমাজ যেদিন থেকে শ্রেণিবিভক্ত হয়েছে সেদিন থেকেই দর্শনের এই শ্রেণি প্রকৃতি।
পুঁজিবাদে শ্রেণিবিভক্ত সমাজ এমন এক প্রান্তীয় পর্যায়ে উপস্থিত হয়েছে যেখানে প্রলেতারিয়েত শ্রেণির উদ্ভব অনিবার্য হয়ে পড়ে। এই শ্রেণির পক্ষে শ্রেণিহীনতার দিকে যাত্রা করে নতুন শ্রেণিহীন সমাজ গড়ে তোলা ভিন্ন নিজের মুক্তিও অর্জন সম্ভব হয় না। কার্ল মার্কস লিখেছেন, পুঁজিবাদী সমাজ গঠিত হলেই প্রলেতারিয়েত শ্রেণির গঠনে থাকবে একটি র্যাডিকাল শৃঙ্খল, যারা নাগরিক সমাজের (ইংরেজি: Civil Society) একটি শ্রেণি, যেই শ্রেণিটি
“সকল শ্রেণিসমূহের অবসান ঘটায়, যারা নিজেই একটি ক্ষেত্র যাদের সর্বব্যাপী দুর্ভোগ-দুর্গতির জন্য আছে একটি সর্বব্যাপী প্রকৃতি এবং যারা কোনো বিশেষ অধিকার দাবি করে না, কেননা কোনো বিশেষ অন্যায় নয়, তাঁদের বিরুদ্ধে আচরিত হয় সাধারণভাবে অন্যায়; যারা আর কোনো ঐতিহ্যবাহী মর্যাদা দাবি করতে পারে না, তাঁরা কেবল একটি মানবিক মর্যাদাই দাবি করতে পারে। … অবশেষে তাঁরা এমন একটি ক্ষেত্র যারা নিজেকে মুক্ত করতে পারে না সমাজের অন্য সমস্ত ক্ষেত্র থেকে নিজেকে মুক্ত না করে এবং সেভাবে সমাজের অন্যান্য সমস্ত ক্ষেত্রকে মুক্ত না করে, যেটা সংক্ষেপে, মানুষের সম্পূর্ণ পরাজয় ঘটিয়েছে [পুঁজিবাদী সমাজে], কাজেই তাঁরা নিজেকে জিতে নিতে পারে শুধু মানুষকে সম্পূর্ণত নতুন করে জিতে নেবার সাহায্যে। একটা বিশেষ শ্রেণি স্বার্থ হিসেবে সমাজের এই অবস্থান হচ্ছে প্রলেতারিয়েতের।”[৮]
প্রলেতারিয়েতের দর্শন তাই শ্রেণীসংগ্রাম যা তাঁদের মুক্তির শর্তাধীন এবং মানবজাতির সামগ্রিক মুক্তির উদ্দেশ্যে নিয়োজিত। মার্কস আধুনিক শ্রমিক শ্রেণিকে সচেতন বিপ্লবী শ্রেণি হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং এই শ্রেণির জন্য রচনা করেন এক বিপ্লবী দর্শন, যার নাম শ্রেণি দর্শন। এই বিপ্লবী দর্শন হলো ইতিহাসের বস্তুবাদী ধারনা।[৯]
তথ্যসূত্র ও টিকাঃ
১. এই বিষয়ে পড়ুন প্রবন্ধ বৈরি সমাজ বিকাশের চালিকাশক্তি শ্রেণিসংগ্রামের স্বরূপ, অনুপ সাদি, সমাজতন্ত্র, ভাষাপ্রকাশ, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১৫, পৃষ্ঠা ৫৭-৬০
২. মার্কস এঙ্গেলস, কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার, ১৮৪৮, মার্কস এঙ্গেলস রচনা সংকলন, প্রথম খণ্ড প্রথম অংশ, প্রগতি প্রকাশন মস্কো, ১৯৭২, পৃষ্ঠা ২৬।
৩. হারুন রশীদ, মার্কসীয় দর্শন, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০০৭, পৃষ্ঠা ১০৯
৪. ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস ১৮৮৫, মার্কস এঙ্গেলস রচনা সংকলন, দুই খণ্ডে সম্পূর্ণ, প্রথম খণ্ড প্রথম অংশ, প্রগতি প্রকাশন মস্কো, ১৯৭২, পৃষ্ঠা ২৩৯।
৫. কার্ল মার্কস, ৫ মার্চ ১৮৫২, পত্রাবলী, মার্কস এঙ্গেলস রচনা সংকলন, দুই খণ্ডে সম্পূর্ণ, দ্বিতীয় খণ্ড দ্বিতীয় অংশ, প্রগতি প্রকাশন মস্কো, ১৯৭২, পৃষ্ঠা ১৩৮।
৬. ভি আই লেনিন, রাষ্ট্র ও বিপ্লব, আগস্ট সেপ্টেম্বর, ১৯১৭, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ, অংশ ৩, অনুচ্ছেদ ৪, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো ১৯৭৬, পৃষ্ঠা ৩৫।
৭. মার্কস এঙ্গেলস, কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার, ১৮৪৮, মার্কস এঙ্গেলস রচনা সংকলন, প্রথম খণ্ড প্রথম অংশ, প্রগতি প্রকাশন মস্কো, ১৯৭২, পৃষ্ঠা ২৭
৮. Marx; Critique of Hegel’s Philosophy of Right, early writings, p. 58, দেখুন, বাংলায়, কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস, ধর্ম প্রসঙ্গে, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, তৃতীয় মুদ্রণ, সেপ্টেম্বর ২০০৪, পৃষ্ঠা ৪৩
৯. প্রবন্ধটি আমার [অনুপ সাদি] ২০১৬ সালে ভাষাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত মার্কসবাদ গ্রন্থের ৩৩-৩৭ পৃষ্ঠা থেকে নেয়া এবং এখানে প্রকাশিত।
অনুপ সাদি বাংলাদেশের একজন লেখক ও গবেষক। তাঁর লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা এগারটি। ২০০৪ সালে কবিতা গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তিনি পাঠকের সামনে আবির্ভূত হন। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘মার্কসবাদ’ তাঁর দুটি পাঠকপ্রিয় প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ে চিন্তাশীল গবেষণামূলক লেখা তাঁর আগ্রহের বিষয়।